গান্ধীবাদী স্বদেশী থেকে সন্ন্যাসী
গৌরাঙ্গে অর্পিত এক কর্পোরেট ভিক্ষুক
শ্রীল প্রভুপাদ
- অলোক কুন্ডু ©
স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের চর্চা করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন কমপ্রোমাইজের কথা । আসলে আমার মনে হয় জীবনের সমস্ত স্তরে সহাবস্থানের
কথাই স্বামীজি বলতে চেয়েছিলেন । কারণ তাঁর নিজের ধর্ম ছিল অদ্বৈতবাদ আর তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন মূর্তির পূজারী । শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের বুনোনকে দুহাতে তলতলে মাটির মতো নিয়ে যেকোনো মূর্তির মাঝে ভগবানের লীলা দেখাত পারতেন সহজাত কথায় অন্যদের টেনে নিয়ে আসতে পারতেন । শুধুমাত্র শুনে শুনে তিনি পুরাণ মহাভারতের ব্যাখ্যা প্রাঞ্জলভাবে করতে পারতেন সে যুগে ইংরেজি জানা রীতিমতো মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে যাওয়ার পথে তিনিও এক সামান্য পূজারীর বাক্য ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেননি । যদিও স্বামীজির ধর্মবোধ শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ ছিল । শ্রীরামকৃষ্ণের কালীভক্তির কারণে যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর আর কখনো দ্বিতীয়বার শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেননি । কিন্তু স্বামীজিও ছিলেন যুক্তিবাদী এবং পুতুল পূজার বিরোধী । তিনি তাই শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছিলেন মনে হয় । অদ্বৈতবাদী স্বামীজি যখন হিন্দুদের দেবী দুর্গার
পুজো করার মনস্থ করেন তখন কোনো শিষ্যই তার কাজে বাধা দেননি পরন্তু যে রাজা ও ব্যবসায়ীদের
সাহায্যে স্বামীজি আমেরিকায় যেতে পেরেছিলেন সেইসব শিষ্যরা রাজারা আনন্দিত হয়েছিলেন । শুধুমাত্র শ্রীশ্রী মায়ের কথামতো পাঁঠাবলি না করার বিষয়টি মেনে নিয়েছিলেন । স্বামীজি নিজেই ধর্মের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন যার তাৎপর্য বোঝা অত্যন্ত কঠিন । নিজে সারা ভারত ঘুরে বেরিয়েছেন দান চাইতে । পরিব্রাজক স্বামীজি যেখানে যেমন পেরেছেন মানিয়ে নিয়েছেন । পুরাণে সন্ন্যাসীকে ঘুরে ঘুরে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখতে বলেছে যাতে একজন সন্ন্যাসী দেশের মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খিদের কথা জানতে ও তাদের পরামর্শ দিতে পারেন স্বামীজি যতটা সম্ভব করেছেন । তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে ১৯৩৮ সালে বেলুড় মঠ স্থাপিত হয়েছে । এত পয়সার অভাব ছিল যে শ্রীমাকে ঘুষুড়িতে টাকা পাঠাতে পারেননি সব সময় তখন সারা ভারত ঘুরে মঠের জন্যে তাঁকে একটা একটা করে টাকা ভিক্ষা করতে হয়েছে । স্বামীজি জরুথ্রুস্টের ভক্ত ছিলেন
অনেক বক্তৃতায় তাকে বিদেশীরা অনেক সময় জরথ্রুস্টবাদী মনে করে ভুল করেছেন । নারীর অধিকার জরথ্রুস্টের মতের প্রথম অঙ্গীকারকে
স্বামীজি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন । শ্রীচৈতন্যের
গণধর্মমতও তাঁকে বিস্মিত করেছিল তিনি জেনেছিলেন শ্রীমদ্ভাগবতের নানা বিশ্লেষণ এবং তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে বারবার ধর্মের নানা পন্থার দীর্ঘ
কাটাছেঁড়া চলেছে । তাই বিশ্ব ধর্মসভা যেখানে
বসেছিল আজও সেই রাস্তার নাম স্বামী বিবেকানন্দের নামে হয়ে আছে । স্বামীজি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর অদ্বৈতবাদের রাস্তা অন্য এক মহত্বে বাঁক নিত যা আজ কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয় । নানা মতের সমন্বয় সাধন করতে তাঁকে যত্নবান হতে হয়েছিল । মূর্তির পূজারী হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে ছিলেন সর্বজনগ্রাহ্য একজন মানবরূপী ভগবান । তাই বেলুড় মঠের নকশায় হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম ধর্মের সমস্ত মোটিফকে একত্রীকরণ করা হয়েছে । পরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন শিক্ষা -স্বাস্থ্য-রোজগার-মানব উত্থানকে মাথায় রেখে বিশ্ব মানব ধর্মের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে । মাঝে নতুন করে হিন্দু ধর্মের আর কোনো এমন বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দ্বারা পথের সন্ধান কারও চোখে আসেনি বা নতুন দিশায় সমস্ত জগতের কল্যাণের পথ তেমন প্রশস্ত হয়নি বটে কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের পর খুব কম সময়ের মধ্যে একক প্রচেষ্টায় এক বৃহদাকার কর্মযজ্ঞের সূচনা করেগেছেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সন্ন্যাসী শ্রী ল প্রভুপাদ মহারাজ । তিনি যা করলেন তা আরও বিস্ময়কর । স্বামীজি ছিলেন অদ্বৈতবাদী যে কারণে আমেরিকা ঘুরে আসার পর ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেশা করা স্বামীজিকে দক্ষিণেশ্বরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি । ইন্দিরা গান্ধীকে জগন্নাথদেব দর্শন করা তো দূরে থাক মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি । আজব ধর্মীয় আচরণ এই দেশের । আর এই দেশেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পান্ডারা নুলিয়াদের দিয়ে হত্যা করিয়েছিল পা টেনে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিল । কারণ সমস্ত ধর্মের মানুষ শ্রীচৈতন্যের সাম্যবাদী ধর্মের কাছে এসে ফল্গুধারার মতো মিশছিল
যেখানে কাউকেই অচ্যুত ভাবা হয়না । ৫০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভূত হওয়ার সময়ে যা নির্দিষ্ট হয়েছিল মায়াপুরের কাছে । দলে দলে এক নতুন ধর্মীয় ভাবনায় এসে মিশ্রিত হচ্ছিলেন এই সৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণকে করেছিলেন তিনি জনগণের দেবতা --" মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বঃত কৃষ্ণ জ্ঞান "
(চৈতন্য চরিতামৃত) । স্কটিসচার্চে সুভাষচন্দ্রের এক ক্লাস নীচুতে পড়া ও সুভাষ অনুগামী অভয়চরণ দে স্বদেশী আন্দোলনে নেমে পড়লেন এবং ইংরেজদের দেওয়া কলেজের শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান করে তা নিলেন না । পরে বসু গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন । ৫৪ বছর বয়সে সন্ন্যাসী হন এবং ৭০ বছর বয়স যখন তখন ১৫ ডলার হাতে নিয়ে অনির্দিষ্ট যাত্রায় আমেরিকা পৌঁছন সঙ্গে সঙ্গী - "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ , কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে । হরে রাম হরে রাম , রাম রাম হরে হরে ।" এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা । তিনি তখন শ্রী ল প্রভুপাদ । তাঁর কাছে আছেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য । তিনি বললেন শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান কোনো কিছুই নয় তিনি শুধুমাত্র ভগবানকে জানেন । ভগবান কে ? ভগ অর্থাৎ ঐশ্বর্য আর বান মানে যার মধ্যে আছে । যার মধ্যে ঐশ্বর্য আছে তিনি ভগবান । শ্রীকৃষ্ণ সেই রূপ ভগবান । নিজের ব্যক্তিসত্বাকে নিজের চেতনা দিয়ে দেহরথের বুদ্ধি দিয়ে এই নাম জপ করলেই ভগবান দর্শন হয় । তার সঙ্গে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সৃষ্ট নৃত্য গান যা শরীর ও মনকে চাঙ্গা করে তোলে । নিরামিষ আহার , হত্যাকারী না হওয়ার অনুরোধ , এমনকি পশু হত্যাও নয় । ১৯৪৪ সাল থেকে তিনি একক প্রচেষ্টায় ইংরেজি পত্রিকা সম্পাদিত করার মধ্য দিয়ে যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার ফল স্বরূপ ১৯৪৭ এ পেয়েছিলেন ভারতের গৌড়ীয় সমাজের দেওয়া উপাধি --ভক্তিবেদান্তিক । এইটুকু সম্বল করেই নিজের পৈতৃিক ব্যবসার নিজের সমূহ দান নিয়ে একটি জাহাজের আস্তাকূড়ে শুয়ে শুয়ে আমেরিকা পৌঁছে যান । ১৯৬৫--১৯৬৬ কঠোর জীবন যাপনের দ্বারা আমেরিকায় ইসকন প্রতিষ্ঠা করেন । তার আগে বৃন্দাবনের দামোদর মন্দিরে ৪ বছর অধ্যয়ন ও নানান গ্রন্হাদির রচনা করেন । ১৯৬৮ তে আমেরিকায় ২০০ একর জমিতে ১৯৭৫ বৃন্দাবনে ১৯৭৬ জুহুতে গড়ে তোলেন বিশাল বিশাল আশ্রম মন্দির ধর্মশালা । এই কাজ করতে সময় লাগলো মাত্র ১২ বছরে আরও ১০০ মন্দির ৮০ খানা ইংরেজি বই ও তিন খন্ডে শ্রীমদ্ভাগবতের অনুবাদ সহ সমস্ত পুরাণ বিদেশীদের কাছে তুলে ধরলেন । ১৯৭২--১৯৭৬ মায়াপুরে ইসকন মাথা তুললো । সেই সময় খড়ের চালা যে ঘরটিতে তিনি থাকতেন সেখানে আজ ২৪ ঘন্টা হরিণাম সংকীর্তন হয় । আজ আমেরিকা রাশিয়া নিউজিল্যান্ড অস্ট্রেলিয়া ইংলান্ড থাইল্যান্ড ব্রাজিল সহ আরও বিভিন্ন দেশে শ্রীল প্রভুপাদ শ্রীকৃষ্ণ-শ্রীচৈতন্যর নাম ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন অতি অল্প সময়ের মধ্যে যা বিস্ময়কর । ১৮৯৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর যার জন্ম ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এই ৮১ বছরে যা করে গেছেন যার উত্তর মিলতে চলছে পৃথিবীর বিস্ময়কর ও বৃহত্তর মন্দির --মায়াপুরে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে সৌন্দর্যে উচ্চতায় যে মন্দির হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপাসনা স্থল ( কাজ চলছে মন্দিরের ২০০৯ থেকে শেষ হবে ২০২২ এ) । শোনা যাচ্ছে ২০২২ শে মায়াপুর সিটি হিসেবে ঘোষিত হবে কারণ ইতিমধ্যেই সেখানে ১০ তলার ফ্ল্যাট সহ অজস্র ফ্ল্যাট উঠতে শুরু করেছে । আশেপাশে অনেক আশ্রম ও মন্দির গড়ে উঠেছে ইসকনের বাইরে ইসকনের নিজস্ব জায়গাও ১৯৭২ থেকে বেড়ে হাজার গুণ হয়েছে । ভালো ভালো ও সাধারণ অতিথি নিবাস অনেকগুলি যেখানে ১০০/৩০০/৫০০/৮০০/২০০০/৩০০০ টাকা দামের সারি সারি ঘরে অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা আছে । আর আছে তিনটি স্থানে পংক্তি ভোজনের দু বেলার ব্যবস্থা যার টিকিট আগে কাটতে হয় । ঘরের বুকিং অন লাইনে বা কলকাতার ২২ নং গুরুসদয় রোড , বালীগঞ্জ কলকাতা -১৯ এই ঠিকানায় হয় ( মেনল্যান্ড চায়নার সামনে ) । ১৯৩৩ সাল থেকে মায়াপুরে তার গুরুদেবের কাছে ( ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর ) যাওয়া তার আজ সার্থক হয়েছে । তিনি বলেছিলেন স্বাধীনতার সংগ্রাম দুদিনের যদি পারিস সারা জীবনের সংগ্রামে নাম । তিনি কথা রেখেছেন সারা পৃথিবীতে শিক্ষা স্বাস্থ্য ও কৃষ্ণনামের উচ্চারণ তাঁকেও মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করেছে । মায়াপুর বাসে দু ভাবে যাওয়া যায় এসি বাস বুক হয় গুরুসদয় দত্ত রোড থেকে যেখান থেকে ঘরের বুকিংও হয় আর সরকারি বাস ছাড়ে প্রতিদিন শহীদ মিনার থেকে দু বার । তিন দিনের আদর্শ ট্যুর । আরতী খুবই উপভোগ্য যখন সেখানে নাচে যোগ দেন । কেনাকাটারও বেশকিছু দোকান আছে । টোটো করে মন্দির ও মন্দিরের বাইরে ঘুরিয়ে দেখার ব্যবস্থা আছে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন