■ ৭৪-তম স্বাধীনতা দিবস ও কার্গিল শ্রদ্ধা
■৩৭০ ও ৩৫/A প্রত্যাহারের মাত্র ১২ দিন আগে লাদাখ ও কাশ্মীরের একাংশ থেকে ঘুরে
এসেছি , কলকাতার ডলফিন ট্রাভেলের সঙ্গে । সবে ঘুরে আসার স্মৃতি টাটকা সবজির মতো
সবুজ হয়ে আছে । আমরা শ্রীনগর এয়ারপোর্টে
১৫.৭.১৯ -এ নেমে ওদের তিনটি ট্রাভেলরে চেপে রওনা দিয়ে পুরনো কাশ্মীরকে আবার যে
ফিরে দেখবো সে আশা কখনও না থাকলেও
স্বপ্ন একটা থেকেই গিয়েছিল । একটু ফ্রেস
হয়ে নিতে, ডলফিনের কাশ্মীর ডেরা অর্থাৎ
ডাললেকের গা-ঘেঁষে হোটেল প্যারাডাইসে গিয়ে নামলাম বেলা তখন ১ টা বেজেছে।
কতদিন পরে সেই স্বপ্নের ডাললেকের ধারে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। সেদিনটা সোনমার্গে
আমাদের স্টে করার কথা। আগামী কাল, পরের দিন জোজিলা হয়ে কার্গিল যাবো শুধু
তাই নয় কার্গিলে থাকবো এবং যাওয়ার পথে
কার্গিল যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়ার মেমোরিয়ালের বীরভূমি ও বিজয় স্মারক দর্শন হবে, যা মন্দিরের থেকে কম কিছু নয়। মনে মনে এইসব ভেবে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো । আমরা সবাই মিলে ৩২/৩৩ জন আছি । সোনমার্গে স্টে করে পরের দিন কার্গিলের পথে যাত্রা শুরু হল নয়নাভিরাম দৃশ্যের পর দৃশ্য। নিসর্গের মনভোলানো রূপের পর রূপান্তরিত প্রকৃতি খুলে দিচ্ছে একের পর দিগন্তের ভূমিতল।
এ শুধু চোখ ও মনকে সৌন্দর্য সঞ্চয়ের সময় বলে ধরে নিতে হবে । আমার বাড়ি কোথায়
কে আমি এইসব স্বার্থপর ভাবনাগুলো যেন ডাললেকের জলে বিসর্জন দিয়ে এসেছি । পথের আর এক সৌভাগ্য অর্জন যা কোনোভাবেই দ্বিতীয়বার হওয়ার নয়।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের আগে পর্যন্ত গ্রাম শহর মিলিয়ে নানা ছোটবড় জনপদ পড়ে । আধা শহরও দেখা দেয় , কোথায় ধান, গম ও অন্যান্য চাষবাস হয়েছে। আমাদের তিনটে ট্রাভেলার হু হু করে ছুটে চলেছে জনপদ ধরে, ক্ষেতখামারের পাশ দিয়ে। কোনও বাড়ির বারান্দায় দু-তিনজন যুবতি এ-ওর গায়ে ঢলে পড়েছে। কখনও স্কুল কলেজ দেখতে দেখতে গেছি। সৌন্দর্য বিন্যাসের যেন বড় অভাব মাঝের জায়গায়। আপনার মন খারাপ করে দেবে। খুব অভাবি মনে হবে। ডাললেক , নাগিন লেকের সঙ্গে আশপাশের সমস্ত জনপদটাই সমতল। বড় দোতলা বাড়ি যেমন পড়ে তেমনি মলিন ছন্নছাড়া গ্রামও দেখতে পাওয়া যায়। ছিমছাম কোথাও নেই এই মাঝের ৫০ কিলোমিটার।প্রেতের মতো বাসস্ট্যান্ড। গাছহীন ভূমিও চোখে পড়বে। সবুজ, নবীন ক্ষেতের গা ঘেঁষে যেসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি গড়ে উঠেছে যেন তার কোথাও কোনও বিন্যাস নেই। কাশ্মীরের সেই সৌন্দর্য যা আমার বড় প্রিয়। ধুলোময় রাস্তা , জনহীন পথ, ফাঁকা দোকানপাট, খরিদ্দার নেই। এইসব জানলার গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছিল হুটহাট করে। থামিয়ে নেমে দেখতে চাওয়ার বাসনা হলেও আমাদের গাড়ি ছুটছে গতবছর। এহেন কাশ্মীর দেখে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এত পয়সা পেয়েছে কাশ্মীর! কোথায় সেইসব গেল? মনের মধ্যে এই প্রশ্ন আসতেই, ফারুক আবদুল্লার মুখটা ভেসে উঠে মিলিয়ে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল এ বুঝি বা বাঙলার কোনও গ্রাম পার হচ্ছি । হেলেপড়া টিনের গ্র্যারেজ, গাছের গুঁড়িতে স্কুলের ছেলেমেয়েরা বসে আছে। লজঝড়ে, ঝড়ঝড়ে বাস দাঁড়িয়ে আছে। যেন যাওয়ার কোনও তাড়া নেই। দুটো কলা গাছ। ওদিকে শীতমহল্লার দু চারটে গাছ দাঁড়িয়েছিল। দূরে দূরে পর্বতশ্রেণির কাছাকাছি চিনার গাছের ছায়ার দুটো বালিকা কিছু খেলছিল। চৌকোনো দাগের ঘরে একপা দিয়ে ঘুঁটি সরাতে সরাতে এগোচ্ছে। দাগওলা ঘরের পাশে উবু হয়ে বসে চার-ছটি মেয়ে, হাতে চাটনির মতো কিছু। তবু যেন সেইসব নেহাত চাকচিক্যহীন গ্রামের মানুষের চোখেমুখে মানুষের ক্ষতি করার বাসনা দেখেছিলাম বলে, মনে পড়ছে না । একজন বুড়ি কাঁথা বিছিয়ে দাওয়ায় বসে ঠায় চেয়ে ছিল রাস্তায়। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল কোথাও। বুড়িটার মুখের চামড়া কুঁচকে দাগ হয়েছে। কত বয়স হবে ১০০ ? ফর্সা টকটকে রঙ। কানে ইয়া বড় বড় ঝুমকো দুলছে। ওরা আমাদের মতো কৌতূহলী নয়। কানেকানে ফিসফিস করছেনা কেউ । মোড়ে মোড়ে সকলে দাঁড়িয়ে। কেউ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যেতে পারবেনা। ধৈর্যের পরীক্ষায় ও পাশের আশায় যেন ঠায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওরা। কেউ স্কুটারে কেউ গাড়িতে, তো কেউ রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য যেন কেউ আগ্রহী নয়। এসবই আমার ভাবনা। কিন্তু বাস্তব বড় তেঁতো।
গা সয়ে গেছে যেন এইসব নাকাবন্দী জীবন যাপনে। আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে
কাঁধ মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জানপ্রাণ
ঢেলে দিচ্ছে স্থানীয় পুলিশ ও তাদের ইন্সপেক্টররা । উর্দি ভিজে ঘাম বুকেপিঠে জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। পাবলিকদের মধ্যে কোনও টানাপোড়েন নেই। ওরা সবাই আটকে পড়েছে, অমরনাথের যাত্রীদের যাওয়ার রুটের মাঝে পড়ে গেছে বলে। আমরাও সঙ্গী এখন অমরনাথ যাত্রীদের। গাড়িতে বসে আছি। যেতে যেতে থামছে। তো আবার চলতে শুরু করেছে । হাসছি রগঢ় করছি নিজেদের মধ্যে। বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে রাজনীতির কথা হচ্ছে। ওর কোনও দিকে থাকার মন নেই । ব্রেক, গিয়ার আর পুলিশের আঙুলের দিকে মন দিয়ে রেখেছে স্পষ্ট, একাগ্রতা মানুষের আপাদমস্তকে কাজ করে। আধাসেনায় এখন মোড়া রয়েছে কাশ্মীরের শহর গ্রাম গঞ্জ। বাসের লটবহরের সঙ্গে সতর্ক প্রহরা । কাশ্মীরের মধ্যবয়সী পুলিশরাও ঘেমেনেয়ে চান । দেখে মনে হচ্ছে ওরাও ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ , নিজের এলাকা দিয়ে অতিথিদের পাশ করানোর গুরুদায়িত্ব ওদের কাঁধে। রুমালে মুখ মুচছে টকটকে গাল খাঁকি পোষাক চামড়ার ব্লেট , বাজুতে বুকে ব্যাজ নিয়ে রাজপুত্তুরের থেকে কম নন এরা সৌন্দর্যের আলোচনা ওদের নিয়ে। হুহু করে বাসের ঝাঁক এগিয়ে চলেছে সোনমার্গের দিকে। যেন জলের মধ্যে মাছের সারি দুলছে। আমাদের তিনজন ড্রাইভার,তারা চশমেসাই পেরতে পেরতে আমাদের গাড়িগুলিকে ভিড়িয়ে দিয়েছিল একেবারে হাই অ্যালার্ট টপ সিকিউরিটিতে মোড়া অমরনাথের গোটা তিরিশ কি তারও বেশি ভেইকেলের সঙ্গে। আমরা চলেছি বাসের লেজ ধরে ধরে। কিন্তু ওইসব বাসে দু তিনরকম স্টিকার মারা তবুও আমরাও চলন্ত অবস্থায় ওই একই সম্মান পাচ্ছি । বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জওয়ানদের দৃষ্টি জানলার মুখগুলোকে তীক্ষ্ণভাবে দেখে নিচ্ছে । বারবার ক্যামেরা লুকোতে হচ্ছে । একটা ক্যামেরায় ভিডিও সমানে চলছে (পরে এইসব দেশের স্বার্থে মুছে দিয়েছি) পেরিয়ে যাচ্ছি ডাললেক, নাগিন লেক, ইউনিভার্সিটি পোস্ট অফিস। হজরতবাল রোড ধরে বরাবর চলেছি, যেতে হবে ৮০ কিমি। হজরতবালের সৈয়দ-এ-আলম মসজিদ , হেল্থ সেন্টার, গেস্ট হাউস পার্ক, তাজদার মসজিদ, নাসিম মোটরস, অসংখ্য পেট্রোল পাম্প পড়ছে সোনমার্গ পর্যন্ত ৮০ কিমি এই পথে। গমের সবুজ ক্ষেত কোথাও কোথাও আরও সবুজ ধানক্ষেত, কিছু অন্য সবজি ক্ষেত বাজারের মধ্যে ফাঁকা দোকান। কোথাও ভিড় বাদুড়ঝোলা বাস দাঁড়িয়ে লোক নামাচ্ছে। পেরিয়ে গেলাম তাজদার কলোনির মোড়,
জাকুরা পুলিশ থানা। পথে পড়লো লালবাবাসাহিব গুরুদ্বার, জামিয়া মসজিদকে ডানদিকে রেখে বাসের দল ও সুরক্ষা বাহিনীর অধীনে চলেছি আমরা, এবড় পাওনা। এ যে এমন উপরি পাওনা চিরকালীন অভিজ্ঞতা।
অবাক হয়ে ফিসফিস কথাবার্তা হচ্ছে বাসের ভেতর। মাঝেমধ্যে আমার বউয়ের কিছু রসালো কথায় সারাবাস যোগ দিয়ে পরক্ষনেই চুপ। থেমে গেছে গাড়ি। ক্যামেরার মুখের লুকোচুরি হচ্ছে। কখন যেন কঙ্গনে ঢুকে পড়েছি এখান থেকে শুরু হয়ে গেছে লে-শ্রীনগর হাইওয়ে। এইপথের ওপরে পড়বে কার্গিল। গন্ডরবাল জেলার মধ্যে সোনমার্গ তখনও সমতল। একটু একটু চড়াই উঠছে তবে বাঁকের পাহাড় নয়। কাশ্মীর যেন কাশ্মীর নয়
চারপাশে চাষের জমি। গ্যারেজের কাছে ক্যানাস্তারা পেটাবার শব্দ। পথের পাশে নির্বাক দাঁড়ানো কাশ্মীরী কলেজ ও স্কুল পড়ুয়া ছেলে
মেয়েরা। বোরখা হিজাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। প্রায় মেয়ে ও মহিলাদের মাথায় গলায় গায়ে ওড়নায় মোড়া , পথে ঠান্ডার কোনও টের নেই। পলিটেকনিক কলেজ, গুলাববাগের সরকারি বালিকা বিদ্যালয় দোকানপাট থেকে থেকে পার হচ্ছে হু হু করে। ডানদিকে সিন্ধুর কোনও শাখা ধরে নিয়েছে গাড়ি। পথের শোভায় ঝিলমের উপনদীও কোথাও কোথাও যুক্ত হয়েছে। এদিকে পহেলগামের লিডারের শোভা নেই। মাঝখানে
রাজাধাবার কাছে ৩.৩০ এর সময় আমাদের
খাওয়ানো হবে বলে তিনটি ট্রাভেলার গাড়ি বাসের সিকিউরিটি লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে ডানদিক করে সামনে বহে চলা তীব্র খরস্রোতা নদীর গর্জনের কাছে থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরলো আধা সামরিক বাহিনী শেষে স্থানীয়রা বোঝাতে এবং বাসে অমরনাথের সিকিউরিটি চেকিং স্টিকার না থাকায় ওরা নিষ্কৃতি দিল। আমাদের ফেলে পথে মিলিয়ে গেলে অমরনাথের লটবহর। ওরা গেল কিছু দূরে অবস্থিত বালতালের অমরনাথের ছাউনিতে । কিন্তু সারাপথে নিরাপত্তা রক্ষিরা একমাস ঠায় দাঁড়িয়ে ডিউটিরত ২৪ ঘন্টা। কী অসম্ভব তাদের সদাজাগ্রত ডিউটি ও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, অবিচল থামের মতো দেশের সুরক্ষা মাথায় নিয়ে সারাদিন সারারাত সমগ্র পথজুড়ে এরা পাহারায় । এইবারের মতো ৭৩ বছরে এরকম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা কোনও দিন দেখেনি কাশ্মীরের জনগণ। তারাও বেশ অবাক হয়েছে, মিডিয়ায় হৈচৈ হচ্ছে। তবু তারা এই ঝঞ্ঝাট মেনে নিচ্ছে কারণ তাদের সারাবছরের রুজিরোজগার জড়িত। তাই অতিথিদের ফিরে যাওয়া ও আসার নির্বিঘ্ন পথ করে দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা পথের কষ্ট তারা সয়ে নিচ্ছে। কাগজে টিভিতে নেতারা বিস্তর সমালোচনা করছে এই নিরাপত্তার। তবু কিছু বলার নেই আধা সামরিক বাহিনী ও কাশ্মীরী পুলিশ যৌথভাবে এই নিরাপত্তার কোনও ত্রুটি রাখেনি। এই দেখার প্রমাণ আমাদের ডলফিন ট্রাভেলের সবাই । সেনাবাহিনীকে তাদের অসীম ধৈর্য্যকে তারিফ করতে করতে চলেছি আমরা। তখনও কেউ জানেনা যে এই নিরাপত্তার আয়োজন আসলে ৩৭০ ধারা রদের। এই নিরাপত্তার কারণে আমাদের ড্রাইভাররা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দোষ দিচ্ছে, তারাও আন্দাজে বলছে। তবু আমাদের কাছে এ এক নতুন অভিযান। নতুন এক অভিজ্ঞতা। মিলিটারি, সামরিক সাজ-সরঞ্জামাদি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। এতক্ষণ যাচ্ছিল লাম আগে পেছনে অন্তত ৩০ রকমের সামরিক গাড়ি,জ্যামার বম ডিসপোসাল, ভিডিও,টিভ, রেডক্রস,কাশ্মীরী পুলিশের গাড়ি। থামলেই তাদের অবিরাম গাড়ি থেকে ঝপাঝপ নেমেপড়া, হুইসেল হুইসেলে কান পাতা দায়। হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নানা সাইজের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে অধীর জনতা গাড়ি আটকে। হেঁটেও যাওয়ার অনুমতি নেই।
নজিরবিহীন নজরদারি। পথে ১০০ হাত অন্তর দু-তিন জন করে জওয়ান আগলাচ্ছে স্হানীয় শৃঙ্খলা। আগামী কাল পথে পড়বে দ্রাস যেখানে শীতকালে মাইনাস ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা নেমে যায় পৃথিবীর দ্বিতীয় ঠান্ডি জায়গা হিসেবে বিখ্যাত। এখান থেকে মানুষের শরীরে রক্তের শক্তিশালীতা বেশি করে থাকতে হবে । বাড়িতে যেদিন ফিরে এলাম সেইদিন কার্গিল দিবস পালিত হচ্ছে সারা দেশে। টিভি খুলে মনে হলো আমরা কার্গিলেই তো আছি। তখনও আমরা
কেউ জানিনা যে কী হতে যাচ্ছে কাশ্মীর ও লাদাখজুড়ে । ছটা ডিভাইসে হাজার ছবি শতশত ভিডিও তুলে এনেছি। এমনকি মিনি ডিভির ক্যাসটগুলো সিডি করতে কবে দেব ভাবিনি। ১৯৪৭ ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলো এবং ধর্মীয় পথে বিশেষ করে পাকিস্তানের উদয় হলো । সংখ্যালঘু হিন্দু নিয়ে বৃহত্তর কাশ্মীর রাজতন্ত্র নিয়ে থেকে গেল। তাতে লাদাখের মতো বৃহত্তম জনপদও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। লে ও কার্গিল যে লাদাখ রিজিয়নের বৃহত্তম জনপদ আগে থাকতেই ছিল সেকথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কার্গিলের দূরত্ব দ্রাস থেকে ৬০ কিমি। ২৩৪ কিমি দূরত্ব লে থেকে এবং ২০৪ কিমি দূরত্ব শ্রীনগর থেকে। তবে কার্গিল পুনরুদ্ধারের আগে এই কার্গিল জনপথের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অনেকবার এলওসি ক্রস করে চলে এসে গোলাগুলি চালিয়ে ছিল। পারভেজ মুশারফ কারও কথাই শোনেন নি। সেনাবাহিনীর প্রধান তখন তিনি। আসলে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট অঞ্চলের মধ্যে স্কার্দু হয়ে কার্গিল থেকে প্রাচীন কালে যে সিল্ক রুট চালু ছিল কারকোরাম পর্বত শ্রেণির অঙ্গ হিসেবে ওটাই ছিল পাকিস্তানে প্রবেশের সহজ পথ এশিয়ার অন্যান্য জায়গা এবং চীন আফগানিস্তানে যাওয়ার আদি পথ । সেই পথ এখন পাকিস্তানের হাইওয়ে । কার্গিলের আশেপাশে পাকিস্তানের বর্ডার লাইন কখনও কখনও খুব কাছে চলে এসেছে । পাকিস্তান হয়ে নদী ঢুকেছে এখানে। এখনও দু দেশে আত্মীয় স্বজনের লুকোছাপা যাতায়াত প্রবহমান এই কার্গিলে। ভারত, কার্গিলের রাস্তা ঘুরিয়ে জাস্করের দিকে ভারতে অবস্থিত সঙ্গমস্থল বরাবর এন এইচ-১ তৈরি করেছে নতুন করে এবং লের দিকে নতুন যোগাযোগ তৈরি করেছে যদিও একমাত্র বাসরুট
চালু আছে মানালি বাস টার্মিনাস থেকে লে
পর্যন্ত। দু দিক দিয়ে লে যাওয়া যায়। মানালি থেকে রোটাংপাস হয়ে আর আমরা যাচ্ছি অন্য পথে। মানালি থেকে রোজ বাস ভোর ৪.৩০ ছাড়ে দুই দিক থেকে। কার্গিল ও লাদাখ বাঁচাতে ভারতের নতুন তৈরি পথ জোজিলা যুক্ত করে। আসলে কার্গিল যুদ্ধের স্থান থেকে কার্গিল ব্লক হেডকোয়ার্টারের দূরত্ব ৩০/৪০ কিমি হবে । পাকিস্তান চেয়েছিল এই লে-শ্রীনগর রোডকে কেটে দিয়ে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে এবং তারা প্রায় সফলও হয়েছিলেন এবং প্রায় দখল নিয়েছিল এই সংযোগকারী ন্যাশনাল হাইওয়েকে। দু মাস তিন সপ্তাহ দু দিন তুমুল লড়াই চলেছিল।
৫২৭ জন বীর সেনা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন আহত হয়েছিলেন ঢের বেশি। হিসেব মতো ১৩৬৩ জন। যদিও ১৯৪৭-৪৮ ভারত পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল হিন্দু রাজা হরি সিংয়ের আমন্ত্রণে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। তখনই ১৯৪৯ সালে সিল্করুটকে তখনই ভারত সিল করে দেয়। ১৯৯৯ সালের ২ মে থেকে ২৬ জুলাই কার্গিলকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল পাকিস্তানের সেনারা। পাহাড়ের
উপর থেকে চোখ রাখা যায় এই কার্গিল-লে হাইওয়েকে প্রায় সোজা ১০০ কিমি পথ। এখনও আমাদের পথের ধারে দু চারটি এদিকে ওদিকে কামান পাকিস্তানের দিকে তাক করা আছে কিন্তু কোনও চৌকি নেই পাহারও নেই। আমরা যখন লাদাখে ৮ দিন ছিলাম তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনীর পজিশন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু কেউ কিছু বোঝেনি। বিপুল সংখ্যায় সেনাবাহিনী লাদাখ ঘিরে রেখেছে । হ্যাঁ যা বলছিলাম কার্গিল যুদ্ধের সময় বফর্স কামান
এবং আকাশ পথে আক্রমণ করে কার্গিলকে ভারত কব্জায় নেয়। বুক পেতে দিয়ে সেনারা মার খেতে খেতে পাহাড়ে শেষ পর্যন্ত উঠে যায়।ভারতের এই কার্গিল পুনরোদ্ধারের নাম ছিল -"বিজয়" । ১৭৩ কিমি দূরে বাতালিক সেক্টরের স্কার্দু থেকে পাকিস্তান যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে আর বহুমুখী আক্রমণে। পারভেজ মুশারফ আসলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা হতে যে চেয়েছিল কার্গিল দখল করে তিনি সেটা পাকিস্তানবাসীকে একটা বার্তা দিতে চয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় জওয়ানদের জেদের কাছে সামরিক বাহিনী তাদের জওয়ানের মৃত্যুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দুরন্ত সাহসের কাছে পাকিস্তান শেষে হার মানে। অবশেষে কার্গিল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। হাই অলটিচ্যিউট যুদ্ধ হিসেবে কার্গিলের যুদ্ধ পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছে । বেইমান পাকিস্তানী সেনারা নিয়ম ভেঙে অযাচিতভাবে পাহাড়ের ওপর থেকে কার্গিলের রোড বরাবর গোলাবারুদ ছোঁড়া এবং পাহাড়ের ওপর থেকে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচের সুবিধার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছিল ২০ বছর আগে। শেষে ভারতীয় জওয়ানরা মরবে জেনেও বুক পেতে দিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে যায় এবং
নিজেদের ভূমির দখল নেয় । তখন থেকেই
পাহাড়ের উঁচু স্থানগুলোতে নতুনভাবে চৌকি
তৈরি হয়েছে । মুশারফ জমানায় কার্গিল কলঙ্ক
পাকিস্তানের এক দুর্বল রণনীতির দৃষ্টান্ত
হয়ে আছে। যদিও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট নওয়াজ সরিফ কার্গিল যুদ্ধের দায় নেননি । পরে ইউএনও সাহায্যে শান্তি চুক্তিতে পাকিস্তান
স্বাক্ষর করে। আমি কার্গিল যখন যাই তখন ওখানে সামরিক বাহিনীর মহড়া চলছে (১৬.৭.১৯)। গান বাজনা ঝালানো চলছে। কোথায় নাচ হবে তার দাগ দেওয়া চলছে। দ্রাসের কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল রঙ হচ্ছে, সমাধিস্থলে তখন দেশাত্মবোধক গানের মহড়ায় আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। চোখ ভিজে যাচ্ছে শুনতে শুনতে, রেকর্ড পড়তে পড়তে। নাচের দলের জন্য জায়গার মাপজোখ চলছে মহিলাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর। শিবিরের চতুর্দিকে সাজো সাজো
রব। মিলিটারি ব্যান্ডে বন্দে মাতরম বেজে চলেছে, নিজের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনাকে প্রশমিত করে ওয়ার মেমোরিয়াল ঘুরে
দেখলাম। জীবন যেন ধন্য হয়ে গেল। শত শহীদের রক্তমাখা ওইভূমি ছেড়ে যেতে
মন চাইছে না মাত্র ৫ হাত দূর থেকে বফর্সকে
সকলে অবাক হয়ে মিলিয়ে নিচ্ছে। আমরা যাবো কার্গিল শহরের দিকে, হিন্দু মুসলমান শিখ সব ধর্মের যে ৫২৭ জন শহীদ জওয়ান মৃত্যু বরণ করেছিল। শোনা গেল তারা স্বেচ্ছায় এই ব্রত মেনে নিয়েছিল। তারা সকলেই জানতো আর ফিরে আসবে না। তাদের ত্যাগ আর তীতিক্ষাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিনা আমাদের এই স্বার্থপর ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রের বাবুগিরিসুলভ আচরণসুলভে। নাছোড়বান্দা সৈন্যদের তেজের গল্প মুখ থেকে মুখে ছড়াচ্ছে। চোখের জল রোখা যাচ্ছে না কিছুতেই। মেজরদের ঘিরে ধরে বড় পদাধিকারীকে ঘিরে ধরে এক এক জায়গায় দর্শকরা আরও গর্বিত কাহিনী শুনতে চান। কথা শুনতে চায়নি জওয়ানরা এমনই তেজদীপ্ত তারা। ওপরে ওত পেতে লুকিয়ে আছে জেনেও স্বেচ্ছায় একটা রাইফেল নিয়ে কয়েকজন ধোঁকা দিতে উঠে গিয়েছিল যাতে তারা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেলেও পেছনের বাহিনী পাহাড়ের মাথা দখল নিতে পারে। এই দুঃশাসহের মর্ম কাটমানি খাওয়া শখের নেতারা কিই বা বুঝবে। এইসব শুনতে শুনতে মাথা নীচু হয়ে গেছে। বাকরুদ্ধ সকলে। বাসে উঠে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে গেল শরীর।
শ্রীনগর থেকে জোজিলা পাস হয়ে পড়বে
দ্রাস। দ্রাসের ঠান্ডা পৃথিবী বিখ্যাত। তার পরেই পড়ে বিখ্যাত কার্গিল শহীদ মিউজিয়াম। আমাদের সেদিন থাকার ছিল কার্গিল শহরে। একটু দূরে। কার্গিল শহরের আগে এই বীরভূমি
যেন মন্দিরের পুজো নিতে ব্যস্ত। যেখানে মৃত্যুকে জয় করে দুমাস বাদে পাহাড়ে উঠে যায় সেনাবাহিনী, উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি সহ্য করে কে আগে জান দেবে এই প্রতিযোগিতায় নামে তারা। শেষে সেনারা বিজয় ছিনিয়ে নেয় সঙ্গে বফর্স কামান ও উপরে বায়ুসেনার রকেট । জয় এসেছিল ২৬ শে জুলাই আমরা গিয়ে পড়েছি ১৬/৭/১৯।মিলিটারি ব্যান্ডের জবরদস্ত মহড়া চলছে তখন। এখানেই তারা শায়িত রয়েছেন সারসার,
অসীম সাহসী ৫২৭ জন ভারতীয় বাহিনীর জওয়ানের জীবন, যারা সবাইমিলে হিন্দু মুসলমান শিখ নেপালির ঊর্দ্ধ্বে চিরকাল থেকে
গেলেন । ©® অলোক কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন