তবু ব্রোঞ্জের পূর্ণাবয়ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি আপনি আজও
অলোক কুন্ডু
অথচ মাইলফলক নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যে বড় রাস্তা
কোনোদিন বিদ্যাসাগরের নামে হাইওয়ে হয়নি
অনেক দিন পর কেঁদেকেটে হলো একটা বিশ্ববিদ্যালয়
ইংরেজ প্রতিপালনে কাটিয়েছিলেন একশতম জন্মদিন
তাই বাদই দিলাম ওইটুকু
দেড়শো বছরে শুধু তো ওইকটা রচনাবলী হাতে পাওয়া
অনেক পরে কর্মস্থলের বুকে একটা বর্ণ পরিচয় উঠলো
কলেজ স্কোয়ারের বিদ্যাসাগর তো সত্তরের টার্গেট ছিল
হা হুতাশ করতে করতে একটা আধুনিক শপিং মল হলো
সত্যি বলছি ভীষণ মন খারাপ হলো
অনেকে বলেছিলেন কিছু তো হলো
বিদ্যাসাগর পুরস্কারের একটা চল আছে বটে
কিন্তু একটাও রেলওয়ে স্টেশন ছিলনা এই সেদিন পর্যন্ত
পাড়ার ছেলেদের উৎসাহে
আর সরকারি ব্যবস্থাপনায়
অজস্র মূর্তির পর মূর্তি এখানে ওখানে ছড়িয়ে
তবু ব্রোঞ্জের পূর্ণাবয়ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি আপনি আজও।
কঠিন মুখমণ্ডলের আস্তিনে গুটিয়ে রাখা
দয়াগুলো জড় করলে একটা হিমালয় হতো
স্কুলগুলোকে জড়ো করলে আর একটা ধ্রুবতারা হতো
আমরা কিছুই গড়তে পারিনি
আপনার গড়াগুলোকে ভেঙে লোপাট করতে চেয়েছি
চেতনা দিয়ে এক এক করে ভেঙ্গেছেন বিভেদের সমূহ প্রাচীর
দয়াগুলি অবিরল জলের ধারার মতো
মিশিয়ে দিয়ে গেছেন যেন এক গোটা করুণার সাগর
মুন্ডছেদ হয়েছে বারংবার
বর্ণ পরিচয় স্তব্ধ হয়েছে থেকে থেকেই
আঘাতে জর্জরিত হয়েছেন কতবার
অনীবার্য ঈশ্বর বিমুখতায় আপনি নিজেই তো ঈশ্বর
দুশোটি বছর কেটে গেছে---প্রণাম হে
বাংলা বর্ণের শ্রেষ্ঠ জাতক বিদ্যাসাগর মহাশয়।
আজ দুশো বছরে পৌঁছলেন যখন
তখন আমাদের সমস্ত মুখমন্ডল কালিমালিপ্ত
আমরা না হয়েছি ঘরের না হয়েছি ঘাটের
সততা দয়া মায়া মমতার জন্য বেছে নিয়েছি চারটি মুখোশ
যুক্তি চেতনা বোধের জন্যে আরও তিনটে
সাতটা মহা মুখোশের আড়ালে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছি
রাগ আহ্লাদ হাসি ও কান্নার জন্য মুখোশ নয় বর্ম রেখেছি
বছরে একবার মুখোমুখি হলে এইরকম কবিতা লিখে দি
লাল মলাটের বইদুটো নাকি আজও বেস্টসেলার
মাইলফলক জানে এক বালকের মেধার উত্তরণের গল্প
রেড়ির তেল থেকে গ্যাসলাইটের কলকাতা তখন
কোম্পানি আমল থেকে বৃটিশ লাটসাহেব
এক্কাগাড়ি থেকে টমটম
ফ্যাকাসে লাল রঙের বর্ণ পরিচয় থেকে বোধদয়
কখনও ফ্যান চাইছে দুর্ভিক্ষের দাপট
কখনও নীলচাষের বিপর্যয় বাঙালি জীবনে
প্লেগ থেকে ম্যালেরিয়ার বিপর্যস্ততা শুনতে শুনতে
চেতনাগুলি সম্বল করে
সত্যিই এক তেজদীপ্ত ঈশ্বর তখন আপনি
রামমোহন জানিয়ে গেলেন সতীদাহ রদের শক্তিশালী দাপট আপনার বাল্যকালে
কে জানতো তখন ঘাটালের বালকের লেখাপড়া তরতর করে ছুটবে নবজাগরণ ঘাটে
বই প্রকাশ থেকে বই লেখা
টোল থেকে স্কুল কলেজস্থাপনা
ব্রাহ্মণদের হাত থেকে সংস্কৃতকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অযুত দাপট
আপনার কাছে বৃটিশ সাহেবের দর্পচূর্ণ পর্যন্ত হয়েছে যে
এসেছিলেন পড়াশোনার মান ঘোরাতে
শেষে সমাজে চরম কুঠারাঘাত
বিধবা বিবাহ আইন তৈরি করিয়েই ছাড়লেন
সমাজের বিপক্ষে রুখে দাঁড়িয়ে দিলেনও
বিধবা বিবাহ--
আয়ের সিংহভাগ দান করলেন অকাতরে
পুজো-পার্বণ নয় মানবতাই আপনার ধর্ম হয়েছে
সাঁওতালদের কাছে আপনার খ্যাতি ডাক্তার বিদ্যাসাগর।
প্রজ্ঞায় বলিষ্ঠায় আপনি কুসংস্কার সরিয়েছেন
সমাজপতিদের যুক্তি খন্ডন করেছেন নিমেষেই
বালিকা শিক্ষার আয়োজনকে করেছেন সর্বোচ্চ সম্মানিত
তবু এই চলে যাওয়া দুইশত বছরে দুইশত দিন কখনও আপনাকে দিইনি
গোপাল হালদা মশাই ছাড়া
আপনাকে নিয়ে তেমন গবেষণাও করলো না কেউ
দুশো বছর বড় কম কথা নয় হে ঈশ্বর
অনেক দিন পর হলো একটা বিশ্ববিদ্যালয়
তবু ব্রোঞ্জের পূর্ণাবয়ব নিয়ে দাঁড়াতে পারেননি আপনি আজও
আপনার যাত্রাপথের কয়েক হাজার মাইল ফলক খুঁজতে বেরিয়ে ফিরে এলাম
এত গ্রাম এত জনপথ এত নিওন এত প্রচার প্রপাগান্ডা কাদের ?
কোনও গ্রাম পঞ্চায়েতে আজও লিখে রাখেনি
বিদ্যাসাগরমশাই এইপথে গিয়েছিলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন