◆ (আমার টুকরো জীবন) পর্ব-১১
● মূর্তি সাহেবের কোনও পুত্র ছিলনা। আমার বাবা ও উনি দুজনে দুজনকেই স্নেহ ও শ্রদ্ধায় এতটাই কাছাকাছি করে নিলেন যে কলকাতা এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে আমার বাবার নাম রেকমেন্ড করে তিনি আনালেন, এখনও ওই নিয়ম এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে আছে, কারণ এটা সংবিধানে আছে। যতদিন মূর্তি সাহেব অবসর নেননি, আমার বাবা পিতার মতো তাঁকে মনে করতেন। এমনকি অফিসের বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত কাজ পর্যন্ত করে দিতেন। ব্যাঙ্কের কাজ রেলের টিকিট কাটা এগুলো করতে পারলে আমার বাবাও আনন্দ পেতেন। ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে গিয়ে ছেলেখেলা করলে কি ধরনের ভয়ঙ্কর বিপদ হয়
তা অন্যদিন বলবো। যাইহোক চাকরি একটা হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের বেতন কিন্তু ভালো ছিল না তখন। তাই স্বাভাবিক ভাবেই কেন্দ্রীয় অফিসগুলোতে বামপন্থী ছাড়া কংগ্রেসের আই.এন.টি.ইউ.সি পাত্তা পেত না। অনেকেই নেহরু নীতির সুখ্যাতি করলেও নেহরু ইন্দিরার ব্যাপারে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা প্রবল ক্ষিপ্ত ছিলেন। খবর কাগজগুলো কখনও তাদের সেই বেদনা তুলে ধরেনি। যাইহোক একদম যাদের খাওয়াপরা জুটতো না তাদের একটা সুরাহা হলো বইকি। আমাদের অল্প স্বচ্ছলতা এলো। সকালে বাসি রুটির বদলে এলো পাঁউরুটি। সন্ধ্যায় এলো মায়ের তৈরি সাদা ময়দার পাতলা পাতলা পরটা আর আলুর দম। এটাই আমাদের সংসারের পেটেন্ট জলখাবার হলো। আমার মায়ের রান্না তখন তেলে ঝালে গরগরে। তিনবেলা ভালোভাবে খাওয়া জুটতো না যাদের তাদের কাছে এছিল চরম পাওয়া। প্রথমেই বলেছি আমরা জমিদার ছিলাম। প্রজাদের আনা বিলে তখন বছরে পাওয়া যেত তিনটাকা, তাও অনেকেই খাজনা দিতেন না। সেইসব জড় করে ৫ ভাগ আর কটাকা। অন্যরা প্রজাদের জমি বিক্রি করতে পারলেও আমাদের যারা প্রজা ছিল তাদের স্বত্ব না থাকলেও সরকারি কর্মচারি ও অফিসাররা কয়েকলক্ষ টাকা ঘুষ চাওয়ায় আমাদের ওইজমি পড়ে আছে প্রজাদের কাছে। আমাদের নয়, সরকারের নয় ভোগদখলকারীদেরও নয়। যা আইন তাতে আমরা কিছু না পেলেও ভবিষ্যতে কারা ওই জমি পাবে সরকার জানেনা। আমরা আশা করিও না। যাইহোক বাবার চাকরির ফলে কিন্তু আমাদের তখন আনন্দের দিন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মূর্তি সাহেবের গল্প শোনা আমাদের সংসারের একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এক অনাত্মীয় যে, এইভাবে একটা সংসারের কাছে দেবতা হয়ে উঠতে পারেন তা শুধুমাত্র আমরাই জানতাম। কাছের রক্তমাংসের মানুষের থেকেও যে দূরের একজন প্রকৃত আপনজন হয়ে উঠতে পারেন তার প্রমাণ আমরা পেয়ে গেলাম। জন্মদাতা পিতার উপেক্ষিত সন্তান মধ্য বয়সে এসে তার বাবা খুঁজে পেয়েছিলেন। একজন অপরিচিত দক্ষিণ ভারতীয় আমাদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন মহাদেবতা। তবে উনি কখনও আমাদের বাড়ি আসেননি। আমার মা, লক্ষ্মী-ঘিয়ের পরটা ও আলুরদম পাঠাতেন ড.মূর্তির জন্য। নিরামিষ ভালো রান্না হলে আমার বাবার এই পিতার জন্যে তাও প্রায়ই যেত। তার সঙ্গে অন্যান্যদের জন্যে সেই যে পরটা আলুরদম লুচি পাঠানো শুরু হয়েছিল তা বাবার চাকরি জীবনে কখনও ছেদ পড়েনি। যতদিন না আমার বাবা অবসর নিয়েছেন ততদিন আমার মায়ের হাতের সাদা ময়দার পরটা আর আলুরদম, ধোঁকার ডানলা, ঘুঘনি জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার অনেকেই খেয়েছেন। স্বনামধন্য শৈলেন মান্না অন্য ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন এবং হাওড়ায় আমাদের বাড়ির কাছে তাঁর বাড়ি হওয়ায় আমার বাবাকে শৈলেন মান্না চিনতেন। মাঠে ঢোকার জন্য তখন বড় বড় খেলোয়াড়রা সাদা কাগজে স্বাক্ষর করে মাঠে ঢোকার পাশ করে দিতে পারতেন। কত বিশ্বাসযোগ্যতার ওপর চলতো দুনিয়া। শৈলেন মান্নার কাছ থেকে সেই পাশ নিতে বাবা বাড়িতে এবং অফিসের টেবিলে প্রায় যেতেন। একদিন ইয়ার্কি করে তিনি বললেন, ''কি রে কুন্ডু, খালি মাঠে ঢোকার স্লিপ দাও মান্নাদা, আর পরটা খাবে অন্যরা সবাই।" এরপর এক দুদিন শৈলেন মান্নার জন্যেও ওই খাবার গিয়েছিল। পরে শৈলেন মান্না বারণ করেছিলেন। মোহনবাগানের আর এক ফুটবলার কম্পটন দত্তরাও ওই অফিসে কাজ করতেন। বয়সে অনেক জুনিয়র, কম্পটন দত্তর জন্য তো প্রায় রোজ টিফিন যেত। শেষে মা আর অত পারতো না। রাগারাগি হয়ে যেত। তারপর ঠিক হলো সপ্তাহে একআধ দিন ৩০/৪০ টা করে পরটা যাবে সঙ্গে ১৫ জনের আলুর দম। তবে আপনারা যারা নেহরু ও ইন্দিরাগান্ধীর অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে পাগল হয়ে যান। ওই দুজনকে আমার বাবা কিন্তু রীতিমতো ঘেন্না করতেন। ১৯৮৩ সালে আমার বাবা অবসর নিয়েছিলেন তখনও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিদের বেতন খুব একটা ভালো ছিলনা। যারা টি.এ পেতেন বা ট্যুর করতেন তবু তারা ভালোভাবে সংসার চালাতে পারতেন। বাবা মাইনের সমস্ত টাকাটাই মার হাতে তুলে দিতেন। নরসিমা রাও ও মনমোহন সিং না এলে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারিরা দীনদরিদ্র হয়ে চিরকাল থাকতেন। তবে পরে আমার বাবা ও মা ভালো পেনশন ও পারিবারিক পেনশন পেতেন। ( ক্রমশ:) অলোক কুন্ডু । ২৯/৯/২০।।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন