কেউ যদি ভাবেন যে সরকার বা প্রশাসন দুবছর পরে হলেও প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে কিছু তো ভেবেছে তাদের মতো হীন বুদ্ধির দ্বিতীয় আর কেউ নেই। সরকারের এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বহু আগে থেকেই উচিত ছিল, গত ২০২০তে এপ্রিল মাসে কার্যকর করা উচিত ছিল। ১০১ টা ডিপার্টমেন্ট আছে সরকারের। বিস্তর পিএইচডি আছে। সরকারের আইএস,বিডিও এসডিও জ্ঞানী মহাজ্ঞানীর কোনও অভাব ছিলনা। তবু কি কেন্দ্র, কি রাজ্য কেউ ভাবেনি শিশু কিশোরদের কি হবে। এর থেকে বড় লজ্জা ঘেন্না আর কিছু হয়না। সরকারের এবং প্রশাসনের এই অনীহা ক্ষমা করা যায় না। আসলে এখানে বিকাশ ভবনের কর্তাব্যক্তিরা যে এক একটা উজবুক ছাড়া আর কিছুই নয় তা আর একবার বোঝা গেল। আমাকে বললে সরকার এতদিন পরেও যা ভাবছে, তার থেকে আরও ভালো প্ল্যান করে দিতাম। সরকারের আইডিয়ায় আসবে না সেইসব। এখন শিক্ষার অ্যাপ হয়ে যাওয়ায় শিক্ষিত ও উন্নত এবং পয়সাওলাদের শিক্ষা নিয়ে কাউকে না ভাবলেও চলবে। এইসব অ্যাপের যে কত প্রয়োজন ছিল তা বুঝতে আর খানিক সময় দরকার সকলের। অনলাইন শিক্ষা মধ্য মেধা বা নিম্ন মেধাদের বা গরিবগুর্বোদের কিছু হয়তো সুরাহা করতে না পারলেও একটা বড় শ্রেণির নিশ্চিত উপকার করবে, এই বৃহত্তর শ্রেণির মধ্যে অবশ্যই নিম্নবিত্তও বাদ যাবেনা। এখানে সরকারী পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা তৃণমূল স্তরে ঠিকমতো এখনও পৌঁছতে পারেনি দুর্বল প্রশাসনের জন্য। যদিও রাজ্য সরকারগুলির আগেই কেন্দ্র সরকারের পাঠশালা প্রোগ্রাম শুরু করেছে। মোবাইল নেই, ট্যাব ছিলনা অথবা থাকলেও ব্যবহারের অভ্যাস অভিজ্ঞতা ছিলনা এবং অভিভাবকদের তদারকি শূন্য ছিল গড়িমসি ছিল এই সব বিস্তর অভিযোগ অনলাইন শিক্ষা পুষ্টি সঞ্চয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে আর এই বাধাদানের সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিয়েছে শিক্ষিতশ্রেণি। এইসব অ্যাপ বা অনলাইন শিক্ষা আগামী দিনে একটা বড় ভূমিকা নেবে। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এই ভূমিকা পালনে ভ্রান্তি ও অযোগ্যতায় পরিচালিত হচ্ছে। যে আকাশছোঁয়া বেতন শিক্ষায় নির্দিষ্ট হয়েছে সেই যোগ্য ভূমিকা সরকারের অফিসার ও শিক্ষকদের কাছ থেকে ফিরে পাওয়া যায়নি। যদিও একমাত্র কলকাতার প্রাথমিক বিভাগের জেলা পরিদর্শক, আমিনুল আহসান সাহেবের নিজস্ব কিছু কৃতিত্ব আছে শিক্ষা প্রসারে। তবে আমি একেবারেই এইসব অ্যাপের বিরুদ্ধে নই। যারা অনলাইন শিক্ষার বিরোধী তারা ১০০ ভাগ ভুল করছেন। শিক্ষা কখনও বদ্ধ জলাশয় নয়। শিক্ষার প্রসার যেভাবেই হবে তাতেই শিক্ষার্থীদের লাভ। এটা বুঝতে হবে যে শিক্ষার মূল বিষয় বর্তমান দিনে মেধার উন্নয়ন ও বিকাশ। কেবলমাত্র এবিসিডি শিখে, মানবিক কিছু শিক্ষা শিখে একজন সমাজের প্রভূত উন্নতি করবে এইসব হাস্যকৌতুক বড় বড় বুকনি অনেক হয়েছে। সমাজসেবক তৈরির বাসনায় খেঁজুরগুড়ে বালি ভর্তি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। মেধার উন্নয়ন আমাদের একমাত্র বাসনা হতে হবে এবং তার সঙ্গে যারা পারবে তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শিখবে। কিন্তু সিলেবাস বলছে বা যশপাল কমিটি বলছে তারা এমন তেলেঝালে চুবিয়ে শিক্ষার খিচুড়ি তৈরি করেছে যাতে সকলের সামর্থ্য সমান। তাই তাদের বুকনিতে সাজানো সকলের সমান সামর্থ্যের শিক্ষা সকলে চেটেপুটে খেয়ে শিক্ষায় পরস্পরের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে চলেছে এবং এইসব হচ্ছে বিদ্যে-বুদ্ধিতে। এখন শিক্ষাকে পণ্যিকরণ থেকে বাঁচাতে যে হীন প্রক্রিয়া এখন আবার শুরু হয়েছে তার একটা ৩৪ বছর আমার জীবনের উপর দিয়ে চলে গেল এবং তার কৌতুককর স্লোগান দিতে দিতে আমার শিক্ষা বিভাগের কলিগরা এমনভাবে সিলিপয়েন্ট টপকে ছক্কা হাঁকালো যে ৩৪ বছর শিক্ষার পণ্যিকরণ নিয়ে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করে, অফিস না করে, গল্পগুজব করে পার্টিবাজি করে প্রতিবাদের নাটক করে, অফিস টাইমে বাড়িতে ঘুমিয়ে, স্কুল ইন্সপেক্টর গিরি করে বাজি মাত করে দিলো। কেউ কেউ অতিবাম সেজে নেপোর দই খেলো, বাড়ির কাছে চাকরি করলো সারাজীবন। বলতে গেলে শিক্ষার প্রসার করতে এসে বেশ কিছুজন শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে ছাড়লো। একজন তো আছেন দিব্যগোপাল ঘটক বলে তিনি শিক্ষার ট্রেনিং দিতে গিয়ে মুড়ি মিছরি ঝোল ঝাল অম্বল এক করে পঞ্চম শ্রেণির বাংলার ভাষা শিক্ষার ফর্মূলা দিয়ে সমস্ত শিক্ষা মাপজোক করেন। এই ধান্দাবাজি দীর্ঘদিন ধরে সহ্য করছে শিক্ষার্থীরা। আমি কিন্তু শিক্ষকদের খুব একটা দোষ দেবো না। এইসব এখনও বিস্তর ফন্দিফিকির রয়ে গেছে মানুষের মনে। তাঁবেদারি করতে করতে আমরা এই দুবছরে কিছুই প্ল্যান নিলাম না। আমরা এঁঢ়ে গুরু দুইতে খালি বলতে থাকলাম স্কুল খোলো গো, স্কুল খোলো গো। ফলে যা হওয়ার তাই হলো, শিক্ষার অপচয় রোখা তো গেলই না পরন্তু শিশু-কিশোরদের চুপচাপ বাড়িতে বসিয়ে রেখে তাদের মাথার বারোটা বাজিয়ে দিলাম। স্কুল খোলা অত সস্তা হবেনা এই কথা পই পই করে বলে এসেছি সকলের বিরোধীতা করেছি আমি একাই। আমি মনে করি এই বিরোধীতার যৌক্তিকতা সমাজ মেনে নিয়েছে। তবে শিক্ষার অনলাইন ব্যবস্থা বা অ্যাপনির্ভর শিক্ষা নিয়ে এই যে হৈচৈ হচ্ছে এই যে বিপরীত করিয়া হচ্ছে এর কোনও সামান্য ভূমিকা ও তাৎপর্য নেই। অ্যাপ শিক্ষা অনিবার্য হয়ে পড়েছে, যা শিক্ষায় পণ্যিকরণ বলছেন সকলে। শিক্ষায় পণ্যিকরণের এই বাক্যটি উচ্চারণে আর কিছুদিন পরে পাপের প্রায়শ্চিত্তের দিক নির্দেশ করবে। দেখা গেছে শিক্ষায় বাণিজ্য ছিল বলেই শিক্ষার্থীদের চাকরিবাকরির চেষ্টা সহজ হয়েছে। প্রথাগত শিক্ষা ধরে রাখা উচিত এবং চতুর্দিকে ফাঁকিবাজি না থাকলে আজ শিক্ষায় পণ্যিকরণের সহজ সুযোগ হতো না। কিন্তু কি করা যাবে। একটি বিদ্যালয়েই তো সকল শিক্ষক সকল শিক্ষার্থীদের কাছে যোগ্য হয়ে উঠতে পারেন না। শিক্ষক নাট্যকার অজিতেশ ও উৎপল দত্ত একেবারেই ব্যতিক্রম। কবি তরুণ সান্যাল এবং অনেক অধ্যাপক সাহিত্যিকদের ক্লাস করার জন্য অন্য কলেজ থেকে ছাত্ররা ক্লাস করতে আসতেন। বিদ্যাসাগরের শিক্ষা ব্যবস্থাও ধরে রাখা এখন সম্ভব নয়। শিক্ষা নিজে তার পরিধি ছাপিয়ে উঠতে চায় এবং এটাই তার চরিত্র, একে রুখে দেবো এই হিম্মত না রাখাই ভালো। ব্যতিক্রমী শিক্ষক আজ সব সময় পাওয়াও মুস্কিল, দূরদূরান্ত থেকে কষ্টকর জার্নি করে কীভাবে একজন ভালো অফিসার হবে এবং শিক্ষক হবে বাম সরকার এটা একেবারেই ভাবেননি। পে-স্কেল ও ডিএ দেওয়ার ব্যাপারে তাদের যত সুনাম অর্জন আছে কিন্তু শিক্ষাকে ঝুলিয়ে দেওয়ায় ব্যাপারে তাদের জুড়ি নেই। এইসব মাঝে মাঝেই বলি কারণ ভেতর থেকে চলে আসে। কিন্তু আমার শক্তি এই বলা ছাড়া তো আর কিছু নয়। আসলে আমি অসহায়ের একটা সিম্বল মাত্র।
এখন করোনাকালে পাড়ায় পাড়ার শিক্ষালয় এই ভাবনার কথা প্রথম আমি ফেসবুকেই তুলেছিলাম। যদিও মুখ্যমন্ত্রী আমার ভাবনা নিয়ে নিয়েছেন একথা বলছি না। পাড়ায় শিক্ষালয় বলতে খানিকটা বোঝায় শিক্ষার্থী যেখানে অবস্থান করবে। এখানে শিক্ষকদের ভূমিকা তার স্কুলে উপস্থিতি দিয়ে স্নানীয় পাড়ায় যাবেন। সাময়িক শিক্ষার এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অর্থ কাজ করায় অনীহা। এই অনীহা সরকারের বেতন যারা নেন তাদের ক্ষেত্রে ১০০ ভাগ জড়িয়ে গেছে। এই ভাবনায় যদি কোথাও জায়গা না হয় তবে স্থানীয় স্কুলেও ক্লাস হতে পারবে না এমন কোনও কথা নেই। কোনো প্রশ্ন করাই অবান্তর এখানে। সকলে আন্দাজ করছেন মার্চ মাস নাগাদ করোনার প্রকোপ কমে যাবে কিন্তু করোনা সহজে এখনই যাবেনা। ঘুরে ফিরে যাওয়া আসা করবে। এইসব করতে করতে প্রবল গ্রীষ্ম এসে যাবে। তাই জুলাই হচ্ছে স্কুল খুলে দেওয়ার আদর্শ সময়। যদি মার্চ নাগাদ সংক্রমণের হার ১০% এর কমে চলে যায় তবে বড় ক্লাসগুলো অলটারনেটিভ ব্যবস্থায় এপ্রিলে খুললেও খুলতে পারে। কারণ এই সময় স্থানীয় জ্বরজ্বালা কম থাকে। তবে বিধানসভায় এতবড় বিষয়টা নিয়ে কেন কোনও আলোচনা হচ্ছে না তা বোঝা মুস্কিল। এই সাময়িক ক্লাস হলেও সর্বত্র যে খুব হৈ হৈ করে পড়ুয়া এসে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। পাড়ায় পড়ুয়া জমতে জমতে জানুয়ারি শেষ হয়ে তো গেল। ফেব্রুয়ারিতে প্রতিদিন ঘন্টা দুই জমায়েত করে ছেলেমেয়েরা ৩০ জনের মধ্যে গ্রুপ করলে ভালো হয়। প্রথাগত লেখাপড়ার আগে শরীর চর্চা হোক। খেলাধুলা হোক কিছুদিন। পড়ার সময় তো অনেক গেছে, নষ্ট হয়েছে। একে ক্লাস বলবো না। হুল্লোড় করুক ওরা। গল্প বলুক নিজেরা। যেমন খুশি পড়ুক। অক্ষর জ্ঞান, ভাষা ও গণিত আপাতত এই তিনটিতে নির্দিষ্ট থাকুক। একসঙ্গে এখন বহু কিছু করার দরকার নেই। ছাত্র-ছাত্রীদের কোনও মতেই তার ওয়ার্ডের বাইরে না নিয়ে যাওয়া উচিত হবে। মনে রাখতে হবে ওয়ার্ডের মধ্যেই পাড়ার শিক্ষাকেও বহু জায়গায় বিভক্ত করতে হবে। আরও ছোট পরিসরে বসার আয়োজন করতে হবে পাড়ায় শিক্ষালয়কে। শিক্ষকরাও এক একজন এক একটি গ্রুপ তৈরি করে পড়ান না। খানিকটা টিউশনির ধাঁচে। ক্লাসগুলো ফরমেশন করার সময় স্থানীয় বড় ক্লাব, বিয়ে বাড়ি ভাড়া দেয় এমন বাড়ি, গ্রামীণ অফিস, পঞ্চায়েত, বিডিও অফিস, বোরো অফিসগুলিকে তৎপর থাকতে হবে। পার্ক ও সংলগ্ন মাঠ সবখানেই ক্লাস করার পরিবেশ তৈরি করতে সরকারের তৎপরতা থাকতে হবে। এমন কিছু শক্ত কাজ নয়, খুব সহজ এইসব প্রচেষ্টা। এই পাড়ায় শিক্ষালয়কে দয়া করে ভারযুক্ত করার প্রয়াস নেবেন না ভারমুক্ত করুন। শিক্ষকদের ভাবনার সঙ্গে আমার ভাবনার অনেকটা তফাৎ হবে, এর কারণ আমাকে সরকার বুঝিয়ে না দিলেও আমি ছোট ছোট বিষয়গুলি চলচ্চিত্র পরিচালকের দৃষ্টিকোন থেকে বিচার করার চেষ্টা করি সব সময় যদিও আমি কোনো পরিচালক নই। বরং বিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে দীর্ঘদিনের ঘর আমার। এস.আই. অব স্কুলস ফাঁকিবাজ হলে পাড়ায় শিক্ষা রসাতলে যাবে। তাকেই বুদ্ধি করে প্রোগ্রাম তৈরি করতে হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের পাড়ায় স্কুল থাকলে সেখানেও ক্লাস হওয়া অবশ্যই যেতে পারে। ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ির দশ পা দূরত্বে যা থাকবে তাতেই ক্লাস করা উচিত। এখানে যেকোনও একটি স্কুলের ধারণা ভেঙে ফেলা দরকার। শিক্ষকরা এক একদিন ভাগ হয়ে এক একটা জায়গায় যাবেন। আমার ধারণা স্কুল হিসেবে ক্লাস হওয়ার উচিত নয়। স্কুলের দেওয়াল ভেঙে, সাইনবোর্ড হীন স্কুল হোক সাময়িক ভাবে। যার অর্থ কোনো স্কুলের নামে ক্লাস হবে না। এস.আই. অফ স্কুলস ফাঁকিবাজ হলে এই শিক্ষা পথেই পড়ে থাকবে। কিছুতেই কিছু হবে না। কারণ তার হাতেই রয়েছে নেতৃত্ব। ©® অলোক কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন