বড় শাড়ির শখ ছিল / অলোক কুন্ডু
রাজশাহী-রেশমি ঢাকাই-জামদানি
ব্রোকেট-জর্জেট-মাইসোর সিল্কে
তার মা কে দারুন মানাতো।
ক্লাস ইলেভেন যখন
মা বলতেন--এখন থেকেই শাড়ি পরবি রে ?
কলেজে উঠলে সব নিয়ে নিস
মায়ের মুখ থেকে হরেক শাড়ির নাম শুনতে শুনতে
মুখস্থ করতো মেয়েটা
মা বলতেন আহা মেয়ের শখ দেখ ।
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
সেই থেকে শাড়ি দেখলেই
মেয়েটা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেত
এঘর থেকে ওঘরে।
ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনই পরে গিয়েছিল
মায়ের মুগা-মেখলাখানা
আর সেদিনই আলাপ হলো অমিতেশের সঙ্গে
আলাপ যত বাড়তে লাগলো
তত একটার পর একটা শাড়ি ভাঙে
কখনো আদিবাসী-উমারিয়া তো বিষ্ণুপুরী
আরানি-রেশম তো কখনো কাঞ্চিপূরম
পাইথানি-সিল্ক থেকে মসলিন
কোনোদিন ভাসতারা-কটন।
অমিতেশ শাড়ির খুঁট ধরে একটান দিয়ে বলতো
খুব যে সাজা দেখছি আজ
কারণ টা কি শুনি ?
কখনো ভাগলপুরী-কটনে কফি হাউসের হৈচৈয়ে
দুজনে চলে যেত নির্জনে
অমিতেশ ধরে রাখতো ইক্কতের খুঁট
অবাক তাকিয়ে বলতো
এত সেজে বুঝি কেউ পড়তে যায়
মেয়েটা বলতো, জানো সাহেব--
কাঁধের ওপর থেকে পিছনে
এই যে মস্ত ঝোলা দেখছো
ওই ঝোলায় তোমাকে বেঁধে রাখবো কিন্তু
অমিতেশ বলতো- বেঁধে রেখে দেবে তো এই আচ্ছা তথাস্তু।
দুবছরের সিনিয়ার অমিতেশ
আমেদাবাদ থেকে পিএইচিডি করে ফিরে
সটান এসেছিল দুপুরে তাদের বাড়িতে
সদর থেকে চিলেকোঠায় গিয়ে থেমেছিল
অমিতেশ বলেছিল চোখ বন্ধ কর উঁহু দেখবেনা
চুপিদেওয়া চোখে দেখেছিল সে --
লালপেড়ে গঙ্গাজল রঙের পাটোলা
সে কি দৌড়োদৌড়ি ছাদের ওপর
শাড়িটা পরিয়ে ছাড়লো শেষে
নীচে নেমে দরজা বন্ধ করে একছুটে আয়নায় গিয়ে দাঁড়ালো
পেছন পেছন এসে ঘোমটা তুলে অমিতেশ বললো
বা এত সুন্দর তো কখনও দেখিনি
ঘন্ট শুক্তো মাটনের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে চলে গেল অমিতেশ।
বাবা বলেছিলেন শাড়িটার নাম যেন কী
মা যুগিয়ে দিয়েছিলেন - পাটোলা
বাবার মুখ থেকেই প্রথম শোনা
গুজরাটের পাটনে এই পৃথিবী বিখ্যাত শাড়ি তৈরি হয়
বাবা জিজ্ঞেস করেননি দাম
বিশ হাজার টাকা দামের স্টিকারটা
সে আগেই তুলে ফেলছিল
শাড়ি পাগল মেয়েটা শাড়িটার যত্ন করতো বটে
মা বলতেন ওটা আর কবে পরবি বলতো ?
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার।
প্রতি বছর পুজোতে মা বলতেন
আমার কেনা শাড়ি তো তোর পছন্দ হবেনা
মেয়ের আমার বড় নাক উঁচু।
কত বছর যে চলে গেল
তারপর কে জানে
অমিতেশের চিঠিগুলো জুড়ে জুড়ে
মস্ত একটা আঠারো ফুট সম্বলপুরী
বা পচমপল্লীর পৈঠানী
কিংবা বারো হাত বোমকাই হয়ে যেতে পারতো।
শেষে একদিন টরেন্টোর অলিভ অ্যাভিন্যু থেকে
চিঠি আসা একবারে বন্ধ হয়ে গেল
পাটোলাটা জীবনে দ্বিতীয়বার কখনও ছোঁয়া হলোনা আর।
অমিতেশের ঘামলাগা শাড়িগুলো
আর কোথাও পরে যেতনা ইদানিং
আলমারির থাকে থাকে
বেঙ্কটগিরি লুগালে গাদোয়াল ক্লাসিকেট
চান্দেরি কটাদরিয়া ঢাকাই-জামদানি
বলরামপূরম মঙ্গলগিরি শান্তিপুরি বাঁধনি
বেগমপরি কাঞ্জিভরম কটকিগুলো
আর ভাদ্রমাসের রোদ দেখতে পেত না।
মা বললেন, বর আর পছন্দ হয়না
শেষে বাবাও বলতে শুরু করলেন --
মেয়ের আমার ভীষণ নাকউঁচু
প্রথম প্রথম লুকিয়ে চোখ মুছতো
এইভাবেই দুটো বছর
তবু আশা ছাড়েনি মেয়েটা
গোঙানির কোনো শব্দ কেউ টের পাইনি তার।
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
বড় বরেরও শখ ছিল মেয়েটার।
দ্বিতীয় পক্ষের বলে বাবা মা রাজি হননি কিছুতেই
শেষে জোর করে রাজি হয়ে গেল নিজেই
বললো আমার তো অপছন্দ হইনি
তোমাদের এত আপত্তির কি আছে বলোতো।
একটা লাল রঙের কাতান বেনারসীতে
ভারি মানিয়েছিল মণিকুন্তলাকে
হুল্লোড় করতে বন্ধুরাও এসেছিল দল বেঁধে
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল।
ফুলশয্যার রাত কাটলে
বাড়ির সকলের সঙ্গে মিশে গেল সে
সেদিনই সুশোভন খুলে দেখালো একটা আলমারি
আলমারিটায় শুধু সার সার শাড়ি আর শাড়ি
তাকে তাকে পারফিউমের সুগন্ধি লেগে আছে
যতক্ষণ শাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল
ততক্ষণ এক হাতে সুশোভনের পাঞ্জাবিটা
চেপে ধরে রেখেছিল।
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে
শাড়ির সব নাম মুখস্থ করেছিল।
আলমারিভর্তি কলমকারী ধনিয়াখালি কলাক্ষেত্র শোলাপুরি ভেঙ্কটগিরি তাঞ্চোই বালুচরি
কড়িয়াল-বেনারসি কিমেরা-সুনোঢ়ি ওভেন পাট্টু
নৌভরী নারায়ণপেট কোসা সিল্কের মতো
শাড়ি গুলোর নাম বলতে লাগলো একটা একটা করে
শাড়ির পাহাড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো
একটা গঙ্গাজল রঙের লালপেড়ে।
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা।
যে গোঙানিগুলো এতদিন শব্দ করেনি
যে কান্নাগুলো লুকিয়ে যেত চটপট
যে কষ্টটা গলার কাছে আটকে থাকতো
আজ তা আর সামলানো গেলনা কিছুতেই
কোনোরকমে আলমারিটা বন্ধ করে
পিঠ দিয়ে দরজা বন্ধ করলো
এই প্রথম হ্যাঁ এই প্রথম ভেঙে গেল বাঁধ
সুশোভনের মুখের দিকে তাকালো একবার
সুশোভন কিছু জানতে চাইলো না
দু হাতে গাল ধরতেই
মেয়েটা বুকের পাঞ্জাবি আঙড়ে ধরলো দুহাতে
গোঙানিগুলো ততক্ষণে কাঁন্নার শব্দে বাঁক নিয়েছে
সুশোভন অস্ফুটে কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল
সুশোভন টের পাচ্ছে পাঞ্জাবিটা ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে
মণিকুন্তলা ফুঁপিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে
সুশোভন নীচু স্বরে বললো কুন্তলা কি হয়েছে
মেয়েটা মাথা নাড়তে শুধু।
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা।
©® অলোক কুন্ডু ⛔
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন