মঙ্গলবার, ৬ অক্টোবর, ২০২০

অলোকের ঝর্নাধারায়-১৯

#অলোককুন্ডুরলেখালিখিওকবিতা #indianwriterscommunity #kolkatadiaries #kolkata #writer #lekhak #facebookpost #darjeelingtourism

অলোকের ঝর্নাধারায়
( আমার টুকরো জীবন)
পর্ব-১৯
■ মে মাসে দার্জিলিং ঘুরে এসেই আবার হৈ হৈ করে আমরা হাওড়া স্টেশন থেকে নভেম্বরে, পুজোর একটু পরে মন্দিরতলার গোরাদার সেলাইস্কুলের সঙ্গে আবার দার্জিলিংয়ের পথে র‌ওনা দিলাম, লক্ষ্মীপুজোর পর। ইতিমধ্যে সেই বছর ৭ দিন ছুটি নিয়েছি। ৮ দিনের জন্য যাচ্ছি এবার। যাতায়াতের দুদিকে রবিবার পড়ছে। পুরুষ বলতে আমি আর গোরা দা। মহিলা ৪৫ জন। আর দুজন কুক। হাওড়ায়, আমাদের জন্য একটা গোটা বগি। ফুল কম্পারটমেন্ট। ছোটবেলায় শুনতাম কুন্ডু স্পেশাল ওইভাবে নিয়ে যায়। ৪৫ জনের মধ্যে গোরাদার স্ত্রী ছেলেকেই শুধুমাত্র চিনি। অধিকাংশ মেয়েরা গোরাদার গ্রামের ওইদিককার। গোটা দশেক মেয়ে শিবপুর ও চ্যাটার্জী হাটের। বয়সে দু তিনজন তার মধ্যে ৩০-৩২ হলেও অধিকাংশের বয়স ১৮-২২। হাওড়া থেকেই বাইরে যাত্রীদের চিলচিৎকার দরজা খুলে দেওয়ার জন্য। ওঠার সময় বাবা বাছা করে অনেককে নামানো হয়েছে। কিন্তু মাঝে কোনও স্টেশনে থামলে যাত্রীদের হুটোপুটি। দরজা বন্ধ আছে। ভেতরে লুকিয়ে লুকিয়ে স্টোভে আমাদের রান্না হচ্ছে। এখনকার মতো জলের জ্যারিকেন ছিলনা। দু জন রান্নার লোক নামিয়ে একটা দুটো জায়গায় জল নেওয়া হয়েছে। বড় জলের ড্রাম দু একটা হাঁড়ি কড়া কুকদের। বাইরে দু দিকে দুটো ফেস্টুন ঝুলছে, তবু লোক উঠতে চায়। দু একজন জবরদস্তি উঠেও পড়েছিল। ঝগড়ার পর তারা নেমেছে। দরজায়, এই কামরা বুক আছে আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে। কেউ ছিঁড়ে দিয়েছে অর্ধেক। আমার তখন বয়স কতো? ২৫ হবে। আমি ডায়রি নিয়ে সকলের নাম ঠিকানা টুকে নিয়েছি। একটা লিস্ট করা হয়েছিল, কিন্তু ফেলে এসেছে গোরা দা। কেবলমাত্র টিকিট আর রেলের ছাপমারা একটা টাইপকরা লিস্ট গোরাদার কাছে। ওটা টিটিকে দেখানোর জন্য যত্ন করে রাখা আছে। মেয়েরা কলর কলর করতে করতে চলছে। হা হা হি হিতে কানের পোকা বেরিয়ে পড়ছে এমন সে আওয়াজ। সালকিয়ার 'জয়া'র সঙ্গে পরিচয় হলো ওদের কারখানা আছে, বেশ পয়সাওয়ালা। ওদের কারখানার এক কর্মচারির বোন গোরাদার সেলাই স্কুলের ছাত্রী। সেইসূত্রে এসেছে। জয়া বলে মেয়েটি একমাত্র সম্ভ্রান্ত। গায়ের রঙ থিন অ্যারারুট বিস্কিটের মতো, গালে হাল্কা টোল পড়ে। শর্মিলা ঠাকুরের মতো অত সার্প নয় তবে তখন তো সুন্দরী বলা যায়। লম্বা নয় বড় জোর ৪ ফুট ১১ হবে। একমাত্র ওর‌ই পোশাক দামি। অধিকাংশ মেয়েদের চেহারায় সচ্ছলতার ভাব নেই। গোরাদা বললো এরা ৭০ ভাগ সেলাইফোঁড়াই করে সামান্য ইনকাম করে। গরিব ঘরের সব মেয়ে। এরা স্কুলে ভর্তি হয়েছে, সার্টিফিকেটটা পেলে যদি কিছু চাকরি জোটে। হাইস্কুলে পার্টটাইম সেলাইয়ের টিচার হলেও একটা সামান্য ইনকাম হয়।। বাম সরকার অবশ্য এদের মধ্যে গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ওয়ার্ক এডুকেশন গ্রুপে নিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছিল‍ পরে। সেই দিক থেকে দেখলে অনেক হাই স্কুলে এরা একটা সম্মানের চাকরি পেয়েছিল। জ্যোতিবাবুর দূরদর্শিতা এইখানেই নতুন মাত্রা এনে দেওয়ার মতো ব্যক্তিত্বপূর্ণ বলবো। এইসব সামান্য লেখাপড়া জানা মেয়েদের কর্মক্ষম করার কথা তখন ভাবাই হোতো না। তবে এইসব মেয়েদের মধ্যে গ্র্যাজুয়েট ৪/৫ জন হয়তো ছিল। জয়ার মতো পড়ুয়া মেয়ে ২০ জন এসেছে যারা ওই সেলাইস্কুলের নয়। তারা বাইরের, কলেজে পড়ে। সকলেই প্রায় হাওড়া গার্লস কলেজে পড়ে। তার মধ্যে একমাত্র জয়া সাইকোলজি অনার্স ফাইনাল ইয়ার। আমি-গোরাদা দুজনে লোয়ারবাঙ্কে শুয়ে পড়লাম। কুক দুজন মেঝেতে। আলো নিভিয়ে সব ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরে উঠে পড়লাম। ইতিমধ্যে নামবো নামবো করছি জয়া আমার হাতে গোলকরে পাকানো একগাদা একশো টাকার নোট দিয়ে রাখতে বললো, বাথরুম যাবে। আমি পাজামা পাঞ্জাবি পরেছিলাম আমার চাদর গুছোচ্ছি। ব্যাগ ঠিক করছি। পাঞ্জাবির পকেটে রেখে দিলাম অতগুলো টাকা। আমারও ঠেকে শেখা অনেক বাকি তখন। এখনকার ভ্যালুতে ৩০/৪০ হাজার তো হবেই। আমাদের সঙ্গে সেলাইস্কুলের তিনজন দিদিমণি আছেন। তাদের বয়স একটু বেশি। তবে ৪০-এর বেশি নয়। একটা জলখাবার ও চা ট্রেনে উঠেই দেওয়া হয়েছিল যাওয়ার সময়। রাতে ডিমের ঝোল ভাত। তার মধ্যে ডিম আলু সিদ্ধ করে এনেছিল গোরা দা। সামনের পাতে লঙ্কা দিয়ে আলুভর্তা মেখে দেওয়া হয়েছিল, এক হাতা করে ডাল। তাও কুকারে ডাল সিদ্ধ করে আনা। তখনকার দিনে কলাপাতা ছাড়া হয়না। জলের মাটির গ্লাস ছিল কিছু, কিন্তু সকলকে দেওয়া যাবেনা। ওয়াটার বোতল সকলের সঙ্গে ছিল। এন.জি.পি-তে নেমে রিক্সায় করে অনেকটা দূরে একটা জায়গায় দাঁড়ালাম। আমরা উঠে পড়লাম ছোট ট্রেনে। এইসময় বিশাল হৈচৈ। আমাদের মেয়েগুলো দাঁড়িয়েছে আমাকে ঘিরে। দুটো কম্পার্টমেন্টে ভাগ করে আমরা উঠেছি। কতগুলো ছেলেগুলো দৌড়ে নেমে গেছে অন্য কোনও যাত্রীর পকেট মেরেছে। তাই হৈ চৈ। ওই কথা শুনে আমার তখন মনে পড়েছে জয়ার টাকাটার কথা। তখনও জয়ার খেয়াল নেই, ওর টাকার ব্যাপারে। একটি মেয়ে বলছে, আপনার পকেটে হাত দিচ্ছিল কিন্তু আমি হাঁটু দিয়ে মেরেছি। দেখুন তো। আমার তখন মাথা খারাপ। কোন পকেটে ছিল দু পকেট হাঁতড়াচ্ছি। পেয়ে কোনোরকমে মেঝেতে বসে পড়েছি। হার্ট অ্যাটাক হ‌ওয়ার জোগাড়।
একজন বলছে কি হয়েছে, দেখুন নিয়েছে কি ? সকলে আমার ব্যাপারটা বুঝতে চাইছে। এতক্ষণ পরে জয়া হাসছে, বলছে কি হলো? আমার তখন ওদের সকলের ওপর রাগ ধরছে। দুটো মেয়ে যারা দেখেছিল তাদের ওপর আর‌ও। একগাদা ইয়ং ছেলে ওইভাবে রোজ ওঠে। রোজ পকেট মেরে শুকনার কাছে নেমে যায়। তবে অন্য একটি লোকের গেছে। জয়াকে টাকা ফেরত দিলাম, বললাম, তুমি তো চেয়ে নেবে এতক্ষণ ? হাসছে, বললো যায়নি তো! ৪৫০০/- টাকা ছিল। তখন ৪৫০০/- টাকার বিশাল দাম। ( ক্রমশ ) অলোক কুন্ডু। ৬.১০.২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...