⛔ আমাদের হাওড়ায় স্কুল কলেজের কিছুটা সময় কেটেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। কৃষ্ণনগর থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পিতার চাকরিসূত্রে হাওড়ায় এসে পৌঁছন তিনি। উল্লেখ্য হাওড়ার ভূমিপুত্র পরবর্তীতে বিখ্যাত পেন্টার, রবীন মন্ডল ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাল্যবন্ধু। বলা ভালো যে হাওড়া-ময়দানেই রবীন দার সঙ্গে একদিন আলাপ হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। রবীন দা, গতবছর প্রয়াত হন। রবীন দার মুখে শুনেছি দুটি পৃথক স্কুলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য কলেজ লাইফ থেকে সেই সখ্যতা আরও বেড়েছিল। প্রথমদিকে রবীন দা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকের মঞ্চ ভাবনা এঁকে দিয়েছিলেন। যাইহোক রবীন মন্ডল দা তখন ছবি আঁকা নিয়ে পড়ছেন আর্ট কলেজে। সৌমিত্র সিটি কলেজে। রবীন দা প্রচ্ছদ করে দেন বন্ধুদের আর্ট কলেজের নামী ছাত্র তখন তিনি, রবীন্দ্রনাথ মন্ডলকে তখন অনেকে চেনেন। সৌমিত্র কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। কিন্তু হাওড়ার সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রাক্তন অধ্যাপক চারুচন্দ্র কলেজ, ও নটরঙ্গ থিয়েটার গ্রুপের পরিচালক) এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে নাটকের জন্য আর একটু বেশি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। লালু ও পলুর বন্ধুত্ব আরও বেশি করে জমে উঠেছে কারণ দুজনেই কলকাতায় পড়াশোনা করেন এবং নাটক ভালোবাসেন। লালুদা কিছুটা সিনিয়র। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়দের 'যুবসভা ক্লাব'-এ তখন নাটকের রেওয়াজ হচ্ছে সেখানে আছেন স্বয়ং সৌমিত্র। সঙ্গে ভগবান গাঙ্গুলী লেনের অমিয়কান্তি ব্যানার্জী ও শঙ্কর ব্যানার্জী। বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশনের ( শিক্ষক ) বিশ্বনাথ দত্ত। আড্ডাখানার স্থান সন্ধ্যাবাজারের চায়ের দোকানে। এরা সকলেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পরবর্তীতে।
•এখানে প্রসঙ্গত একটু অন্য আলোচনায় আসি। স্বাধীনতার আগে হাওড়ায় সুভাষচন্দ্র এসে, নীলমণি মল্লিক লেন ও এম সি ঘোষ লেনে ফরওয়ার্ড ব্লকের যে ভিত খুঁড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তা হাওড়ায় তখনও অক্ষুন্ন আছে। ফরওয়ার্ডব্লক আশ্রিত হাওড়া সঙ্ঘ ক্লাব তখন হাওড়ার সংস্কৃতির পিঠস্থান। তখন হাওড়ায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক বিশাল নেতা বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায় আছেন। এদতসত্ত্বেও কিছুমাত্র নড়ানো যায়নি হাওড়া সঙ্ঘের সদস্যদের। তাই পাশেই কংগ্রেস তৈরি করলো হাওড়া উদার সঙ্ঘ ক্লাব। নাট্যকার তখন যুবক জগমোহন মজুমদার সেখানে নাটক করা শুরু করলেন তিনি, কংগ্রেসের ব কলমে --" ঠাকুর দা। " নাটক মহলা চলছে তাঁদের। এদিকে হাওড়ায় তখন 'হাওড়া সঙ্ঘ' উঠতি যুবকদের কাছে সংস্কৃতির পুরোযায়ী হয়ে উঠেছে, প্রেরণাস্বরূপ। এর মাঝে রাজনৈতিক দলের ছত্রাছায়ায় না থেকে সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়রা পঞ্চাননতলায় নতুন নাটকের মহলা শুরু করলো রবীন মন্ডল পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ( রবীন মন্ডলের মঞ্চ ভাবনা), তাদের নাটকের নাম --"সধবার একাদশী। " সম্ভবত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখানেই প্রথম অভিনয় করেন। এই দলের পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুজনকেই দেখতে তখন উত্তমকুমার একেবারে। পার্বতী দাকে তো আরও সুন্দর দেখতে। বহু আগেই শুনেছি জগমোহন মজুমদারদের সেই নাটকের মহলাকক্ষে, হাওড়া উদার সঙ্ঘ ক্লাবে এলেন শুভেচ্ছা জানাতে রবীন মন্ডল, সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়রা। তখন থেকেই রবীন মন্ডলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুরু হলো জগমোহন মজুমদারের। পরে রবীন মন্ডল এঁকে দিলেন নটনাট্যমের লোগো এবং মঞ্চ ভাবনা।
•প্রকৃতপক্ষে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতার ওকালতি ছেড়ে হাওড়ায় রেলের বড় চাকরি নেওয়ার কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই স্কুল জীবন শেষ করেন। বোর্ডের পরীক্ষার সিট পড়েছিল আজকের অক্ষয় শিক্ষায়তনে অর্থাৎ তখনকার হাওড়া রিপন স্কুলে। তিনি হাওড়া থেকেই সিটি কলেজে পড়তে শুরু করেন। হাওড়া জেলা স্কুলের ১৫০ বর্ষ উদযাপনের সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০১১-তেও স্কুলে এসেছিলেন আবৃত্তি করে গেছেন প্রাক্তনীদের অনুষ্ঠানে জেলা স্কুলে।
অনেকে বলেন সালকিয়ার,গোলাবাড়ির রেলের নূন গোলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা অফিসার হিসেবে চাকরি করতেন এবং নূন গোলায় সৌমিত্ররা
থাকতেন। তবে এই প্রতিবেদক শুনেছিলেন তিনি থাকতেন হাওড়ার ফাঁসিতলার কলভিন কোর্টে রেলের অফিসার্স কোয়ার্টারে। কারণ স্কুল বয়েসেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পিতার সঙ্গে কালীবাবু বাজার আসতেন।
তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন তৎকালীন রিপন স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ( বর্তমান অক্ষয় শিক্ষায়তনে
পাশে উনি থাকতেন) মাধবকিশোর চক্রবর্তী।
•আগেই বলেছি, হাওড়ার পঞ্চাননতলা রোডের নাট্যকার অধ্যাপক,সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ( নটরঙ্গের ফজল আলী আসছে-এর ডিরেক্টর) ছিলেন কাছের বন্ধু। রামকৃষ্ণপুরে পুরনো বাটার দোকানের কাছে একটি চায়ের দোকানে যুবসভার আড্ডা বসতো। দুজনে মিলে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখতে যেতেন। সুশান্ত দা সৌমিত্রর থেকে কিঞ্চিৎ বড় ছিলেন। এখান থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শিশির ভাদুড়ীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এম এ পঞ্চম বর্ষে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। যাইহোক হাওড়ার এম. সি. ঘোষ লেনে পার্বতী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও ছোটখাটো আড্ডা ছিল তাঁদের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়ার অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতির কাছে রবীন-দার বাড়ি, পঞ্চাননতলা রোডে লালুদার বাড়ি, গোরাবাজারে পার্বতী দার বাড়িতে আকচার এসেছেন ও গেছেন। লক্ষ্মণ দাস লেনের মুখে পঞ্চাননতলা রোডে সামান্য কিছু দিন বসবাস করে গেছেন। এমনকি সালকিয়ায় শ্বশুর বাড়ি। অনেকে তাই বলেন সালকিয়ায় থাকার সময়ই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর আলাপ হয়।
•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সবে এম.এ পাশ করেছেন। ব্যাটমিন্টন খেলোয়াড় সালকিয়ার একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম শুরু হয়েছে। তখন হাওড়ায় আর থাকেন না। শিশির ভাদুড়ীর কাছে যেতে শুরু করেছেন এম. এ-শেষ বছর থেকে। বাংলায় এম. এ করছে শুনে শিশির ভাদুড়ী বললেন ,"বা বেশ।" এতদিন বাংলায় এম.এ-কে সকলে যাচ্ছেতাই করতো, সৌমিত্র মনে মনে ভাবলেন এই মানুষটার বলাতে ভরসা পাওয়া গেল। এতদিনে একজন সঠিক মানুষের দেখা পেলেন। সেই সময় একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন সৌমিত্র। আকাশবাণীর একটি ঘোষকের পদে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখা হলো অখ্যাত এবং থিয়েটারের সাইডরোলের অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হাজার জনের মধ্যে প্রথম হলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় দ্বিতীয় হলেন সৌমিত্র। চাকরি হলো অনিলের। সেই যে ইডেন গার্ডেন্সের ফুটপাতে সিগারেট খেতে খেতে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হলো সেই আলাপ চলেছিল অনিল চট্টোপাধ্যায়ের আমৃত্যু পর্যন্ত। পরে অনিল চট্টোপাধ্যায় টালিগঞ্জে যোগ দিয়েছিলেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। পরে নায়ক ও অভিনেতা। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই প্রতিবেদক একবার অনিল চট্টোপাধ্যায়ের একটি সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলেন তাতে অনিল চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন ও তপন সিংহকেই বাংলা সিনেমার আদর্শ পরিচালক বলেছিলেন। বলেছিলেন বাংলা সিনেমার উন্নতধারার এই দুই পরিচালক বাঙালি জীবনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন।
•পরবর্তীকালে শিবপুরে একটি ঘরোয়া আসরে রবীনদাকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হলো তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঘরোয়া আসরে দুজনের সখ্যতার গল্প ও ডালমিয়া পার্কে ঘাসের উপর শুয়ে হাওড়ায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কৈশোর ও কলেজর লাইফের কথা ও গল্প বলেছিলেন। কেউ কেউ বলেন তিনি থাকতেন হাওড়ার ফাঁসিতলার কলভিন কোর্টের রেলের অফিসার্স কম্পাউন্ডে ( অনেকে বলেন তিনি গোলাবাড়ি থানার কাছে নূনগোলা কোয়ার্টারে থাকতেন, যেহেতু তাঁর পিতা রেলের নূন গোলার বড় অফিসার ছিলেন)। চার্চ রোড, পুরনো হাওড়া ময়দান, পঞ্চাননতলা রোড, রামকৃষ্ণপুরে হেঁটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের হাওড়ার ধুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছেন এটা ভাবলেই আশ্চর্য হতে হয়। টাউন হলেও উপস্থিত হয়েছেন তখনকার দিনের সখের নাটকে। কলকাতায় চলে যাওয়ার আগে অন্ততপক্ষে ৭ বছর তিনি হাওড়ায় থেকে গেছেন খানিকটা অলক্ষ্যে। অনেক পরেও মৃণাল সেনের বাড়ির ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা ক্যালকাটা পেন্টার্সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীনদার দেখা হতো। রবীন দার ছবি দেখতেও এসেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রবীনদাও কয়লাঘাটে, রেলের অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে কলকাতা করপোরেশন থেকে পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা দেখতে। বহু আসরে দু-বন্ধু বোঝাপড়া করে উপস্থিত হয়েছেন কখনও। বিখ্যাত কলা সমালোচক ও কলকাতার প্রথম বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা অহিভূষণ মালিক রবীন দাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আনন্দবাজারে অহিভূষণ মালিকের টেবিলের চারপাশে বসে আড্ডা দিয়েছেন রবীন দা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পার্বতী মুখোপাধ্যায়। একদিন রবীন দা ছবি আঁকছেন আমি এই অধম, বসে তাই দেখতে দেখতে হাওড়ার পঞ্চাননতলার বাড়িতে সেইসব শুনছি। আমি পার্বতী মুখোপাধ্যায়ের স্নেহভাজন ছিলাম। উনি কংগ্রেস করতেন ওনার স্ত্রী ছিলেন ব্যাঁটরা বিবিপিসি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। পার্বতী দা কলকাতা করপোরেশনের বড় অফিসার ছিলেন এবং ছবি আঁকার একজন বিদগ্ধ আলোচক ছিলেন। পরে গড়িয়াহাটে ফ্ল্যাট করে পার্বতী দা চলে যান এবং লেক মার্কেটের সামনে আর্ট গ্যালারি করেন।
•হাওড়ার মেথর ইউনিয়নের লিডার অর্ধেন্দুশেখর বোসও ছিলেন কলকাতার পুরনো, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। আবার হাওড়ার 'যুবসভা'রও তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পুরনো বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন বলতে গেলে একসময় ছিল সংস্কৃতির চাঁদের হাট আর এখানেই অহিভূষণ মালিকের হাতেই ছিল শিল্পীদের উঠে আসার সিঁড়ি। সহকারী,পার্বতী মুখোপাধ্যায় এখানেই থেকেই হয়েছিলেন কলা সমালোচক, রবীন দা পেয়েছিলেন শিল্পীর উত্তরণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকে হাতেখড়ি। হাওড়ার অর্ধেন্দু বোস ও আনন্দবাজারের অহিভূষণ মালিকের হাত ধরে একপ্রকার সংস্কৃতির উত্থান হয়েছিল বলা যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন তার আর এক সহযোগী। আজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে সেই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তবে শুধুমাত্র জগমোহন মজুমদার এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর আরও থাকার দরকার।
•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্য অনেকবার বলেছেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে যখন কবি তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা সত্যজিৎ রায়কে প্রথম নাগরিক সংবর্ধনা দিলেন, তখনও সত্যজিৎ রায়ের কাছে পর্যন্ত যেতে পারেননি। চেনার কথা তো দুর। এমনকি কফি হাউসে সুনীল শরৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের টেবিলে তার কোনও স্থান ছিলনা। কফি হাউসে যাওয়ার জন্য কোনোরকমে বন্ধু নির্মাল্য আচার্যর মাধ্যমে একটা কার্ড জোগাড় করতে পেরেছিলেন। তখনও তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত
"এক্ষণ "-এর ভাবনা আসেনি। পরে যখন এক্ষণ প্রকাশিত হয় তার প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পর নির্মাল্য আচার্যর কাছে সত্যজিত রায়ের অনেক কিছু আসল আর্টওয়ার্ক ও পান্ডুলিপি থেকে যাওয়ায় পুলিশ যখন নির্মাল্য আচার্যর বাড়ি রেইড করে তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঝামেলায় থাকতে চাননি, কারণ নির্মাল্য আচার্য, সত্যজিৎ রায়ের কাছে পৌঁছনোর সেতু হলেও রায় পরিবারের জন্য আজ তিনি সৌমিত্র হতে পেরেছেন। এমনকি তিনি মাণিকদা বললেও নিজেকে পুত্রই মনে করতেন। তাই সত্যজিৎ রায়ের মরদেহ বাড়ি থেকে যখন বের করে নিয়ে আসা হয় নন্দনের পথে, তখন সিনে সেন্ট্রালের ছেলেদের সঙ্গে একই লরিতে একমাত্র ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই কাঁদো কাঁদো মুখের ছবি ইতিপূর্বে আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম।
• এবার একটা আমার ব্যক্তিগত একটা আনন্দের কথা। সেটা হলো আই. এ বি. এ পড়ার সময় তিনি যে হাওড়ার পঞ্চাননতলায় থাকতেন এবং রোজ যে কালীবাবু বাজারে বাজার করতে আসতেন সেকথা সৌমিত্র চ্যাটার্জী লিখে ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের ৭ জন অভিনেতার মধ্যে তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কেও লিখে গেছেন। তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন কালীবাবুবাজারে বাজার করেছি অথচ অত কাছে থেকেও তখন এত বড় মাপের অভিনেতা যে থাকতেন তখন আলাপ করতে পারিনি। ( সূত্র সৌমিত্র চ্যাটার্জীর লেখালেখি)
•সাংবাদিক #সুপ্রকাশকে ধন্যবাদ হাওড়ার কিছু সময় #এইসময়ে (১৬.১১.২০) তুলে ধরার জন্য। আমি এখানে আরও একটু সংযোজন করবো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিরিক্ষা সম্পর্কে। হাওড়ার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে সব থেকে ভালো তথ্য দিতে পারতেন অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিল্পী রবীন মন্ডল। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। উনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকে কিঞ্চিৎ বড় ছিলেন এবং উনিই সৌমিত্রকে নিয়ে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখতে যেতেন। সেই সময় সালকিয়ার ব্যাটমিন্টন খেলোয়াড় দীপা চ্যাটার্জীর সঙ্গে সৌমিত্রর প্রেম হয় নাটকের সুবাদে। অনেকে বলেন সালকিয়ার গোলাবাড়ির রেলের নূনগোলার অফিসার ছিলেন তাঁর পিতা, তাই হয়তো দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয়ে থাকতে পারে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়ায় মিশতেন অহিভূষণ মালিকের ভাবশিষ্য পার্বতী মুখোপাধ্যায়, ভারত বিখ্যাত পেন্টার রবীন মন্ডল ও কংগ্রেস নেতা বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ভাই বিমল চট্টোপাধ্যায়ের জামাই চারুচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ওঁনাদের আড্ডা ছিল রামকৃষ্ণপুর সন্ধ্যা বাজারে। এই থেকে বোঝা যায় তখন থেকেই তাঁর মেলামেশা পরবর্তীতে যারা বিখ্যাত হয়েছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেলামেশা ছিল সংস্কৃতির সঙ্গে। পরবর্তীতে একমাত্র শিল্পী রবীন মন্ডলের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি নিজে বলেছেন আমি স্কুলে পড়ার সময় থেকে কালীবাবুবাজারে যেতাম কিন্তু আলাপ হয়নি অত বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে। এই থেকে বোঝা যায় তিনি থাকতেন মধ্য হাওড়ায় ছোট থেকেই। সব মিলিয়ে ৭ বছর মতো ছিলেন। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সৌমিত্রর প্রথম মেন্টর ছিলেন বলা যায় ( সৌমিত্র সেকথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু নামটা উল্লেখ করেননি), শিশির ভাদুড়ীর কথা সেই যে কানে ঢুকিয়ে ছিলেন তারপর থেকে শিশির ভাদুড়ীর সমস্ত শো-য়ে তিনি গেছেন। তাঁর শেষ মঞ্চ অভিনয়ের দিন আলাপ করেন প্রণামের মাধ্যমে এবং প্রায় বাড়ি যাতায়াত শুরু করে দেন এম. এ পড়ার শেষ বছর থেকে। তারপর সকলে জানেন শিশির ভাদুড়ী সম্পর্কে তাঁর বিস্তৃত লেখালেখি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাত্র সাতজন সর্বভারতীয় অভিনেতাকে নিয়ে নানাভাবে লিখেছেন। বলরাজ সাহানী থেকে তুলসী চক্রবর্তী।
কালীবাবুবাজারে তুলসী চক্রবর্তী একটা ময়লা সাধারণ গেঞ্জি বা কখনও ফতুয়া পরে ও ভাঁজকরা ধুতি পরে বাজার করতেন সেকথা তার অবজারভেশন থেকে পাওয়া যায়। আলু পটল দোকানি ও মুটে ওলাদের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তীর রঙ্গ-রসিকতাগুলো তিনি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ভাবে, পরে বিভিন্ন আলোচনায় তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ণ হাওড়ায় আজ পর্যন্ত কেউ করেছেন বলে আমি দেখিনি। ভানু-জহর বিশেষ করে অনিল চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে তিনি ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন।
•পড়ার পাঠ চুকিয়ে যখন আকাশবাণীর একটি ঘোষক পদের এক হাজার জনের মধ্যে ইন্টারভিউ দিয়ে দ্বিতীয় হন তখন প্রথমজন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ এবং সেই আলাপ চিরস্থায়ী ছিল দুজনের। যখন শতরূপা দি-র বাবা অধ্যাপক তরুণ সান্যাল সাধারণ খ্যাত সত্যজিৎ রায়ের সংবর্ধনার আয়োজনে ব্যস্ত এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কজনকে জড়ালেন এবং পরে আরও অনেকে যুক্ত হলেন তখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কফি হাউসে, নিতান্তই ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মতো বন্ধু নিয়ে আলাদা বসে থাকেন এবং শিশির ভাদুড়ীর ভাবশিষ্য হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। ©® অলোক কুন্ডু।
( সূত্র : প্রয়াত পার্বতী মুখোপাধ্যায়, প্রয়াত রবীন মন্ডল, নাট্যকার জগমোহন মজুমদার, বন্ধু অশোককৃষ্ণ দাস)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন