⛔ তফাৎ যাও... সব ঝুট হ্যায়। হ্যাঁ "ক্ষুধিত পাষাণ"- এর থেকেও তখন এই উচ্চারণে বাজার মাতোয়ারা। যারা দেখে ফেলেছেন অথচ মেহের আলী পড়েননি তারাও ততদিনে ক্ষুধিত পাষাণ জেনে গেছেন। তাই জনগণের কাছে সৌমিত্রর পরিচিতি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ এর সরকারি কর্মচারী দিয়েই। কারণ অপুর সংসার তখনও সকলের দেখা হয়ে ওঠেনি।
•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, " আমি মাণিকদার আবিষ্কার। আসলে সৌমিত্র যখন জানতে পারলেন যে সত্যজিৎ রায় 'অপরাজিত' করছেন, তখনই তার প্রথম সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছা জাগে এবং এক বন্ধুর বন্ধুকে ধরে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি গিয়ে দেখাও করেন। কিন্তু সৌমিত্র তখন সেই অপুর থেকে একটু লম্বা হয়ে যাওয়াতে ও বয়স বেশি হওয়ায় সৌমিত্রকে সেটাও জানিয়ে দেন, সত্যজিৎ রায়। তাই সেই সময় তার চান্স হয়নি। কিন্তু অপুর সংসার করার আগেই সত্যজিৎ রায় ডেকে পাঠান সৌমিত্রকে। অপুর সংসারের সাফল্যের পর সৌমিত্র ভেবেই ছিলেন সিনেমাকেই পেশা করবেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তো ডাক আসেনি, তাছাড়া এতদিন তো নাটক ও শিশির ভাদুড়ীর কাছে যাতায়াত করেছেন সৌমিত্র এবং নানা জায়গায় নাটকের মঞ্চে চান্স কীভাবে পাওয়া যায় সেই দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার সময় তার চলে যাচ্ছে, বিস্তর টানাপোড়েন তখন।
•চারুলতাকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুজনকেই সাংবাদিকরা বহুবার, বহু রকম প্রশ্ন করেছেন। সৌমিত্র বলেছেন চারুলতা বিশ্বের একটা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, এমনকি মাণিকদার কাছেও চারুলতা, তাঁর প্রিয় ছবি। সৌমিত্রর দ্বিতীয় ছবি ক্ষুদিত পাষাণ তপন সিংহর সঙ্গে। সত্যজিৎ রায় তপন সিংহ দুজনকেই সৌমিত্র ভীষণ সম্মান করতেন সেটা সকলেই জানেন। ক্ষুধিত পাষাণ, যেহেতু চেনা ও বিখ্যাত গল্প, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই নেওয়া তাই সৌমিত্রর তো পড়াই ছিল। তপন সিংহ ডাকতেও সঙ্গে সঙ্গে তবুও কথা দেননি। যদিও সৌমিত্র জানতেন, তপন সিংহ বাংলা ছায়াছবির তখন একজন বড় বাণিজ্যিক সফল পরিচালক এবং হাবিজাবি ছবি করেন না, তাছাড়া বহু নবাগতকে সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে সৌমিত্র তো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করে বুঝে ফেলেছেন কি ধরনের কাজের সিস্টেম, অভিনয় শেখানো কোন স্তরের, মোদ্দা কথা সৌমিত্রও আশা করছেন যে চান্স পেলে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আবার একবার যদি চান্স পাওয়া যায়, তবেই তার ফেম হবে। ঠিক এই সময়টাতেই সিনেমাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের দিগদর্শনও খুলে যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। মনের মধ্যে আলোড়ন হতে থাকে, কি করবেন তিনি। মানিকদাকে কীভাবে জানাবেন। সত্যি কি ক্ষুধিত পাষাণে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন ? এই দুশ্চিন্তা নিয়ে তখন সত্যজিৎ রায়ের কাছ যান। সৌমিত্র জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তার পক্ষে ওই রোল করা উচিত হবে কিনা ? অর্থাৎ তিনি ক্ষুধিত পাষাণে সাচ্ছন্দ্য হতে পারবেন কিনা। তপন সিংহ ডাকার পর রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন," মাণিকদা, আমার কি ছবিটা করা উচিত হবে? সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, " অবশ্যই উচিত হবে, একশো বার উচিত হবে। "
•সৌমিত্র বলেছেন, মাণিকদা বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব, অত্যন্ত বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির মূল্যায়ণ করেছিলেন। " সত্যজিৎ রায়ের উৎসাহেই সৌমিত্র তপন সিংহর কাছে কাজ করতে শাহস পেয়েছিলেন। যদিও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে গিয়ে, প্রথম প্রথম সৌমিত্রর, বাধো বাধো লাগতো সেটে। সৌমিত্র আবারও বলেছেন, তপন সিংহের সঙ্গে কাজ করে কিন্তু অনেক কিছু শিখেছি। পরে বুঝতে পারি মাণিকদা কেন জোর দিয়ে বলেছিলেন। পরে ঝিন্দের বন্দীতে, বিশেষ করে কীভাবে হাঁটাচলা করতে হবে তার বেশ কিছু ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। ঘোড়ায় চড়া ও অসি শিক্ষাও নিতে হয়েছিল পরে। তপন সিংহ অভিনয় শিল্পটা ভালই জানতেন। নাট্যকার মন্মথ রায়ের নাটকটি হুবহু ফলো করেছিলেন তপন সিংহ। তপন দা সবসময় খুব সচেতন ভাবে সাধারণ দর্শকদের জন্য সিনেমা করতেন। কিন্তু ক্ষুধিত পাষাণ মুক্তির পর কাগজে বহুভাবে বিরূপ সমালোচনা, অনেক কটুবাক্য ও ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেলেও সাধারণ পাবলিক ক্ষুধিত পাষাণ দেখতে ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে ছবি বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়নি। কিন্তু ছবির সংগীত সৃষ্টিতে ছিলেন দিকপাল মানুষরা। উস্তাদ আলি আকবর খান। সহযোগিতায় ছিলেন, উস্তাদ আমির খান, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিখিল ব্যানার্জী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। তখনই 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে' রবীন্দ্র সঙ্গীত থেকে জনগণের গান হয়ে গেল। এই সময়ে রবীন্দ্র সংগীতের ফাংশনও বেড়ে যায়। নৈহাটির একটা জলসায় গিয়ে পৌঁছেছেন দেবব্রত বিশ্বাস ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। সংগঠকদের জলসায় নিয়ম ছিল, যিনি আগে পৌঁছবেন তিনি আগে গাইবেন। দ্বিজেন দা আগে গেলেও, জর্জ দা বললেন, আগে আমি গামু, বলে জোর করে স্টেজে গিয়ে বসে পড়লেন। উনি সিনিয়র। দ্বিজেন দা খানিকটা থম মেরে গেছেন। দেবব্রত বিশ্বাস হারমোনিয়াম ধরে যা করেন না তাই করলেন সে-দিন। জনতাকে জিজ্ঞেস করলেন কোন গান তিনি গাইবেন? প্রায় একসঙ্গে সবাই চেঁচিয়ে, ' যে রাতে মোর। ' জর্জ দা তখন দুবার হারমোনিয়ামে যে রাতের সুর বাজিয়ে থামলেন। বললেন, " শুনেন, এইখানে উদ্যোক্তারা ঠিক করেছিল একডা জিনিস। যে আগে আইবেন, সে-ই আগে গাইবো। দ্বিজেনবাবু এইহ্যানে আগে আইছেন, ওঁরই আগে গাওনের কথা, কিন্তু আমি অঁরে এখানে বসতে দিই নাই। ক্যান দিই নাই হেইডা আপনাগো কই---আপনারা সক্কলে 'ক্ষুধিত পাষাণ' সিনেমাডা দ্যাখছেন, সেই সিনেমাডাটায় দ্বিজেনবাবু এত অসাধারণ গাইছেন যে সেই গান আমার আগে শোনালে আর আপনারা আমার গান শোনবেন না। " জর্জ দার অনুকরণীয় গলায় ওই কথার পর হাততালিতে ভরে গিয়েছিল জলসাস্থল। একই সঙ্গে জর্জ বিশ্বাসের মতো মানুষ, দ্বিজেনদাকে ও ছবিটাকে সম্মান জানিয়েছিলেন যা ভাবাই যায়না।
•তপন দার সঙ্গে ভূপাল ও রাজস্থানে আউটডোরে গিয়ে ইউনিটের সকলের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয়েছিল তা বহুকাল ভাঙেনি। এমনকি ক্যাম্পফায়ার পর্যন্ত হয়েছিল। ভূপালের যে বাড়িটা বাইরে থেকে সিনেমায় দেখান হয়েছিল তা আসলে একটা পুরনো বিখ্যাত মসজিদ। এই কারণে তখন ওখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তপন দা বহু আলোচনা করে সমস্যাটি মিটিয়ে ছিলেন। ভারতবর্ষের সম্প্রীতি এটাই বোধহয়। যারা গল্পটি পড়েছেন ও সিনেমাটি দেখেছেন তারা অন্তত বলবেন, সেই প্রাচীন স্থাপত্যের কতখানি প্রয়োজন ছিল ওই সিনেমায় ও রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের কয়েকদিন আগে ক্ষুধিত পাষাণের মুক্তি হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মাণিকদার তিন কন্যাও, যেখানে রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব, অমূল্য হয়েছিল। কেননা মাণিকদার ছিল নতুন ভাবে বিন্যাস করার প্রবণতা।কাদামাখামাখির দৃশ্যটা করতে গ্রামের লোকেরা জল ঢেলে ঢেলে "মালদা"তে কাদা করেছিল রাস্তা, টাকা খরচ করে জল ঢালাতে সমস্যা হয়েছিল কারণ বৃষ্টির অপেক্ষায় সময় চলে যাচ্ছিল। সিনেমার ভেতর কত যে গল্প থাকে যার শেষ নেই।
•১৯৬১-রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। সমাপ্তির মতো অত মিষ্টি প্রেমের সিনেমা বাংলাতে নেই বললেই চলে। তবে তিন কন্যার পোস্টমাস্টার ( ১৮৯১/১৯৬১) স্বর্ণখচিত একখন্ড হীরে। চারুলতা অর্থাৎ নষ্টনীড় তো কলেজে পড়া ছিল (১৯৬৪) কিন্তু মানিকদা কখনও হুবহু গল্প প্রোজেক্ট করে দেননি। পৃথিবীর বহু সিনেমা স্কুলে অবশ্যই পাঠ্য চারুলতা ও পথের পাঁচালী। যার কোনও কিছু বাদ দেওয়া যায় না। যদিও নষ্টনীড় রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীমূলক লেখা। সিনেমার চারুলত হলো, আলোছায়ার মায়া।
( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সাক্ষাতকার ও লেখাকে সংগ্রহ করে এডিট করা। - অলোক কুন্ডু)
©® অলোক কুন্ডু। ২৭.১১.২০২০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন