মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

অলোকের ঝর্নাধারায়: আমার টুকরো জীবন

অলোকের ঝর্নাধারায় -২ 
(আমার টুকরো জীবন)

গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের রাজ্য সম্পাদক ইন্দ্রনাথ দা'কে প্রথম দেখেছিলাম কলকাতার একটা আর্ট ফেয়ারে, কিন্তু উনিই যে ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা পরে বুঝতে পারি। শুনেছিলাম ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন সিপিএমের কম্যিউনে যেরকম বিমান বসু থাকেন। একদিন বন্ধু আবৃত্তিকার নূপুর বসু ওর শিক্ষিকা,মায়ের বিষয়ে আমার হাওড়ার অফিসে এলো তখন কথায় কথায় সেই প্রথম ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম জানতে পারি। ওর সঙ্গে গিয়ে একদিন নিউ সিনেমার ওপর ইন্দ্রনাথ দার সঙ্গে আলাপ করি ( তারিখ মাস সাল পরে দেখেশুনে বসাবো এখনই মনে পড়ছে না ) আমি তখন বর্ধমানের ভাতারে পোস্টিং আর্ট কলেজ ও বি.এড পড়তে গিয়ে পরপর প্রায় আটবছর আমার সঙ্গে তখন আমার আত্মীয়-স্বজন, পরিবার বলতে কার‌ও সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে পারিনি। তার উপর তখন বন্ধুদের সঙ্গে ছুটির দিনে একাডেমির পেছনে বসে একটা আড্ডা দি।ওখানে যে চপ ক্যাটলেটের ক্যান্টিনটা ছিল সেখানে আড্ডাটা হোতো, এখন ওইখানে ছেলেমেরা বসে থাকে। আট বছর বোহেমিয়ান জীবন। সেইসব বন্ধুরা অধিকাংশ বহু আগে কলকাতা ছেড়েছে আর দেখাসাক্ষাত নেই। চয়ন-শুক্তির সঙ্গে আর দেখা হয়না। দুজনেই এখনও ছবি আঁকে প্রদর্শনী করে। দিলীপ ভট্টাচার্য‌ও ছবি আঁকে কাগজে রিভিউ পড়ি। এদের সঙ্গে আর দেখা হয়না। যাইহোক যা বলছিলাম ইন্দ্রনাথ দা বেশ ফর্সা, ধুতি পাঞ্জাবী পরেন সুপুরুষ। বাম আমলে বুদ্ধদেব বাবুর পরের জন। বুদ্ধবাবু তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী তখন। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা ইন্দ্রনাথ দা প্রচ্ছদ‌ও করেন। খুব ভালো মানুষ। আমার নাম‌ও বলতে পারেন। সেই ইন্দ্রনাথ দা আর্ট কলেজের ছাত্রদের আব্দারে একটা বড় সেমিনার ডাকলেন কলকাতায়। তথ্যকেন্দ্রে এলেন বড় বড় মানুষ সকলেই সহমত হলেন যে বিদ্যালয়স্তরে শিল্প শিক্ষা চালু করার বিষয়ে। ইতিমধ্যে কুমোরটুলিতে প্রথম গিয়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু যে বক্তব্য রেখেছিলেন প্রাথমিক স্তরে পুতুল গড়তে হবে, সেই ইতিহাস তুলে ধরে বক্তব্য রাখলেন ইন্দ্রনাথ দা। হাতে সব সময় সিগারেট থাকে ইন্দ্রদার। স্বনামধন্য বিজন চৌধুরী তখন আমাদের ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ, উনিও বক্তব্য রাখলেন। অস্ট্রেলিয়া সরকার তখন বিজন চৌধুরীর উপর তথ্যচিত্র তুলছে। স্যারের বাড়ি বালীর সাহেববাগানে, আমি গেছি অনেকবার। হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা গণস্বাক্ষর করলো, বড় বড় দিকপাল শিল্পীরাও স্বাক্ষর করলেন। শিক্ষামন্ত্রী কান্তি বিশ্বাসের কাছেও তা জমা পড়লো। কিন্তু বামফ্রন্ট তা মানলো না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
ইন্দ্রনাথ দা'র কাছে নিউ সিনেমার ওপরে গেলাম একদিন। এক কথায় আমার নাম ধরে একজনকে চা দিতে বললেন। আমি যা দেখেছি ইন্দ্রনাথ দা 
একজন চরম বামপন্থী হয়ে এত সাধারণ থাকতেন এবং আজকের দিনে মনে হয় ওইসব নির্লোভ মানুষ গুণি স্বনামধন্য শিল্পী হয়েও এবং ইন্দ্র-দার হাতে বামফ্রন্ট সরকার থাকা সত্বেও কোনও কিছু করেছিলেন বলে কখনও শুনিনি। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে বুদ্ধ বলে ডাকতেন। কান্তি বিশ্বাসকে কান্তি বলে ডাকতেন। এত ভাব হয়ে গেল যে ইন্দ্রনাথ দা ওর প্রদর্শনীর ইনভিটেশন হাতে দিলেন। আমার দেখা অতি সৌন্দর্যমন্ডিত হাতের লেখা ইন্দ্রদার। আমার সঙ্গে সিপিএমের কোনও সম্পর্ক নেই। তবু লোকটাকে আমার ভালো লেগে গেল। এহেন সৎ নির্লোভ আমি দেখিনি।এমনকি ইন্দ্রদা একদিন বললেন, তোকে মেট্রোচ্যানেলে আর্টক্যাম্পে ঢুকিয়ে দিলাম।
আমার তো মহাআনন্দ, কেননা মহারথীরা দলবেঁধে ছবি আঁকবেন। আমরা জুনিয়ররা ভরাট করবো। এই সুযোগ কখনও হবে আমার জীবনে। ইন্দ্র-দাকে ভগবানের মতো মনে হচ্ছে আমার মতো সামান্যজনের কাছে। এরপর একটা বড় কি একটা মেলা ঠিক ময়দানের কোথাও একটা হয়েছিল। সেখানে নানারকম প্রদর্শনী হয়েছে।
ইন্দ্রনাথ দার কার্ড এলো বাড়ির ঠিকানায় গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের অনুষ্ঠান। বড় বড় আর্টিস্টের নাম। ব‌ইয়ের স্টল। পেন্টারদের প্রদর্শনী। আমার কোনও সুযোগ নেই। আমি ওইসব সুবিধা নেওয়ার পক্ষেও নেই। যাইহোক উদ্বোধন একটা শনিবার করে হয়েছিল। আমি বর্ধমানের ভাতার থেকে উপস্থিত হলাম। একটু দেরিতে, ততক্ষণে অনুষ্ঠান শেষ। এক জায়গায় মাঠের মধ্যে ইন্দ্রনাথ দা বসে গুণমুগ্ধরা দু চারজন 
আছেন। আমি বসলাম গিয়ে একটু দূরে। বললেন এত দেরি হলো কেন রে ? খুব আন্তরিক কন্ঠস্বর।
একটু দূরে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বসে আছেন। ইন্দ্রনাথ দা হঠাৎ আমার হাতে একটা লাইটার ও সিগারেটের প্যাকেট দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে আয়, বুদ্ধকে। আমি আগেই দেখেছি বসে আছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, তার কাছে একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে, দুজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে, কিছু আলোচনা করছেন। আমি তো হকচকিয়ে গেছি, কি বলছেন ইন্দ্র দা। প্রথমটা বুঝতে পারিনি। আমি বুদ্ধবাবুর কাছে গেলাম হাতে দিলাম আমার দিকে তাকালেন না। সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা নিয়ে আমার হাতে প্যাকেট ফিরিয়ে দিলেন, অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করছেন। দুবারেই আলো জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালেন। ওটাও ফিরিয়ে  দিলেন। সেই প্রথম শুনলাম জলদগম্ভীর স্বর বুদ্ধবাবুর। আমাকে বললেন ওনাকে দিয়ে দাও। আমি চলে এলাম ইন্দ্রদার কাছে। ©® অলোক কুন্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...