শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০

শ্রী ল প্রভুপাদ ও ইসকন : অলোক কুন্ডু


🌏 গান্ধীবাদী স্বদেশী থেকে সন্ন্যাসী গৌরাঙ্গে 
সমর্পিত প্রাণ কর্পোরেট জীবন থেকে এক 
আশ্চর্য ভিক্ষুক শ্রীল প্রভুপাদ - অলোক কুন্ডু ©

⛔ আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি ও কেউ কেউ পড়েছি মিশেল ফুকোর আত্মার যত্ন। যদিও এই ফরাসি দার্শনিক যৌনতার ইতিহাসও লিখেছেন সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। দক্ষিণী ও আদিগুরু যমুনাচার্য যিনি ছিলেন রামানুজমের (আয়েঙ্গার গোষ্ঠীর) গুরুদেব। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী অদ্বৈতবাদী দশনামী সম্প্রদায়। স্বামীজির -- নিরাকার অদ্বৈতবাদ। তোতাপুরী, বড়পলঙ্গ, তেঙ্গলঈ-ধারা, সীতরাম দাস ওঙ্কারনাথ থেকে শঙ্করের মায়াবাদ প্রায় সব মিলিয়ে ৯০০ বছরের একটি ফল্গুধারার মতো হিন্দুদের ধর্মের নানাবিধ চর্চা ও আত্ম উপলব্ধির বিষয় কিন্তু এইসব এত জটিল যে সাধারণ মানুষের দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয়নি, সে তাই সব সময় একজন গুরু খুঁজেছেন। কখনো হিন্দুরা তাদের ধর্মের তুল্যমূল্য বিচারে যায়নি। বরং স্বাধীনভাবে যে যার মতো মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী থেকেছে। একে অপরের দেখে দেখে নিজেরাই ধর্মের আচরণে হয়ে উঠেছেন নিজেরাই পুরোহিত। একদল অর্ধ শিক্ষিত পুরোহিতের
শেখানো বুলিও কেউ কেউ শিখে ফেলেছেন। অশিক্ষিতের হাতে পড়ে পুরোহিতরাই এখন জানে না যা করতে বলছে তা তারা জানেনা এবং জানতেও চায়না। ইতিহাস ও সাহিত্যের হাত ধরে ধর্মীয় মতবাদ যেমন এগিয়ে এসেছে, হিন্দুদের কাছে আজ সেটাই ধর্ম। 

⛔ধর্মীয় আচরণ তাই হিন্দুদের কাছে খানিকটা দুর্গা পুজোর হৈ-হল্লার মতো। যার ফলে গুরু গজাতে ভারতের নানা প্রান্তে কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রকাশ্যে স্বামীজিই প্রথম, ধর্মীয় যুক্তির কথা বললেন। তারও আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সারা ভারতে হিন্দুদের ধর্মের এই শাখা যা দক্ষিণে চালু ছিল তাতেই চৈতন্য এনেদিলেন। বিপুল জন সমর্থনে (রথ ও যাত্রাপালায় বাংলাদেশ এক নতুন সংস্কৃতি আবিষ্কার করলো উড়িষ্যা থেকে এল রথ) দেশকে ভক্তিরসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। মানুষের দুঃখ কষ্টে শ্রীকৃষ্ণ হলেন আশ্রয়। শুধু কৃষ্ণ নাম নিয়েই বহু মানুষ তখন থেকেই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নামে, হিন্দুদের মধ্যেই একটি নতুন সম্প্রদায়ের শ্রীবৃদ্ধি ঘটালো এবং এই সুযোগে সারা বাংলাদেশের মধ্যে কিছু ধান্দাবাজ গুরুর গুরত্বও বেড়ে গেল। একদিকে সমস্ত ধর্মমত থেকে এই মানবধর্মের যত প্রসার হতে লাগলো তত হিন্দু ব্রাহ্মণরাও নিজেরা জটাজুট হয়ে গুরু বনতে লাগলো। 

⛔ একদিকে স্বাধীনতার মতো উত্তাল আন্দোলনে মানুষের দিশেহারা অবস্থা। বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রামমোহন দ্বারকানাথ ঠাকুর ধর্মের বিচার বিবেচনার সাথে মানুষের অধিকার সুরক্ষার কথা ভাবছেন। বিদ্যাসাগরের কাছে পন্ডিতের ধর্মীয় ভাবাবেগের থেকে বাস্তব আচরণ বড় হয়ে দাঁড়ালো। রামমোহন আবার ধর্মকে প্রার্থনা সভায় নিয়ে গেলেন। দেবদেবীর মাহাত্ম্য মধ্যযুগে বাড়বাড়ন্ত হলেও বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের হাতে পড়ে তার নবজন্ম হলেও সেই ধারা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে পড়লো পরিচর্যার অভাবে। মানুষের কী করা উচিত তা তার বোধগম্য হচ্ছে না এরকমই পরিবেষ্টিত দেশে এলেন এক তিনি স্বামীজি। স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের চর্চা করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন কমপ্রোমাইজের কথা। আসলে আমার মনে হয় জীবনের সমস্তস্তরে সহাবস্থানের কথাই স্বামীজি বলতে চেয়েছিলেন।  কারণ তাঁর নিজের ধর্ম ছিল অদ্বৈতবাদ আর তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন মূর্তির পূজারী। 

⛔ শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের এই বুনোনকে দুহাতে তলতলে মাটির মতো নিয়ে যেকোনো মূর্তির মাঝে ভগবানের লীলা দেখাত পারতেন। যত মত তত পথের সন্ধান আসলে উদারতার জন্ম হলো শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য এইদেশে।সহজ ও সরল কথায় অন্যদের টেনে নিয়ে আসতে পারতেন নিজের কাছে। শুধুমাত্র শুনে শুনে তিনি পুরাণ মহাভারতের ব্যাখ্যা প্রাঞ্জলভাবে করতে পারতেন তাই সে যুগে ইংরেজি জানা রীতিমতো মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে যাওয়ার পথে এগিয়ে থাকা স্বামীজিকেও শ্রীরামকৃষ্ণ চুম্বকের মতো টেনে রেখেছিলেন। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার। পৃথিবীর বিরলতম ঘটনা। তাই এক সামান্য পূজারীর বাক্য ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেননি স্বামীজি। যদিও স্বামীজির ধর্মবোধ শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের কালীভক্তির কারণে যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর আর কখনো দ্বিতীয়বার শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেননি । কিন্তু স্বামীজিও ছিলেন যুক্তিবাদী এবং পুতুল পূজার বিরোধী। তিনি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছিলেন । অদ্বৈতবাদী স্বামীজি যখন হিন্দুদের দেবী দুর্গার পুজো করার মনস্থ করেন (Compromise) তখন কোনো শিষ্যই তার কাজে বাধা দেননি পরন্তু যে রাজা ও ব্যবসায়ীদের সাহায্যে স্বামীজি আমেরিকায় যেতে পেরেছিলেন সেইসমস্ত শিষ্যরা, রাজারা আনন্দিত হয়েছিলেন, এই ভেবে যে, যত মত তত পথকে স্বামীজি বাস্তবে করে দেখাতে পেরেছিলেন। শুধুমাত্র শ্রীশ্রী মায়ের কথামতো পাঁঠাবলি না করার বিষয়টি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। 

⛔ স্বামীজি নিজেই ধর্মের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন যার তাৎপর্য বোঝা আজ অত্যন্ত কঠিন। নিজে সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন দান চাইতে। পরিব্রাজক স্বামীজি যেখানে যেমন পেরেছেন মানিয়ে নিয়েছেন। পুরাণে সন্ন্যাসীকে ঘুরে ঘুরে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখতে বলেছে, যাতে একজন সন্ন্যাসী দেশের মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খিদের কথা জানতে ও তাদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং সকলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন স্বামীজি যতটা সম্ভব তাই করেছেন। তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে ১৯৩৮ সালে বেলুড় মঠ স্থাপিত হয়েছে। তার এত পয়সার অভাব ছিল যে শ্রীমাকে ঘুষুড়িতে টাকা পাঠাতে পারেননি সব সময়। তখন সারা ভারত ঘুরে মঠের জন্যে তাঁকে একটা একটা করে টাকা ভিক্ষা করতে হয়েছে। স্বামীজি জরুথ্রুস্টের ভক্ত ছিলেন। অনেক বক্তৃতায় তাকে বিদেশীরা অনেক সময় জরথ্রুস্টবাদী মনে করে ভুল করেছেন। নারীর অধিকার জরথ্রুস্টের মতের প্রথম অঙ্গীকারকে স্বামীজি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের গণধর্মমতও তাঁকে বিস্মিত করেছিল তিনি জেনেছিলেন শ্রীমদ্ভাগবতের নানা বিশ্লেষণ এবং তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে বারবার ধর্মের নানা পন্থার দীর্ঘ কাটাছেঁড়া চলেছে। তাই বিশ্ব ধর্মসভা যেখানে বসেছিল আজও সেই রাস্তার নাম স্বামী বিবেকানন্দের নামে হয়ে আছে। স্বামীজি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর অদ্বৈতবাদের রাস্তা অন্য এক মহত্বে বাঁক নিত যা আজ কারো পক্ষেই জানা আর সম্ভব নয়। নানা মতের সমন্বয় সাধন করতে তাঁকে যত্নবান হতে হয়েছিল। মূর্তির পূজারী হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে ছিলেন সর্বজনগ্রাহ্য একজন মানবরূপী মহামানব। তাই বেলুড় মঠের নকশায় হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম পারসিক ধর্মের সমস্ত মোটিফকে একত্রীকরণ করা হয়েছে। পরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন শিক্ষা -স্বাস্থ্য-রোজগার-মানব উত্থানকে মাথায় রেখে বিশ্ব মানব ধর্মের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। 

⛔ এই দেশে নতুন করে হিন্দু ধর্মের আর কোনো এমন বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দ্বারা পথের সন্ধান কারও চোখে আসেনি বা নতুন দিশা নিয়ে সমস্ত জগতের কল্যাণের পথ তেমন প্রশস্ত করার কথা কোথাও শোনা যায়নি। আদপে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে বিন্দু ধর্মের পূজা ব্যবস্থা প্রবেশ করিয়ে দিলেও তা কোনও অবাস্তব কিছু হয়নি। আমাদের অজানার নীচের অংশ আমরা যেন দেখতেই পাইনি। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের পর খুব কম সময়ের মধ্যে একক প্রচেষ্টায় এক বৃহদাকার কর্মযজ্ঞের সূচনা করে গেছেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী , সন্ন্যাসী শ্রী ল প্রভুপাদ মহারাজ । 

⛔ তিনি যা করলেন তা আরও বিস্ময়কর। স্বামীজি ছিলেন অদ্বৈতবাদী যে কারণে আমেরিকা ঘুরে আসার পর ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেশা নিয়ে স্বামীজিকে দক্ষিণেশ্বরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীকে জগন্নাথদেব দর্শন করা তো দূরে থাক মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের মতো উদার মহামানবের সংস্পর্শে এসে পুরীর মন্দিরে প্রবেশের এক মহা রসিকতা শুনিয়ে গেছেন আমাদের। আজও অনেক আজব ধর্মীয় আচরণে বন্দী আমরা, এই দেশে। আর এই দেশেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পান্ডারা নুলিয়াদের দিয়ে হত্যা করিয়েছিল, পা টেনে ধরে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিল। অন্যমতে গর্ভগৃহে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ সেই সময় সমস্ত ধর্মের মানুষ শ্রীচৈতন্যের সাম্যবাদী ধর্মের কাছে এসে ফল্গুধারার মতো মিশে যাচ্ছিল। যেখানে কাউকেই অচ্যুত ভাবা হয়না। ৫০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভূত হওয়ার সময়ে যা নির্দিষ্ট হয়েছিল মায়াপুরের কাছে। তাঁর জন্মস্থানের পাশেই। দলে দলে এক নতুন ধর্মীয় ভাবনায় এসে মিশ্রিত হচ্ছিলেন এই সৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণকে করেছিলেন তিনি জনগণের দেবতা ---" মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বঃত কৃষ্ণ জ্ঞান "(চৈতন্য চরিতামৃত)। 

⛔ স্কটিসচার্চে সুভাষচন্দ্রের এক ক্লাস নীচুতে পড়া ও সুভাষ অনুগামী অভয়চরণ দে স্বদেশী আন্দোলনে নেমে পড়লেন এবং ইংরেজদের দেওয়া কলেজের শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান করে তা নিলেন না। পরে বসু গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন। ৫৪  বছর বয়সে সন্ন্যাসী হন এবং ৭০ বছর বয়স যখন তখন মাত্র ১৫ ডলার হাতে নিয়ে অনির্দিষ্ট যাত্রায় আমেরিকা পৌঁছন সঙ্গে সঙ্গী - "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।" 
এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা। তিনি তখন শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁর কাছে আছেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য। তিনি বললেন শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান কোনো কিছুই নয় তিনি শুধুমাত্র ভগবানকে জানেন। কে এই ভগবান ? শ্রীচৈতন্য ৫০০ বছর আগে যে সাম্যবাদী ধর্মীয় আচরণ ও সংকির্তন গণভোট গণজমায়েত "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।" এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা। এই ভাবাবেগের পৃথিবীব্যাপী একটি প্রধান কার্যালয় মায়াপুরের ইসকন মন্দির। 
⛔©® অলোক কুন্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...