রানী কি ভাও ( Rani Ki Vav) ও পাটোলা
শাড়ির জন্য গুজরাটের পাটন বিখ্যাত - অলোক কুন্ডু
স্বাধীনতার বহু আগে পোরবন্দরে গান্ধীজি জন্মগ্রহণ করেছিলেন । পরে রাজকোটে গান্ধীজির বাল্যকাল কাটে । কিন্তু গান্ধীজি
সবরমতীর তীরে আশ্রম গড়ে যখন থাকতে লাগলেন তখন গান্ধীজি বলেছিলেন -"প্রথমত
আমি গুজরাটি দ্বিতীয়ত এই আশ্রম গড়তে
পয়সাঅলা কিছু মানুষের দরকার তা আমেদাবাদে আছে । আমেদাবাদে এখনও
অনেক কিছু করার আছে " সেই আমেদাবাদ বহু
বছর গুজরাটের রাজধানী ছিল এবং এখনও আমেদাবাদ আর গান্ধীনগর গায়ে গায়ে ।
কোনটা আমেদাবাদ আর কোনটা গান্ধী নগর
বোঝা দায় । সে যাই হোকনা কেন, আমেদাবাদের নির্মাতা আহমেদ শা, সোলাঙ্কিদের
পরাস্ত করে তাদের বৃহত্তর গুজরাটের রাজধানী পাটনকে তুলে আনেন সবরমতীর তীরে নাম দেন আহমেদাবাদ । আসলে মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ নিয়ে ,সৌরাষ্ট্র সহ গুজরাটের রাজধানী ছিল পাটন । সোলাঙ্কি রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা বনরাজ চাওডা (৭৪৫ AD) Anhilpur-Patan নামে গুজরাটের রাজধানীর পত্তন করেন । ইন্টারনেট হওয়ায় আমরা মাত্র কয়েক বছর হলো এই পাটনের নাম রপ্ত করতে পেরেছি । তার আগে কেবলমাত্র ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রীরাই ও পর্যটকদের মধ্যে পাটনের পরিচিত সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু সাধারণ বাঙালির মধ্যেও পাটন বলতে নেপালের পাটনের নামই মনে
পড়ে । আমেদাবাদ ( আহমেদাবাদ বা আমদাবাদ ) থেকে পাটনের দূরত্ব আগে ছিল ১০৮ কিঃমিঃ ( গুগল ১৪৫ ) কিন্তু আমি
গেছি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রুট ধরে মেহেসানা ও
মোদেরার সূর্য মন্দিরের মতো হেরিটেজ ছুঁয়ে ( আমেদাবাদ-পাটন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হাইওয়ে )
একদিকে ১৩৫ কিঃমিঃ হবে । একেবারেই গ্রাম বলা যায় । বিশেষ করে আদি পাটন , সিটি থেকে একটু দূরে তৈরি হয়েছে । আসল পাটন
প্রায় গ্রামের মতোই আছে । হাঁটা পথে (১) পাটোলা হাউস মিউজিয়াম (২) পাটন হেরিটেজ
মিউজিয়াম (৩) রানী কি ভাও ১০/১৫ মিঃ-এর মধ্যে হয়ে যাবে , দেখতে কিন্তু ২ ঘন্টার মতো
সময় দিতে হবে , কারণ রানী কি ভাওয়ের পিছনেই আছে সোলাঙ্কি রাজাদের আর এক স্টেপ ওয়েল বলা যায় প্রজাদের জন্য জলের
তালাও/তালাব/পুকুর /ভাও বাঁধানো ও একসময়ের ওই ভাওতেও মন্দির ছিল জলের
মধ্যে । চতুর্দিকে চ্যানেল করা মাঝে উঁচু জমি
তাতে মনে হয় এটিও ছিল জলের রিজার্ভার
এবং কাছেই ছিল সরস্বতী নদী । সেখান থেকে
জল আসতো । এখন নদী এক কিলোমিটার
দূরে । এখন তৈরি হয়েছে সেখানে একটি ফিল্টার
পানীয় জলের প্রকল্প এই দ্বিতীয় ভাওয়ের অনতিদূরে । যদিও দ্বিতীয় খোলা সাদামাটা
জলের বিস্তৃত ঘাট , খুব বেশি স্থাপত্য নেই ।
ছিল কিনা বোঝার উপায় নেই । তবে তথ্য
বলছে ওখানেও ঘাটে জলের ওপর মন্দির
ছিল , ভাঙা কিছু বাস্তু পড়ে আছে । মনে করা
হয় এখানে মহিলা ও পুরুষদের আলাদা ঘাট
ছিল জলের মধ্যে মন্দিরকে ঘিরে । আসলে
গুজরাটকে সুলতান মাহমুদ থেকে মহম্মদ গোরি, তৈমুর লঙ,হুমায়ূন থেকে ঔরঙ্গজেব এমনকি আকবর আক্রমণ করে দখল করতে চান । আফগানিস্তান মধ্য এশিয়া , দিল্লির সুলতান
ও বিভিন্ন প্রান্তিক রাজত্ব বহুকাল ধরে গুজরাটকে আক্রমণের দিশা করেন ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যান । গুজরাট নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি সুলতান
ও তাদের আমির ওমরাহ ও স্থানীয় শাসকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে ছিল । দীর্ঘ দিনের
লড়াই চলে তার মধ্যে দু/তিন বার মুঘল সাম্রাজ্যে
থেকে গুজরাট হাতছাড়া হয়ে যায় । কিছু বছর
আগে এই পাটনে সরপঞ্চ নির্বাচন নিয়ে হিন্দু-মুশলিম রায়ট হয়েছিল , যদিও সেইসব ঘটনা যেন আর না হয় দেখতে হবে গুজরাট প্রশাসন ও সরকারকে । আমি ট্যুরিস্ট হিসেবে পাটনকে দেখতে চাই তার মলিনতা
যেন আমার মন খারাপ করে না দেয় । পাটনের ২০১১-এর জনসংখ্যা ১,৩৩,৭৪৪ । হিউয়েন
সাঙ গুজরাটের বহু স্থানের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করেছেন কিন্তু তখন পাটন ছিলনা । আইহোল লিপি থেকে জানতে পারি নর্মদা থেকে কাবেরী পর্যন্ত চালুক্য রাজত্বের সীমান্ত ছিল । ৭৪৫ AD তে চালুক্য / সোলাঙ্কি রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন বনরাজ চাওডা । উত্তর মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভে বাকাটদের পতনের পর সোলাঙ্কি রাজত্ব দুর্ভেদ্য করতে তাঁরা ( ৯৪০ CE থেকে ১১২২ CE) তারা
পাওয়াগড়ে দূর্গ নির্মান করেন । ১৫ সেঞ্চুরিতে
মহম্মদ বেগাদা পাওয়াগড়ও দখল করে নেন ।
বর্তমানে ভদোদরা থেকে ট্যুর নিয়ে রোপওয়ে করে পাওয়াগড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখে নেওয়া
যায় । পাটন হলো মাউন্ট আবু ও আমেদাবাদের মাঝে । পাটনের পথে পড়ে হিন্দু মন্দির স্থানীয়
মদেরা গ্রামে ( এটিও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত) । মদেরায় জানুয়ারি মাসে তিন দিনের
ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্সের ফেস্টিভ্যাল হয় । মদেরার
মন্দিরটি ভারতের দ্বিতীয় সূর্য মন্দিরের তকমা
পেয়েছে ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে স্থান পেয়েছে
মন্দির তৈরি করেন সোলাঙ্কি/ চালুক্য রাজা
ভীম-১ । মোদেরার কাছেই আছে আর এক
সূর্য মন্দির ও রাজ প্রাসাদ পুষ্পবতী নদীর তীরে। মেহেসনাতে । মেহেসনার চামুণ্ডা মন্দির বিখ্যাত মূর্তি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত । তৈরি করেন Mehsaji । মোদেরার সূর্য মন্দিরের সঙ্গে আছে
সমবেত হল, সূর্য কুন্ড ও মন্দির এবং এইসব
ভগ্নাংশ নিয়ে একটি দুর্লভ মিউজিয়াম । সুন্দর বাগান আছে সবকটি হেরিটেজের সঙ্গে এগুলির
সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্ব
কালে । সোলাঙ্কিরা ৮০০ বছর আগে সৌরাষ্ট্র
থেকে যে তাঁত শিল্পীকে এনেছিলেন রানীর
শাড়ি তৈরির জন্য তারা পাটনে থেকে গেছেন।
এঁদের শাড়ির নাম হলো পাটোলা । এঁদের পদবী
থেকে শাড়ির নাম । ক্রমে ৭০০ বংশধর মিলে সারা বিশ্বের বাজারে পাটোলা শাড়ি পাঠানো
ছিল এদের পারিবারিক ব্যবসা । প্রথম দিকে
এরা নিজের মেয়েকে এই শাড়ি তৈরির ব্যাকরণ
শেখাতো না । পরে তা আটকানো যায়নি । এখন
এঁদের পরিবারের ধন দৌলতের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা
ও অন্যান্য ব্যবসায় এরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে
পড়েছে । যার ফলে এখন একটা পরিবার এই
বিদ্যা ধরে রেখেছে পাটনে । যার মিনিমাম দাম
এক লাখ থেকে সাত/ আট লাখ । পাটনে ডুপ্লিকেট ছাপ মেরে পাটোলা বিক্রি হয় তার
দামও ১০.০০০/- হাজার । কিন্তু সেগুলি নামে
পাটোলা নয় এবং ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ভুক্ত নয় ।
পাটোলা শাড়ি বাজারে পাওয়া যায় না । এঁদের
কাছে অর্ডার দিতে হয় । রাজা ভীম -২( পিতাপুত্র মিলে ১০২২-১০৬৪) হঠাৎ মারা যেতে রানী
উদয়মতী এই নান্দনিক আশ্চর্য এবং বিস্ময়কর
স্টেপ ওয়েল বা ধাপ কুয়োটি তৈরি করেন কিন্তু
তিনি সমস্তটা দেখে যেতে পারেননি । মূলা রাজা ও খেমরাজা দুই বংশধর রেখে যান । Rani Ki Vav সরস্বতী নদীর তীরে ( ১১ সেঞ্চুরিতে তৈরি)
বর্তমান ১০০ টাকার ল্যাভেন্ডার কালার ব্যাঙ্ক নোটের উল্টোদিকে রানী কি ভাওয়ের মোটিফ
মুদ্রিত হওয়ায় গুজরাটের ঐতিহাসিক মূল্যকে
ভারত সরকারের এক বিরল স্বীকৃতি হিসেবে
দেখছে গুজরাটিরা । ৬৬ মিটার চওড়া ও
১৪২ মিটার লম্বা এটি সাত তলা বিশিষ্ট সিঁড়ি
দিয়ে নীচে নেমে গেছে ( এখনকার মাপে ১০/১২
তলা নীচে হবে) তবে বিভিন্ন সময়ে পাটনে দেশী-বিদেশী সুলতানদের আক্রমণে রানী কি
ভাওয়ের উপরের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে ।
হিন্দু ধর্মের দেবতা ও অপ্সরা মূর্তি দিয়ে সুনিপুণ ভাবে বালি পাথরে খোদাই করা এই তালাও
বা পুকুর । ২০১৪ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের ও ২০১৬
ভারতের শ্রেষ্ঠ পরিচ্ছন্নতা পুরস্কার পায় এই
সৌন্দর্য স্থাপত্য । দুর্গা কল্কি অবতার শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরামের মূর্তি গুলি করা বলছে যেন । অনুপম
খোদাইকৃত কিছু ঝাফরিও আছে দেওয়াল বরাবর । ৫০০ র বেশি মূল বড় মৌলিক ভাস্কর্য
প্যানেল ও ১০০০ এর বেশি মিনিয়েচার ভাস্কর্য
প্যানেল ছাড়াও থাম , সিলিং, জাফরি দেওয়ালে
ধর্মীয় মোটিফে ভারতীয় ধর্মীয় মাইথোলজির
বিকাশ ঘটেছে । আছে যোগিনী, নাগকন্যা, সোলহা-সিঙ্গার বিশিষ্ট স্টাইল , বিষ্ণুর দশাবতার। মোট ১৬ রকমের স্টাইলে ফেসিয়ালের দেখা মেলে এখানে । একেবারে শেষে একটি কুয়ো সংশ্লিষ্ট হয়েছে যার উপরের অংশের তিন দিক ঘেরা সেখানে পোড়া ইঁট লক্ষনীয় । এই ট্যাঙ্কটি উপর থেকে ক্যামেরা দিয়ে দেখতে হয় ঝুঁকে দেখা যায় না । সেখানে জল আছে। ৯. ৫ /১০ মিটার গোল আকৃতির ও ডিপ ২৩ মিটার। এন্সিয়েন্ট রাজস্থানী শিল্প রীতিতে এই আয়তাকার পুকুরের স্থাপত্য রূপ পেয়েছে । এই ধরনের ধাপ পুকুরের মধ্যে পৃথিবীর মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ । একে ১১ সেঞ্চুরির ওয়ান্ডার্স বলা হয়েছে । ৫০/৬০ বছর আগেও এখানকার জলে জন্মানো জড়িবুটি থেকে ভাইরাল রোগ সেরে যাওয়ার বহু প্রমাণ আছে । কিন্তু রানী কি ভাউ এখন সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচ্ছন্ন স্থান হয়েছে তাই এর বাইরে হয়েছে সুন্দর মনোরম মনোমুগ্ধকর বাগান । গাড়ি পার্কিং ঠান্ডা ফিল্টার করা পানীয় জলের ব্যবস্থা । রানী কি ভাও কে ঝকঝকে তকতকে করা হয়েছে । জায়গায় মাপ ১১.৬ একর । বাবার জোন
৩১০.০ একর । এর সমস্তটায় আজ আর যেতে দেওয়া হয়না স্যুইসাইড করা ও স্থাপত্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভয়ে । ভেতরে একটি ট্যানেল ছিল যেটি এখন বুঝিয়ে বেলা হয়েছে পাথর ও কাদা দিয়ে নিরাপত্তার জন্য । ঐতিহাসিকরা মনে করেন আক্রমণ হলে রাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা করা ছিল কেউ বলেন বর্ষায় জল আনার জন্য। তবে রাজ্যের নিরাপত্তার জন্যও একে ব্যবহার করার যতটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ । এটি ৬৪ মিটার লম্বা ও ২০ মিটার প্রশস্ত ছিল । করিডোর হিসেবেই এটি ব্যবহার হতো মনে হয় ।
ট্যানেলটি পাটনের একটি গ্রাম সিদপুর পর্যন্ত
গিয়ে মিশেছে । এই রানী কি ভাওতে সিঁড়ি ভেঙে
নামলে ঠান্ডা বাতাস অনুভব করবেন । কোনো রানী তার ভালোবাসার জন্য কোনো রাজার জন্য এমন নিরিবিলি সৌধ নির্মাণ করে গেছেন কিনা
সন্দেহ হয় । অনেকে বলেন বিধবা রানী এই
নিরিবিলি পুকুরে এসে রাজা ভীমের জন্য দুঃখ
ভাসাতেই এরকমটা করেছিলেন সেখানে ধর্মীয়
মোটিফে তিনি বুকের কষ্ট দেবতার কাছে অর্পণ
করতেন কিন্তু এই স্থাপত্য শেষ হওয়ার আগেই
রাণি মারা যান । যেহেতু এটি ভূমিকম্পের প্রন
এরিয়া তাই এর স্ট্রাকচার মাঝে মাঝেই পরীক্ষা
করা হয় । ভুজের ভূমিকম্পের সময় খুব একটা
এর ক্ষতি হয়নি যা বিভিন্ন আক্রমণে এখানকার
ক্ষতি হয় । অনেকেই মনে করেন পাটনে এতবার
আক্রমণ হওয়া সত্বেও রানী কি ভাইয়ের উপরের
অংশ ছাড়া কিছু মাত্র ক্ষতি করতে পারেনি আক্রমণকারীরা । রাজা কর্ণ এই কাজটি শেষ করেন । Copyright ©®Alok Kumar Kundu