শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০

আগে রবীনদাকে দেখিয়ে নাও: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় • অলোক কুন্ডু

⛔ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকজন অনুগামী তাঁর ৪০ বছরের ১৫০ টি আঁকা ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী করবেন বলে ভাবলেন, তখন প্রথমেই মনে পড়লো ফ্রেন্ড, ফিলোজফার বয়সে ৪ বছরের বড় প্রখ্যাত শিল্পী রবীন মন্ডলের কথা, তখনও দুজনেই তো পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে আছেন। আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়ায় থাকাকালীন রবীন মন্ডলের ড্রইংয়ের ভক্ত হয়ে পড়েন। তার আগে থাকতেই অবশ্য তাঁর আঁকাআঁকির সঙ্গে একটা পরিচিয় ঘটেছিল। খুব কাছ থেকে সৌমিত্র, শিল্পী রবীন-দার বাড়িতে বসে থেকে, আঁকা প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজের খাতা ডায়রিতে আঁকা শুরুও করেন কম বয়স থেকে। জীবনে চারবার বাড়ি বদলাতে তাঁর অনেক খাতা, ডায়রি বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে। জলরঙেও কিছু এঁকেছেন তার সবকিছু আর তখন কাছে নেই। পরে কয়লাঘাটে যে দোকানে রবীন মন্ডলের কাছে যোগেন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, শুভাপ্রসন্নরা আড্ডা দিতে আসতেন, সৌমিত্র, বিখ্যাত আর্টিস্টদের ওই ঠেকেও গেছেন বহুবার। ছবি সম্পর্কে তাই একটা আইডিয়া যে তাঁর কাছে ছিলনা তা কিন্তু নয়। আইডিয়া থাকলেও সৌমিত্রর ছবি আঁকা একদমই তাঁর নিজের মতো করে এঁকেছেন। এছাড়া তিনিও তো মাষ্টার আর্টিস্ট সত্যজিৎ রায়ের পাশে গিয়ে দেখেছেন সবকিছুই। নিজের বাড়ির ড্রইংরুমের দেয়ালে তাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী রবীন মন্ডলের পেন্টিং টাঙাতে কখনও ভোলেননি, সৌমিত্র। তাঁর প্রয়াণের পরও কন্যা পৌলমী তা ফেলে দেবেন না। যখন গত ৯.১.১৪ তে আই.সি.সি.আর-এ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ড্রইং ও পেইন্টিংগুলি নিয়ে বড়সড় প্রদর্শনী হয়েছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রসেনজিৎ, অরিন্দম শীল, যোগেন চৌধুরী ওয়াসিম কাপূর এবং আরও অনেকে। সেইসব ছবিগুলো জড় করে পি. সি চন্দ্র গ্রুপ পরে বই প্রকাশ করেছিল গত ১৫.১.২০১৯-এ "ছায়া ও ছবি" নামে। সৌমিত্র, তাঁর আঁকা গুলোকে বলেছিলেন, "আমার খেলা।" সাংবাদিকরা যখন ওই দুটি স্থানে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কীভাবে ছবি আঁকায় এলেন সৌমিত্র দা ? এদের মধ্যে শিল্পী ও শিল্প সমালোচক  শঙ্কর মজুমদারও ছিলেন। আপনি তো সিনেমার নায়ক, নাটক করেন, অজস্র লেখালেখি করেন, কবিতা লেখেন, পত্রিকা বের করেন, সৌমিত্র হেসে বলেছিলেন, "দেখ, রবীন-দার সঙ্গে হাওড়ায় থাকতে আলাপ। ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওঁর মতো না পারলেও একটু আধটু সকলের মতো আঁক কাটাকাটি করতাম চিরকাল।" সৌমিত্র বক্তব্য রাখতে গিয়ে, প্রদর্শনীর উদ্বোধনে বলেছিলেন ," হাওড়ায় আমি ও রবীন-দা একই পাড়ায় থাকতাম। পরে রবীন দা আমার নাটকে অনেক হেল্প করেছিলেন। তবে আমার দুজন ইন্সপেরেশনের, একজন হলেন, রবীন দা আর অন্যজন হলেন বেঙ্গল স্কুল ঘরাণার শিল্পী চৈতন্য চট্টোপাধ্যায়। ওঁর ছবি আছে একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের দোতলায়। ঠাকুর ভাসান হচ্ছে, ছবিতে অন্ততপক্ষে ৫০ জন চরিত্র আছে। কী নিখুঁত, কী অসাধারণ আবেদন সেই ছবিতে। সম্পর্কে আমার ভগ্নিপতি। ওঁর দুই ছেলে আমার তো ভাগ্নে, ওরা খুব ছবি আঁকতো। তারাও আমার অনেকটা ইন্সপেরেশন ছিল। ওরা দুজনে খাতায় আঁক কাটাকাটি করতে করতে চট জলদি ছবি এঁকে ফেলতো। ওদের দেখে দেখে কিছুটা চর্চা হয়েছিল তখন।" তাছাড়া চৈতন্য চট্টোপাধ্যায় শেষদিকে ওই রিয়েলিস্টিক আঁকার বদলে খাতায় কলম দিয়ে লেখা ও আঁকার সংমিশ্রণে অদ্ভুত ছবি আঁকতেন। তার প্রতিও সৌমিত্র আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। যদিও যোগেন চৌধুরী ও ওয়াসিম কাপূর ওই পেন্টিং ও ড্রইংকে সৌমিত্রর আর্টওয়ার্ক নামে অভিহিত করেছিলেন তাদের বক্তব্যে। রবীন মন্ডল, আজীবন বন্ধু সৌমিত্রর পেন্টিং সম্পর্কে অবশ্য কিছু বলেননি। কেন এঁকেছেন জিজ্ঞেস করাতে সৌমিত্র বলেছেন, নাটকের স্টেজ, চরিত্র ও ফরমেশন করতে আঁকাআঁকি করতেই হয়েছে। মেকআপের ছবি আঁকা আমার অভ্যাস। কোনির মেকআপের ছবি এঁকে অভিনয় করেছিলাম। তাছাড়া কসটিউম ডিজাইন নাটকের বড় একটা ভাবনা।" সৌমিত্র ফ্রন্টলাইনকে বলেছিলেন, " I did it for fun.  আবার অন্যদের বলেছেন, " আঁকার শিক্ষা আমার নেই। আমার ছবি জড় করে প্রদশর্নী করার আইডিয়া একদমই আমার নয়। সেই সাহসও হয়নি। কয়েকজনের ইচ্ছাতে প্রদর্শনী হচ্ছে। বিশেরভাগ ছবি পেন দিয়ে কাল ও ডার্ক ফ্ল্যাট টোনের। মুখ অথবা মুখোশের মতো মুখ।" অবশ্যই এইসব কোনও কম্পোজিশন নয়, রিয়ালিস্টিক মোটেই নয়। সরঞ্জাম সহকারে ছবি আঁকার কথা বলেননি। মিশ্র মাধ্যমে ছবিকে দাঁড় করিয়েছেন। সৌমিত্র বলেছিলেন, "অধিকাংশ ছবি কেউ আমাকে পোস্টকার্ড পাঠালে, সেটাই ক্যানভাস করেছি। তাছাড়া আমি নাটকের লোক, ছবিতে তাই মুখোশের রূপান্তর ঘটেছে।" সৌমিত্র বলেছিলেন তাঁর ছবি : "অভাবিত। ভাবনা থেকে নয়। হঠাৎ আঁকা।" হাওড়ায় থাকার সময় রবীন-দার ড্রইং দেখেই তো বন্ধুত্ব করেছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন বরং রবীন মণ্ডলকে লোকে চেনে। সৌমিত্রর তখন কোনও খ্যাতি নেই। রবীন মন্ডলের পায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে ছোটবেলায় তিনি স্কুলে যাননি। তাই হয়তো এতবড় শিল্পীকে আমরা পেয়েছিলাম। সৌমিত্র, রবীনদার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, "আমার আরও একজন ইন্সপেরশন আছেন, ক্যালকাটা পেন্টার্সের রবীন দা। হাওড়ায় থাকার সময় আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। মনে আছে গান্ধীজি বক্তৃতা দিচ্ছেন, আমরা শুনতে গেছি। বক্তৃতা শুনতে শুনতে রবীনদা গান্ধীজির ছবি এঁকে ফেললেন। তাই যখন আমাকে বলা হ'ল যে আমার আঁকা ছবিগুলি নিয়ে একটা প্রদর্শনী করার তখন ওদের বললাম, আগে রবীনদাকে দেখাও এইসব। উনি রাজি হলে তবেই প্রদর্শনী করা যাবে। (৪.১২.২০)। ©® অলোক কুন্ডু। 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...