■ অলোকের ঝর্নাধারায়-১
দরলাঘাট, হোটেল বাগেলা
■ সেবার মানালি থেকে সিমলা ফিরবো ৩০/১২/০৭। ৩১.১২.০৭- এ আগে সিমলাতে গিয়ে ওখান থেকে কুফরির একটা গ্রামে গেলে তবেই জানতে পারবো ৩১.১২.২০০৭-এর ফেরার ট্রেনের টিকিট জুটেছে কিনা। ওখানে একটি ট্যুর পার্টির এজেন্টের কাছে সিমলা থেকে হাওড়ার আমাদের ফেরার ট্রেনের টিকিট আছে। হিমালয় ক্যুইনে কালকায় বদলিয়ে ফেরার টিকিট স্পিডে পৌঁছে গেছে জানতে পারলাম ২৯.১২.২০০৭-এর রাতে। বহু কষ্টে শেষে ফোনে খবর পেলাম। হঠাৎ করে দেরিতে মানালি আসার সিদ্ধান্তে, আমাদের ফেরার টিকিট কেটে নিয়ে আসতে পারিনি। শুধুমাত্র আসার টিকিট পেয়েছি। ইতিমধ্যে দুবার মানালি আসা হয়ে হয়ে গেছে। এইবার মানালি এসেছিলাম ২৭/১২/০৮-এ। আগের দিন মানালিতে স্নোফল হয়ে গেছে। ভাগ্য এমন খারাপ যে পরে আর তা পাওয়া গেল না। তবে সোলানভ্যালিতে প্রচুর বরফ পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে চলে আসার জন্যে মানালিতে কালীঘাটের ভিড় যেন। থিক থিক করছে বাঙালি এমনকি আমার পাড়ার তিনটে পরিবারের সঙ্গে পর্যন্ত দেখা হয়ে গেল। সকলেই ভয় দেখাচ্ছে সিমলাতে ৩০.১২-তে কোনও ঘর নেই। একটা বাথরুমে থাকলে তার ভাড়া ২০০৭-এই ৪০০০/৫০০০ এক রাত। মহাসমস্যায় পড়লাম। ৩১.১২-তে প্রতিবছর সারারাতের ফ্যাংশন হয় ম্যালেতে, অন্তত একদিনে একলক্ষ লোক দিল্লি চন্ডিগড় ও নিচ থেকে হুল্লোড় করতে উপস্থিত হয়। সে যে কি হুলুস্থুল কান্ড চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা মুস্কিল। দলে দলে ছেলেরা পোর্টেবল মাইক মিউজিক সেট, ব্যান্ডপার্টি আরো কত কি সঙ্গে চলেছে। কালীবাড়িতে চেনা থাকলেও মেঝেতে কম্বল মুড়ি দিয়ে কতজন পড়ে থাকবে তার কোনও ঠিক নেই। চার কিমি দূর পর্যন্ত আশেপাশের সব বাড়ি হোটেল ভর্তি ৩০ ও ৩১ তারিখ প্রতিবছরে। এটাই হয়ে আসছে। ২৯.১২তে গিয়ে পড়লাম মানালির ট্যুরিস্ট অফিসে। কি হবে আমাদের? অনেক কথার পর একজন স্টাফ দিশা দিলেন একটা। তবে সেটা মানালি সিমলা রোড থেকে ফেরার পথে একটু ঢুকে দরলাঘাটে ( সোলান জেলার মধ্যে পড়ে) ওদেরই ( hptdc) ট্যুরিজমের হোটেল ও অ্যাকোমোডেশন, "হোটেল বাগেলা।" সোলান জেলা তে পড়ে জায়গাটা হলো- দরলাঘাট। ওখান থেকে ওরা মানালি থেকে সিমলা ফেরার একটা গাড়ি ভাড়া ও বুক করেদিল। তবে গাড়ি আমাদের ৪৫ কিমি দূরে আগেই নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে। খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা ভালো। সিমলা মানালি হাইওয়েতে না হলেও একটু ঢুকলে এদের রেস্টুরেন্টের নামডাক আছে। থাকাও এলাহি। কিন্তু ধারেকাছে সিমলা ফেরার গাড়ি পাওয়া মুস্কিল। সিমলা ফিরতে গাড়ির ড্রাইভারকে দু তরফের ভাড়া গুনে দিতে হবে। ৪৫ কিমি দূর যদিও খুব একটা দূর নয় কিন্তু আমাদের সিমলা পেরিয়ে কুফরির গ্রামে একবার যেতে হবে টিকিট সংগ্রহ করতে। যাইহোক ওইখানে নির্জনতা একেবারে পেয়ে বসেছে জায়গাটায়। শীতে বরফও পড়ে। হোটেলের পেছনে বাগান আছে তবে ইয়া উঁচু মোটা জালের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। বন্যজন্তু বিশেষ করে শিয়াল,হনুমান বন্য কুকুর ভাল্লুক সাপ খড়গোস, বেঁজি পাখিদের কচিৎ দেখাও মিলে যায়। বড় বড় ঢালা কাঁচের জানলা হোটেলের ঘরের পেছেনের বাগানের দোলনাজুড়ে রোদে দোল খাচ্ছে সেখানে। কিন্তু আশেপাশে কোনও দোকান বাজার স্কুল হাট কোনও কিছুই নেই। কাছাকাছি ছোট গ্রাম থাকলেও দু একটা মাত্র গাড়ি তাদের আছে। তবে হোটেলের ম্যানেজার বুক করে গাড়ি আনিয়ে দেবে সে বিষয়ে খুব একটা চিন্তা নেই। কিন্তু ৩১ তারিখ সকাল সকাল না বের হলে বিশাল জ্যামে পড়ে যাবো আমরা, দুপুরে ফেরার ট্রেন। একেবারে হনিমুন পারপাস জায়গা বটে। হোটেলে লোকও খুব কম। অনেক সময় মিটিং পারপাস গ্রুপ বুকিং এখানে আসে। রেস্টুরেন্টে বিলিতি মদ পাওয়া যায়। লাউঞ্জে বসে দু একজনকে খেতে দেখলাম। এদিকটা একেবারেই অচেনা জায়গা আমাদের ড্রাইভারেরও। কোনও ভাবে গাড়ি পৌঁছলে খাওয়া ও থাকার জন্যে বুকিং হয়। সিমলায় হোটেল না পেয়ে hptdc-র কয়েকজন বোর্ডার এখানে উঠেছেন দেখলাম। বেঁচে গেছি দলে দলে এই ৪৫ কিমি দূরে আর কেউ উড়ে আসেনি। হোটেলটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং পরিবেশ সুন্দর হলেও দৃশ্যপট খুব একটা এখান থেকে দেখা যায়না। পাইন-ফার বা শীতের গাছপালার সেই পরিবেশ ওইখানে নেই। দূরের পাহাড়টা এখান থেকে বহুদূরে। অস্পষ্ট মায়াবী। হোটেলটা একটা উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে যার ফলে পেছনের জঙ্গল ও পাহাড়ের উঁচুটা কতদূর বোঝা যায়না। সাধারণত হোটেলটি বিয়ের মরসুমে সেই পারপাসে সরগরম হয়ে ওঠে। বাইরেটা কিছুটা পুরনো আমলের হলুদ এলা রঙের ছিল তখন কিন্তু বর্তমানে রঙটঙ পাল্টেছে। উঁচুও হয়েছে। হোটেলের ভেতরটায় ডাইনিং হল ও ঘরগুলোকে বেশ কয়েক বছর আগে আধুনিক করা হয়েছে। সাদা ধবধবে চাদরে মোড়া বিছানা দেড়ফুট উঁচু ও নরম। রাতে বেশ ঠান্ডা এক্সট্রা কম্বল আলমারিতে দেওয়া আছে। টিভি আছে। গরম ঠান্ডা জলের কোনও প্রবলেম নেই দোতলায় থাকার ব্যবস্থা। সার সার ঘর। বেশ বড় ঘর। একতলায় কিচেন, বড় ডাইনিং, পোর্টিকো, বাগান, অফিস লাউঞ্জ। হোটেলের সামনে পরিষ্কার পিচেমোড়া রাস্তা সারাদিনে সিমলা থেকে অন্য কোথাও বাস যাতায়াত করে গোটা ৬-য়েক। এত কিছুই মানালি থেকে জানা যায়নি। বাকিটা এসে দেখা গেল। কিন্তু ওরা মানালি থেকে আমাদের জন্য ফোন করে বলে দিল আর বুক করে দিল। হাতে আকাশের চাঁদ পাওয়া কেন তা পরে বলতে থাকবো। সিমলায় গ্যারেজওলা গাড়ির এক ড্রাইভার পেয়ে গেলাম তবে অ্যাম্বাসাডার। আমাদের পৌঁছনোর কথা। গাড়ির কার্যকারিতা দেখবার জন্য নয়। ওই ড্রাইভার বাগেলাতে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল যখন তখন বিকাল এবং তারিখ হলো গত ৩০-শে ডিসেম্বর ২০০৭। সাধারণত বিদেশীরা এইসব হোটেলে এসে থাকে। কারণ সিমলা আর মানালির সরকারি হোটেলের থেকে এখানে রেট অনেকটাই মডারেট।
গাড়িটা চলে যেতে যেন মন খারাপ হয়ে গেল। সে মন খারাপ বুঝি বিয়ের পর মেয়েদের প্রথমদিকে বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছনোর মতো। কেউ কোথাও নেই। এমনকি একটা রাস্তার এমন বাঁকে হোটেলটা এমন একটা এল টাইপের জায়গায় যে রাস্তার দুটো প্রান্ত কোথায় যে পৌঁছলো তা বোঝার ঠিক উপায় নেই। যেন সারা পৃথিবী থেকে একে লুকিয়ে রেখেছে। পৌঁছে গরম জলে গা ধুয়ে ডাইনিং-এ গরম গরম মশলা চায়ের সঙ্গে রোস্ট করা লম্বা লম্বা আলু ভাজা আর বাঙালি টাইপ পরটা আর মাখনে ভাজা টোস্ট ও ওমলেট মিলিয়ে মিশিয়ে মুখে মিলিয়ে যেতে থাকলো। গাড়ির সামান্য ধকল ও সারাদিনের কি হয় কি হয় অবস্থা ততক্ষণে চলে গেছে। মহিলা রাঁধুনিরা অতিরিক্ত চায়ের আব্দার মিটিয়ে হাসিমুখে জেনে নিয়েছে তাদের তৈরি খাবারের গুণগত মান ঠিক মতো ছিল কিনা? পরের দিন বাসে করে যাবো বলে মনস্ত করেছি সিমলা। কিন্তু ঠিক সকাল ৯.২০ নাগাদ মানালির দিক থেকে একজন একটা মারুতি ভ্যানে করে এসে হোটেলের সামনে নামতেই ধরলাম। রাজিও হয়ে গেলো ড্রাইভার সাহেব আমাদের সিমলা নিয়ে যেতে। কিন্তু বললো জলদি বেরিয়ে পড়ুন মুস্কিল হয়ে যাবে দেরি হলে। আমাদের রেডি হওয়াই ছিল। তড়িঘড়ি একটা হোটেল বয়কে দিয়ে লাগেজ নামিয়ে গাড়িতে তুলেতে গাড়ি দুদ্দাড়িয়ে ছেড়ে দিল। পথের সৌন্দর্য বেশ মনোরম কেননা এ যেন বেশ পয়সাওয়ালাদের পাড়া দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে বলে মনে হয়। বাড়িঘর সব বেড়া বা গ্রীল ও পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ঘ্যারেজে প্রত্যেকের গাড়ি ছিমছাম বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি বোগেনভেলিয়া গেটের মাথায়। ফুলের টব দিয়ে সাজানো। আবার পাহাড় উৎরাই চড়াই। দূরে কাছে কোনও কোনও জায়গাটা অনেকটা সমতল চোখ বুজলে পুরনো নিউ আলিপুরের ওপর দিয়ে চলেছি মনে হচ্ছে। ভেতরের পথ। আবার পাহাড় অনেক অনেক খোপ খোপ বাড়ি দূর থেকে মনে হয়। সবুজের ভেতর সবুজ। মিলিটারি চৌকি। ড্রাইভার আঙুল দিয়ে দেখালো, এখানে কোন একটা হিন্দি সিনেমার স্যুটিং হয়েছিল। নাচগানের স্পট মেলাতে মেলাতে চেনা সিমলার রেলস্টেশন পেরিয়ে উঁচু নিচু করে করতে করতে গাড়ি পৌঁছলো কুফরির একটা গ্রামে। তখনও স্মার্টফোন ফোন হয়নি। পাতি ফোন। সেই দিয়ে ধরলাম এজেন্টকে। রোদ খাচ্ছিল দলবেঁধে একদল। গাড়ির নম্বর বলে দিয়েছিলাম। একটা চকে কয়েকজন গাড়ি থামালো। ওদের মুখস্থ কোন নম্বরের গাড়ির কি তার চেহারা। হাতবাড়িয়ে স্পিডপোস্টের খামটা নিয়ে নমস্কার সেরে ধন্যবাদ দিতে দিতে আমাদের গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে বেলা ১১.০০ তেই জ্যামজটে হাজার হাজার লোকে সিমলা তখন বড় অচেনা। দলে দলে চলেছে ম্যাল। মাথা আর মাথা। কোনরকমে ড্রাইভারের পেমেন্ট মিটিয়ে টিকিটের জেরক্স করে লকার রুমে তল্পিতল্পা রেখে কালীবাড়িতে তড়িঘড়ি গিয়ে একটু খেয়েই
আমরাও ম্যালেতে। একঘন্টা থেকে কোনরকমে দৌড়তে দৌড়তে হাঁপিয়ে ট্রেনে। তখনও দেরি আছে ছাড়তে। ইঞ্জিন শব্দ করে হুইসেল দিয়ে ছেড়ে দিল। ততক্ষণে ম্যালে জায়গায় জায়গায় অর্কেস্ট্রাপার্টি তাসাপার্টি গীটার নাচের দল হাজির দলে দলে আইসক্রিম খাচ্ছে আমরাও আইসক্রিম হাতে নিয়ে নেমে এসেছি। পোশাক যেমন ঝলমল করছে সকলের, তেমনি বেলা ১ টাতেই আলো জ্বলে উঠেছে চতুর্দিকে। জায়গা দখল করতে রেলিং ধরে বসা শুরু হয়ে গেছে। শুনছি সারারাত নাচ গানে হুল্লোড় হবে। দলে দলে ভাগ ভাগ হয়ে হবে আবার কেন্দ্রীয়ভাবে হবে। এক এক বছর বরফ পড়েছে তারওপর চলেছে নাচগানের আসর। ঠান্ডাকে দুহাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে সবাই। ট্রেন যত নিচে নামছে তত ভিড় অন্য দিক থেকে আসছে। ফিরতি ট্রেনের মাথায় জানলায় ঠাসাঠাসি ভিড়। ছেলেমেয়ে কে যে কার ঘাড়ে বসে আছে বোঝার উপায় নেই। মাঝেমধ্যে রাস্তায় রাস্তায় গাড়ির লাইন মিডিবাস গাড়ি সব ভিড়েভিড়। উপচে পড়ছে। এমনকি ওই অন্ধকারে ট্রেনের মাথায় বসে ছেলেমেয়েরা কীভাবে কতগুলো সুড়ঙ্গ পার হচ্ছে তা ঠিক বোধগম্য হলোনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন