সোমবার, ৫ অক্টোবর, ২০২০

অলোকের ঝর্নাধারায়-১৭

#অলোককুন্ডুরলেখালিখিওকবিতা
#indianwriterscommunity
#kolkatadiaries #kolkata #writer #lekhak #facebookpost

■অলোকের ঝর্নাধারায়
(আমার টুকরো জীবন)
পর্ব-১৭

সবে গ্র্যাজুয়েট হয়েই তিন বছরের মাথায় সরকারি চাকরি। চাকরির দু-মাসের মাথায় অফিসের এক বন্ধু, স্মরণ বললো, এই ক্লার্কের চাকরিতে তো বেশি মাইনে নয়রে,বরং চল বি.এড.পড়ি দুজনে। বি. এড.পড়লে বাইরে থেকে পরীক্ষা দিয়ে স্কুল ইন্সপেক্টর হ‌ওয়া যায়। তাই দুজনে নাইটে ভর্তি হয়ে গেলাম যাদবপুর বিদ্যাপীঠে। অফিস করে ১৮ মাস ধরে যাদবপুরে বি.এড পড়তে গেছি। কিন্তু আমার ওই বন্ধু তিনমাস পরে ছেড়ে দিল। সেই সময় আমি গোলপার্কের ফার্ন রোডের মামার বাড়িতে থাকতাম। কিন্তু যখনকার কথা বলছি তখন আমার বি.এড পড়া শেষ হয়ে গেছে। বি.এড শেষ করেই, তালতলার ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে, নাইটে ফাইন আর্টসে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেও এক ঘটনা, মধ্য হাওড়া শিক্ষালয়ের আর্ট টিচার পৃথ্বীশ দা আগে আমাদের পাড়ায় থাকতেন। উত্তরপাড়ায় উঠে গেলেন, একদিন ওনার নতুন বাসায় উত্তরপাড়ায় গেছি, পৃথ্বীশ দা আর্ট কলেজের ফর্ম হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন তোমার দরকার আছে। ব্যস পরীক্ষা দিলাম। চাকরিতে এত সময় দিতে গিয়ে ছবিআঁকা অবশ্য সব লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। হাওড়া অথবা শিয়ালদহ স্টেশনে নাইট কলেজের পর স্কেচ করে বাড়ি ফিরতে রাত ১২ টা হয়ে যেত তখন। আবার রবিবার বন্ধুদের সঙ্গে আউটডোর বেরিয়ে যাই। ব্যাস নতুন জীবন, বাড়িতে কে আসছে কে যাচ্ছে কিছুই খবর রাখি না। একপ্রকার বাউন্ডুলে জীবন। আমার বন্ধু ছিল বর্তমানের শিল্প নির্দেশক, অলয় ঘোষাল। তখনই অলয় দারুণ ছবি আঁকতো। অলয়‌ও আমাদের সঙ্গে স্কেচ করতো। একসঙ্গে যারা বাইরে আমরা স্কেচ করতাম, নিজেদের মধ্যে একটা দল হয়ে গেছে বেশ ভালো। ওই দলে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের ছেলেরাও কয়েকজন আছে। হৈ হৈ করতে করতে অফিসে ছুটি নিয়ে প্রথম ৭/৮ দিনের ট্যুরে ছবি আঁকতে দার্জিলিং চলে গেলাম। তবে অলয় যায়নি। কলেজের গ্রীষ্মের ছুটি তখন। সকলে আমাকে করলো ম্যানেজার। একদিন আঁকতে বেরিয়ে ঠিক করা হলো, সেদিন সিঙ্গল সিঙ্গল কাছে দূরে আমরা বসবো। ছবির দৃশ্যমান স্থান যেন কমন না হয় সকলের। অ্যাঙ্গল‌ও এক না হয়। খেয়েদেয়ে তাই এক একজন এক একদিকে চলে গেলাম। প্রত্যেকর সঙ্গে একটা জায়গায় দেখা হ‌ওয়ার টাইম ঠিক করা হলো। ছবি আঁকতে গিয়ে এখানে একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটলো। সেই কথাটাই বলবো। শুনলে মনে হবে এরকম ঘটনা সত্যি হয়! একবারে সত্যি ঘটনা। পরে আর‌ও তিনবার দার্জিলিং গেছি কিন্তু ঠিক ওই জায়গাটা আমি আর আবিষ্কার করতে পারিনি। বড় ইচ্ছে ছিল ওই পরিবারের সঙ্গে দ্বিতীয়বার পরিচয় করার। তবে স্টেশনের একটু সামান্য নীচে হবে জায়গাটা। সকলেই জানেন দার্জিলিংয়ে মাঝেমধ্যে মেঘ এসে কুয়াশায় ঘিরে ধরে চারপাশ। আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি শুনে আর‌ও দু চারজন জুটে গেল। আমাদের দলে ১০ জনের মতো ছেলে তখন। কিন্তু সেদিন সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি, আঁকতে গিয়ে। আমি যেখানে বসে আঁকছিলাম সেখানে আমার ডানদিকে একেবারে দূরে দেখা যাচ্ছে রোপ‌ওয়েটাকে। মাথার পেছন দিকে স্টেশন। তবে দুটো বাড়ির ফাঁক দিয়ে খানিকটা দেখা গেলেও স্টেশন বলে কিছু বোঝা যায় না যেখানে বসেছি। সামনে নীচের দিকে কখনও রোদ আবার কখনও কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে। বামদিকে কয়েকটা বাড়ি। দুদিকেই রাস্তা নেমে উঠে গেছে। তবে আমি বসেছি একটা তেমাথার মাঝে।  পেছনেও স্টেশনের দিকে রাস্তা। তবে হাঁটা পথ। আমার তিন ফুট সামনে দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে বটে তবে খুব কম। তবে দুদিক থেকেই আমাকে দেখতে পাবে। কেউ সরাসরি আমার গায়ে, গাড়ি উঠিয়ে দেবেনা। আমি যে দৃশ্যপট সামনে এনেছি, তা হলো ডানদিকে বাড়িগুলো ঘেঁষাঘেঁষি করতে করতে ক্রমশ দূরে মিশে গেছে। আর‌ও দূরে দুতিন রঙের সবুজ পাহাড়। সিধে রোপ‌ওয়ের যাতায়াত দেখা গেলেও ঘনঘন নয়। চা বাগানগুলো এত দূরে যে অস্পষ্টতা ও আলোর ফোকাসে একটা মায়াময় আবছায়া রূপ দন্ডায়মান। বাঁ দিকেও বাড়ি। শুধুমাত্র যে রাস্তাটা চলে গিয়ে নীচে হারিয়ে গেছে না দাঁড়ালে সেটা বোঝা যায়না। পেন্সিলের স্কেচ যখন করেছি তখন‌ও লক্ষ্য করিনি যে আমাকে কেউ দেখছেন, বামদিকের একটা বাড়ি থেকে। বাড়ির সামনে একটা বেশ দাওয়া মতো সেটা টিন দিয়ে ঢাকা। চালার শেষ প্রান্তে একটা সদর ঘর দুদিকে কাঠের জানলা মাঝের দরজাটা বন্ধ। পাশে আর‌ও দুটো বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতেই ফুলের বেশকিছু গাছ। ছবি আঁকতে গেলে সব জায়গাতেই পথচারী কিংবা পাশাপাশি বাড়ি থেকে কৌতূহল হয়ে দেখে থাকে, এটা নতুন কিছু নয়। মাঝে একবার ঝিরিঝিরি করে পাতলা জল পড়লো কুয়াশা থেকে। আমার এক্সট্রা পলিথিন সিট আঁকাতে ঢাকা দিয়ে ব্যাগ চাপিয়ে কাছের বাড়িটার ছাউনিতে একটু দাঁড়ালাম। থেমে যেতে গিয়ে বসেছি। জল রঙ। প্যালেটে রঙ গুলে রঙ চাপাতে ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষণ হলো ফার্স্ট টোন চাপাতে ব্যস্ত। যে বাড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেই বাড়ির জানলায় দুটি মুখ। শরীরের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। মা ও মেয়ে মনে হলো। অন্য কোনও সম্পর্ক‌ও হতে পারে। সেকেন্ড টোন সবে শেষ হয়েছে একটু দাঁড়িয়ে দেখছি ছবিতে কি কি ভুল হয়েছে। পাটা ধরে গেছে। পাটা ছাড়িয়ে নিচ্ছি। দেড় ঘন্টার মতো হয়ে গেছে। ফাইনাল টাচ দিয়ে এবার উঠে পড়বো। তবে অন্যদিন একসঙ্গে দু তিনজন থাকি, কথা হয়, গল্প হয়, হাসি ঠাট্টা হরদম চলতেই থাকে, আঁকার‌ও সুবিধা হয়। কি ভুল হচ্ছে কেউ না কেউ ধরিয়ে দেয়। আজ একবারে মুখবুজে কাজ। কাউকে জিজ্ঞেস করার‌ও নেই। হঠাৎ আমার সামনে দাঁড়িয়ে ফ্রকপরা একটি মেয়ে। একদম নেপালি নয়। একটু লম্বাটে মুখ, বয়স ১৭/১৮ হবে। পায়ে মোটা হাওহাই। হাঁটুর নীচ পর্যন্ত সাদা জামা। একটা লাল বুকখোলা সোয়েটার। মেয়েটার হাতে একটা বড় পোর্সিলিনের সাদা বাটি। একবাটি তেলমাখা মুড়ি। তেলে ভাজা চিনেবাদামে ভর্তি। আমি নির্বাক। কি করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছি না। কিছু একটা বলছে, কিন্তু সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। নিতে বলছে এইটুকু বুঝলাম। দূরে মেয়েটির মা দাঁড়িয়ে বাড়ির সদর দরজায়, আমাকে হিন্দিতে নিতে বললেন। আমি বাটিটা নিতেই মেয়েটি ফট ফট করতে করতে ভদ্রমহিলাকে কি সব বলতে বলতে হাসতে হাসতে চলে গেল। ভদ্রমহিলাও ঢুকে গেছেন। খুব দূরে নয়। মাত্র ১২/১৩ ফুট দূর হবে। ওরা অনেকক্ষণ থেকে দেখছিল। তবে পরে আর জানলায় কেউ নেই। আমি আগেকার দিনের ওয়াটার বোতল থেকে জল বার করে হাত ধুয়ে মুড়ি খেতে শুরু করলাম। ভেতর ভেতর লঙ্কা দেওয়া। গুঁড়ো মশলা দিয়ে মাখা বাদামগুলো তখনও গরম আছে। আমি আর ওই বাড়ির দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছি না। বেশ খিদে পেয়েছিল। ভাবছি এই কথা বললে ওরা আজ চাঁদা তুলে আমাকে পেটাবে। এরপর খাবার জল এলো। আগেকার দিনের মোটা ঘোলাটে বড় কাঁচের গ্লাসে ধোঁয়া ওঠা সঙ্গে চা। গ্লাসের মুখটায় একটা চাপা দেওয়া। মেয়েটা আমার পেছন দিক থেকে এসে জলটা আমার হাতে দিল। চা-টা একটা প্লেন জায়গায় রাখলো। জলটা গরম করে দেওয়া বেশ অনেকটাই খেলাম। মেয়েটা এতক্ষণ রাস্তায় হাঁটু রেখে বসেছে। হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা নিল। আমি ততক্ষণে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়েছি। মনে হলো ভদ্রমহিলা বোধহয় জানতে চাইছে চা গরম আছে কিনা। তখন‌ও আমার ছবি আঁকা শেষ হয়নি। বললাম, হ্যায়। চা খাওয়ার ফাঁকে জানতে চাইলেন কেন আঁকছি কোথা থেকে এসেছি। আধঘণ্টা দেরি যে হয়ে গেল আমার তখন খেয়াল নেই। চা খেয়ে গ্লাস দিয়ে এলাম দাওয়াতে। এইভাবে ঋণী হয়ে যাবো কখনও ভাবতে পারিনি। তখনও আমার ঘোর কাটেনি। আমি ছবি আঁকার থেকে ওদের ব্যবহার ওদের আচরণ ওদের স্নেহবৎসল এই ব্যবহারে আমি আপ্লুত। আমি যে নেবোনা না নেবোনা করছিলাম সেটা যেন ঠিক হয়নি আমার বলা, ওই ভেবে কুঁকড়ে আছি বেশ।
পরে মনে হলো ছবিটা পরেরদিন গিয়ে দিয়ে আসা উচিত ছিল। কোনও কারণে দেওয়া হলোনা, সময় হলোনা। সকলকে বলতে, প্রথমে কেউ বিশ্বাস‌ই করতে চায়নি। কিন্তু এই ঘটনার জন্য যে ওদের সকলকে চা পকোড়া খাওয়াতে হলো সেটা এখনও মনে আছে। জীবনে অনেক দুঃখকষ্ট পেয়েছি। তবে এইরকম হীরেমাণিক ঘটনাগুলো ভাবলে এত আনন্দ হয় যে আমাকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয়। কিন্তু এখনও বুঝি তবুও যেন কত ঋণী আছি...( ক্রমশ) অলোক কুন্ডু। ৫.১০.২০

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...