●আদতে কি সম্ভব গরীবের হাতে পয়সা দেওয়া ?
যদি এরকম হোতো টাকা ছাপিয়ে বিলি করা যেত। তা কি সম্ভব ? অমর্ত্য সেনের তৃতীয় পক্ষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা গরিবের অর্থনীতির জয় এইসব গালভরা নামের আড়ালে যে উন্নয়নই থাকনা কেন আসলে এইসব কথা থিওরির একটা মায়াজাল। প্রায় একই বিষয়ের দুই ধরনের মৌলিক বিষয়ের প্রস্তাবনায় দুজন বাঙালির এই পর পর পৃথিবী জয়ে সারা পৃথিবী আন্দোলিত।
নোবেলজয় নিশ্চিত ভালো । যেকোনো থিওরি মুগ্ধতা ছড়ায় ঠিকই কিন্তু সার্বিক সমাজে বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে তার ভালোত্বের জয়গানে গরীবের জয় হয় কতটা হয়? অথচ নরসিমা রাও
এক হাতে অর্থনৈতিক সংস্কার ও অন্য হাতে মিড ডে মিল এনে দেখিয়েছিলেন গরিব, মধ্যবিত্ত ও বড়লোকের অর্থনীতিকে এক সুতোয় কীভাবে বাঁধতে হয়। স্বামীজি গান্ধিজি থেকে ইউনূস সাহেব
( বাংলাদেশ) নানা আয়তনে আসলে গরীবের অর্থনৈতিক জয় চেয়েছিলেন । কিন্তু ভর্তুকির এই দেশে তা কীভাবে সম্ভব ? মধ্যবিত্তের পকেট কেটেই এদেশের উন্নয়ন চলছে ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে। ভুল হলো ইংরেজি আমল থেকেই। অর্থনীতির এই আঞ্চলিক উন্নয়ন কীভাবে গোটা ভারতভূমির উন্নয়ন হয়ে উঠবে ? বড়লোক বাঁচাতে বাঁচাতে এইদেশ "হ্যায় রাম যায় রাম"-এর মতো হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল, কাব্য নিয়ে হলেও অর্থনীতিতে তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথের
নোবেল পাওয়া কোনও ব্যাপার ছিলনা বোধহয়।
দেখতে গেলে রুখাশুকা শান্তিনিকেতনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটা অঞ্চলের চেহারা
শিক্ষা দিয়ে পাল্টে ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়েছিলেন
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটাতে। কিন্তু ভর্তুকি
তো এখন এই দেশের দিশেহারা অবস্থা। তার উপর নতুন থিওরি গরিবের হাতে টাকা গুঁজে দাও। নাকি আরও মদ্যপান বাড়াও আরও মহুয়া বিক্রি বাড়াও! একি সত্যিই কোনও রূপকথার অর্থনৈতিকতা? ভর্তুকি এখন এই দেশের অর্থনীতিতে ব্রাজিলের মতো দাবানল আগ্রাসি হয়ে উঠতে পারেও। সকলেই ওটা চান, ভর্তুকিতে সিনেমা পর্যন্ত হবে। পথের পাঁচালীর ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা কি সমস্ত কিছুর মধ্যে মেনে নেওয়া যায়? বাৎসরিক পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি ইনকামের পরিবারের চাই বেশি ভর্তুকি কারণ এরা শিক্ষায় এগিয়ে আসতে পেরেছে। একটা মোটামুটি পেট চালানোর মতো ক্ষমতা এরা অর্জন করে ফেলেছেন। ৬/৭ লক্ষ টাকা খরচ করে ছেলেকে অথবা মেয়েদের হয় বি.টেক পড়িয়ে কোনক্রমে ১০/২০ হাজার টাকার একটা ইনকাম করিয়ে নিতে পারছেন না অথবা ৬/৭ লাখ টাকায় এদেশের প্রাইমারি শিক্ষকের চাকরি ক্রয় করে নিয়ে উন্নয়ন। কিন্তু অন্যদের কীভাবে কি হবে ? গ্রামে চাষবাস থাকলেও প্রতিটি মানুষের কাছে পয়সা কোথায়। প্রকৃতপক্ষে টিউশনি করে গ্রামের অর্ধেক যুবক যুবতীর জীবনে টিঁকে থাকে। টিউশনির উপর দাঁড়িয়ে এরা বিয়ে পর্যন্ত করে নেয়। তাদের কী হবে ? ধীরে ধীরে একটা সময় এরা কর্মহীন হয়ে পড়েন, এই দল কি শেষ পর্যন্ত এনজিওর সাহায্য নিয়ে বেঁচে উঠবেন। রোজ রোজ নগদ টাকার জন্য লাইন দেবেন। সামান্য দুমুঠোয় পেট চালাবেন ? ইউনূস সাহেব মাইক্রো ফিনান্সের বাস্তবায়ন করিয়ে দেখেছেন কিন্তু একটা জায়গায় এসে ঋণ দিয়ে ,ক্ষুদ্র মূলধন বাড়ানোর বিস্ফোরণ করিয়ে ( আঞ্চলিক ভাবে) কিছুজনের ভালো করে দেখাতে গিয়ে পরে ওখানেও সাফল্যের পেছন পেছন দুর্নীতির ব্যাপক প্রবেশ ঘটেছে এবং ইউনূস সাহেবকেও তাড়া করে ফিরছে মাইক্রো ফিনান্সের দুর্বলতাগুলো এবং মাইক্রোফিনান্সের আপন ভাই সারদা ইত্যাদির পাল্লায় পড়ে বহু গরীবের সর্বনাশ ঘটেছে । থিওরি মজবুত হলেও তার বেড়ার মজবুতি ফসল খেয়েছে পোকায়। অবশ্যই এখানে মাইক্রো ফিনান্স থেকেই বন্ধন ব্যাঙ্কের জয় এসেছে।
বিনায়ক স্যারের দাওয়াইয়ে দিল্লির সরকারি
স্কুলের ছাত্রদের নিশ্চিত ভালো হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কৃষি পরিকল্পনা আর ব্যাপক
ছিল তখনকার দিনে, গান্ধিজির সুতো কাটার মধ্যেও বিস্তর পার্থক্য ও মতের দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়েছে সমাজ এই দুই মহান ঋষির ভাবনায়।
আজকের দিনে হয়তো অচল হয়ে পড়েছে। আসলে অর্থনীতিই যুগ পাল্টাবার জিয়নকাঠি।
তবু রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীজির থিওরি প্রশ্নাতীত । গান্ধিজি নোবেল পেলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিলনা কিন্তু তিনি নোবেল নিতেন না। সর্বাধিক প্রস্তাব তো গান্ধীজিকে ঘিরেই আছে নোবেলের কিন্তু তিনি তা পাননি। তার মানে এই নয় যে অমর্ত্য ও বিনায়ক স্যারেদের মতো মহান নোবেলজয়ীরা কেউ ছোটমাপের। নোবেলের মানবিক আবেদনের বিকল্প নেই । সত্যজিৎ রায় মৃত্যুর সামনে
দাঁড়িয়ে সিনেমার নোবেল পেয়েছিলেন । তিনি সামান্য স্ক্রিপ্টের মধ্যে অপুর পাঠশালায় কিংবা অপারাজিতর স্কুল ইন্সপেকশনে অথবা আগন্তুকে ময়দানে উৎপলদত্তকে দিয়ে ভূগোল শিক্ষা আসলে তা এক প্রকার গরীব ও মধ্যবিত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নের গোড়ায় শিক্ষিত হওয়ার একটা বিদ্যুৎরেখার আশ্চর্য আবিষ্কার দেখিয়েছিলেন। যা সিনেমার আঞ্চলিক পর্বে আবর্তিত হলেও মানুষের মধ্যে একটা প্রশ্নের চিন্তা জাগ্রত করেছিলেন যে শিক্ষিত হওয়ার প্রয়োজন আছে অর্থনৈতিক উন্নয়নে। কিন্তু সেখানে ভর্তুকি নেই। রবীন্দ্রনাথের থিওরিতেও ভর্তুকি নেই। কাজ কর খাও। গান্ধীজির থিওরি কাজকে সব সময় যুক্ত করো। কিন্তু এখন তো গরীবের অর্থনীতি মানে ভর্তুকি। জানিনা গ্রামের শিক্ষিত বেকারত্ব কীভাবে ঘুঁজবে ? নাকি কম মেধাবী ছেলেরা ছয় সাত লাখ দিয়ে বি.টেক পড়ে ডেলিভারি বয়ের কাজ খুঁজবে ? বা চাকরি কিনবে ? এদেশে সরকারি চাকরিতে ঢুকলে তো বহুজনই জিওর মালিকের মতো কোটিপতি হওয়ার আশা করেন । ঘুষ নেন ,কাজ করেন না, ইউনিয়ন করেন বি.এস.এন.এল, ভারত পেট্রোলিয়াম ইত্যাদিকে ক্ষণস্থায়ী করে তুলেছেন এই ইউনিয়নবাজি, কাজ না করে করে বসে বসে মাইনে নেওয়ার ধান্দায় কোম্পানি উঠে যেতে বসেছে। এমনকি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কয়লা থেকে এক ওয়াগন কয়লার দাম জোরজবরদস্তি আদায় করে নিচ্ছেন নেতারা এবং গ্যাসের ভর্তুকিও চাইছেন। উন্নয়নের নামে আঞ্চলিকতার পর্ব ছেড়ে সার্বিক ভাবে শিক্ষিত মাফিয়া তৈরি করে অর্থনীতির বিপর্যয়ে আগুন দিচ্ছেন কিছু হৈ-হল্লা করা পাব্লিক। যে পরিমাণ কয়লা মাফিয়ারা নিচ্ছে সেই পরিমাণ গরিবরা যদি পেতো তাহলে স্থানীয়ভাবে তো এলাকায় গরিব থাকার কথা নয়। একই সঙ্গে ভর্তুকি প্রত্যাহার ও সকলের রোজগার এবং ইউনিয়নের
ঝান্ডা প্রত্যাহারই করাই হবে জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন। গরীবের উন্নয়ন করতে গিয়ে যদি বেকায়দায় ফেলে মধ্যবিত্ত যুবক-যুবতীদের আরও গরীব করে দেওয়ার ফর্মূলার দিকে দেশ এগিয়ে চলে তাহলে কাঁচা টাকা বিতরণ করে গরিবদের বাঁচানোর কথা কত বছর ধরে চলতে পারবে । অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেলে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ও আমরা গর্বিত। আরও গর্বিত আর এক নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেনের জন্য। কিন্তু এই সৌর্য দিয়ে এই দেশের মলিনতা কতটা ঘুঁচে যাবে জানিনা। এই দেশের জন্যে এই দেশের এনজিওদের একটা সমস্যা আছে। সারা পৃথিবীতেই এনজিওর প্রচেষ্টায় একদল গরীব মানুষের মধ্যে নানাভাবে অর্থনৈতিক সামঞ্জস্যবিধান করার একমাত্র উপায় বলে একটি থিওরি কাজ করছে। এতে ভালো খারাপ দুই হচ্ছে । ফেসবুকের সাহায্যে গ্রুপের বন্ধুদের মধ্যে এই থিওরীর নতুন আবিষ্কার ও গরীবের ভালো করার আগ্রহের পরিধি সুখকরভাবে বিস্তৃত হয়েছে। গরীবের এতে ভালো হয়েছে। যদিও এই বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে মানুষের ব্যক্তিগত প্রচার আছে তা হোক। আনন্দের প্রচারের সঙ্গে গরীবের ভালো করার প্রবণতার দিকটি আজ উজ্জ্বলতা পেয়েছে সন্দেহ নাই । কিন্তু গরীবের ভালো করতে গিয়ে এনজিওগুলি ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে যাওয়ার মধ্যে একটি বিপর্যয়ের সূত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। হাওড়ার জগৎপুরের কালীপদ দাসের যে বড় এনজিও ছিল তা বামপন্থীদের পাল্লায় পড়ে দশভাগ হয়ে গোষ্ঠী করে টাকা লুটপাটের খেলায় কালীপদ দাসের মৃত্যুর পর সেই গরিবদের খাওয়াপরার চেহারা এখন কঙ্কালের মতো। বিনায়ক স্যারের থিওরিটি অত্যন্ত আধুনিক এবং সঙ্ঘবদ্ধভাবে মানুষের ভালো করার প্রচেষ্টার উন্নয়ন ঘটাবে সন্দেহ নাই। মানুষের দ্বারা মানুষের যে বিপর্যয় তৈরি হয় তার জন্যে শৌখিনতা অনেকাংশেই
দায়ি। একদল মানুষের শৌখিনতার চাপে কিছু
মানুষ গরীব হয়ে পড়ে ( বাজার বাড়ার বদলে বাজার ছোট হয়ে যায় । উদাহরণ দেওয়ালির প্রদীপ কেনা হচ্ছে মল থেকে) গরীব বাঁচানোর জন্য এনজিওদের ওপর প্রখর দৃষ্টি রাখতে হবে । তবে আঞ্চলিকভাবে কিছু গরীবের উন্নয়ন ঘটানো হলেও জনবিস্ফোরণের এইদেশে তা খুবই সীমিত হবে। চীনের অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজকল্যাণ আমাদের ভেবে দেখা উচিত কারণ আঞ্চলিকভাবে গরীবের উন্নয়ন হওয়া
কাম্য নয়। অনুন্নত দেশের কিছু নীতি আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাবে পালিত হয় সেগুলো সব ভর্তুকি নীতি। মিড-ডে-মিলকে আরও ভালো করে অন্য ভর্তুকি তোলা উচিত। আসলে বিশ্বব্যাংকের বেশ কিছু পরিচালক ভর্তুকিকে তোল্লাই দেন। এদেশের
ভোটে জিতে আসার একটি মগজাস্ত্র হলো ভর্তুকি প্রদান। যে যত ভর্তুকি দেবে সেই সরকারের ভোট তত বেশি পাবে। কিন্তু এই ভর্তুকি পেয়ে দাতাকে আর পাবলিক মনে রাখেনা। প্রিয়রঞ্জন হাসপাতালে যাওয়ার আগে পুরুলিয়ায় দাঁড়িয়ে বলে গিয়েছিলেন আদিবাসীদের জন্য কংগ্রেস সরকার পুরুলিয়ায় ২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে সেই বছরে, তার ২৫ হাজার টাকা যদি পুরুলিয়ায় উন্নয়ন হয়েছিল তখন। কাকে কি বলবেন ?কংগ্রেসের জেতার অনেকটা জুড়ে আছে এই ভর্তুকি প্রদান। ভিক্ষে দেওয়ার বিষয়টি সারা পৃথিবীতে চালু আছে এটি ভালো বৃত্তিও। কিন্তু ভর্তুকি বড় না কাজ বড়। ভারত ও চীন এই মহারাষ্ট্রের সমাজকল্যাণ কিন্তু পরস্পরের বিরোধী
চীনেও ভর্তুকি আছে। কিন্তু চীনের কি অবস্থা ছিল আর কি হয়েছে আমাদের সঙ্গে একটু যদি তুলনা করে দেখি তবে এইসব অর্থনৈতিক পুরস্কার মূল্যহীন মনে হবে। এইসব থিওরি চীনের কাছে প্রযুক্তির জঞ্জালের থেকেও বড় বেশি মাথা যন্ত্রণার কারণ হবে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের আগ্রহ অনেক বেশি ভর্তুকিও সেখানে নিয়ন্ত্রিত।
■©® অলোক কুন্ডু ( গতবছর আজকের দিনে লেখা)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন