শনিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

বড় শাড়ির শখ ছিল / Poetry of Alok Kundu

বড় শাড়ির শখ ছিল / অলোক কুন্ডু

রাজশাহী-রেশমি ঢাকাই-জামদানি
ব্রোকেট-জর্জেট বা মাইসোর সিল্কে
তার মাকে দারুন মানাতো ।
যখন ক্লাস ইলেভেন মা বলতেন
এখন থেকেই শাড়ি পরবি ?
কলেজে উঠলে সব নিয়ে নিস
মায়ের মুখ থেকে হরেক শাড়ির নাম
শুনে শুনে মুখস্থ করতো মেয়েটা
মা বলতেন আহা মেয়ের শখ দেখ ।

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
সেই থেকে শাড়ি দেখলেই
মেয়েটা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেত ।

ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনেই
পরে গিয়েছিল মায়ের মুগা মেখলাখানা
আর সেদিনই আলাপ হয়েছিল অমিতেশের সঙ্গে
আলাপ যত বাড়তে লাগলো
তত একটার পর একটা শাড়ি ভাঙে
কখনো আদিবাসী উমারিয়া তো বিষ্ণুপুরী
আরানি-রেশম কখনো কাঞ্চিপূরম
পাইথানি-সিল্ক থেকে মসলিন তো কোনোদিন ভাসতারা-কটন ।

অমিতেশ শাড়ির খুঁট ধরে একটান দিয়ে বলতো
--খুব যে সাজা আজ ?
কখনো ভাগলপুরী-কটনে
কফি হাউসের হৈচৈ থেকে দুজনে
চলে যেত নির্জনে একাএকা --ইক্কতের সাজে
বলতো জানো সাহেব--
কাঁধের ওপর থেকে পিছনে
এই যে মস্ত ঝোলা দেখছো
ওই ঝোলায় তোমাকে বেঁধে রাখবো--দেখো ।

দুবছরের সিনিয়ার অমিতেশ
আমেদাবাদ থেকে পিএইচিডি করে ফিরে
সটান এসেছিল একদিন দুপুরে তাদের বাড়িতে
সদর থেকে চিলেকোঠায় গিয়ে থেমেছিল
অমিতেশ বলেছিল চোখ বন্ধ কর উঁহু দেখবেনা
চুপি দেওয়া চোখে দেখেছিল সে --
লালপেড়ে গঙ্গাজল রঙের একটা--পাটোলা ।

বাবা বলেছিলেন শাড়িটার নাম যেন কী
মা যুগিয়ে দিয়েছিলেন - পাটোলা
বাবার মুখ থেকেই প্রথম শোনা
গুজরাটের পাটনে
এই পৃথিবী বিখ্যাত শাড়ি তৈরি হয়
বাবা জিজ্ঞেস করেননি দাম
সে বিশ হাজার টাকা দামের স্টিকারটা
আগেই তুলে ফেলছিল
শাড়ি পাগল মেয়েটা শাড়িটার যত্ন করতো বটে
মা বলতেন ওটা আর কবে পরবি বলতো ?
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার ।

প্রতি বছর পুজোতে মা বলতেন
আমার কেনা শাড়ি তো তোর পছন্দই হবেনা
মেয়ের আমার নাকউঁচু ।

কত বছর যে চলে গেল তারপর কে জানে
অমিতেশের চিঠিগুলো জুড়ে জুড়ে
মস্ত একটা আঠারো ফুট সম্বলপুরী
বা পচমপল্লীর পৈঠানী
কিংবা বারো হাত বোমকাই হয়ে যেতে পারতো
শেষে একদিন টরেন্টোর অলিভ অ্যাভিন্যু থেকে
চিঠি আসা একবারে বন্ধ হয়ে গেল
পাটোলাটা আর পরাই হলোনা তার ।

অমিতেশের ঘামলাগা শাড়িগুলো
আর কোথাও পরে যেতনা
আলমারীর থাকে থাকে
বেঙ্কটগিরি লুগালে গাদোয়াল ক্লাসিকেট
চান্দেরি কটাদরিয়া ঢাকাই-জামদানি
বলরামপূরম মঙ্গলগিরি শান্তিপুরি বাঁধনি
বেগমপরি কাঞ্জিভরম কটকিগুলো
ভাদ্রমাসের রোদ দেখতোনা আর ।

শেষে বাবাও বলতে শুরু করলেন --
মেয়ের আমার নাকউঁচু
বর আর পছন্দ হয়না ।
প্রথম প্রথম লুকিয়ে চোখ মুছতো
এইভাবেই দুটো বছর তবু আশা ছাড়েনি মেয়েটা
গোঙানির কোনো শব্দ কেউ টের পাইনি তার ।

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
বড় বরেরও শখ ছিল মেয়েটার ।
দ্বিতীয় পক্ষের বলে বাবা মা রাজি হননি কিছুতেই
শেষে জোর করে রাজি হয়ে গেল মেয়েটা নিজেই
কাতান একটা লাল রঙের বেনারসীতে
ভারি মানিয়েছিল
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল মেয়েটার ।

ফুলশয্যার রাত কাটলে
সুশোভন খুলে দেখালো একটা আলমারি
আলমারিটায় শুধু সারসার শাড়ি
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে
শাড়ির সব নাম মুখস্থ করেছিল মেয়েটা ।

হঠাত আজ আলমারিভর্তি
কলমকারী ধনিয়াখালি কলাক্ষেত্র শোলাপুরি ভেঙ্কটগিরি তাঞ্চোই বালুচরি কড়িয়াল-বেনারসি কিমেরা-সুনোঢ়ি ওভেন নৌভরী নারায়ণপেট কোসা সিল্কের মতো
একগাদা বেওয়ারিস শাড়ির মধ্যে দেখতে পেল
একটা গঙ্গাজল রঙের হুবহু লালপেড়ে পাটোলা
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
আজ আর একটাও নাম মনে করতে পারলোনা
সুশোভনের বুকের পাঞ্জাবি আঙড়ে ধরে
হাউহাউ করে কেঁদে উঠলো মেয়েটা ।
© অলোক কুন্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...