অলোকের ঝর্নাধারায়
(আমার টুকরো জীবন)
পর্ব-১৫
■হাওড়ার অফিসে শিক্ষকদের ১২০০০ হাজার কিংবা তারও বেশি পেনশন ফাইল দেখেছি, করেছি এমনকি ফাইল খুলে পর্যন্ত সাজিয়ে দিয়েছি। সেলাই করে দিয়েছি যাতে না কাগজ হারিয়ে যায়।এটা আক্ষেপ নয়। মেন লোডটা আমি নিলেও শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকজন সাহায্য করেছেন। দিন দিন আরও কাজ বেড়ে গেছে ক্রমশ। ডিপিপিজির ফাইলের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করাও আমার ঘাড়ে চেপে গেলো। যদিও খুব কম ফাইল সল্টলেক থেকে ফেরত আসতো এবং এলেও এক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে পুণরায় পাঠানো হোতো। এছাড়া সমস্ত চিঠিপত্র করার দায়িত্বও পড়ে গেল। বিশাল পেন্ডিংয়ের বিশাল ভিজিটর। প্রতিদিন ভিজিটর মিট ২০/৩০ জন। সরকারি অফিসে কাজ চাইতে গেলে তাকে খেদানো হচ্ছে একটা অবধারিত ব্যাপার। লোককে যাচ্ছেতাই করা দুর্ব্যবহার করা। কিন্তু হাওড়ায় এসে আমার রোজ চা খরচ হতে লাগলো ৭০/৮০ টাকা। শিক্ষকরা বুঝতে পারলো বহুবছর বাদে তারা একজন বন্ধু পেয়েছে। কেউ শুধু মুখে ফিরে যাননা। চা নয় এলে কাজ চলার খবর জানতে পারেন।
● বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মাত্র ১৫ মিনিট হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির কারও সঙ্গে সামান্য কথা বলার সময় পাওয়া বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ালো দিনকে দিন। সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল আমার পারিবারিক জীবন।
কলকাতায় কাজ করার সময় যে ছুটির পর এক আধদিন সন্ধ্যায় একাডেমিতে নাটক দেখেছি, আমার মেয়ে বউ এমনকি শালি পর্যন্ত চলে গেছে। আমার সেইসব শেষ হয়ে গেল। বিদ্যালয় পরিদর্শকদেরই যে কাজ আমি করে দিচ্ছি সেটাই তারা ভুলে গেলেন। আমাকে সাহায্য করার বদলে তারা সবসময় চেষ্টা করলেন আরও অন্যান্য কাজ চাপিয়ে দেবার। সব সময় তাদের চেষ্টা থাকলো আমাকে কীভাবে ব্যতিব্যস্ত রাখা যায়। তাদের ইউনিয়ন না করার জন্য তারা সকলে মিলে মাসিক সভায় আমাকে শত্রুর মতো করে আক্রমণ করতে থাকলো।
●একদিন অফিসে মুখ নীচু করে কাজ করছি। আমার টেবিলের সামনে এসে হাজির হলেন এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক। রিটায়ারড শিক্ষক শিক্ষিকারা তো হামেশাই আসেন। ওনাকে দেখে আমি টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার স্কুলের স্যার শুভেন্দুবাবু। উনি আমাকে ভুলে গেছেন। তখন ওনার বয়স ৭২/৭৩ কি আরও বেশি হবে। সঙ্গে মনে হয় ওনার পুত্র হবে, ঠিক চিনিনা। স্যারের এক হাতে লাঠি ও অন্য হাতে একটা থলি। পেনশন ফাইল জমা করবেন। আমি তখনও পরিচয় দিইনি। আমি জিজ্ঞাসা করলাম কবে রিটায়ার করেছেন। উনি বললেন ৭ বছর আগে। কেন এত দেরি। উনি কাঁপছেন। আমার সামনের চেয়ারে বসতে বসলাম। বললেন ওনার অবসরের ব্যাপারে আইনি জটিলতা থাকায় দেরি হয়েছে। হাইকোর্টের জজ সাহেবের অর্ডার সঙ্গে দেওয়া আছে। আমি বললাম আমি আপনার ছাত্র। উনি দেখলেন আমাকে। সাল জিজ্ঞাসা করলেন। দেখলাম চিনলেন না। থলি থেকে ফাইল বার করলেন। সেই দোর্দণ্ড প্রতাপ আর নেই স্যারের। স্যার প্রচুর ছেলেকে মেরেছেন কিন্তু আমাকে মারটা মনে হয় একটু বেশি ছিল। তা নয় যাকে মেরেছেন সে অন্ততঃ স্যারকে ভোলেনি। জিজ্ঞাসা করলেন কতদিন বাদে পাবো টাকা পয়সা। বললাম একটু সময় লাগবে, কারণ সবটুকু আমি করিনা। আমার কাজের পরও উপরে নন্দা দি মিলিয়ে দেখেন আবার। তারপর অডিট অফিসার দেখেন। তারপর সল্টলেকে যায়। ধরে নিন নরম্যালি দু তিনমাস লাগার কথা।
●কিন্তু সল্টলেকে তখন সমস্ত জেলার পেন্ডিং জমে পাহাড়। বাম সরকার সত্যিই তখন শিক্ষকদের পেনশনের জন্যে একটু নড়েচড়ে বসেছে। মাঝে একটা হচপচ অবস্থা হয়েছিল। শিক্ষকদের পেনশন দেওয়ার ব্যাপারে প্রভূত চেষ্টা চলছে। কিন্তু জেলা অফিসগুলোতে বিদ্যালয় পরিদর্শকরা নড়বড়ে করে রেখেছে। তারমধ্যে কিছু কাজের লোক সব সময় থাকেন, তাদের কেউ কেউ এখনও আছেন তারা কাজটা করেছিলেন যথাসাধ্য। হয়তো আমার থেকেও বেশি করেছিলেন বলে সেইসব জেলা অনেক উপরে ছিল। হাওড়া নড়বড়ের অন্যতম। কলকাতায় প্রণব সরকার না থাকলে ওখানেও এই একই অবস্থা হোতো।
●যদিও শিক্ষক ও সরকারি কর্মচারীদের সম্মানে তুলেছে বাম সরকার। এটা না মেনে উপায় নেই। শিক্ষকদের পেনশনের জন্য সমস্ত আইনকানুন বামফ্রন্ট সরকারের করা। আসলে কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও বিদ্যালয় পরিদর্শক সমিতির জন্য সরকার কিছু করতে পারছিল না। কর্মচারীদের ইউনিয়ন ছিল শিক্ষকদের অসম্মানিত করার একটা বড় বাধা। তারা পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলা অফিসকে কুক্ষিগত করে রেখেছিল। তখন হাওড়া জেলার প্রাইমারিতে খাতাকলমে সিদ্ধান্ত নেওয়াই ছিল মাসে সর্বোচ্চ ১৫ টি ফাইল সল্টলেকে যাবে। অথচ অবসর নেন তার থেকেও বেশি। প্রতিটি সার্কেলে অবসর মাসে তখন ২০/২২ জন। জেলায় মাসে অবসর নিচ্ছে ৩২০-এর বেশি। তার ওপর মাত্র দুবছরের বেশি পেনশন পেন্ডিংয়ের কোনও হিসেব জেলায় নেই। বাম আমলেরই ১৯৮১ থেকে পেন্ডিং পেনশনের কোনও হিসেব নেই জেলা অফিসে নেই। ফাইলগুলো কোথায় আছে কেউ জানেনা। ধুঁকতে ধুঁকতে ১০/১২ বছর পরে কোনও শিক্ষক এলে তবে বোঝা যায়। পুরনো যে হিসেব যায় তাতে মারাত্মক ভুল। দেখানো হয় পেন্ডিং ২০০টা তা আসলে ২৯ বছরের পেন্ডিং গুণে শেষ করা যায়না। কারেন্ট ফাইল নিষ্পত্তি হয় মাত্র ১৫ টি। তখন হাওড়া কাউন্সিল অফিসে চেয়ারম্যান হিসেবে এসেছেন সিপিএমের জেলা নেতা ও এবিটিএ-র নেতা শ্রদ্ধেয় উমাশঙ্কর গাঙ্গুলী মহাশয়। পরিচ্ছন্ন মানুষ, সৎ মানুষ, নিরপেক্ষ মানুষ। কাজের মানুষও বটে। যিনি প্রভূত ক্ষমতার শীর্ষে বসে কখনও ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। এইরকম মানুষের দেখা পাওয়াও সৌভাগ্যের। এত জবরদস্ত নেতা কাজের খুঁটিনাটি বোঝেন, কখনও নিজের জন্যে সামান্যতম সুবিধা নেননি। ইনি হাওড়ার একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমায় বললেন ১৫ টা নয় দ্বিগুণ করুন। সম্ভবত স্বপন বাগচিদা তখন কাউন্সিলর এ.আই অফ স্কুলস্, স্বপনদার অনেকগুলি কাজ। ওই মিটিংয়ের সময় সম্ভবত স্বপন দা ছিলেন। এরপর আমি বাড়িতে ৫/৬ টা ফাইল রাতে দেখার জন্যে নিয়ে যেতে থাকলাম। রাত তিনটে পর্যন্ত চলতো কাজ। যাই হোক ওনাকে আমি কথা দিলাম বাড়াবো। তবে আমি কিছু সাহায্য চেয়েছিলাম। পরে উনি এবিপিটিএর জেলা সম্পাদক রাধাবল্লভ সাহাকে বললেন কয়েকজন কাজ জানা ভালো শিক্ষক দেওয়ার জন্য যারা আমাকে সাহায্য করবেন। চারজন শিক্ষক ও হাওড়া কাউন্সিলের দুজন নিয়ে একটা সেল হলো জায়গার অভাবে দু জায়গায় বসে কাজ আরম্ভ হলো।
●শুভেন্দুবাবুকে বললাম যত তাড়াতাড়ি পারবো আপনার ফাইল সেরে দেবো। তবু তিনমাস একটা সময় ধরে রাখুন স্যার। আমি বললাম চা খাবেন স্যার। উনি মাথা নাড়লেন, খাবেন না। ওনার ছেলেকে বললাম একমাস বাদে খোঁজ নিন। এমনিতে আমার হাতে কয়েক হাজার পেন্ডিং। আমার নাওয়া খাওয়ার সময় নেই। কেউ বাড়িতে এলে অশান্তি হয়ে যায়। আমি কোথাও যাইনা। কবিতা লেখা তো স্বপ্ন। এত কাজের মধ্যে বিদ্যালয় পরিদর্শকদের ইউনিয়ন ডি.আই. সাহেবকে দিয়ে আরও একটা সার্কেল অফিসের চার্জ জবরদস্তি গছিয়ে দিয়েছে। ব্যতিব্যস্ত করা ওই শুরু হলো। আমি মুখগুঁজে কাজ করছি আর আমার অন্য বিদ্যালয় পরিদর্শকরা অফিসের একটা ঘরে তখন আড্ডা দিচ্ছে। হৈ হল্লা করছে।
আড্ডার হাটে বসেছেন আমার পেছনে লাগা মায়া দাস, রঞ্জিত ব্যানার্জীরা। হো হো হি হি চলছে। আমার ঘাড়ে কিন্তু দুটো অফিস। দুপুর বেলা বাস ঠেঙিয়ে আন্দুল যেতে হবে ওখান সন্ধ্যা ৭ টা।
●আসলে শুভেন্দুবাবু একসঙ্গে দু জায়গায় কাজ করতেন। হাওড়া মিউনিসিপ্যালিটিতে উনি ছিলেন ক্লার্ক সকাল ১১.০০ টা থেকে আর আমাদের স্কুলে পড়াতেন সকাল ৬.২০ থেকে ১০.২০ পর্যন্ত। দুটো অফিস থেকেই উনি সরকারি বেতন ও ডিএ নিতেন। এই ঘটনা কংগ্রেস আমলের। কীভাবে নিতেন? মনে হয় উনি কংগ্রেস করতেন এবং কোনও বড় নেতার ছত্রছায়ায় ছিলেন। কিন্তু কেউ কি ওনার নামে অভিযোগ পর্যন্ত করেনি। এইসব ওনাকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই। তখন শিক্ষকরা ৬৫ বছর পর্যন্ত চাকরি করতেন। কিন্তু শিক্ষকের পেনশনটাই উনি আবেদন করতে বাম আমলে আটকে যায়। দু জায়গায় চাকরি দু জায়গায় বেতন নেওয়ার জন্য। এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। তাই দীর্ঘদিন ধরে কেস চলেছে হাইকোর্টে। তখন ডি এ খুব কম ছিল। যাইহোক হাইকোর্ট শেষ পর্যন্ত পেনশন আটকায়নি। একটি অফিসের কর্মজীবনের ডি.এ যত টাকা উনি নিয়েছিলেন তা ওনাকে জমা করতে বলে হাইকোর্ট। তখনকার দিনে ওইটাকার পরিমাণ খুব বেশি নয়। আমাকে বহু লোক এসে বলে শুভেন্দুমাষ্টার খুব বদমাইশলোক, দুটো চাকরি করেছে। আপনি ঘোরান ওনাকে। আসলে শুভেন্দুবাবু কাউকে চাঁদাটাদা দিতে চাননি। ৭/৮ বছর কেস লড়েছেন। হারজিত করতে করতে ডিভিশন বেঞ্চের রায় এনেছেন। প্রচুর টাকা কোর্টঘর করতে খরচ হয়েছে। আমি তাদের বললাম একদম আমার কাজে নাক গলাবেন না। আসলে অফিসের কেউ কেউ টাকাপয়সা চায়। আর এটাই হচ্ছে সরকারি অফিসের মূল রোগ। শুভেন্দুবাবু তাড়াতাড়ি পেনশন পেয়েছিলেন। আর একটা দিন বড় জোর আসতে পেরেছিলেন। আর কখনও দেখা হয়নি। ( ক্রমশ:) -অলোক কুন্ডু । ৩.১০.২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন