শিক্ষক দিবস
অলোক কুন্ডুু
টিভি থাকলেও রেডিওতে গান শুনতে শুনতে
ঘুমোতে যাওয়ার অভ্যাস সুশোভনের অনেক
দিনের । আজ ঘুম ভাঙলো তখন , যখন রুবি
রেডিওটা অন করে দিয়ে নিজেকে একবার
আয়নায় দেখে নিয়ে গুন গুন করতে করতে
বারান্দার দিকে বেরিয়ে গেল । যেতে যেতে
বললো --দিনটা না হয় আজ তোমাদের বাবা ,
তাবলে আটটা অবধি শুয়ে থাকবে গো ?
পরক্ষণেই কী একবার মনে হলো আঁচলটা
কোমরে বেঁধে উঁকি দিল বললো--ও মাষ্টার
ওঠোগো , আটটা যে বেজে গেল বলি অন্য
দিন তো এমন হয়না , এমন মটকা মেরে পড়ে
থেকোনা গো মাষ্টার । কাছেপিঠে কেউ না
থাকলে আজকাল রুবি এই নতুন নামেই
ডাকতে বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে । মাষ্টার
ডাকটার মাহাত্মে সুশোভন আর বেশিক্ষণ
বিছানায় পড়ে থাকতে পারলো না ।--চা
দিলে তো ঘুম ভাঙবে , সুশোভন বেশ
উচ্চস্বরেই বললো যাতে কথাটা পাশের
রান্নাঘর পর্যন্ত রুবির কানে পৌঁছতে পারে ।
বাথরুমে গিয়ে মুখ চোখটা ধুয়ে এসেই
মোবাইলের স্যুইচটা অন করতেই হোয়াটস
অ্যাপে ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের আর কালাম
সাহেবের ছবি ও বাণী দিয়ে প্রাক্তন ছাত্র-
ছাত্রীদের পোস্টগুলি শব্দ করে আসতে
শুরু করেছে । সুশোভন চুলটা আঁচড়ালো ।
রুবি কখন ঘরে এসে ঠক করে চায়ের প্লেট
বসিয়ে দিল সুশোভন দেখেনি । এখন
দেখলো । কপালে ঘাম একটা গোলাপি
আটপৌরে শাড়ি ছোটহাতা কালো ব্লাউজ ।
জানলা দিয়ে রোদ আসছে রুবির পনিটেলের
দিক থেকে । উড়ো চুলের ভেতর দিয়ে সেই
আলো রুবিকে উথলানো দূধের মতো মনে
হলো । রোজের টিউশনির জন্যে রুবিকে
দেখাই হয়না সকালের দিকটায় । রুবি
বললো --ছাড়ো মাষ্টার এখন প্রচুর কাজ ।
ঘরময় মিষ্টি একটা ঘামের গন্ধ ছড়িয়ে দিয়ে
রুবি বেরিয়ে গেল । স্কুলে চাকরি পাওয়ার
পর থেকে এই গ্রামেই উঠে এসেছে । গ্রাম হলেও মোটরবাইকে শহরে যেতে মাত্র এক ঘন্টা লাগে ,
বাড়ি থেকে একটু দূরে তাই ভাড়া নিয়ে এই
দোতলায় থেকে গেছে । সেপারেট দু কামরার
ঘর আর বাড়িঅলা প্রিয়তোষবাবুও খুব ভালো
মানুষ । আবার মেসেজ এলো , সম্বিৎ ফিরে
পেলো সুশোভন --ব্যাঙ্কের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার প্রাক্তন ছাত্রী মৌমিতা , ক্লাস টুয়েলভের সুকান্ত
টিউশন নিতে আসা পল্লবী , স্কুলের বেস্ট ফুটবলার নিরঞ্জন , ইলেভেনের চৈতী থেকে শুরু করে কলেজের বন্ধু উজ্জ্বলদের মেসেজ গুলো
সুশোভনের মনের গভীরে আলো ফেলতে
শুরু করেছে । তৃপ্তিতে তার মুখ ভরে যাচ্ছে ।
তাই ভেতরের বারান্দার দরজার দিকে একবার
সে দেখে নিল । রুবি সেটা যেন কিছুতেই না টের
পায় । পেলে সারাদিন পেছনে পড়ে যাবে । মুচকি
হাসি হাসতে হাসতে চায়ে চুমুক দিল । শিক্ষকের
এই ছেলেমানুষী সে নিজেই একা উপভোগ করতে লাগলো । সবকটি মেসেজ বেশ মনোযোগ দিয়ে
দেখা হয়ে গেল । চায়ের কাপ-প্লেটটা টেবিলে
রাখলো । সুশোভন মনে মনে ভাবলো --
আজকালকার ছেলেমেয়েগুলো এই বিশেষ
দিনগুলিকে বেশ মনে রাখতে পারে । এমনকি
শিক্ষকদের জন্মদিনটাকেও ওরা ভোলেনা ।
অথচ নিজের বিয়ের দিনের কথা বা রুবির
জন্মদিনের কথা তার নিজেরই মনে থাকেনা
বলে গত তিন বছরে রুবির অনুযোগের শেষ
নেই । সুশোভনের মনে হলো এযুগের ছেলে-
মেয়েরা জীবনকে ভালোকরে এনজয় করতে
জানে , এদের কাছে অনেক শেখার আছে ।
কী সুন্দর সব শব্দভূষণ জুড়ে জুড়ে ওরা
মেসেজগুলি তৈরি করেছে একেবারে তার মতো
করে । শিক্ষক দিবসের সার্থকতা বোধহয় এটাই
এইসব শব্দবন্ধের মায়া আজ সুশোভনকে ঘিরে
ধরেছে যেন । আজকের সকালের এই ভালো
লাগা তাকে যেন প্রকৃতি ও বাস্তবের এক
অভূতপূর্ব মায়ায় দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায় ।
কেউ ইংরেজি শব্দে কেউ বা রবীন্দ্রনাথের
কবিতায় কেউ গানকে প্রাসঙ্গিক করে মেসেজগুলি পাঠিয়েছে । এইসব সুন্দর কথায় সুশোভনের মন ভরে গেল । ভাবতে ভাবতে আয়নার সামনে দাড়িটা কেটে নিল । গুন গুন করে গাইলো -আমি জানি নাই গো সাধন তোমার বলে কারে জানি নাই..। এরই মধ্যে পাশের গ্রাম মাণিকপুর হাই স্কুলের ,তার কাছে যারা প্রাইভেট পড়তে আসে, ছেলেমেয়েগুলোও এসে চলে
গেছে । প্রণামের সঙ্গে বেশ বড় কয়েকটা মিষ্টির প্যাকেট আর কেউ বই কেউ একজোড়া করে পেন দিয়ে গেল । সঙ্গে রুবির জন্যে একটা পারফিউমও এনেছিলওরা । আজ ওদেরও আনন্দের দিন । বারণ করলে শুনবে কেন ?
এখনকার প্রিয় ছাত্র ক্লাস টেনের সৌরভ দিয়ে গেল আনন্দ থেকে প্রকাশিত ঝুম্পা লাহিড়ীর বাংলা গল্পের সংকলন আর সাথে কিছু ফুল । যারা তার কাছে পড়তে আসে তারাই মুখ্যত এনেছিল ফুল আর মিষ্টির প্যাকেটগুলো
রুবি একটু আগে এসে সব গোছগাছ করেছে
একবার বললো --হ্যাঁ গো এত মিষ্টি কে খাবে
প্লেটে সাজিয়ে বাড়িঅলাদের একটু দিয়ে
আসি তাহলে ? রুবি গতকাল ওদের জন্যে ফিসফ্রাই করে রেখেছিল। টিভিতে রান্নাঘর
দেখে দেখে বানানোর নতুন এই কলা চাতুর্যের পরীক্ষা রুবি এরকম প্রায়ই করে থাকে । আজ গরম করে সেসব যারা প্রণাম করতে এসেছিল তাদেরকে দিয়েছে । ইতিমধ্যে স্নানটাও সেরে
নিল সুশোভন । আজ মনটা বেশ ফুরফুরে
লাগছে । তার ওপর আজ আর বাজার করতে যেতে হয়নি । গতকালই এক কেজির একটা ইলিশ আর অর্ডার দিয়ে রাখা ভেটকির ফিলেগুলো এনেছিল । তাতে তিন চার দিন
চলেই যাবে দুজনের । বাজারে যেতে হয়নি
যদিও তাই আনন্দের একটা কারণ হলেও মূল কারণ আজ টিউশনির ছেলেমেয়েগুলো কেউ পড়তে আসবে না । রোজকার ওই ঘেঁয়ে জীবন তার ভালো লাগেনা । প্রথম প্রথম টিউশনি তাই করতে মন চায়নি কিন্তু অভিভাবকদের অনুরোধেই শুরু করেছিল । এখন সুশোভন
রাজি থাকলেও ছাড়ার উপায় নেই...তাই
অগত্যা এইসব মেনে নিয়েছে । এই টাকা
গুলোর মালিক রুবি । গতকালই সদলবলে
ওরা বলে গিয়েছিল --স্যার আমরা কেউ
পড়তে আসবো না । তার ওপর আজ সকাল থেকে এত শুভেচ্ছা আর প্রণাম যে মনটা তার আজ যেন খুশির বন্যায় ভাসছে । তার উপর আরও খুশির কারণ হলো স্কুলে আজ বড় অনুষ্ঠান আছে । আজ মিড ডে মিলে শিক্ষকদের দেওয়া চাঁদায় ছাত্র শিক্ষক শিক্ষিকা সকলের জন্যেই ঢালাও মাংসভাতের আয়োজন করা হয়েছে । আজ ক্যাটারার দিয়ে তাই রান্নার আয়োজন । সিএলআরসির কজনকেও
আসতে বলা হয়েছে । গান বাজনা বক্তৃতা তো আছেই । ইলেভেনের ছাত্র-ছাত্রীরা দায়িত্ব
নিয়েছে । শিক্ষক দিবসে তার লেখা একটা
নাটক করবে ছেলেমেয়েরা । তার জন্যেও খানিকটা বেশি খুশি সে । ব্যস্ততার মধ্যে শুধু বিকেলে রুবিকে নিয়ে পুজোর মার্কেটিংটা
সেরে ফেলতে হবে কারণ দেশে তাদের যৌথ পরিবার অনেককে দেওয়ার আছে । আছে
রুবির ফর্দ মতো কেনাকাটা যদিও তা ভিন্ন
বিষয় তবু সুশোভন দিনের প্ল্যানটা একবার
ভেবে রাখছে । দেখতে দেখতে এই
গড়ভবানীপুর সুপ্রভাময়ী বিদ্যানিকেতনে
তার আট আটটা বছর কীভাবে যে কেটে
গেল সুশোভন এতদিন টেরই পায়নি ।
রান্নাঘর থেকে কখন যে রুবি এসে ছোটবোন টুম্পার দেওয়া গত ভাইফোঁটার মৌরি রঙের উপর আকাশী আর গোলাপীর ডুরে দেওয়া পাঞ্জাবির সাথে ধোপদুরস্ত একটা সাদা
পায়জামা আলমারি থেকে বের করে দিয়ে টানটান বিছানার একধারে রেখে গেছে
সুশোভন একবারও টেরও পায়নি । ছোটবোন টুম্পা জানে তার দাদার পছন্দটা । পাঞ্জাবিটা তার যে খুব পছন্দের রুবিরও সেটা জানা
ছিলো তাই একবছর পর হলেও এই প্রথম
বার করে দিয়েছে আজ । রুবিও জানে যে আজকের দিনটা এলে সুশোভন খুব খুশি হয় ।
রুবিরও বেশ লাগে । পাঞ্জাবির পছন্দটা রুবি বুঝে ফেলায় সুশোভনের হাসি এলো । দূর
থেকে রবীন্দ্রসংগীত ভেসে আসছে । একটু আগেই সে একবার জানলার কাছে গিয়েছিল যেখান থেকে এই গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলটা
দেখা যায় । এখন ওদের অনুষ্ঠান চলছে ।
রুবি বোধহয় ছাদে গেছে তাদের এই দু
কামরার ভাড়াকরা আপন ঘরে কোনো শব্দ
শোনা যাচ্ছে না । পাঞ্জাবিটায় হাত রেখে
সুশোভন কেমন যেন আনমনা । আজ এত আনন্দেও যেন বড় একা মনে হলো ।
একবার জানলার কাছে সিগারেট ধরাতে
গিয়ে তা পারলো না । সিগারেট ও লাইটারটা
সে আজ আর ছুঁতে পারলো না । হঠাৎই তার নিজের প্রাইমারি স্কুলের কথা মনে পড়ে গেল । জানলার কাছে আরও একটু এগিয়ে গেল । এখান থেকে এই গাঁয়ের প্রাইমারি স্কুলটা দেখা যায় । স্কুলের সৌন্দর্য বেশ বেড়েছে । এটা যেন প্রাইমারি স্কুল বলে মনেই হয়না । তার নিজের সেই প্রাইমারির মতো একবারেই নয় । তবু যেন মনে হলো হ্যাঁ ওটাই তো তাদের সেই প্রাইমারি স্কুলটা । যে স্কুলটাকে সে প্রাণের থেকেও
বুঝি বেশি ভালোবাসে । বহু বছর বাদে হলেও
সুশোভন যেন তার দিব্য চক্ষু দিয়ে হুবহু
দেখতে পেল । না তার স্কুলের কোনো পরিবর্তন হয়নি । একই আছে । সাক্ষাৎ তাদের প্রিয়
সফি স্যারকেও সে সকলের আগে দেখতে
পাচ্ছে । এইতো সেদিনের কথা । তার এই
বাসার সামনে যে নারকেল গাছটা দাঁড়িয়ে
থাকে ঠিক তার পাতায় ফাঁকে বেলার
ঝিরঝিরে রোদ খেলা করছে । দূরে যেখানে তাদের গাঁয়ের স্কুল যেখানে প্রুসিয়ান ব্লুর আকাশটায় সাদা পায়রার মতো মেঘ
দেখা যায় । ধীরে ধীরে সুশোভনের সব মনে পড়তে শুরু করলো । ওই তো তার
ছোটবেলার ছিটেবেড়ার মাটি ঝরে পড়া
এবং তার মধ্যেই নিকোনো প্রাইমারি স্কুলটাকে । পাশ দিয়ে বয়ে যেত কুনুর নদী । স্কুলের আগে একটু ঝোপঝাড় তাকে সবাই আতরের বন
বলতো । আগে নাকি সেখানে সিউলি আর বকুলের জঙ্গল ছিল । আর একবারে গ্রামের শেষে মাঠের ধারে তাদের মাটির স্কুলের
আনন্দ মনে যেন লেপ্টে আছে । কলেজে
উঠে হস্টেলে চলে যাবার পর থেকে করিম বুলবুলি ইমানুর সুবল কাঞ্চি মূর্মু --এদের
কারো সাথেই অনেক বছর আর দেখা হয়নি ।
ধানক্ষতের শেষে কিছুটা আলপথ ধরে যেতে হতো মাটি ফেলে গ্রামের পঞ্চায়েত থেকে
স্কুলের সামনে কিছুটা সাইকেল চলার মতো করেদিয়েছিল তার বেশ মনে আছে । উলুকাশগুলো এই সময় অনেকটা উঁচু হয়ে চোখেমুখে লাগতো । একশোর উপর
ছেলেমেয়ে নিয়ে মীনা দিদিমণি , রবিয়ুল
মাষ্টার স্যার আর সবার সেরা ভরাট গলায়
সারা স্কুল গমগম করা সফি স্যার । দুটো
ঘরকে সাকুল্যে চারটে খাড়া করা এই ছিল
তার স্কুল বাড়ি । মাথায় টিন আর খড়ের চালা । সামনে বারান্দার মতো লম্বা দাওয়া । স্কুল
ঝাড়ু দেওয়া পরিষ্কার করার জন্যে তারা
কজন আগেভাগেই স্কুল চলে আসতো ।
আগে যাওয়ার আর একটা কারণও ছিল
সেটা একটু খেলার জন্যে । তবে দশটা
বাজলেই সফি স্যার চলে আসতেন । নিজে
হাতে আগে খাবার জলের জালা ভরতেন । বুলবুলি কাপড় ধুয়ে এনে মুখে চাপা দিত ।
স্কুল বসে গেলে সারাক্ষণ খালি পায়ে চারটে
ঘর ঘুরে ঘুরে দেখতেন । কখনও মীনা দিদিমণিকে বলতেন-- একটু গলা ছেড়ে
পড়ানা বাপু । একদিন কীসের জন্যে যেন
রবিউল স্যার একদিন বারোটার সময় দেরি
করে স্কুলে এসেছিল । সফি স্যার হঠাৎ করে
ধানক্ষেত পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন । সুশোভনের
বেশ মনে আছে । রবিউল স্যারের সেদিন আর স্কুলে ঢোকা হয়ে উঠেনি ধানক্ষেত থেকেই চলে যেতে হয়েছিলো তাঁকে । কিছু তর্কাতর্কিও হয়েছিল । শোনা কথা , সেইদিনই ছুটির পর বিকেলে সফি স্যার রবিউল স্যারের বাড়ি
গিয়ে একপ্রস্ত চা-মুড়ি খেয়ে এসেছিলেন ।
বেশ মনে আছে গাঁয়ের সকলে বলেছিল
রবিউল স্যার রাজনীতি করে দলবল এনে
সফি স্যারকে অপমান করবে । গ্রামের সবাই সফি স্যারের ভক্ত । পরের দিন কিছুই হয়নি
তার বদলে সেই এক জামবাটিতে শশা আলুসেদ্ধর সাথে রবিউল স্যারের বাড়ি
থেকে আনা মুড়ি দিয়ে রোজকার মতো
তিনজনে দিব্যি একসঙ্গে গল্প করেছেন ।
একটু বড় হয়ে সে শুনেছিল--
তর্কাতর্কি করা আর দেরি করে স্কুলে আসার জন্যে রবিউল স্যার সফি স্যারের কাছে ক্ষমা চেয়ে
নিয়েছিলেন । এখনো ছবিটা যেন তার চোখের
সামনে ভাসছে । আজ সেই দিনটার কথা বেশি করে
মনে পড়ছে । স্যার বলতেন মনে রাখবি এই দিনটার
কথা আর এই ছবির মানুষটার কথা । তখন সুশোভন
এত ছোটো যে স্যারের কথার মর্মবাণী ঠিকমতো
বুঝতে পারেনি । আজ সেই ফিফথ্ সেপ্টেম্বর ।
আজও শিক্ষক দিবস । আজও তার স্পষ্ট মনে
পড়ে । ফি বছর এই দিনটা আসার আগে তাদের
স্কুলে তোড়জোড় শুরু হয়ে যেত । দু দিন আগে
থাকতে সকলের কাজ ভাগ করে দিতেন স্যার ।
মোহিনী চৌধুরী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান স্যারের
খুব প্রিয় ছিল । তারা প্রত্যেকে দোপাটি জবা
শালুক পদ্ম যে যা পারতো তাই নিয়ে আসতো
সঙ্গে আনতো ধূপ । কেউ আনতো হারমোনিয়াম ।
কেউ আনতো টেবিলক্লথ । স্যার আনতেন পাগড়ি
পড়া রাধাকৃষ্ণনের ছবি । সফি স্যার আগের দিন গাঁয়ের সব ছোটোদের জন্যে এনে রাখতেন লজেন্স আর বিস্কুট ।
হাজরাদের বাড়ি থেকে আসতো মস্ত বড় দুটো
শতরঞ্চি । পনের দিন আগে থাকতে গানের
দিদিমণি ভাড়া করে নিয়ে আসতেন সফি স্যার ।
মোহিনী চৌধুরী দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানের
সঙ্গে তারা প্র্যাকটিস করতো আগুনের পরশমণি
ছোঁয়াও প্রাণে । অনেক বড় হয়ে জানতে সে জানতে পারে যে সফি স্যার নিজের থেকে টাকা দিয়ে তিনদিন
আগে নাচের দিদিমণিও ভাড়া করে আনতন ।
কাজী নজরুল ইসলামের গানের সঙ্গে মেয়েরা
নাচ প্র্যাকটিস করতো । কোনো কিছুই সাধারণ
করে প্রকাশিত করায় অভ্যস্ত ছিলেন না তিনি কিন্তু
নিজে ছিলেন অতি সাধারণ । আরও কথা মনে
পড়ছে । এই দিন গাঁয়ের দু-চারজন মানুষও
আসতেন তাদের সেই স্কুলে । সর্বপল্লী
ড. রাধাকৃষ্ণনের ছবিতে অনেকই মালা দিতেন । মেউরদের বাড়ি থেকে একজন ছাত্রের মা শাঁখ
বাজাতে আসতেন । কাঁচ দিয়ে বাঁধানো ছবিটায়
মীনা দি চন্দন পরিয়ে দিতেন । ডাক পড়লেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছবিকে ঘিরে ফুল দেওয়ার ধুম
পড়ে যেত । তবে স্যার আগের দিনে হাতে ধরে
শেখাতেন অতিথিকে এবং ছবিতে কেমনভাবে
ফুল মালা দিতে হয় । দূর গাঁয়ের অবসরপ্রাপ্ত
মাষ্টার মশাইদের প্রতিবার একজনকে সংবর্ধনা
দেওয়া হতো । ফুল মিষ্টি মানপত্র এইসব । এর
বেশিকিছু উপহার দেওয়ার সামর্থ্য ছিলনা স্যারের ।
শেষে পাতাপেড়ে খিচুড়ি চাটনি বঁদে আর একটা
চচ্চড়ি সকলের জন্যে বরাদ্দ থাকতো । তার
জন্যে গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল সংগ্রহ থেকে
তেল নুন পর্যন্ত নিয়ে আসতেন স্যার । ছাত্র
ছাত্রীরাও আনতো যে যা পারতো কেউ একটাকা
দুটাকা পর্যন্ত দিত । সারা বছর স্কুলে গাঁয়ের
লোকেদের আসা যাওয়া ছিল তাদের ওই এক
টুকরো স্কুলকে ঘিরে । কারো পোস্ট কার্ড পড়ে
দিতেন তো কারো লিখে দিতেন । জ্বর পেটের
অসুখেও অনেকেই স্যারের কাছে আসতেন । এক
শিশি মিষ্টি গুলিতে কী এমন থাকতো কে জানে
তাতেই তারা সেরে উঠতো । এমনকি তাদের
গ্রামের কারো কারো মেয়ের বিয়েতেও স্যার সব
কাজ ফেলে চলে আসতেন দেখভাল করতে ।
সামান্য স্কুল ফাইনাল পাশ করা ওই মানুষটা
নাকি মাত্র সাড়ে সাতাশ টাকার জন্যে পাঁচ মাইল
দূর থেকে এই আতরের জঙ্গলে তাদের বিদ্যালয়ে এসেছিলেন একসময় । আজ সুশোভন যা মাইনে
পায় তার ওপর টিউশনি নিয়ে যা হয় তা দিয়ে তাদের সংসারের আর্থিক ঔজ্জ্বল্য রুবির উপচে পড়া হাসি থেকে এক একদিন সুশোভনের বুকের উপরে এসে
মধুর করে ধাক্কা মারে । সুশোভন জানে রুবির সবে দুমাস চলছে । আগতের আনন্দের সঙ্গে তার এই আর্থিক উজ্জ্বলতা তাকে ও রুবিকে যে একটা দারুন তৃপ্তি দেয় । সেটা সুশোভন বিলক্ষণ জানে । যদিও
অনেকগুলি ডিএ সরকার মেরে দিয়েছে । আজ
তার বিশ্বাস হচ্ছে যে সফি স্যারেরা শিক্ষকতা
করতে এসে কানাকড়িও পাননি । শিক্ষকদের
ভাতে মেরে একটা কল্যাণী একটা দুর্গাপুরের বেশি
তো কিছু হয়নি । সুশোভনের এইসব রাজনৈতিক
কথা শুনতে একদম ভালো লাগেনা তবু তার যেন
মনে হয় বিষয় দুটির মধ্যে কোথাও যেন একটা
মিল আছে । এইসবের সঙ্গে তার মন কখন যে
তার বাল্যকালে চলে গেছে সেটা সে অনুভব করতেই
পারেনি । বারবার সফি স্যারের মুখটা তার হৃদয়ের
অনুভবে ভেসে উঠছে । শুধুমাত্র সে মনে করতে
পারলো আজও তো শিক্ষক দিবস । সকাল থেকে
মেসেজ প্রণাম উপহার ফুল মিষ্টির বাক্স কোনো
কিছুই তো বাদ গেলনা । আজ সেই একই রকম
আনন্দের দিন । বরং তার বাহুল্যতা অনেক
বেড়েছে । তার আজ আনন্দ হওয়ারই কথা ।
তবু কেন যে সুশোভনের এই বিষাদ সিন্ধুতে ডুবে
যেতে চাওয়া তার কোনো ব্যাখ্যা হয়তো পাওয়া
যাবেনা তবু আজ যেন আজ এক অন্যমনষ্কতা
তাকে পেয়ে বসলো । সুশোভন জানে না সেটা
আসলে কী ? প্রতিদিনের মতো ঠিক সকাল
দশটায় সফি স্যার সাইকেল থেকে নামলেন ।
সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে । স্যার ক্রমশ এগিয়ে
আসছেন রঙিন কাগজ কেটে শিকলি বানিয়েছে
তারা । সেই ফুলহাতা ওয়েষ্ট প্যাটার্নের বোতাম
দেওয়া লম্বা ঝুলঅলা ঢিলেঢালা শার্ট । জায়গায়
জায়গায় যা সুন্দর করে রিপু করা । সেটাই মাড়
দিয়ে পরতে জানাতেই যা মনে হতো যেন নতুন ।
সেই মানুষটার পায়ের কাছে উলু ঘাস আজও
শরতের বাতাসে একইভাবে লুটিয়ে পড়তে চাইছে ।
এক এক করে পর পর সেইসব সুশোভন দেখতে
পাচ্ছে । প্রতিদিন যে সব ছেলেমেয়রা সাফাইয়ের
কাজে আগে চলে আসতো তারা দূর থেকে
দেখামাত্র স্ট্যাচু হয়ে যেত যেন তারা সাক্ষাৎ
ঈশ্বর দেখছে । স্যার কাছে এসেই কোনো দিন
চারটে পিয়ারা দিয়ে বলতো ভাগ করে খেয়ে
নিস তোরা । স্যারের ধুতিটা পর্যন্ত মনে হতো
সেদিনই বুঝি কিনেছেন কাছে এলে দেখা যেত
সেখানেও সেলাই । হাতে পুরনো আমলের
ঘড়িটায় সূর্যের আলো পড়লে আলো ছিটকে
পড়তো । সাইকেলটা পর্যন্ত নতুন মনে হতো ।
এইভাবে যে কখন দশটা বেজে গেছে একেবারেই
খেয়াল করেনি সে । সেই ছিটে বেড়ার স্কুলে
একে একে সকলেই আসতে শুরু করেছে ।
টেবিলটা সাদা চাদরে ঢাকা কেউ রাধাকৃষ্ণনের
ছবির কাছে একমুঠো শিউলি রেখে গেছে ।
অন্যদিকে পাশের ঘর থেকে রুবির ডাক ভেসে
আসছে । তবু যেন সে ডাক শুনতে পাচ্ছে না ।
জানলার আরও কাছে গিয়ে কোনো কিছু খুঁজতে
চাইছে । হ্যাঁ সে এতখানি দূর থেকে সফি
স্যারকেই দেখতে পাচ্ছে । রিপু করা একটা
ধোপদুরস্ত ওয়েষ্টার্ন শার্ট । সেই ধবধবে ধুতি
সাইকেল থেকে স্যার নামলেন । সুশোভনের
হাত ভর্তি শিউলি ফুল সে স্ট্যাচু হয়ে স্যারের
মুখের দিকে চেয়ে আছে --স্যারের মুখ থেকে
কথা খসার অপেক্ষায় । স্যারের এক হাতে
সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের ছবি । স্যার বললেন
হ্যাঁরে মনে আছে তো আজ কার জন্মদিন ?
© অলোক কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন