গতকাল নন্দনে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়-এর (২৬-২-১৬) " সোহরা ব্রিজ " রিলিজ
করলো প্রিমিয়ার-শো । বাংলা চলচ্চিত্রের
অন্যধারার ছবির নির্দেশক বাপ্পাদিত্য দেখে
যেতে পারেননি তাঁর এই ছবির প্রিমিয়ার শো ।
তাই তার বন্ধুরা শোকমগ্নতায় করলেন তারই
আলোচনা । যা করাটাই স্বাভাবিক ছিল ।
উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী ব্রাত্য ব্সু । একালের
প্রখ্যাত নায়ক-অভিনেতা প্রসেনজিৎ
চট্টোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন । কাল একে
বৃষ্টি এবং তার সিনেমার পরিচালক সদ্য প্রয়াত
হয়েছেন । কে প্রিমিয়ারটা প্রেজেন্ট করবেন
সে নিয়ে দ্বিধা থাকলেও জড়তা ছিলনা ।
এই গত নভেম্বরেই ঘুরে এসেছি চেরাপুঞ্জি ।
আসলে চেরাপুঞ্জির আসল নামই--সোহরা ;
এটা জেনেছিলাম ওখানে গিয়ে । মেঘালয়ের
সাব-ডিভিশ্যনাল টাউন " সোহরা " কে ১৮৮৩
তে বৃটিশরা চেরাপুঞ্জি রূপে দখলে নেয় ;
ভারতের ইস্ট খাসি হিলস্ কেই সোহরা নামে
খাসিরা আজও ডেকে থাকে । পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও চেরাপুঞ্জির বিশ্ব রেকর্ড বৃষ্টিপাত
( ১৮৬১ এর জুলাই থেকে ১ লা অগস্টের
বৃষ্টিপাত ) । আসলে ( So-har-a কে )
বৃটিশরা উচ্চারণ করে ' CHURRA '
তে রূপান্তরিত করেন । চেরাপুঞ্জিকে
Land of Oranges বলা হয় । চেরাপুঞ্জিতে
একঘর বাঙালি থাকে তারা কিন্তু খ্রিস্টান
সম্প্রদায়ের তারা এসেছিলেন বাংলাদেশের
সিলেট । ওপারেই সিলেট । অসম-
মেঘালয়জুড়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ
বৃটিশদের আসার আগে থেকেই হয়ে আসছে ।
আমি গত নভেম্বরে চেরাপুঞ্জির
" কনিফেরাস রিসর্টে " উঠেছিলাম । ওই রিসর্টে
প্রতি বছর একদল সাহেব-মেম জার্মানী থেকে
১২ চাকার দো-তলা বাস নিয়ে ১২/১৪
জন বিদেশী আসেন বৃষ্টির বিভিষিকা দেখতে ।
সে কথা অন্য ব্যাপার । যদি আপনারা বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের SOHRA BRIDGE দেখতে
গিয়ে বৃষ্টিপাত খুঁজতে চান ,
তাহলে কিন্তু তা পাবেন না । ট্যুরিস্টরা
চেরাপুঞ্জিতে গিয়ে রাত কাটান না । লোকাল
ট্যুর করে চলে আসেন । দেখেন - গুহা , সিলেট ,
পাহাড়ি রাস্তা , রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি ।
কিন্তু চেরাপুঞ্জির আসল বিষয় হলো - এখানে খোলামুখের কয়্লা খনি ; শিল্পের অন্যতম
অনুঘটক চুনাপাথর বৃটিশরা আবিষ্কার
করেছিল এখানে । বৃটিশদের তৈরি ঘোড়ায়
চড়া পথ এখনও আছে সোহরাতে ;
চেরাপুঞ্জিতে । পথ চলে গেছে সিলেট ।
যেখান থেকে হয়ে আসছে দীর্ঘ অনুপ্রবেশের
কাহিনী । বাপ্পাদিত্য তার এই চলচ্চিত্রে সেই
কাহিনীকে মূল ফোকাস পয়েন্ট করেছেন ।
কিন্তু কাহিনী এখানে চলচ্চিত্রের মেজাজকে
ধরেছেন - অন্যধারার প্রেক্ষাপটে ।
বহুদিন আগে " দ্য মিস্ট " নামের জাপানি
একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম । কুয়াশা আর
ছবির নায়িকা জুড়ে ছিল সেই চলচ্চিত্রটি ।
এই ছবির পরিচালক সেই বিদেশী ছবিকে
একেবারেই কপি করেননি । চেরাপুঞ্জিতে
বিদেশীরা আসেন ( গোয়াতেও বিদেশীনিরা
আসেন এবং কোটিপতি বিদেশীনিরা তাদের সেক্সচ্যুয়াল স্যাটিসফ্যাকশন-এর জন্য
এদেশের কিছু যুবককে টাকা দিয়ে
একমাসব্যাপি ভাড়া করেন । এমনকি এইরকম
ভাড়া খাটতে বেশ কিছুদিন আগে কলকাতার
একটি ছেলে বেশ ডলার কামিয়েছিলেন ।
এরকম একজনের সঙ্গে আমার বছর কুড়ি
আগে সারারাত রেলের টিকিটের লাইনে
আলাপ হয়েছিল এবং সেই গল্প শুনেছিলাম ।
তখন অবশ্য সেই যুবক বিয়ে থা করে থিতু
হয়েছিলেন ) এরকমটা যে ভারতের আর
কোথাও হয়না তা কে বলতে পারে ? এই
বিষয়টিকেও এই সিনেমার একটি মুখ্য
অবলম্বন হিসেবে দেখা গেছে । যার জন্য
একটু সেক্সচ্যুয়ালিটি এসেছে খুব নগন্যভাবে ।
আর যাই হোক বাপ্পাদিত্য বাঙালিকে সাবালকত্ব শিখিয়ে গেছেন । কিন্তু এই " সোহরা ব্রিজ "
সিনেমাটি প্রকৃত অর্থে কাহিনী উপ-কাহিনীর
থেকে বড় ব্যাপার আমার মনে হয়েছে এই
ছবিটি যেন সিনেমাটিক পেইন্টিং । আরো
ভালো করে বলি কথাটা । সিনেমা যে একটি
ভিস্যুয়াল আর্ট এবং অ্যাপ্লায়েডআর্টের মতো
-সোহরা ব্রিজ দেখতে দেখতে আমার সে
কথাই মনে হয়েছে । টাইটেল থেকেই যার শুরু
হয়েছে । চিত্রনাট্য ছাড়া সিনেমা হয়না ।
কিন্তু কথা-বার্তা অত্যন্ত কম সেই চিত্রনাট্যের
পরতে পরতে । এতদিনে বাপ্পাদিত্য বুঝি
বোঝাতে চেয়েছিলেন শুধু মুখে ভারতের
অখন্ডতা বললেই তা অখন্ডতা হয়ে যায়না।
এখানে প্রয়োজনে যেখানে অসমিয়া
( অহমিয়া ) ভাষার যেখানে খাসি ভাষার
প্রয়োজন এবং ইংরেজি উচ্চারণ রাখা দরকার
সেখানে সেটাই অবিকল ব্যবহার করেছেন ।
তাই এই সিনেমা অসম ( অহম) মেঘালয়েও
দর্শক পাবে । সিলেট থেকে কীভাবে রোজ
রাজনীতির হাত ধরে খুল্লামখুল্লা টাকা-ডলারের
হাত ধরে এপারে ( ওদের কথায় বাঙালিরা
আজও বিদেশী) লোক ঢুকছে সেই আগুনের
মতো বিষয়্কেও এই ছুঁয়ে গেছে । ছবিটি মুখ্যত
সিঙ্গল ক্যারেকটরের ফিল্ম । একটি মেয়ে রিয়া । কনভেন্টে পড়া । তার পিতা লেখক সন্দীপ
চট্টোপাধ্যায় কলকাতা ছেড়ে এবং রিয়ার
মাকে ছেড়ে এক অসমিয়া নারীর কাছে চলে
এসেছেন । সময়কাল নকশাল মুভমেন্ট
থেকে সন্ত্রাসবাদের কথা আছে । এমন কিছু
ডায়লগ আছে যা শুনে মনে হতে পারে যারাই
সরকারে ছিল এবং আছে তাদের
প্রত্যেককে বাপ্পাদিত্য বার্তা দিয়ে গেছেন ।
সে বার্তা পড়তে জানলে সরকার ও দলের
রাগ হবে কিন্তু বাপ্পাদিত্যের বলায় তেমন স্পষ্ট
রাজনীতি নেই । কিন্তু ষা আছে যা আমি
ও আমার স্ত্রী গত নভেম্বরে গোটা একদিন ধরে
ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছি সেই মানুষসমান দীর্ঘ
চেনা নভেম্বরের পোড়া ঘাসের জঙ্গল ।
কয়লা-চুনাপাথর শ্রমিকদের ছেড়ে যাওয়া
কালো কালো পোড়া বাড়ি । সরু পিচের রাস্তা ।
ছোটো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সিম্বলিক এলোমেলো ক্রস যা আসলে খাসি
সম্প্রদায়ের কবরস্থান । যে রকমটি নির্জন
চেরাপুঞ্জিকে বাপ্পাদিত্য দেখিয়েছেন - সোহরা
আসলে সেই রকম একদম । আমিও সেই
চেরাপুঞ্জিকেই দেখে এসেছি । নায়িকা বা মূল
চরিত্র সারা চেরাপুঞ্জির ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে
বেড়িয়েছেন কিন্তু তিনি আসলে তার কলকাতা
ত্যাগী লেখক পিতাকে খুঁজতে এসেছিলেন ।
বিশাল ফ্রেমে সেই সব অবাক নিসর্গকেও
বাপ্পাদিত্য দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন
ক্যামেরার কারুকাজে । এই ছবির ক্যামেরা
লোয়ার রিয়ার অ্যাঙ্গেলে প্রথমে স্থির থাকে
মিনিটব্যাপি ধীরে ধীরে অনেকটা পরে বাঁক নিতে
থাকে খুব কাছ থেকে । মনে হয় থ্রি ডি মুভি
দেখছি না তো । এই সিনেমার এডিটিং প্রচুর জাম্পকাটের ব্যবহারে ছবির স্পিডকে ধরে
রাখতে সাহায্য করেছে । ছবির মিউজিক
খাসিয়াদের রূপককে কখনও তুলে ধরেছে
তো কখনও তার সুর দক্ষিণ আমেরিকার
লোক সংগীতের আঙ্গিকে । কখনো সুরকার
দু- একটি মাত্র যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহারে তার
জাত চিনিয়েছেন । এত কম কথা । স্বল্প উপ
কাহিনী । পিতা-পুত্রির এক সামান্য গল্পকে
এই সিনেমার এডিটররা ( সম্পাদনা)
অসামান্য করে তুলেছেন কতক্ষণ কোথায়
কতখানি রাখতে হবে । এই ছবির সেতুর এক
পারে এক যুবতী যে আজকের দিনের মেয়ে
নিজের শরীর ভোগের কথা যার জানা আছে
ইংরেজি কবিতার মানে যে বুঝতে পারে ;
অবলীলায় ধরাতে পারে একটার পর একটা
সিগারেট । যার কাছে প্রয়োজনে যৌনতা
মদ্যপান দোষের নয় । আর তার ব্রিজ অর্থাৎ
তার পিতাকে খোঁজার প্রয়াস তাকে জানার
ইচ্ছে অবশেষে বুঝতে পারা ও পিছিয়ে থাকা
উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যাকে সম্যক রূপে
উপলব্ধি করার মধ্যে দিয়ে এই গল্পের
প্রয়োজনে এক অন্য ধারার নারী চরিত্র
ফুটিয়ে তুলেছেন যা ভারতীয় সিনেমায়
দ্বিতীয়বার আসেনি । সিনেমাটির প্রধান
অভিনেতা বরুণ চন্দ । তিনি প্রিমিয়ারের
শুরুতেই বলে দিয়ে ছিলেন এই ছবিকে একটু
অন্যভাবে দেখতে হবে । আমি মনোযোগ দিয়ে
দেখিছি - এ ছবি সিনেমার পেইন্টিং ছাড়া
আমি কিছু ভাবতে পারিনি । কারণ গল্পের
থেকে ভিস্যুয়ালাইজেশন রূপান্তরের প্রধান
বিচার্য বিষয় এখানে ক্যামেরা । কীভাবে তা
প্যান করছে কী দৃশ্যপট তুলে ধরছে এই তুলে
ধরার মধ্যে রঙের প্রাচুর্য যা চেরাপুঞ্জির
বাস্তবতা -রুক্ষ প্রাণহীন । বাস্তবিক যেখানে
পানীয় জলের সমস্যা আছে শুষ্কতার মধ্যে
তার নিদর্শন পাই । অথচ এখানেই বৃষ্টিপাত
বেশি । না এটা ছবির বিষয়ে ছিলনা ।
বাপ্পাদিত্য বেঁচে থাকলে তাঁর সব কথা
হয়তো আবারও বলতে পারতেন....
© অলোক কুন্ডু
বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯
সোহরাব্রিজ সিনেমার আলোচনা ©®অলোক কুন্ডু
এতে সদস্যতা:
মন্তব্যগুলি পোস্ট করুন (Atom)
প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু
#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...
-
বড় চমক, বাংলা থেকে এনডিএর-র উপরাষ্ট্রপতি প্রার্থী ●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●●● গত তিন বছর বিভিন্ন ইস্যুতে মমতা সরকারকে নিশানা করেছেন ব...
-
⛔ এটা ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৯৭-এর 'বর্তমান' খবর কাগজ। বরুণ সেনগুপ্ত'র আগাগোড়া ১০০% সমর্থন তখন। জিতেন্দ্রপ্রসাদ এসে সোমেন মিত্রকে নিয়ে...
-
#অলোক_কুন্ডুর_লেখালিখি_ও_কবিতা #CoronavirusLockdown #COVID19PH #COVID19 #CoronavirusPandemic #coronavirus #ভিটামিন_সি ■ বিজ্ঞানী ইন্দুভূষণ ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন