ইয়াসের লন্ডভন্ডের চেয়ে সুপারি কিলার সংবাদের যশ বিতরণ / অলোক কুন্ডু
এমন তো নয় যে ঘূর্ণিঝড় এই প্রথম হলো গো। কিন্তু মিডিয়ার নাটক বাজি যেন একটু বেশি মনে হলো না। দীঘার কাজুবাদামের দোকানের ভেতরে মোটরবাইক ভাসছে, কেমন যেন মজা লাগলো। আরে গোসাবা, হিঞ্জলগঞ্জ, নামখানা, মালঞ্চ, পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কোথায় গেল। হাওড়ার শ্যামপুর কই? বাড়িঘর ছেড়ে ঘর-গেরস্থালি ছেড়ে কে কবে সহজে চলে যেতে চায়? পারে না সহজে। গৃহপালিত পশুগুলো আজ কোথায় যাবে ? হাজার ঝড় জলের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েও মানুষ সরে যায় নি কখনও। শেষ পর্যন্ত রেসকিউ করতে হয় তাদের। গবাদি পশুর জন্য অবশ্যই সেল্টার বাড়াতে হবে। ৭৫ বছর শুধু কেন বৃটিশদের সাহায্যও সব জলের মধ্যে ঢুকে গেছে সেই কবে। কিছুই হয়নি। এই রাজ্যের ৩৪ বছরের বন্যার হিসেবের কোটি কোটি টাকার হিসেব আজ পাওয়া যাবেনা। ত্রাণ দিয়ে ভোটার ক্রয় করা ছাড়া এখানকার রাজনৈতিক দলের আর কোনও গুণাবলী দেখতে পাওয়া যাবেনা। যায়নি। আজ পর্যন্ত যত ঝড়ঝঞ্ঝা হয়েছে তত লাভবান হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। অবশ্যই গ্রামে গ্রামে যে বামেদের কোথাও কোথাও দোতলা অফিস হয়েছে তার পয়সার সবটাই তো বন্যা আর ঘূর্ণিঝড় থেকে। সে যাকগে। কিন্তু কোনও নেতা এই আমদানি থেকে আজ পর্যন্ত বাদ যায়নি বোধহয়। স্বাধীনতার পর একটু একটু করে করলেও এতদিনে তো দু হাজার কিলোমিটার জুড়ে পাকা ঘরবাড়ি ও পাকা বাঁধ করে দেওয়া হয়ে যেত। পাকা বাড়ি না করলেও চলতো। যদি উপকূল তীরবর্তী অঞ্চলকে একটা মাষ্টার প্ল্যান করে নিয়ে, ভাগ ভাগ করে জায়গায় জায়গায় চৌবাচ্চা সিস্টেমে গ্রামকে গ্রাম ঘিরে রাখা যেত। সেল্টারও কি দু একটাও করা যেত না? কিন্তু কোনও কিছুই হয়ে ওঠেনি। এখন তো সাংবাদিকরা এমন করছে যেন কোথা থেকে গোপনে তারাও টাকা পয়সা পেয়েছে, অথবা কোনও দিক থেকে সুপারি পেয়েছে। হাবুডুবু খাচ্ছে আধা কোমর জলে সেকি রেসকিউয়ের ধুম। জলের তোড় এলে ইন্টারভিউ দিতে দিতে রেসকিউ বেরিয়ে যাবে তখন। একেবারে নাচনকোদন করে টিভি ফুটেজ। যেন ল্যান্ডফলটা দীঘাজুড়েই হয়েছে, হয়তো পশ্চিমবঙ্গেই। কলকাতা টিভির মহিলা সাংবাদিক এবং তাদের ড্রাইভার তো এমন কাঁদছে যেন পুত্রসন্তান মরে গেছে। ল্যান্ডফল যেন দীঘাতেই হয়েছে। এত তোড়ে জল এলে তো ভেসে তো গেছেই অনেক কিছু। সমুদ্রের একহাত দূরে পর্যন্ত ১০ বছর আগেও কোনও দোকানঘর ছিলনা, সবগুলো প্রায় এক মানুষ জলে। কিন্তু এইভাবে দলে দলে দীঘাতেই বা কেন এত সাংবাদিক গেলেন। কি টিআরপির গুণরে বাবা। উপকূল বরাবর হয়েছে বিপদ, জলচ্ছাস হবেই তো। সমুদ্রকে যেখানে যেখানে ঘিরে ফেলা হয়েছে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হবে, মন্দারমণি তো উদাহরণ আছে। নদী সাগর উত্তাল তো হয়েছে। সাংবাদিকরাও কেন্দ্রীয় টাকার ভাগ পাবে বলে অনেকে ফেসবুকে বলছেন, মহা হাসির খোরাক। কেউ আবার পুরনো ফুটেজ দেখাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড় এই প্রথম নয় এবং এবারে সবথেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতি এমনও নয় রে বাপ। ৭৫ বছরের ঘোটলা রে এইসব। ঘাটাল ঘাটাল করে সকলেই মরে গেলেন, ঘাটালের মানুষের দুর্দশার কথা কেউ ভাবে না, সেদিকে একবার ক্যামেরা গেলে তো পারতো। উত্তরও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুর এমনকি পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়াতেও প্রতিবার লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে পড়ে যান। নদী বাঁধের ধারে ঘরবাড়ি হলে কি যে দুর্দশা হয় তা দামোদরের দুই পারের মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতা কিছু কম নয়। ঘূর্ণিঝড় আর বন্যা যাই হোক না কেন মশা, সাপ আর পেটের অসুখেও লোক মরে যায় প্রচুর। বিপর্যস্ত মানুষগুলোর আর কিছু করার থাকেনা তখন, তারা পায় খালি চিঁড়েগুড়, পলিথিন সিট আর হাতে কিছু আর্থিক সাহায্য। বাম আমল থেকে এই আমল পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অর্থ লুট, এইকারণে একটা বেশ মওকা হয়ে গেছে। হরিলুটের টাকার যেমন হিসেব হয়না তেমনি প্ল্যানও হয়না। দীঘার সি-বীচে দোকান বসে গেল অনর্গল। আমরা গিয়ে মজা লুটি। পরে সেইসব দোকান ভেসে গেলে আহা-উহু করবো, সাংবাদিকরা দীঘার সি-বীচে জল জমা দেখিয়ে দিচ্ছে। কম কি ? ঘরে বসে এইসব দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। সমুদ্রের ধারে টালি দিয়েও সৌন্দর্য করা উচিত কিনা ভাবা উচিত আমাদের। নাকি গার্ডওয়াল আরও বাড়ানো উচিত। সমূদ্র উপকূলের পাবলিক এরিয়াকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, যদি ডমিনেট করা না হয়, তবে ক্ষয়ক্ষতি বাড়বে। এত বছরে সুন্দরবন অঞ্চলের মানুষের জন্যই তো তেমন কোনও প্ল্যান করা হলোনা। যদি এমন হতো জায়গা ঘিরে রেখে কংক্রিটের বাঁধ দিয়ে বড় বড় যদি চৌবাচ্চা গড়ে তোলা যেত দশহাজার একর জায়গা জুড়ে। তাহলে কেমন হতো। একটা মাষ্টার প্ল্যান নিয়ে যদি এইরকম চৌবাচ্চা করা হতো বিঘের পর বিঘেতে, হল্যান্ডের অনুকরণে, অন্তত তাদের ১০% যদি করা হতো এখানে। হল্যান্ড তো পুরোটাই বাটির মতো। সমূদ্র থেকে এক কিলোমিটার দূরে যদি এইরকম গ্রামপরিধি সরকার গড়ে তুলতো এবং লোককে যদি বলতো ওই গ্রামেই সকল নিম্ন আয়ের ও গরিবদের বাড়ি করতে হবে। তার জন্য জল প্রকল্প থেকে নিকাশি প্রকল্প ও বাড়ি ঘরের প্ল্যান সরকারের মতেই করতে হবে। যদি নদী বাঁধগুলি আরও চওড়া করে তৈরি করা হতো এবং পাঁচ ফুট অন্তর ব্যাপক বনসৃজন করা হতো। তাহলে অন্যরকম একটু হতো। বাঁধের কাজ কিছুটা হওয়ার পর যদি বাঁধের দুফুট ভেতরে পলিথিনের সিট দিয়ে একপ্রস্থ বাঁধরক্ষার প্ল্যান করা হতো তবে ওপরের দু-ফুট মাটি ধুয়ে গেলেও ভেতরের পলিথিন কিন্তু সহজে জলের তোড়ের কাছে মাথা নত করতো না। পারলে পলিথিনের ব্যাগ তৈরি করে তার ভেতর মাটি দিয়েও বাঁধের উপরি ভাগের দেওয়াল রক্ষা করা যায়। যাই করা হোক না কেন, একটা যেন মাষ্টার প্ল্যান করা হয় কিন্তু এই ৭৫ বছরে মনে হয় তা কিছুই হয়নি। বসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলিকে যদি পৃথকভাবেই প্রথম থেকে তৈরি করা যেত। পঞ্চায়েত যদি এই ৪৪ বছরে কঠোর হতো। তাহলেও হতো। উপকূল অঞ্চলে তো পঞ্চায়েতের একমাত্র কাজ হতে পারতো উপকূল বাঁচাতে চাওয়া। প্রতিবারে কয়েক হাজার কোটি এইভাবে জলাঞ্জলি দিতে কখনও হতোনা। জনজীবন বাঁচাবো কি না ? এই প্ল্যান করেই তো ১৯৭৭ সাল থেকে বামেরা মাঠে নামতে পারতো। আজ নিউটাউন গড়ে বামেরা যত কৃষককে বাস্তুচ্যুত করেছে তার থেকে বেশি নাম করতে তারা পারতো উপকূলীয় মানুষের রুজিরোজগার ও জীবন বাঁচানোর জন্য এক মাষ্টার প্ল্যান করে। কাঁচা বাঁধের ভেতরের জমিগুলোকেও জায়গায় জায়গায় ক্রংক্রিটের পাঁচিল দিয়ে ভাগ করে দেওয়া যদি হতো তাহলে বাঁধ ভাঙলেও গ্রামগুলোর মাঝ বরাবর ব্যাপক জল খালের মধ্য দিয়ে বহুদূরে পাঠিয়ে দেওয়া যেত এবং তার তেজও কমে যেত। এদিকে গ্রামের ভেতরের রাস্তা ও ঘরবাড়ি থাকতো ঘেরা চৌবাচ্চার মধ্যে। প্লাবনের জলকে বসতির কাছে না আসতে দেওয়ার একটি মাষ্টার প্ল্যান তৈরি করা উচিত ছিল। আর ওই এরিয়ার বাইরে যারা বাড়িঘর করবেন তাদের উপযুক্ত ভিত দিয়েই তবে বাড়িঘর করতে হবে নিজেদের মতো করে হলেও প্ল্যান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা উত্তরণের ভাবনা থাখতে হবে এবং আগে হলেও হতে পারতো। এইরকম মাষ্টার প্ল্যান করার কোনও ব্যবস্থা হয়নি। এখনও সময় আছে উপকূল এরিয়া ও বন্যা কবলিত এলাকায় মাষ্টার প্ল্যান করা হোক। সমূদ্র উপকূলকে সৌন্দর্য করতে হলে সমুদ্রের প্রাকৃতিক স্থানটি ছেড়ে করা উচিত। কতটা উঁচুতে ওইসব দোকান ঘর, বাড়িঘর করা উচিত এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক নিয়মশৃঙ্খলা মেনে করা উচিত। তাছাড়া সুন্দরবনের বসতীপূর্ণ অঞ্চলকে চিহ্নিত করে চৌবাচ্চায় রূপান্তরিত করতে হবে। সি বিচের গা ঘেঁষে ব্যবসা ও বসতি গড়ে তোলার বিষয়ে একটি কঠোর আইন করা দরকার। সঙ্গে সঙ্গে উপকূলের বিদ্যালয় গুলিতে আরও পরিকাঠামো উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেখানে জলের রিজার্ভার থেকে জনতা পায়খানা ও দোতালায় থাকার ব্যবস্থা আরও বাড়াতে হবে। সমুদ্র উপকূলেও সেল্টার বাড়াতে হবে। বড় নদী ও সমুদ্রের ধারে জনবসতি কমাতে হবে। পর্যাপ্ত মশারী, পাউচের পানীয় জলের ব্যবস্থা, পাম্প সেট, গোডাউন এবং গ্রামে গ্রামে সিভিল ডিফেন্স স্বেচ্ছাসেবকদের টিম গড়ে তুলতে হবে। এইসব না থাকলেই সাংবাদিক ও তার ক্যামেরা ম্যান হাঁটু জলে স্থানীয়দের বলবে সাঁতার কাটুন সাঁতার কাটুন, আমরা ছবি তুলে বলবো জলচ্ছাসে রেসকিউ টিম কেমন সাঁতার কাটছে, আর ল্যান্ডফল হয়েছে আসলে এই প্রথম ২০২১-এ। ইতিপূর্বে যে সব ১২৩/১৩০ কিমি ঝড় হয়েছে তার জন্য কিছুই দুরবস্থা কখনও হয়নি কোথাও। ©® অলোক কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন