শনিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০২১

কারা সরকার গড়বে : অলোক কুন্ডু


🌏 আপনি বুঝে নিন, এইবার কে বা কারা সরকার গড়তে পারেন : অলোক কুন্ডু

⛔ যতক্ষণ না কোনও নতুন দল কোথাও রাজ্য সরকারের আসনে না বসেন, ততক্ষণ যদি কেউ বলেন সেই দলটা খারাপ, সেই দল কিছুই করতে পারবে না এবং ওই নতুন দলের দ্বারা কিছু করা সম্ভবপর নয়। তখন আমরা খানিকটা হতভম্ব হয়ে যাই। রাজনীতি করেন না এরকম মানুষ কিছুতেই ওইরকম চাপানো কথা মানতে পারেন না, চাননা। এইরকম কথা খানিকটা অবান্তর প্রসঙ্গের মনে হলেও রাজনীতি করা লোকেরা ঘুরেফিরে ওটাই প্রমাণ করে ছাড়তে চাইবে যে নতুন দল কোনও কিছু করতে পারবে না। আর এইরকম আনাড়ি কথা অনেকবার শুনতে শুনতে আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়তে হয়েছে। কিন্তু দেখবেন যে কোনও নতুন দল প্রথম ৫ বছর সব সময় ভালো কাজ করবে, এইটা বাম রাজত্বকাল থেকে আমরা দেখে আসছি। 

⛔২০১১ সালে যখন তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল তখন আমি বর্ধমানে আছি। সেই সময় একদিন বর্ধমান ডি. আই. অফিসে বসে যে প্রশান্ত মুখার্জী আমাকে বলেছিল তৃণমূল কংগ্রেসের আয়ূষ্কাল মাত্র ছ'মাস পর্যন্ত যাবে, পরে দেখলাম সেই প্রশান্ত মুখার্জী বিদ্যালয় পরিদর্শক সমিতির সম্পাদক হয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেসের সাহায্য নিয়ে, সমিতির প্যাড ছাপালো তেরঙ্গা কালারে। সেই সময় বর্ধমান ডি. আই অফিসে গেলে, মুখে মুখে শুনতে পেতাম, ২০১২-র প্রথমেই পড়ে যাবে তৃণমূল সরকার। যদিও ওইসব রটনা রটিয়েছিল সিপিএমের লোকজনেরাই। পরে রাতারাতি তারা তৃণমূল হয়ে যায়। সে যাই হোক, এখন এ রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের দুটো টার্ম কমপ্লিট হওয়ার মুখে। ২০০৬-এ তো ২৩৫ আর ৩০ এমন কথাও শোনা যেত। ২০০৬-এ কেউ ভাবেনি তৃণমূল কংগ্রেস কখনও ক্ষমতায় আসতে পারবে! তখন কেউই জানতো না।

⛔ বিজেপি সম্পর্কেও সেই এক কথা শুরু হয়েছে। বিজেপি এলে পশ্চিমবঙ্গ শেষ হয়ে যাবে। কারা বলছে ? বলছে মূলত সেই বামপন্থীরাই। যারা ২০১১-তে বলেছিল তৃণমূল ২০১২-তে রাজ্য থেকে পালাবে, তাদের কেউ কেউ আবার বলেছিল তিনমাসও যাবেনা সরকারটা। আগে শুনতাম, বিজেপির একটা মাত্র দোষ ছিল। বিজেপি কম্যুনাল পার্টি। মুসলমান দেখলেই মেরে ফেলবে। এখন তার সঙ্গে জুটেছে বিজেপি তৃণমূল ফেরতদের নিয়ে দল, নিজের বলে কিছু নেই। তাই কি ? আসলে এই বঙ্গে বিজেপি বলে কিছু হয়না এটা একটা প্রচার মাত্র। কিন্তু ইতিপূর্বে আমরা দেখেছি অটলবিহারী বাজপেয়ীর সময়ে বিজেপির জন্যই এখানে তৃণমূলের শক্তি সঞ্চয় হয়েছিল। বিজেপি না থাকলে তৃণমূল হয়তো এইরকম ক্ষমতায় কখনও উঠে আসতে পারতো না। অটলবিহারী বাজপেয়ী নিজে , মমতা ব্যানার্জীর কালীঘাটের বাড়িতে এসে, ওই দলকে কতখানি মানসিক মদত দিয়েছিলেন কতখানি উজ্জীবিত করেছিল তা আজও ভোলা যায়না। তৃণমূলের যত না এম.পি হয়েছিলেন তখন, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিজেপি করেছিল তৃণমূলের জন্য। মন্ত্রী সভায় শতকরা হিসেবে ৭৫% গুরুত্বপূর্ণ রেলমন্ত্রী ছেড়ে দিয়েছিলেন তারা মমতা ব্যানার্জীকে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিজেপির যে এটা কতবড় আত্মত্যাগ যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। এই কয়েক বছরে সারাভারতে বিজেপি দল, নরেন্দ্র মোদীর জন্য যে বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নিয়েছেন অন্য কোনও দল হলে তা নিতেই পারতো না বোধহয়। তা ছাড়া বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহকে মাঝখানে রেখে জ্যোতিবাবুরা এবং বামপন্থী দল একদিন বিজেপির সঙ্গে ব্রিগেডে হাত মিলিয়ে ছিলেন কংগ্রেসকে কোনঠাসা করতে, এই কথা আজও সকলের মনে আছে। তাই বিজেপি শুধুমাত্র নতুন নয়। সাম্প্রদায়িক দলও নয়। বরং সাম্প্রদায়িক দল এই ছাপ মেরে দিয়ে, অন্যান্য দল তাকে মানুষের মধ্যে থেকে আলাদা করে দিতে চাইছে। এই যুক্তি কিন্তু পাবলিক মোটেই খেতে চায়না। এই কু-যুক্তি কিন্তু জনগণ যে কিছুমাত্র মানছে না তা জনসভায় বিজেপির ভিড় দেখলেই বোঝা যায়। এইসব দেখে ভাবতে হয় যে সেক্ষেত্রে অন্য দলগুলোর চরিত্র ঠিক আছে কিনা !? অবশ্য তা একমাত্র আগামী নির্বাচনেই বোঝা যাবে যে কংগ্রেস+ বাম জোট আব্বাস সিদ্দিকীদের ছাড়া এইবার দাঁড়াতে পারবে কিনা, ভোট পায় কিনা।

⛔ যদিও রাজনৈতিক বিতর্ক একটা আছেই যে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দল। এমন নয় যে এইদেশকে তারা মানে বিজেপি একদম চালাতে পারছেনা। এমনটা কখনও হয়নি। যা বলছিলাম বিজেপির সাহায্য ছাড়া তখন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের একলা চলো নীতি খুব একটা কার্যকরী করে তুলতে তৃণমূল তখন একদমই পারেনি। সেই সময় বিজেপির সাহায্য সঙ্গে না গেলে কংগ্রেসের সাহায্য ছাড়া এইভাবে তৃণমূলের টিঁকে থাকা তখন মুস্কিল হোতো, অসম্ভব ছিল। তখন কিন্তু কংগ্রেসের ফুল টিম অটুট ছিল। ২০০৭ এ যখন নন্দীগ্রাম আন্দোলন তখন কিন্তু প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি পর্যন্ত কংগ্রেসকে নন্দীগ্রামে আলাদা লড়তে বলেছিলেন। যদিও এখন সেই করুণ পরিস্থিতি তৃণমূল কংগ্রেসের হয়নি বলে ওইযুক্তি এখন কেউই মানতে চাইবেন না। যদি কংগ্রেস ২০১১-তে একসঙ্গে পথে না নামতো এবং মাত্র ৬৫ সিটে সোনিয়া গান্ধী রাজি না হতেন, তাহলে ২০১১-তে কি হতো, বলা খুব শক্ত ছিল। কারণ কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার ২০১১-এর নির্বাচনের সময় যেভাবে প্রশাসনিকভাবে সাহায্য করেছিল ও যেভাবে হেলিকপ্টার দিয়ে, বক্তা দিয়ে, সিআরপিএফ দিয়ে, যৌথ মিছিল করে যতখানি সাহায্য করেছিল তা এখন তৃণমূল সম্পূর্ণ ভূলে গেলেও খবর কাগজে সেইসব স্পষ্ট উল্লেখ আছে। এখানে কংগ্রেসের মৃত্যু ঘটানোর জন্য যে তৃণমূল অংশত দায়ী সেকথা সকলেই এখন স্বীকার করতে শুরু করেছেন। এমনকি তৃণমূলের এক সময়ের ঘোর শত্রু সোমেন মিত্র ও তাঁর স্ত্রীর জন্য তৃণমূল এমপি ও এমএলএ বিতরণ করে কংগ্রেসের ঘর ভেঙে দিয়েছিল।

⛔ পশ্চিমবঙ্গে এখন দুটি দল সম্পর্কে নানা বিরোধিতা করে প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের কথা উঠে আসছে। তার একটি দল হলো বিজেপি, দ্বিতীয় দলটি হলো আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট। এখানে দেখার যে বাংলার বিজেপি দলটার পেছনে একটা বৃহত্তম দলের কিন্তু সাপোর্ট আছে। কিন্তু আব্বাসের সেরকম কিছু নাই, পুঁজি নাই, একেবারে নিঃসঙ্গ দল। সবচেয়ে মজার কথা এই দুটি দলকে সাম্প্রদায়িক দল হিসেবে ইদানীং চিহ্নিত করছে সকলে। আবার বলতে গেলে সকলে নয়। করছে মূলত তৃণমূল। নব নির্মিত আব্বাস সিদ্দিকীর ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের সর্বোচ্চ নেতা একজন তরতাজা যুবক। তিনি একজন ধর্মীয় শিক্ষাগুরু হলেও তার বংশ পরিচয়ের কারণে তিনি গুরু হয়েছেন। এমনকি তিনি ডক্টরেট নন, অধ্যাপক নন, কবি-সাহিত্যিক নন। বলতে গেলে কিছুই নন। কিন্তু অসাধারণ ভালো বক্তা। তার সভায় তুমুল ভিড়। ধুলোমাখা কথাবার্তাকে জনতার কাছে অসামান্য করে পরিবেশন করতে পারেন। এই জন্য তার কোনও ভাষাজ্ঞান দরকার পড়েনা। স্বরযন্ত্রের ওঠানামা ও জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে যুক্তিবাদ ছড়িয়ে দেন সভায়। বক্তব্যের মধ্যে কোনও জ্ঞানগর্ভ কথা থাকেনা তার, কোনও এমন উদাহরণ থাকেনা যাতে করে তাকে মণীষাসম্পন্ন বলা চলে। কিন্তু বক্তব্যগুণ তার অসাধারণ। বলার টেকনিক তার একান্তই মৌলিক। সাদামাটা কথাকে কৌশল দ্বারা অনুপ্রাণিত করতে পারেন। জনসভাকে চুপ করিয়ে রাখতে জানেন। ফেসবুকে ফ্যান ফলোয়ার অনেক। মুখটা নির্মল হাসিতে ভরপুর হলেও নিজেকে কঠিন করতেও জানেন। সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলে আগামী দিনের মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার হবেন।

⛔ পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়ের একটা বৃহত্তম অংশ তাকে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছে তার এই বৃহত্তর অনুগামী হয়েছে মাত্র তিনমাসের মধ্যে। কোনও রাজনৈতিক দল যাতে না, আব্বাস গড়তে পারেন তার জন্য অনেক বাধা এসেছিল, মূলত তৃণমূল কংগ্রেসের কাছ থেকে। তার কাকা পীরজাদা ত্বহা সিদ্দিকী, যিনি মূলত এখন তৃণমূলের লোক। তিনি জনসভা করে আব্বাসকে
আক্রমণ করেছেন কিন্তু কিছু করতে পারেননি। 

⛔ আমরা জানি মমতা ব্যানার্জীর কাছেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যথেষ্ট পরিমাণে আছে। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের একটা বৃহত্তম অংশ মমতার সঙ্গে এখনও রয়েছে এবং এই কারণে গোঁড়া হিন্দুরা মমতার থেকে সরেও গেছেন। এই তোয়াক্কা তৃণমূল যে করেনা তা খোলসা করে দিয়েছেন তৃণমূলের ভোটকৌশলী পি.কে। তিনি বলেছেন ৩০℅ সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলিম ভোট তাদের কাছে আছে। মুসলিমদের বেশ কিছু অংশ কংগ্রেস ও সিপিএমকে এখনও চায়। যদিও তার সংখ্যা বেশিয়ঞয়, কমতে শুরু করেছে, সেই সংখ্যা আজ নগন্য। মালদা মুর্শিদাবাদের একচেটিয়া মুসলিম ভোট কংগ্রেসের কাছে আর পুরোপুরি নেই, তা ভাগ হয়ে তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএমেও চলে গেছে। এদিকে আদিবাসী মতুয়া ও বর্ডার এলাকার হিন্দু ভোট বিজেপির প্রতি আসক্তি থাকলেও এন আর সি-র কারণে
( সি.এ.এ) কিছু ভোট বিজেপির ইতমধ্যে ক্ষয় হয়েছে। যদিও বিজেপির হাতে ১৮ টা এম. পি আছে এখন এবং তারা জোটবদ্ধ হয়ে বিজেপির সঙ্গেই আছে। তাদের মধ্যে কোনও দোলাচল নেই। 

⛔ তৃণমূলের এখন সবচেয়ে বড় বিপদ, তাদের নিজ দলটাকে নিয়ে। প্রতিদিন দলটা ভেঙে
বিজেপির দিকে চলে যাচ্ছে। আজ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে তৃণমূল দলটি বুদ্ধিজীবী, গায়ক অভিনেতার উপর নির্ভর করে চলছে। আজও টালিগঞ্জ থেকে অভিনেতা অভিনেত্রী এনে দল ভরাট করতে হচ্ছে। এই দলটা মূলত চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য। এই একমুখী নির্ভরশীলতা কিন্তু রাজনীতির একেবারে ভুলপথ। এখান থেকেই যে স্বৈরতন্ত্র জন্মগ্রহণ করে কংগ্রেস ও বামপন্থীরা এবং বাকি বুদ্ধিজীবীরা তা বারবার সতর্ক করলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তা কখনও শোনেননি। উড়ে আসা লোকেদের দিয়ে শিখিয়ে পড়িয়ে রাজনীতি যে হয়না এই স্বতসিদ্ধতা তৃণমূল বুঝতে চায়না। এমনকি পাড়ায় পাড়ায় মুড়ি মুড়কির মতো কবি ও আবৃত্তিকার যে তৃণমূলের কেউ নন সেটাও তৃণমূল বোঝেনি। কারণ এইসব লোকের অধিকাংশ আবার ২০১২- র পর থেকে তৃণমূলে এসেছেন। যারা ২০১১ থেকে ছিলেন সেই ব্রাত্য বসু যোগেন চৌধুরীদের রাজনীতি না করলেও চলতো কিন্তু এমপি, মন্ত্রী হয়ে তারা রয়ে গেলেও তারা ঠুঁটো একরকম। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা নিজেদের পারেননি। ৭০/৮০ জন বুদ্ধিজীবীর মধ্যে কুনাল ঘোষ একমাত্র রাজনীতি বোঝেন খানিকটা, যদিও লোকটি চরিত্রগত ভাবে অসৎ এবং পশ্চিমবঙ্গের লোকের কাছে কুনালের কোনও গ্রহণযোগ্যতা নেই। তৃণমূলের বৃহত্তর অংশ এইসব অরাজনৈতিক লোকে ভর্তি। জনগণ এদের খুব একটা পছন্দও করেন না। দেখা গেছে মুনমুন সেন পর্যন্ত অনুকূল সময়েও জিতে আসতে পারেননি। তৃণমূলের রাজনৈতিক নেতারা সকলেই বয়ঃবৃদ্ধ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একক ক্ষমতায়নের ফলেই যে খানিকটা তাদের বিপর্যয় ঘটেছে, হয়তো তারা বোঝেন কিন্তু তাদের শিরদাঁড়া আর সোজা করার মতো পথ তাদের আর জানা নেই। সকলেই তারা নৈবেদ্যর সন্দেশের মতো হয়ে গেছেন। তাদের ধার নষ্ট হয়ে গেছে। সৌগত,সুব্রত সুদীপের দ্বারা আর কিছু করার নেই। কল্যাণ এই দলের পিছিয়ে থাকা অনেক জুনিয়র হলেও জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এর দ্বারায় আর হয়না। শুভেন্দুর বিরুদ্ধে হাত-পা নেড়ে ক্যারিকেচার করেও নিজেকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করতে খুব একটা পারেননি-- কল্যাণ। যদি মিডিয়া বিজেপির ভুলগুলো ধরিয়ে না দিতো তাহলে তৃণমূল কংগ্রেসের এখন লড়াইয়ে তেমন ধার নেই যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে পারে। উল্টে গ্রামেগঞ্জে তৃণমূল পতাকা খুলে দেওয়া, ফেস্টুন ছেঁড়া, ঘর ভেঙে দেওয়া, মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া এবং ভীতি প্রদর্শনের রাজনীতি বেছে নিয়েছে। আর এখান থেকেই যে তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরছে ও পতনের সৃষ্টি হয়েছে এই আপ্তবাক্য বোঝার ক্ষমতা তাদের নেই। এখন মূল প্রশ্ন হলো ২০১১-এর পাশে থাকা ভোটারদের তৃণমূলই দুয়োরানি করে সরিয়ে দিয়েছিল আগেই। তাদের টানার নানা প্রচেষ্টা কতটা তারা বলপ্রয়োগ করে করতে পারবে তা ভোটের দিনই বোঝা যাবে। 

⛔ এইসব ক্ষয় হতে পারে জেনেই তা কাটিয়ে উঠে, ধার পড়ে যাওয়ার আগেই শুভেন্দু দল থেকে বেরিয়ে এসেছেন। তার বয়সও অনেক কম সমস্ত নেতাদের চেয়ে। ছেলেমেয়ে, বউবাচ্চা নেই।কোনও পিছুটান না থাকায় শুভেন্দু রাজনীতিটা করেন নেশার মতো করে। সৌগত, সুব্রত ও সুদীপদের দীর্ঘ রাজনৈতিক কার্যক্রমে, একঘেয়েমি থাকলেও শুভেন্দু এদের মধ্যে ছিলেন শক্তিশালী ধনুকের মতো। মাথার ওপর দীর্ঘ দিনের পোড়খাওয়া রাজনীতিক ও পিতা, শিশির অধিকারী আছেন--তার। ভাইরাও আছেন সঙ্গে। যারা রাজনীতি করছেন ছোট থেকে। এতদিন তারা এক-একজন এক-একটা দিক সামলেছেন--তৃণমূলের। এমনটা নয় যে তারা জন্মেই নেতা হয়ে গেছেন। একটি পরিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবার। তাই রাজনীতি কীভাবে করতে হয় অধিকারী পরিবারের ভালোই জানা আছে। আক্রমণ কখন, কোথায় কীভাবে করতে হয় শুভেন্দু তাই ভালোরকম শিক্ষা পরিবারের কর্তার কাছে পেয়েছেন। তৃণমূলের কারখানায় শুধুমাত্র নয়। শুভেন্দু, সোমেন মিত্রের কংগ্রেসের কারখানাতেও কর্মজীবন কাটিয়েছেন। শুভেন্দু যুবক বয়স থেকেই পোড় খাওয়া রাজনীতিক। তৃণমূলের অন্দরমহলে বহু দপ্তর, বহু পদ সামলেছেন--একা। বক্তৃতা করতে ছুটে গেছেন এক-একদিন ৩০০/৪০০ কিমি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই তুলনায় যা প্রিভিলেজে থাকেন বক্তা হিসেবে শুভেন্দুর কাছে যেতে বহু পথ এখন যেতে হবে তাকে। হয়তো ভবিষ্যতে অভিষেককে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতেও হতে পারে। মাঠে-ময়দানে বক্তব্য রাখেন একেবারে শিশুদের মতো। একা অভিষেক তৃণমূলের বড় নেতা হয়ে উঠবেন এটা কখনও সম্ভব নয়। আর অভিষেকের এই বড় হওয়ার প্রচেষ্টা থেকেই মুকুল ও শুভেন্দুর দল ছাড়া। শুভেন্দুর নিশানা এখন একমুখী এবং পরিষ্কার এবং একটিই তার ফোকাস পয়েন্ট। যারা মঞ্চে নাটক করেন তারা ভেবে দেখুন, মঞ্চে ফোকাসের আলো মুখে ও দেহে না নিতে পারলে অভিনয়কে তুলে ধরা যায়না। শুভেন্দু তার ফোকাস বুঝে গেছেন। 
রাজীব গান্ধীকে একসময় হারানো হয়েছিল
"গলি গলি মে শোর হ্যায় বফর্স কা কমিশন আয়া হ্যায়। " শুভেন্দুর সেই একই রকম আক্রমণের চাতুর্যময় সৃষ্টিতে তৃণমূলের ঘর এখন যে টলমল করতে বসেছে, সকলেই তা টের পাচ্ছেন। ইতিমধ্যে শুভেন্দুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ চৈতন্য মহাপ্রভুকে নকল করা ভঙ্গিমায় শুধুমাত্র দৃষ্টিগোচর হয়েছে তা নয়, ভক্তিবাদী হিন্দুদের তিনি আপ্লুত করে ফেলেছেন। তিনি যে খোল ঢোল বাজাতেও পটু তাও জনগণ বিশ্বাস করে ফেলেছেন। কিন্তু জনসভায় বক্তৃতা করার কায়দায় তিনি এক মৌলিক ভঙ্গিমা সৃষ্টি করতে চাইছেন। সেটা কি ? দুটি চরিত্রকে ঠেসে ধরা। কখনও মহাপ্রভুর সহজ ভঙ্গিমা থেকে চলে যাচ্ছেন কথার জাদুতে। মন্ত্রের মতো ছড়িয়ে দিচ্ছেন কথা থেকে কথা। পরক্ষণেই তিনি দুটি হাত নামিয়ে এনে তর্জনী ও হাত দিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গীমায় একটি নির্দিষ্ট ঘরের দিকে আক্রমণ তুলে আনছেন, মাত্র দুটি লাইনে। বলতে গেলে একটি নির্দিষ্ট চরিত্রকে আক্রমণ করছেন। ভুল বললাম দুটি মানুষকে তিনি একসঙ্গে আক্রমণ করছেন। সকলের মনন যন্ত্রকে নিবন্ধন করে দিচ্ছেন তার বাক্যবাণের 
ব্যবহারিক প্রয়োগ থেকে প্রয়োগে। অঙ্গভঙ্গি দিয়ে সৃষ্টি করছেন মজা। বিদ্রুপগুলি ছুঁড়ে দিয়ে অপেক্ষা করছেন তার তাৎক্ষণিক উত্তর শোনার জন্য। এইসব কথা ধাবিত হচ্ছে তৃণমূল দলের প্রতি। জনগণের মনে একটা রেজিস্ট্রেশন করে দিতে পেরেছেন, ছাপ ফেলে দিতে পারছেন। যেন তিনি যা বলছেন সঠিক বলছেন। বিজেপির জনসভাগুলি যে শুভেন্দুর জন্য আরও বেশি করে প্লাবিত হচ্ছে সেই আন্দাজ এখন সকলেই পেয়ে গেছেন।

⛔ কিন্তু অন্যরা শুভেন্দুকে আক্রমণ করছে নানা দৃষ্টি কোন থেকে। যার ফলে কল্যাণ, মদন, ও কুনালদের, শুভেন্দু-আক্রমণ পেনিট্রেশন করতে পারছে না। শুভেন্দুকে ফালাফালা না করার ফলে বিজেপির দল ক্রমশ ঘন হচ্ছে ফাঁকা জমির জন্য । কুনাল মদন কল্যাণের লক্ষ্যবস্তু ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া তৃণমূলের একজন অন্তত স্বচ্ছ, নির্ভুল নেতা নেই যিনি শুভেন্দুর সমকক্ষ হতে পারেন। শুভেন্দুকে যদি ইউরোপীয় ফুটবলারদের মতো দক্ষতা সম্পন্ন ভাবা হয় তবে তৃণমূলের ফুটবল প্লেয়াররা কলকাতা মাঠের হবেন। শুভেন্দু একজন খাটিয়ে, লোড নিতে জানেন, ইতিমধ্যে তৃণমূলের হয়ে বিশাল বিশাল দপ্তর, অফিস ও জনসভা সামলেছেন। তার উপর শুভেন্দু এখন জুট করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও জেড ক্যাটাগরির সিকিউরিটি ভোগ করছেন। তুলনায় ক্ষমতা এখন মমতার পরেই। ইদানীং শুভেন্দু অধিকারী, বিজেপিতে আসার আগে থেকেই তৃণমূলের মানসিক হৃদকম্পন শুরু যা হয়েছিল তা এখনও অব্যাহত আছে। হাওড়ার ডাঃ রথীন চক্রবর্তী, বৈশালী ডালমিয়া, লক্ষ্মী রতন শুক্লা রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বহু ছোটবড় নেতা তৃণমূলের ভেতরের ছিদ্রগুলি প্রতিদিন সাংবাদিক সম্মেলন করে জনগণের কাছে বিতরণ করছেন। এতে জনগণের কাছে তৃণমূলের গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে চলে যেতে বসেছে। এদিকে যেখানে বিজেপি মিটিং করছে উত্তরোত্তর ভিড় বাড়ছে তাই। 

⛔ ঠিক আব্বাস সিদ্দিকীর ভিড়ও তীব্র গতিতে ছুটছে। এই আব্বাস সিদ্দিকীকে একমাস আগেও
তৃণমূল দল একদম পাত্তা দেয়নি। এখন তৃণমূলের ভুল তারা নিজেরাই বুঝতে পারছে। এখন প্রশ্ন আব্বাস সিদ্দিকী ও তার ভাইয়ের ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট কি করবে এখন ? তৃণমূল কিন্তু তাদের সঙ্গে ফ্রন্ট করতে খানিকটা মরিয়া এখন। আবার অন্যদিকে কংগ্রেস এবং সিপিএম ও বামেরা আব্বাস সিদ্দিকীর সাহায্য চান। কিন্তু একটা বিষয় পরিষ্কার যে ৫০/৬০ টা সিট তাদেরকে ছাড়তে সকলেই নারাজ। আব্বাস সিদ্দিকী এবং হায়দ্রাবাদের মিম মিলে ইতিমধ্যে তারা একটি জোট গড়ার পরিকল্পনা করে ফেলেছেন। কিন্তু যেভাবেই হোক এই জোট গড়তে, কংগ্রেস,সিপিএম ও তৃণমূলের ঘোর আপত্তি আছে। তাই তারা কায়দা করে মিমকে বিজেপির লোক বলে বারবার দেগে দিচ্ছে। 
কিন্তু অবাক কান্ড বিজেপি এই বিষয়ে মাথা ঘামায়নি কখনও। তারা অন্তত আব্বাস সিদ্দিকীর বিষয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করেনি, মিমের বিষয়েও নয়। 

⛔ বরং শুভেন্দুকে বলতে শোনা যাচ্ছে ৭০% হিন্দুর ভোটের কথা। দেখতে গেলে তৃণমূল কংগ্রেসের এখন ছন্নছাড়া অবস্থা। সেই কারণে যা খুশি যেমন খুশি তারা জনগণের জন্য বিলিয়ে দিতে চাইছেন সমস্তটাই একটা ব্যাপক ঋণ-ধার করে। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সর্বাধিক ঋণে জর্জরিত দান খয়রাতির রাজ্য। এই দান খয়রাতি কেবলমাত্র নির্বাচনে জিততে যে তা সকলেই বোঝেন। কিন্তু যেভাবে প্রতিদিন ভোটের হাওয়া গরম হতে শুরু করেছে তাতে করে হিন্দু ভোট যদি বিপ্লব ঘটায় তাহলে বিজেপির উত্থান আটকিনো মুশকিল হবে। 

⛔ এখন এইবার পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন জমে যাবে যদি আব্বাস সিদ্দিকীরা মিমকে নিয়ে জোট করেন। যে যাই বলুন মিমকে নিয়ে তারা ফ্রন্ট করলে সর্বোচ্চ সুবিধা অর্জন করতে পারবেনই। এই মূহুর্তে তৃণমূল চেষ্টা চালাচ্ছেন আব্বাসের সঙ্গে বাইরে থেকে বোঝা পড়া করার। মিম ভেতরে থাকলেও তারা এখন খুব জোর একটা আপত্তিতে যাবেনা। কিন্তু তৃণমূলের এখন মহা বিপদ। তারা যদি আব্বাস সিদ্দিকীর সঙ্গে যায় তাহলে তাদের হিন্দু ভোটে ধ্বস নেমে যাবে। এই ভয় তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তবে কংগ্রেস সিপিএমের সেই ভয় নেই। তাদের সঙ্গে খুব একটা ভোটার নেই এখন । একমাত্র মুসলিম ভোটই তাদের বাঁচাতে পারবে। তাই তারা চাইবেন যেভাবেই হোক আব্বাস সিদ্দিকীদের ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্টের সঙ্গে যেতে। বাঁচার সহজ রাস্তা এটিই। আর যদি কংগ্রেস ও বামেরা আব্বাসের সঙ্গে যেতে পারে তবে পশ্চিমবঙ্গের ভোট বাজার নিঃসন্দেহে জমে যাবে। এইরকম জোট হলে পশ্চিমবঙ্গে এইবার ত্রিশঙ্কু হওয়ার চান্স খুব বেশি। আবার হিন্দু ভোট একদিকে ৪০% চলে গেলে বিজেপির ১৪০/১৪৫ টা বা তার বেশিও পেতে পারে। ১৫০ টি সিটি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল হয়েও উঠতে চলেছে তাদের। 

⛔ মনে রাখতে হবে এইবার নির্বাচন কমিশন অফিসারদের ওপর সাসপেনশন ধরিয়ে দেবেন। যারফলে নির্বাচনের দিন রাস্তায় ভোটার ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবেন না। বুথের কাছে যাওয়া তো দূরের কথা। ভোট দিতে আটকানো মনে হয় যাবেনা এইবার। কমিশন মনে করলে যাকে তাকে অ্যারেস্ট করবে বিধিলঙ্ঘন করলেই। অতএব আব্বাস সিদ্দিকীরা মিমকে নিয়ে ৬০ টা আসন চাইলে ৪৫ টা জিতেই যাবেন এবং তারা আগামী মন্ত্রীসভায় নিশ্চিত থাকতে চলেছেন। আর তারা যা চাইছেন তা হলো তাদের অনুমতি ছাড়া নতুন সরকার কোনও নড়াচড়া করতে পারবে না। এইবার আপনি বুঝে নিন কে বা কারা সরকার গড়বে এবারে। 

⛔ বিজেপি ও আব্বাস সিদ্দিকীরা মন্ত্রীসভা গড়লে আশ্চর্য হবো না। সকলেই এই ভয়টাই পাচ্ছেন। অথচ এই দুই দল এখনও পর্যন্ত কখনও রাজ্য চালায়নি। কেউ কাউকে গালাগালি অসম্মান করেনি। ফ্রন্টও করবে না। 
©® অলোক কুন্ডু

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...