কপিলের শোয়ে এসে কপিলের মস্করার জবাবে কে.কে জানিয়েছিলেন তার নামকে ক্ষুদ্রতম দুটি অক্ষরে সীমাবদ্ধতায় কেন তিনি বেঁধে ছিলেন। কপিলের শোয়ে অনেক হাসিমস্করা হয়। ভীষণ একটা ভালো প্রোগ্রাম
এই টিভি শোটিতে হয়ে থাকে। কিন্তু কপিল কখনও কাউকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে হাত রেখে ইয়ার্কি খুব একটা করেনা। ব্যতিক্রম কে কে। এত সরলতা মাখা মুখ যেন কোনও নাক উঁচু ভাব তার মধ্যে থাকতে একদমই নেই।
তার মধ্যে যেন আড়ালের মগডাল নেই। সেলিব্রেটির ছুঁতমার্গ নেই কোনও। তাই হয়তো গান গাইতে গাইতে যখন তিনি অস্বস্তি বোধ করছেন, তার শরীর বিপন্ন মনে হয়েছে তখন তিনি জল খেয়ে ঘাম মুছে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন নিজেকে, ম্যানেজ করেছেন নিজেকে নিজেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। ভক্ত থেকে উদ্যোক্তা কাউকেই তিনি ব্যতিব্যস্ত করে তুলতে চাননি। আসলে এই গুণাবলী সকলের থাকেনা। তার ওপর তার ছিল মার্জিত ব্যবহার। হয়তো এইরকম বড় পেমেন্টের প্রোগ্রামে এসে তাদের কিছু ফিরিয়ে দিতেও তিনি চেয়েছিলেন। নব্বইয়ের ছেলেমেয়েরাই তো তার বিশেষ গুণগ্রাহী, তাদের আব্দার অনুরোধের বন্যায় কতবার তো ভেসে বেড়িয়েছেন তিনি। আসলে মানুষটার মধ্যে কর্তব্যবোধ, একটা যেন ঋণী হয়ে থাকার কুন্ঠাবোধ বড় বিষয় ছিল। ভক্তদের কাছে তাদের মনোরঞ্জনের দাবী যে থাকে তাকে তিনি অপূর্ণ রেখে কখনোই চলে যেতে চাননি। পয়সা উসুল নয়, তাদের মনোবাঞ্ঝা পূরণ করতে তাকে হবেই, এই নাছোড়বান্দা মনোভাব তাকে উজ্জীবিত করেছে সন্দেহ নাই। তার এই কনর্সাটের পাওয়ারফুল শো-কে তাই তিনি তুঙ্গে নিয়ে গেছেন। জানতেন না এত লোক হবে। আবার হলে ঢোকার মুখে তিনি এত সংখ্যায় বিপুল ছাত্রদের উপচেপড়া ভিড় দেখে গাড়ি থেকে নামতেও চাননি। তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কি তবে বুঝতে পেরেছিল আজ এখানে ভয় আছে। বড় শিল্পীরা সঙ্গে লোকলস্কর নিয়ে পথে ঘোরেন। সঙ্গে থাকে তাবড় তাবড় শরীরের লোকজন। এইসব কেকে-র সঙ্গে ছিলনা একদম। দমদম বিমানবন্দরে নামার সময় কোনও ভিড়ের সামনাসামনি তাকে হতে হয়নি। ভক্তদের উন্মাদনায় তাকে পড়তে হয়নি। হোটেলে এসে নিজের গানের চর্চা করেছেন, সময়েই পৌঁছে গিয়েছিলেন নজরুল মঞ্চে। ভেবেছিলেন রাজ্য সরকারের হল, সেখানে সমস্ত ব্যবস্থাপনা দারুণ থাকবে। কোনও কিছুই গাঁয়ের মতো নয়-- এই নজরুল মঞ্চ। এক সময়ে কলকাতা ও মফস্বলের বিশাল বিশাল মাঠে মহম্মদ রফি থেকে কিশোর লতাকে সামলে দিয়েছে উদ্যোক্তারা। বহুকালের সংস্কৃতির জায়গা। কিন্তু যে আশাবাদী হয়ে এসেছিলেন তা তাসের ঘরের মতো এমন যে ভেঙে পড়তে পারে, তা কখনও তিনি ভাবেননি হয়তো। অত প্রবল ভিড়কে তাই প্রাথমিক ভাবে ম্যানেজ করতে চেয়েছিলেন গানের প্লাবন দিয়ে। উপচে পড়া ভিড়কে সামাল দিতে এবং তাদের মন জয় করার বাসনা তখন তাকে তন্ময় করে রেখেছিল শুধুমাত্র এমনটা নয়। গানের তালিকা ও অনুরোধগুলি তাকে শেষ করতেও তো হবে। শিল্পী যে একজন মানুষ তার যে ভেতর ভেতর টেনশন হয় তা আর কবে কে জানতে চেয়েছে। টেনশন মুক্ত হতে তাই নিজেকে যতদূর পেরেছেন উদ্দাম করেছেন। চূড়ান্ত স্থানে এমন করে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন যাতে চিরকাল তাকে মনে রাখে, কলকাতা।
সারা পৃথিবীজুড়ে এর থেকে বড় বড় অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকেছেন। সব সামলে নিয়েছেন উদ্যোক্তারা। কিন্তু বুঝতে পারেননি কলকাতাতেই হবে তার শেষ কনসার্ট। চোখের জলে সাজানো গানগুলো যে তার মৃত্যুর পরেও সারা কলকাতার নিস্প্রদীপ ঘরে ঘরে একদা বেজে উঠবে, স্বপ্নেও কখনও ভাবেননি। তিনি ফাঁকি দিতে চাননি। কোনও ফাঁকি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভবও ছিলনা সেদিন। তিনি ভাবেননি কলকাতার কনর্সাটে তার জন্য আর এক ডবল " কে অক্ষর" এমন ভাবে লুকিয়ে আছে যা তার নামের মধ্যেই বিদ্যমান। মঙ্গলবার গভীর রাতে কলকাতার নজরুল মঞ্চের কলঙ্কিত কনসার্টের পরই যে তিনি হঠাৎ করে মারা যাবেন একথা সেদিন কেউই ভাবেননি। কিন্তু ভেবেছিলেন বুঝি অন্তর্জামী। কি অব্যবস্থাপনার মধ্যে তাকে গাইতে হয়েছিল তার পরবর্তীতে প্রকাশিত ভিডিওগুলি দেখে সকলে আঁতকে উঠছেন। একটা অতিরিক্ত বিশৃঙ্খলা বললেও ভুল হবে।
গড়িয়াহাটের মৌচাক থেকে থিক থিক করছে ভিড়। হলের সামনে চলছে ধস্তাধস্তি, ইঁট-পাটকেল ছোঁড়া। হলের ভেতর ফায়ারএস্টেটুইঙ্গারের ধোঁয়া, প্রায় ৭ হাজার ফোন থেকে ভিডিও হওয়ার সময় যে তাপ বিকিরণ হয় তার একটা প্রবল অস্বাস্থ্যকর শক্তি। এ.সি নিভিয়ে দেওয়া, হাজার হাজার ওয়ার্ডের দৈত্যাকার লাইটের ঝনঝনানি যা শিল্পীর শারীরিক অস্বস্তি বাড়িয়ে ছিল শতগুণ। স্টেজের চারিদিক ও হলের সমস্ত মেঝে ভর্তি করে যুবক যুবতীদের বসে থাকা, উইং ঘিরে শতশত ছেলেমেয়েদের দাঁড়িয়ে থাকা। এইসব তো ছিল। তার সঙ্গে ছিল ছেলেমেয়েরা এপাশ ওপাশ দিয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে, চরম অব্যবস্থাপনা। এইসব থেকে কখন বেরিয়ে যাবেন তাই শিল্পীর উদ্বেগের শেষ ছিল না। তার মনের অন্দলমহল মাপতে যাওয়ার কারও তখন ইচ্ছা নেই। এইসব কেউ জানতে চায়নি। একটা চক্রব্যুহে তিনি আটকে পড়েছেন, সম্পূর্ণ তিনি একা। একেবারে একা। ওদিকে সকলে তারা চাইছে আরও চাইছে। বাঙালি আজ লজ্জায় মর্মাহত লজ্জিত। বাঙালিদের মধ্যে যারা সুস্থ তারা সকলেই আজ ভীষণ ক্ষোভে, মর্মবেদনায় চোখের জল ফেলছেন। কে.কের বাড়িতে হয়তো আজ সকাল সকাল আলো নিভে গেছে। দিল দে চুকে সনম সেই কবেই তো দেখে ফেলেছিল বাঙালির এই প্রজন্ম। তবু আজ বন্ধুরা পাঠিয়ে দিচ্ছে পুরনো সেই গানটাও। কেকের গানে গানে হোয়াটসঅ্যাপ ভর্তি হয়ে গেলেও আজ কারও উপর কারও অভিযোগ নেই। নব্বইয়ে বড় হওয়া প্রজন্মের কাছে কেকের এই হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার আফসোসগুলি যেন বুকফাটা কান্নার মতো। কোনও কৈফিয়ত নেই। কৃষ্ণকুমার কুন্নাথকে তার মালয়ালী পিতামাতা যে নামকরণ করেছিলেন, আজ তাকে সংক্ষিপ্ত আকারে কে.কে করেছিল তার গানের জগতের স্টুডিওর প্রোডাকশন হাউস ও কতিপয় উৎসাহী ভক্ত। সত্যি সত্যি যে তার জীবনটাও অতি ক্ষণস্থায়ী হয়ে হঠাৎ কেকে-র মতো ছোট হয়ে যাবে, একটা অনিশ্চয়তা এসে শেষ করে দিয়ে যাবে তারাও তা কেউই জানতো না।
১৯৬৮ -তে যে দিল্লিতে তার জন্মগ্রহণ ও গায়ক হয়ে ওঠা সেখানে তিনি আর কখনও ফিরতে পারবেন না। কালের বিচার কেন যে এত বেদনাদায়ক হয় কেউ তার উত্তর দেবে না আজ। দিল্লির মাউন্ট সেন্ট মেরি স্কুলে পড়াশোনা করার সময়ও কেউ জানতেন না যে এই ছেলেটাই একদিন বিরাট গায়ক হয়ে উঠবে। কিশোর কুমার এবং সঙ্গীত পরিচালক আর ডি বর্মনের মতো গায়কদের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে তাদের মতোই পঞ্চাশের কোঠায় চলে গেলেন এক নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়ে। কখনও কোনো সঙ্গীত প্রশিক্ষণ নেননি যে মানুষটি ভবিতব্য তাকে যে একদিন গানের জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলবে এবং সেখান থেকেই যে তিনি একদিন অদৃশ্য হয়ে যাবেন এই কথা কখনও কেউ ভাবেননি। একটার পর একটা প্রবাহের মধ্য দিয়ে তার যাত্রাপথের
উত্তরণ ঘটেছে। যুবক যুবতীরাই হয়ে উঠেছিলেন তার প্রধান ভক্তকূল। কিরোরি মাল কলেজ থেকে বাণিজ্যে স্নাতক করার সময় , তিনি 'হরাইজন' ব্যান্ডের প্রধান গায়ক ছিলেন। একদা টাইপরাইটার বিক্রি করতে করতে চাকরি ছেড়ে একদিন গানকেই বেছে ছিলেন বাস্তবে বেঁচে থাকতে। আশ্রয় নিয়ে ছিলেন হোটেলে গান গেয়ে বেঁচেবর্তে থাকবেন। সেই গানই কি তবে তার জীবনের কাল হল। জিঙ্গেল গেয়ে সামান্য নাম করেছিলেন একসময়ে, সেখান থেকে প্লেব্যাক করতে করতেই তিনি
তারকা হয়ে উঠেছিলেন। কলকাতা মঙ্গলবার দেখলো সেই তারকার একক শোয়ে নজরুল মঞ্চের এধার থেকে ওধারে ছুটে বেড়াতে বেড়াতে হাততালির আদরগুলো
তিনি সারা শরীরে মেখে নিচ্ছেন। আর তা তিনি যত কুড়োতে লাগলেন তত তার কর্তব্যবোধ তাকে বের হতে দিল না সেই চক্রব্যুহ থেকে। শিল্পীর শারীরিক বিপর্যয়ের কথা কেউ সামান্য ভেবেও দেখলো না। যেন আগের জন্মে তিনি নজরুল মঞ্চের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন। সমস্ত ঘাম রক্তের ঋণ স্বীকার করে গেলেন। কাউকে এতটুকু বলতে পারলেন না, অথবা বললেন না যে তিনিও মানুষ, তার শরীরটা আজ ভালো নেই। যদি বলতে পারতেন তবে এই জঙ্গি জনতার রায়ে, অচিরেই ফুৎকারে কে.কে হয়ে যেতেন একজন ভিলেন। আর ফাটকা খেলোয়াড় রূপঙ্কর দুনিয়ার সমস্ত আলো কেড়ে নিতেন। যেভাবে একা একা কে.কে বিমানবন্দরে নেমে ছিলেন তেমনি নিঃশব্দে তাকে কলকাতা ছাড়তে হতো। কেকে একজন ভালো মানুষ। সরল নিষ্পাপ তাই তাকে এই নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হতে হল। ©® অলোক কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন