বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০

শতবর্ষে ছাপচিত্রি শিল্পী হরেন দাস : অলোক কুন্ডু






⛔ শিল্পী হরেন দাস : অলোক কুন্ডু

(১) 🎨 • ইউরোপ ও পৃথিবীতে অষ্টাদশ শতককে দিগদর্শনের দশক বলা যেতে পারে। যেখানে মুদ্রণ শিল্প ও ছোটগল্প থেকে কল্পনা নির্ভর অবাস্তব রোমান্টিক কাহিনীর উদ্ভাবনার কাল বা আঁতুড়ঘরের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় শিল্পকলার বিস্তার ও উদ্ভাবন তারও আগে। শিল্পকলার মন্ময়তার কথা বলতে গেলে পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলতে গেলে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রভাব আলোচনা করতে গেলে ইউরোপের প্রভাব ফেলে দেওয়া যায়না। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা সর্বোপরি পেন্টিং সম্পর্কে বলতে গেলে ইউরোপীয় অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ছাপচিত্র আবিষ্কার হয় অষ্টম শতাব্দীতে, চীনে। ভগবান বুদ্ধের বাণী ও ছবি আজ্ঞা ও উপদেশ গ্রথিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছাপচিত্র আধুনিক হয়ে মাথা তোলে, টেকনোলজির সাহায্য নেয় জাপান, স্পেন জার্মানিতে। আমাদের দেশে ১৫৭৯-এ কেরালার খ্রীস্টানদের কাছ থেকে যীশুর ছবি ও বাণী ভারতে ছাপচিত্রের প্রচার পায়। ১৮১৬ সালে সমগ্র বাংলাদেশে অন্নদামঙ্গল কাব্যে ছাপচিত্রের গরিমা মানুষ বুঝতে পারে এখানে। ১৮৫৩ সালে কলকাতার বউবাজারে বটতলার বইয়ে ছাপচিত্রের আকাশে নক্ষত্র সমাবেশের আয়োজন দেখা যায়। উত্তর ও মধ্য কলকাতা জুড়ে শিল্পী ও কর্মকার ছুতোর সম্প্রদায়ের জোটবদ্ধতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে শিল্পীরা নিজেরাই লোক শিল্পীদের মতো করে নিজেদের শিল্প গড়ে নেয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা স্টুডিওতে (১৯১৬) মুকুল দে ছাপচিত্রের চর্চা শুরু করেন ( উল্লেখ্য মুকুল দে আইনস্টাইনের দু ঘন্টা ধরে পোট্রেট করেছিলেন।)

(২) 🎨• অবনীন্দ্রনাথের নতুন চিত্রধারণার বিরুদ্ধে ধিক্কার বিস্তৃত হচ্ছে এখানে। অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথের নামকরণের দ্বারাই প্রবাসীর উন্মোচন হচ্ছে। মর্ডান রিভিউতে " সীতা " ছেপে বের হচ্ছে সঙ্গে ভারতীয় শিল্প সুষমার একনিষ্ঠ প্রচারক এক আইরিশ যুবতীর ( নিবেদতা ) প্রশংসিত বিবরণ থাকছে সঙ্গে। বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভে ১৯০১-এ জাপানি চিত্রকর ওকাকুরা কাকুজো এলেন জাপানি ওয়াস পদ্ধতি নিয়ে। শিল্পের সংস্কারবাদী চিন্তাধারার প্রয়োগ এবং ঔপনিবেশিক বিস্তারবাদের নকল ও অনুকৃতি ধারাকে রুখে দিয়ে ভারতীয় ধারার সংস্কার সাধন করে ভারতীয় বোধের পুনুরুত্থানে এগিয়ে এলেন আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ,ই.বি. হ্যাভেল। তিনি অবনীন্দ্রনাথকেই ভারতীয়ত্ব ধারার পথপ্রদর্শক রূপে চিহ্নিত করলেন। হ্যাভেল চলে যেতে আর্ট স্কুল থেকে বিদগ্ধ ছাত্র নন্দলাল, অসিতকুমার হালদারদের নিয়ে (১৯১৫) বেরিয়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথ। খুললেন ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি। দক্ষিণে রবি বর্মার ইউরোপীয় ঘরানার ভারতীয় মিথ ও পুরাণের পুনর্জন্ম শুরু ঘটে গেছে। অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরে রাধাকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ওমর খৈয়াম উঠে এলো। ঈশ্বরী প্রসাদের মতো মাটি থেকে উঠে আসা পাটনা ঘরণার শিল্পী ও শান্তিনিকেতনের রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো ছাপচিত্রি আর্ট স্কুলের নতুন দলকে আবিষ্কার করলেন। এই
সবকিছু হরেন দাসকে উদগ্রীব ও উৎসাহী করে তুললো। ১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংয়ের উপর জোর দেওয়া হলো, তারপরও তার প্রভাব পড়লো। ভারতে তখন শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাব। কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের উদ্যোগপর্বে সেই অন্ধকার অনেকটা কেটে যায়।

(৩) 🎨• ১৯০১ সরকারি আর্ট স্কুল। ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ শাসনে, উৎপাদন নির্ভর সৃষ্টি করার উপর জোর। প্রভূত্ববাদ ঘিরে ফেলেছে চতুর্দিক। ভারতের বাইরে, গৃহযুদ্ধের পরিবেশ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এখানে আমাদের উপনিবেশ ও ইংরেজ শাসনে দেশীয় জনজীবন প্রাণান্তকর, যন্ত্রণাকাতর। মুৎসুদ্দি, ফড়ে, বনিয়া সামন্ততান্ত্রিক স্থানীয় জমিদার রাজাদের অস্থিরতাময় অভিভাবকত্ব ও স্বজন-পোষণ ঘিরে ফেলেছে নাগরিকদের মনোজগত। শাসনের অমার্জিত জাঁতাকলে পড়ে এদেশের সামাজিক অবস্থান দিশেহারা। বিশ্বযুদ্ধের তটস্থতা, ভয়াল মন্দতা একদিকে। অন্যদিকে একের পর এক নিরাশাবাদীতা নিয়ে বাঙালি জীবনযুদ্ধ জারি রেখে ক্ষীণভাবে অগ্রসর হচ্ছে। বঙ্গভঙ্গ, স্বাধীনতা আন্দোলন, চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দা। এইসব মিলেমিশে বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের এক প্রাণান্তকর অবস্থা। পারিপার্শ্বিক সমাজ চেতনায় নানা জটিলতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে মহা-মন্বন্তর ও দুর্ভিক্ষদশা এবং গণমৃত্যুর বিভীষিকায় নাগরিক দুর্দশা মানুষের চিন্তা চেতনায় বিকাশের বদলে ঘাটতি শুরু হয়েছে। ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ যুগের শিল্প রীতির পরিচর্যায় (১৭৫৭-১৯৪৭) বৈদেশিক শাসক শ্রেণির রুচি প্রভাব পড়তে শুরু করলো ভারতের ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক চিন্তা ভাবনায়। ভারতে পাশ্চাত্য ধারার ছবি আঁকিয়েদের আগমনে পুরোদস্তুর সংঘাতময় শিল্পের এক ঘরানা এদেশে সৃষ্টি হলো। ইউরোপীয় শিল্পচিন্তার বদলে যা অনেকটা ইংল্যান্ডীয় অনুকরণ। ঠিক সেইসময় শিল্প ও শিল্পতত্বের সন্ধানে তখন কলকাতার নামডাক শুরু হলো। ইংরেজরা তাদের প্রয়োজনেই ভারতের চারটি স্থানে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল আর্ট স্কুল খুলে দিলেন। শৌখিন কারুশিল্পের মর্যাদা ও সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলাকে অস্বীকারের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ভাবা শুরু হলো ঘর সাজানোর পদ্ধতি। জ্ঞান ও রুচিবোধ কিছুটা বাড়লো জমিদার বাড়িতেও। আলোছায়ার সংঘাতময় বিন্যাস বিস্তৃত হলো। জাপানি ওয়াসপদ্ধতিও এলো কলাভবন হয়ে। অজন্তা, কাপড়, রাজপুত ও মুগল যুগের শিল্পের সঙ্গে বিলিতি আধিপত্যর সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান ক্রমশ বাড়তে থাকলো। আর্ট কলেজের শিক্ষায় হান্টার সংযুক্ত করলেন প্রকৃতিবাদী শিক্ষা। সনাতন শিল্পশৈলীর প্রভাবকে হান্টার সুযোগ করেদিলেন। ভারতীয় শিল্পের পুনর্জীবন ঘটলো।

(৪) 🎨• অবশ্য এই সময় ভারতের ঊনিশ শতককে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাহেবদের অবদান অনস্বীকার্য। কলাভবন ও বেঙ্গল স্কুলের জনপ্রিয়তায় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ছাত্রদের মধ্যে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকায় ছাত্রদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। ইউরোপীয় নানা ঘরাণার সঙ্গে জাপানি ওয়াস পদ্ধতি জেনে নিতে চাইছে নবীন ছাত্রদল। অবনীন্দ্রনাথের ভারতীয় নস্টালজিক স্টাইলাইজেশনে সৃষ্টির নব উন্মোচন হলো। অনুপম সৌন্দর্যবোধে আকৃষ্ট হলেন ছাত্ররা। উন্মোচন হয়েছে অবনীন্দ্রনাথের নতুন শিল্পরীতির । জাতীয়তাবাদী ভূমিকা ছবি আঁকায় ছায়া ফেললো। রাজপুত, মুগল আমলের রীতিনীতি, কাঁঙড়া শিল্প রীতির কারুকাজ, পারসিক, জাপানি, তিব্বতী জাপানি ছাপাই ও ওয়াসপদ্ধতি মিলেমিশে ভারতের প্রাচীন শিল্প ভেঙে
তৈরি হলো শিল্পের সমাবেশ।

(৫) 🎨 •আমরা যারা ছবি আঁকার সঙ্গে পরিচিত তারা সকলেই জানি শিল্পী হরেন দাস তাঁর শিল্পকৃতি নিয়ে অমর হয়ে আছেন। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস শিল্পী হরেন দাসের নাম ৯০ ভাগ ভারতবাসী শোনেন নি। যদিও একসময়ে কলকাতার জি.সি.লাহা-য় পাওয়া যেত হরেন দাসের ছাপচিত্রের বই। যদিও আর্ট কলেজের ছাত্রদের কাজের সুবিধার জন্য হরেন দাস সামান্য দামে ওই বই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তবুও শিল্পীকে বহু মানুষ এখনও চেনেন না। এই না জানাটা আমাদের কাছে খুবই লজ্জার এবং দোষের। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবে এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে যে একজন সামান্য রাজনৈতিক নেতা এখানে যত খ্যাতি পেয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বদের তত সম্মান জোটেনি। হরেন দাসকে জানতে চাইলে আপনারা এখন আমাজন থেকে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ছাপচিত্রের সম্ভারগুলির বই (১৯৪৫-১৯৯০) সংগ্রহে রাখতে পারি। প্রিন্ট মেকিং শিক্ষণীয় বিষয়ের ছাত্রদের অবশ্যই তা সংগ্রহ করার মতো।

(৬) 🎨• এমনিতেই ১৯২১ আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক সময়। যদিও ১৯১৯ থেকে শান্তিনিকেতনে
রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে অসিতকুমার হালদারকে প্রধান করে আঁকাআঁকির পর্ব চালু হয়েছিল তবু ১৯২০-তে নন্দলাল বসুর সেখানে যোগদান ও ১৯২১ থেকে কলাভবনের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায় ১৯২১ এ জন্মগ্রহণ করে ১৯৯৩-এ প্রয়াত হন। হরেন দাসও (১৯২১-১৯৯৩) তাই। কিন্তু কেউ বড় একটা হরেন দাসকে আজও চেনেন না। অবশ্যই দুজনের এখানে তুলনা টানবার জন্য এই লেখার অবতারণা নয়।

(৭) 🎨• হরেন দাস একজন স্বনামধন্য ভারতীয় চিত্রকর। প্রধানত ছাপচিত্রির পরিচিতি নিয়ে তাঁর সৃষ্টির ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি বন্দিত হয়েছে। কাঠ খোদাই, লিনোকাট, এইচিং। ছাপচিত্রের সমূহ প্রক্রিয়ায় তিনি একজন লিথোগ্রাফের মাষ্টার পেন্টার হিসেবে ভারত ছাড়াও জাপান, জার্মানি, চিলি, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড ও আর্জেন্টিনাতেও আলোচিত হয়েছেন। যদিও বাটালি, নরুন, হাতুড়ি নিয়ে উডকাট বা কাঠখোদাই করে তার শিল্পরূপগুলি প্রকাশিত করেছেন এবং তাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বিদ্যাসমূহের প্রকাশভঙ্গি থেকে তিনি সচেতন ভাবে কাঠখোদাইয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেছিলেন। ছাপচিত্রের ক্রিয়াকৌশলে ঋদ্ধ এবং কাঠখোদাইয়ের একজন দক্ষতম কারিগর-শিল্পী তিনি। এক অনুপঙ্খ নিরীক্ষার মাধ্যমে তা অর্জন করেছিলেন। ছাপচিত্রের একজন মেধাবী চিত্রি হিসেবে, শিল্পী হরেন দাস সেই অনুপঙ্খ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যা একরকম বিরল। তিনি নিজের জাত চিনিয়ে গেছেন তাঁর মৌলিক সৃষ্টির মায়ামুগ্ধতার দুয়ার খুলে দিয়ে।

(৮) 🎨• বিষয় নির্বাচন, ড্রইং, ট্রেসিং, খোদাই, প্রিন্টিং
ও স্টাইল এই ৬ টি বিষয়ে সমান দক্ষতা ছাড়া একজন বিরল ছাপচিত্রি হওয়া যায় না। হরেন দাস ছিলেন সেই উচ্চাঙ্গের শিল্পী। ছবি তৈরির আর্থিক ভার কমের কারণে একসময় লোকশিল্পের সঙ্গে খোদাই শিল্পী ও শিল্পের পরিচিতি গড়ে ওঠে। নকশা অলঙ্করণ, অলঙ্কার, গৃহসজ্জায় এই শিল্পীদের কদর বেড়ে যায়। ইউরোপে এই শিল্পের পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে ছাপাই ছবির দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। বইয়ের ছবি ও ফটোগ্রাফ প্রিন্ট থেকে একটি চিত্রের একাধিক সংস্করণের কারণে মধ্যযুগে ছাপচিত্রের বিস্তার ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বেড়ে যায়, আসে ইনটাগলিও পদ্ধতি। কখনও জলরঙের ওয়াস দিয়ে চতুর্থস্তর হয়ে ওঠে আরও মোহময়। ছাপচিত্রকে বলা, 'শূন্যতার জয়।' ইংরেজিতে বলা হয় "ডেলিকেট ট্রানপারান্সি।"
আদিম যুগ থেকে ছাপচিত্র মানুষের সঙ্গী হয়ে থাকার জন্য আজও এই শিল্প ব্যতিক্রমী হলেও তা উঠে যায়নি। হরেন দাস মাল্টিকালার ইম্প্রেশনে আপন দক্ষতার শীর্ষদেশ অতিক্রম করেছিলেন। প্রত্যেকটি রঙের জন্য মূল অঙ্কনকে সতন্ত্রভাবে বিচ্ছিন্ন করে পুণরায় একসূত্রে গ্রথিত করার মধ্য দিয়ে যে মধুর ব্যঞ্জনা, যে সঞ্চার, যে ধ্বনির সৃষ্টি করেছিলেন, সতন্ত্রভাবে ব্লকের ব্যবহার করেছিলেন তা আমাদের অবাক করে বইকি।

(৯) 🎨•হরেন দাস যখন শিল্পকলা চর্চায় ছাত্র হয়ে দিনাজপুর থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে এলেন তখন এবং তার বহু আগে থেকেই দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপ ও ভারতবর্ষ জুড়ে নানাবিধ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষন্নতা দেখা দিয়েছে। এখানকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও প্লেগ-ম্যালেরিয়া মহামারীতে জনজীবন প্রায়ান্ধকারে নিমজ্জিত। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই দুঃখের সঙ্গী। আরও বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে জনজীবনে হতাশা নেমে এসেছে তখন।

(১০) 🎨• হরেন দাসের শিক্ষা এখান থেকেই পরিপূর্ণতা পেল। তার ছাপচিত্র ইউরোপীয় ও জাপানি ধারায় আত্মীকরণ করলো। পরম মোহনীয়তাকে তিনি করলেন বিষয়বস্তুর মূল উদ্ভাবনী শক্তি। উৎকৃষ্ট উৎকীর্ণ পদ্ধতিতে তাঁর শিক্ষা এতটাই নিবিষ্ট হলো যে তাকে উৎকর্ষতার বিচারে সৌন্দর্য নির্মাণের দিগদর্শন বলা হলো। ওয়াটার,অয়েল,গুয়াস,ওয়াস পেন্টিং, কালীঘাট চিত্রকলা, পুনর্জাগরণবাদী অগ্রগতি,
পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে অনুপ্রাণনা। সংস্কারবাদী মনোনয়ন। এই সমস্ত মিলে শিল্পীর যুবা মনে বাছাই পর্বের অবতারণা শুরু। বিভিন্ন ভাবের সঞ্চারে তাঁর মনে বিচিত্র চিত্র ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু
এতকিছুর মধ্যে তিনি তার শিক্ষাগুরু কলাভবনের
রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকেই আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁর কাছেই শেখা শুধুমাত্র সাদাকালো নয় ছবির শূন্যতার বিভাজনে ছবিতে ঢালতে হবে আরও
রঙ, জীবনের রঙও। অবশ্য হরেন দাসের পূর্বসূরীদের সময় থেকেই শিল্পীরা নতুন ভাবে সাহস উদ্ধার করতে পেরেছিলেন এখানে। কারণ ইতিমধ্যেই জাপানে, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে ভারতীয় চিন্তাধারার চিত্রকলা ধিকৃত হয়েছে। সমালোচিত হয়েছে। বিষয়ের অস্পষ্টতা, শিল্পের মায়া ধরতে অক্ষম, ধর্মীয় চিন্তায় মগ্ন, কারুকার্য প্রিয়তা ও অপূর্ণতা এইসব সমালোচনায় ইংল্যান্ড, জাপান ও জার্মানিতে ধিক্কার পড়ে গেছে। সেই সমস্ত ঘেন্না ইতিমধ্যে মিটিয়ে দিয়েছেন অসিত হালদার, নন্দলাল বসু ও হরেন দাসের গুরু রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরা।

(১১) 🎨• আমাদের পক্ষে তাঁর গুণাগুণ বিচারে তাই কখনও স্পর্ধা দেখাতে পারি না। ছাপচিত্রের যে ৪/৬ প্রস্ত সমৃদ্ধ ব্যাকরণ থাকে বিখ্যাত চিত্রকর হরেন দাস তার প্রতিটি স্তরকে সন্নিবেশিত করেছেন তাঁর আপন ভালবাসা দিয়ে। নারী থেকে গ্রামগঞ্জের সরলতা, গল্পগাথা, যাত্রাপালার আলো আঁধার, প্রামাণ্য বাস্তব গ্রামীণ জীবন ও জীবিকা তুলে এনেছেন। নিজের দেখা গ্রামীণ ঘটনা প্রবাহকে মনোমুগ্ধকর ভাবে চিত্রিত করেছেন। গ্রামীণ শ্রমের মর্যাদাকে যে দক্ষতা দিয়ে, ললিতকলার সমধিক ভাব বিন্যাস সৃষ্টি করে তাকে ড্রইংয়ের পটুত্বের মহিমায় রঞ্জিত করেছেন শুধু তাই নয়, রঙ-রূপের ব্যঞ্জনার বৈভবে, বর্ণ বিভাজনের মুন্সিয়ানায়, বর্ণময়তার শুদ্ধতায়, শিল্পকলার সমূহ সম্ভার ঢেলে দিয়েছেন। ঐতিহ্যমন্ডিত শিল্পরীতির প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর প্রতিটি সতন্ত্র সজ্জায়। ট্র্যাডিশনাল প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার না করার সিদ্ধান্ত তাঁকে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অনাবিল সৌন্দর্য রীতিগুলি দাঁড় করানোর নান্দনিক চিন্তায় তিনি যে জাপান ও ইউরোপীয় আধারে আবদ্ধ থাকেননি, তা তাঁর পূর্বাপর সমস্ত প্রতিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আকারপ্রকার চয়নে তার মনোজগতের নান্দনিক রস ফুটে উঠেছে। কখনও দুরন্ত সাহসী অভিযান নেই তাঁর মধ্যে। অভিযোগের বার্তাবহন নেই, বিতর্ক নেই,
নগ্নিকার আবির্ভাব নেই। ছায়া প্রচ্ছায়ার সৃষ্টিতে কল্পনাশক্তির অনবদ্যতা লক্ষ্য করার মতো । লৌকিক ভারতীয়তাকে সঙ্গী করেছেন জীবনের বাস্তববোধ থেকে। পাশ্চাত্যর আধুনিক রীতির সমন্বয় রক্ষা করেছেন, মিশিয়ে দিয়েছেন ইউরোপ জাপান ও কলাভবনে তাঁর গুরুর শিক্ষাকে। মগ্নচেতনার মুগ্ধতাগুলি দিয়ে মণিমুক্তোর মতো তৈরি করেছেন তাঁর ছবির পটগুলিকে যা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় এবং রচনার মৌলিকত্বে অহংকারি। সৌন্দর্য চেতনা শিল্পের মস্ত গুণ। শঙ্কা ও সংকটের গতিপ্রবাহ বুঝতে পারা শিল্পীর আরও বড় চেতনা। শিল্পের অক্ষয় উৎস্যকে উদযাপন করার মধ্য দিয়ে তিনি কোনও দুঃখবোধকে জাগ্রত করে প্রেক্ষাপট সাজাননি । শিরোনামে অভিহিত করার খুব প্রয়োজন থাকেনা তাঁর ছবিগুলিকে তবুও নাম তাঁর বুঝি এক ভূষণরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি বর্ণের সংঘাত সৃষ্টি নেই তাঁর ছবিতে। জীবিকা যে জীবনের মহানবস্তু, প্রান্তিক জীবন চর্চার অঙ্গ, এইসবকিছুকে তার স্বভাবসিদ্ধ আবেগে প্রাণঢালা অভিব্যক্তিতে হরেন দাস এক স্বপ্নের মতো আলোর আভার মধ্যে সমস্ত সারল্যে তা উপস্থাপিত করে গেছেন। সাধারণ মানুষের গণসংস্কৃতির ধারা আমাদের ভারতীয় ধারণায় হরেন দাস বিধিবদ্ধ করে গেলেন। দেবতারা ক্যালেন্ডার ও কাঁচবাধানো থেকে নেমে এসে কোথাও গণকৃষ্টির হাত ধরে হরেন দাসের যাত্রাপালায় হ্যাজাকের পূর্বাপর রঙিন আলো জ্বেলে দিলেন। ( ছাপচিত্রি সুশান্ত চক্রবর্তী হরেন দাসের অনলাইন প্রদর্শনী সার্থক হোক এই কামনা করি) ©® অলোক কুন্ডু।












কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...