🙅 সত্যি মমতা ব্যানার্জীর এটি মাষ্টার্স-স্ট্রোক বটে। যতটা শুভেন্দুকে হারানোর জন্য ততটা কিন্তু নন্দীগ্রাম জেতার জন্য নয়। নন্দীগ্রামে শুভেন্দুকে আটকে রাখার জন্য আসলে এই ব্যবস্থা বা প্ল্যান। এটা না হলে শুভেন্দুকে আটকানোর আর দ্বিতীয় পথ ছিলনা। কিন্তু ইলেকশন কমিশন যদি ঠিক করে নির্বাচনের প্রশাসনিক কাজ করতে পারে সেখানে কে জিতবে কে হারবে এখন থেকে বলা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। তবে বিজেপি বলতে শুরু করে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমতুল্য এখন পশ্চিমবঙ্গে একজন নেতা তিনি শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দুকে তৃণমূল এতদিন ব্যবহার করেছে তাদের দলকে বাঁচানোর জন্য। শুভেন্দুকে তৃণমূল ব্যবহার করেছে বক্তৃতা করার জন্য, সংগঠন করার জন্য এবং প্রশাসনে সাহায্য করার জন্য। এই তিনটি ক্ষেত্রেই শুভেন্দুর সাফল্য নজিরবিহীন। তার অভাববোধের যন্ত্রণা থেকেই যে শুভেন্দুকে বধ করার এই মরিয়া পরিকল্পনা তা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। শুভেন্দু ছিল একসময় তৃণমূলের রক্ষাকর্তাও। কারণ এই মূহুর্তে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শুভেন্দুকে কোনোভাবেই বক্তৃতা করে আটকানো যাবেনা। আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি শুভেন্দু বলেছেন ৩০০ কিলোমিটার দূরে সৌগত রায়কে ভোটে জেতাতে ও বাঁচাতে শুভেন্দুকে বক্তৃতা করতে পাঠিয়েছিল তৃণমূল। এমনকি হাওড়া, উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত বক্তৃতা করে বেড়িয়েছেন শুভেন্দু।
🙅 নন্দীগ্রামে কে হারলো কে জিতলো সেটা কোনও বড় বিষয় নয়। বিষয়টা হলো এখন ভোট যুদ্ধে জেতা। কোন দল জিতবে এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আগেই লক্ষ্মণ শেঠকে তার এলাকায় ঢুকতে দেওয়া হয়েছিল কারণ তৃণমূলের জেতাকে এগিয়ে রাখতে এবং সিপিএমের ভোটবাক্সকে পুনরুদ্ধার করতে। তখন শুধুমাত্র শত্রু ছিল বিজেপি। এখন বিজেপির দোসর হয়েছে শুভেন্দু। তৃণমূলের এখন ডবল এনিমি। মমতা ব্যানার্জী দাঁড়ানোর কথা বলার ফলে নন্দীগ্রাম রাজনীতি এখন জমজমাট। কিন্তু তেমনি তৃণমূলকে আগেকার রাজনৈতিক স্ট্যাট্রেজি এখন সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে হবে। একই সঙ্গে শুভেন্দুর ভোট ব্যাঙ্ক কমিয়ে বাম ভোট সম্পূর্ণ টেনে আনতে হবে। বামেদের পুরনো ভোট বামেদের দিকে গেলে তৃণমূলের পক্ষে তা হবে দুশ্চিন্তার কারণ। লড়াই এখন বাগে-কুমিরে। তৃণমূলের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন এইবারের ভোট যেন দাবার বোর্ড হয়ে উঠতে চলেছে। বিরোধীদলের এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত যে এবারে হাওড়া ও কলকাতায় অবাঙালি ভোটের ৯০% ভাগ বিজেপির দিকে ঝুঁকতে পারে, সেক্ষেত্রে ভবানীপুর কেন্দ্রটি তৃণমূলের টালমাটাল অবস্থায় আছে। তৃণমূলের দ্বারা প্রচারিত "বহিরাগত" শব্দটি দেশের পক্ষে যতই ক্ষতিকারক হোক না কেন এই স্লোগান এখন তৃণমূলের ভোট বৈতরণী পার করার মূল অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অস্ত্র প্রয়োগ একমাত্র বিজেপির বিরুদ্ধেই। আবার এই অস্ত্র ভোঁতা হয়ে গেলে বিজেপির ভোট বাড়তেও পারে এবং ডবল হয়ে যেতেও পারে। সেক্ষেত্রে অবাঙালি ভোটের একটা ভালো অংশ বাম-কংগ্রেসও এবারে বঞ্চিত হয়ে পড়বে। অবাঙালি ভোট-- কলকাতা হাওড়া আসানসোলের বহু অংশে এবারে হার জিতের পক্ষে একটা জরুরি অক্ষরেখা।
🙅 সারা রাজ্যে ১০ টি রাজনৈতিক দলের প্রচারে আক্রমণের অভিমুখে এখন একা বিজেপি লড়ছে। নিঃসন্দেহে বিজেপিকে এখানে বিশাল প্রতিবন্ধকতার মধ্যে লড়তে হচ্ছে। তৃণমূল কিন্তু ২০১১-তে এতবড় প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়তে হয়নি। বিজেপি বিরোধী তীব্র মতামত থাকা সত্ত্বেও কৃষি আন্দোলন হওয়া সত্ত্বেও কিন্তু বিজেপি সারা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে প্রতিটি দিন বেড়ে উঠছে। শুভেন্দুর কলকাতার মিছিলে অংশ নিয়ে উপস্থিত থাকা, শুভেন্দুর কলকাতার জনসভায় উপস্থিত থেকে বক্তৃতা করা তৃণমূলের পক্ষে একপ্রকার বিশাল ভয়ের ব্যাপার। এই মূহুর্তে শুভেন্দুর পাল্টা বক্তৃতা করতে গিয়ে কল্যাণকে ক্যারিকেচার পর্যন্ত করতে হয়েছে। কুনাল ঘোষ বক্তৃতা করতে গেলেই নেট জুড়ে চোর শব্দের ফুলঝুরি উড়ছে। কুনাল ঘোষ শেষ পর্যন্ত ধুরন্ধর শিশির অধিকারীর বিপক্ষে বলে ফেলে বিপদে পড়ে গেছেন। শেষে কুনাল ঘোষকে একঘন্টা ধরে শিশির অধিকারীকে তেল দিয়ে বৈঠকী আড্ডার মতো করে নমনীয় হয়ে বোঝাতে হয়েছে--বর্ষীয়ান শিশির অধিকারীকে। শুভেন্দু চলে গিয়ে তৃণমূলের ভালোর থেকে মন্দ বেশি হয়েছে। এখন পর্যন্ত শুভেন্দুর ভিড় ছাপিয়ে যেতে তৃণমূলের একাধিক নেতা পারেননি। তাই মাষ্টার্স প্ল্যান নিয়েছেন মাননীয়া নিজেই। কিন্তু এই প্ল্যান খানিকটা চ্যালেঞ্জের মতো হয়ে গেছে। কারণ মমতা ব্যানার্জীর নন্দীগ্রামের সভায় লোক এসেছিল বাসে করে। আশপাশের সমস্ত কলেজ থেকে ভিড় করেছিল ছাত্ররা। মমতা জিতবেন না হেরে যাবেন তা ভবিষ্যতই বলবে। তবে শুভেন্দুকে খানিকটা আটকানোর কৌশল যে মমতা ব্যানার্জীর এই ঘোষণা তা বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু শুভেন্দুকে কতটা আটকানো যাবে সেটা বোঝা মুস্কিল। শুভেন্দু সত্যিই নন্দীগ্রামের মানুষের জন্য লড়েছেন। যদি গোলমাল পাকিয়ে শুভেন্দুকে হারিয়ে দেওয়া যায় তবে হয়তো শুভেন্দুকে নন্দীগ্রামে হারালেও শুভেন্দু কিন্তু আগামী দিনে আরও বড় নেতা হয়ে উঠতে পারে। কারণ দমিয়ে রোখা যাবেনা শুভেন্দুকে। কিন্তু বিজেপির পজিশন কিন্তু আরও ভালো হলেও হতে পারে। সবকিছু এই মূহুর্তে পরিষ্কার নয়।
শুভেন্দু কিন্তু শারীরিক পরিশ্রম করতে পারে তার কোনও পিছুটান নেই। একরকম ডাকাবুকো টাইপের।
🙅 তবে নন্দীগ্রামে যে ঘরে ঘরে এবারে প্রচুর টাকাপয়সা দেওয়া হবে এটা প্রায় নিশ্চিত। দু-দলকে জিততে হলে টাকা না ছড়িয়ে উপায় নেই। টাকাপয়সা দুপক্ষই এখানে ছড়াবে এখানে। বাঁচবার লড়াই দুপক্ষেরই। এখনও ভোটের কোথাও কিছু হয়নি, কিন্তু শুভেন্দু পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে তার গড়ে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত এবং অনেকগুলো বড় বড় সভা একের পর এক রোজ করে চলেছেন। মাননীয়াকেও এখন বেশি সময় দিতে হবে দুই মেদিনীপুরে। শুভেন্দুর চরিত্র কিন্তু একরোখা। হারানো সে জীবনে কম দেখেছে। রাজনীতি নেশার মতো দুজনেরই। সারা পূর্ব মেদিনীপুর শুভেন্দুর মুঠোর মতো করে চেনা। মাননীয়া যদি নন্দীগ্রামে সত্যিই দাঁড়ান তবে সেখানে বামেদের যে পুরাতন মাটি ছিল তা তৃণমূলের পক্ষে যেতে হবে। এই বিষয়টা ইতিমধ্যে বামেদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। নিশ্চিত ভাবে তারা নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রীর বেশি করে বিরোধিতা করবেন, তা না করলে এই মূহুর্তে বামেরা পূর্ব মেদিনীপুরে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। অথচ তারা এতদিন ভেবে রেখেছিল নন্দীগ্রাম উদ্ধার করবে এবং বিজেপির বিরুদ্ধেই যাবতীয় অস্ত্র শানাবে। মমতা ব্যানার্জীর দাঁড়ানোর ঘোষণায় সবচেয়ে দোটানায় পড়ে গেল এখানে বামেরা। এখানে একসময় শুভেন্দুর জন্য কংগ্রেসের একটা পুরনো মাটি ছিল। সোমেন মিত্রর সহচর হিসেবে শুভেন্দু কংগ্রেসের গড় আটকেছে সেইসময়। তৃণমূলের গড় তৈরি করেছে একসময়ে এখন বিজেপির। তবে মনে হয় নন্দীগ্রামের মুসলমান সমাজ এখনও শুভেন্দুকেই বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই বিশ্বাস খানিকটা ধাক্কা খাবে মমতা ব্যানার্জীর এই ঘোষণায়। হয়তো ভেন্দুকে আরও পড়ে থাকতে হবে এখানে। যার ফলে বিজেপির সামান্য ক্ষতিও হবে। তৃণমূলেরও কিন্তু একটা ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা কলকাতার বুকে গভীর ভাবে থেকে যাচ্ছে। পাশাপাশি অঞ্চলও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সুব্রত বক্সী যত সহজতর উপায়ে কলকাতায় বসে মমতা ব্যানার্জীর নির্বাচন দেখতেন এখন তাকেও কলকাতা ছাড়তে হবে।
🙅 মমতা ব্যানার্জীর দাঁড়ানোর কারণে অধীর চৌধুরীরাও এখানেও সভা করবেন। আর যদি আব্বাস সিদ্দিকী আলাদা করে সিট দেন তবে তারা নন্দীগ্রামেও দেবেন। নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাঁড়াতে চাওয়ার একটা বড় কারণ মুসলিম ভোট। এখন নন্দীগ্রামের মানুষদের ওপর ঝড়ঝাপটা এলেও তারা এতদিন একহয়ে লড়েছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে একটা মহাসমস্যা তৈরি হলো। একটা বড় ফাটল হতে চলেছে যা তারা চাইবেন না। কোনদিকে এখন তারা যাবেন। কাকে সঙ্গ দেবেন। এইসবকে কেন্দ্র করে যদি খুনোখুনি শুরু হয় এ ভয় নন্দীগ্রামের মানুষদের মনে ইতিমধ্যে উঠতে শুরু করেছে। ভোটের টাকা না অশান্তি কোনটা এখন তাদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেয় সেই চিন্তা নন্দীগ্রামের জনগণের। চিন্তা দুটো রাজনৈতিক দলেরও। এখানে নীচতলায় দলবদলের আশঙ্কাও দেখা যাবে। মারদাঙ্গার সঙ্গে নন্দীগ্রামের নাম জুড়ে যেতেও পারে। এখন ভোটের ময়দান সরগরম হয়ে উঠতে চলেছে সারা রাজ্যের সঙ্গে নন্দীগ্রামেও। দুদিন অন্তর সভা জনসভা, ভিড়ভাট্টায় শান্তির থেকে অশান্তির বাতাবরণ এখন নন্দীগ্রামের ভাগ্যের সঙ্গে জুড়ে গেল যতদিন না ভোট শেষ হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন