বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

সোহরাব্রিজ সিনেমার আলোচনা ©®অলোক কুন্ডু

গতকাল নন্দনে বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়-এর (২৬-২-১৬) " সোহরা ব্রিজ " রিলিজ
করলো প্রিমিয়ার-শো । বাংলা চলচ্চিত্রের
অন্যধারার ছবির নির্দেশক বাপ্পাদিত্য দেখে
যেতে পারেননি তাঁর এই ছবির প্রিমিয়ার শো ।
তাই তার বন্ধুরা শোকমগ্নতায় করলেন তারই
আলোচনা । যা করাটাই স্বাভাবিক ছিল ।
উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রী ব্রাত্য ব্সু । একালের
প্রখ্যাত নায়ক-অভিনেতা প্রসেনজিৎ
চট্টোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন । কাল একে
বৃষ্টি এবং তার সিনেমার পরিচালক সদ্য প্রয়াত
হয়েছেন । কে প্রিমিয়ারটা প্রেজেন্ট করবেন
সে নিয়ে দ্বিধা থাকলেও জড়তা ছিলনা ।
এই গত নভেম্বরেই ঘুরে এসেছি চেরাপুঞ্জি ।
আসলে চেরাপুঞ্জির আসল নামই--সোহরা ;
এটা জেনেছিলাম ওখানে গিয়ে । মেঘালয়ের
সাব-ডিভিশ্যনাল টাউন " সোহরা " কে ১৮৮৩
তে বৃটিশরা চেরাপুঞ্জি রূপে দখলে নেয় ;
ভারতের ইস্ট খাসি হিলস্ কেই সোহরা নামে
খাসিরা আজও ডেকে থাকে । পৃথিবীর ইতিহাসে এখনও চেরাপুঞ্জির বিশ্ব রেকর্ড বৃষ্টিপাত
( ১৮৬১ এর জুলাই থেকে ১ লা অগস্টের
বৃষ্টিপাত ) । আসলে ( So-har-a  কে )
বৃটিশরা উচ্চারণ করে  ' CHURRA '
তে রূপান্তরিত করেন । চেরাপুঞ্জিকে
Land of Oranges বলা হয় । চেরাপুঞ্জিতে
একঘর বাঙালি থাকে তারা কিন্তু খ্রিস্টান
সম্প্রদায়ের তারা এসেছিলেন বাংলাদেশের
সিলেট । ওপারেই সিলেট । অসম-
মেঘালয়জুড়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ
বৃটিশদের আসার আগে থেকেই হয়ে আসছে ।
আমি গত নভেম্বরে চেরাপুঞ্জির 
" কনিফেরাস রিসর্টে " উঠেছিলাম । ওই রিসর্টে
প্রতি বছর একদল সাহেব-মেম জার্মানী থেকে
১২ চাকার দো-তলা বাস নিয়ে ১২/১৪
জন বিদেশী আসেন বৃষ্টির বিভিষিকা দেখতে ।
সে কথা অন্য ব্যাপার । যদি আপনারা বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের SOHRA BRIDGE দেখতে
গিয়ে বৃষ্টিপাত খুঁজতে চান ,
তাহলে কিন্তু তা পাবেন না । ট্যুরিস্টরা
চেরাপুঞ্জিতে গিয়ে রাত কাটান না । লোকাল
ট্যুর করে চলে আসেন । দেখেন - গুহা , সিলেট ,
পাহাড়ি রাস্তা  , রামকৃষ্ণ মিশন ইত্যাদি ।
কিন্তু চেরাপুঞ্জির আসল বিষয় হলো - এখানে খোলামুখের কয়্লা খনি ;  শিল্পের অন্যতম
অনুঘটক চুনাপাথর বৃটিশরা আবিষ্কার
করেছিল এখানে । বৃটিশদের তৈরি ঘোড়ায়
চড়া পথ এখনও আছে সোহরাতে ;
চেরাপুঞ্জিতে । পথ চলে গেছে সিলেট । 
যেখান থেকে হয়ে আসছে দীর্ঘ অনুপ্রবেশের
কাহিনী । বাপ্পাদিত্য তার এই চলচ্চিত্রে সেই
কাহিনীকে মূল ফোকাস পয়েন্ট করেছেন ।
কিন্তু কাহিনী এখানে চলচ্চিত্রের মেজাজকে
ধরেছেন - অন্যধারার প্রেক্ষাপটে ।
বহুদিন আগে " দ্য মিস্ট " নামের জাপানি
একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম । কুয়াশা আর
ছবির নায়িকা জুড়ে ছিল সেই চলচ্চিত্রটি ।
এই ছবির পরিচালক সেই বিদেশী ছবিকে
একেবারেই কপি করেননি । চেরাপুঞ্জিতে
বিদেশীরা আসেন ( গোয়াতেও বিদেশীনিরা
আসেন এবং কোটিপতি বিদেশীনিরা তাদের সেক্সচ্যুয়াল স্যাটিসফ্যাকশন-এর জন্য
এদেশের কিছু যুবককে টাকা দিয়ে
একমাসব্যাপি ভাড়া করেন । এমনকি এইরকম
ভাড়া খাটতে বেশ কিছুদিন আগে কলকাতার
একটি ছেলে বেশ ডলার কামিয়েছিলেন ।
এরকম একজনের সঙ্গে আমার বছর কুড়ি
আগে সারারাত রেলের টিকিটের লাইনে
আলাপ হয়েছিল এবং সেই গল্প শুনেছিলাম ।
তখন অবশ্য সেই যুবক বিয়ে থা করে থিতু
হয়েছিলেন ) এরকমটা যে ভারতের আর
কোথাও হয়না তা কে বলতে পারে ? এই
বিষয়টিকেও এই সিনেমার একটি মুখ্য
অবলম্বন হিসেবে দেখা গেছে । যার জন্য
একটু সেক্সচ্যুয়ালিটি এসেছে খুব নগন্যভাবে ।
আর যাই হোক বাপ্পাদিত্য বাঙালিকে সাবালকত্ব শিখিয়ে গেছেন । কিন্তু এই " সোহরা ব্রিজ  "
সিনেমাটি প্রকৃত অর্থে কাহিনী উপ-কাহিনীর
থেকে বড় ব্যাপার আমার মনে হয়েছে এই
ছবিটি যেন সিনেমাটিক পেইন্টিং । আরো
ভালো করে বলি কথাটা । সিনেমা যে একটি
ভিস্যুয়াল আর্ট এবং অ্যাপ্লায়েডআর্টের মতো
-সোহরা ব্রিজ দেখতে দেখতে আমার সে
কথাই মনে হয়েছে । টাইটেল থেকেই যার শুরু
হয়েছে । চিত্রনাট্য ছাড়া সিনেমা হয়না ।
কিন্তু কথা-বার্তা অত্যন্ত কম সেই চিত্রনাট্যের
পরতে পরতে । এতদিনে বাপ্পাদিত্য বুঝি
বোঝাতে চেয়েছিলেন শুধু মুখে ভারতের
অখন্ডতা বললেই তা অখন্ডতা হয়ে যায়না।
এখানে প্রয়োজনে যেখানে অসমিয়া
( অহমিয়া ) ভাষার যেখানে খাসি ভাষার
প্রয়োজন এবং ইংরেজি উচ্চারণ রাখা দরকার
সেখানে সেটাই অবিকল ব্যবহার করেছেন ।
তাই এই সিনেমা অসম ( অহম)  মেঘালয়েও
দর্শক পাবে । সিলেট থেকে কীভাবে রোজ
রাজনীতির হাত ধরে খুল্লামখুল্লা টাকা-ডলারের
হাত ধরে এপারে ( ওদের কথায় বাঙালিরা
আজও বিদেশী) লোক ঢুকছে সেই আগুনের
মতো বিষয়্কেও এই ছুঁয়ে গেছে । ছবিটি মুখ্যত
সিঙ্গল ক্যারেকটরের ফিল্ম । একটি মেয়ে রিয়া । কনভেন্টে পড়া । তার পিতা লেখক সন্দীপ
চট্টোপাধ্যায় কলকাতা ছেড়ে এবং রিয়ার
মাকে ছেড়ে এক অসমিয়া নারীর কাছে চলে
এসেছেন । সময়কাল নকশাল মুভমেন্ট
থেকে সন্ত্রাসবাদের কথা আছে । এমন কিছু
ডায়লগ আছে যা শুনে মনে হতে পারে যারাই
সরকারে ছিল এবং আছে তাদের
প্রত্যেককে বাপ্পাদিত্য বার্তা দিয়ে গেছেন ।
সে বার্তা পড়তে জানলে সরকার ও দলের
রাগ হবে কিন্তু বাপ্পাদিত্যের বলায় তেমন স্পষ্ট
রাজনীতি নেই । কিন্তু ষা আছে যা আমি
ও আমার স্ত্রী গত নভেম্বরে গোটা একদিন ধরে
ঘুরে ঘুরে দেখে এসেছি সেই  মানুষসমান দীর্ঘ
চেনা নভেম্বরের পোড়া ঘাসের জঙ্গল ।
কয়লা-চুনাপাথর শ্রমিকদের ছেড়ে যাওয়া
কালো কালো পোড়া বাড়ি । সরু পিচের রাস্তা ।
ছোটো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সিম্বলিক এলোমেলো ক্রস যা আসলে খাসি
সম্প্রদায়ের কবরস্থান । যে রকমটি নির্জন
চেরাপুঞ্জিকে বাপ্পাদিত্য দেখিয়েছেন - সোহরা
আসলে সেই রকম একদম । আমিও সেই
চেরাপুঞ্জিকেই দেখে এসেছি । নায়িকা বা মূল
চরিত্র সারা চেরাপুঞ্জির ফাঁকা রাস্তায় ঘুরে
বেড়িয়েছেন কিন্তু তিনি আসলে তার কলকাতা
ত্যাগী লেখক পিতাকে খুঁজতে এসেছিলেন ।
বিশাল ফ্রেমে সেই সব অবাক নিসর্গকেও
বাপ্পাদিত্য দর্শকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন
ক্যামেরার কারুকাজে । এই ছবির ক্যামেরা
লোয়ার রিয়ার অ্যাঙ্গেলে প্রথমে স্থির থাকে
মিনিটব্যাপি ধীরে ধীরে অনেকটা পরে বাঁক নিতে
থাকে খুব কাছ থেকে । মনে হয় থ্রি ডি মুভি
দেখছি না তো । এই সিনেমার এডিটিং প্রচুর জাম্পকাটের ব্যবহারে ছবির স্পিডকে ধরে
রাখতে সাহায্য করেছে । ছবির মিউজিক
খাসিয়াদের রূপককে কখনও তুলে ধরেছে
তো কখনও তার সুর দক্ষিণ আমেরিকার
লোক সংগীতের আঙ্গিকে । কখনো সুরকার
দু- একটি মাত্র যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহারে তার
জাত চিনিয়েছেন । এত কম কথা । স্বল্প উপ
কাহিনী । পিতা-পুত্রির এক সামান্য গল্পকে
এই সিনেমার এডিটররা ( সম্পাদনা)
অসামান্য করে তুলেছেন কতক্ষণ কোথায়
কতখানি রাখতে হবে । এই ছবির সেতুর এক
পারে এক যুবতী যে আজকের দিনের মেয়ে
নিজের শরীর ভোগের কথা যার জানা আছে
ইংরেজি কবিতার মানে যে বুঝতে পারে ;
অবলীলায় ধরাতে পারে একটার পর একটা
সিগারেট । যার কাছে প্রয়োজনে যৌনতা
মদ্যপান দোষের নয় । আর তার ব্রিজ অর্থাৎ
তার পিতাকে খোঁজার প্রয়াস তাকে জানার
ইচ্ছে অবশেষে বুঝতে পারা ও পিছিয়ে থাকা
উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যাকে সম্যক রূপে
উপলব্ধি করার মধ্যে দিয়ে এই গল্পের
প্রয়োজনে এক অন্য ধারার নারী চরিত্র
ফুটিয়ে তুলেছেন যা ভারতীয় সিনেমায়
দ্বিতীয়বার আসেনি । সিনেমাটির প্রধান
অভিনেতা বরুণ চন্দ । তিনি প্রিমিয়ারের
শুরুতেই বলে দিয়ে ছিলেন এই ছবিকে একটু
অন্যভাবে দেখতে হবে । আমি মনোযোগ দিয়ে
দেখিছি - এ ছবি সিনেমার পেইন্টিং ছাড়া
আমি কিছু ভাবতে পারিনি । কারণ গল্পের
থেকে ভিস্যুয়ালাইজেশন রূপান্তরের প্রধান
বিচার্য বিষয় এখানে ক্যামেরা । কীভাবে তা
প্যান করছে কী দৃশ্যপট তুলে ধরছে এই তুলে
ধরার মধ্যে রঙের প্রাচুর্য যা চেরাপুঞ্জির
বাস্তবতা -রুক্ষ প্রাণহীন । বাস্তবিক যেখানে
পানীয় জলের সমস্যা আছে শুষ্কতার মধ্যে
তার নিদর্শন পাই । অথচ এখানেই বৃষ্টিপাত
বেশি । না এটা ছবির বিষয়ে ছিলনা ।
বাপ্পাদিত্য বেঁচে থাকলে তাঁর সব কথা
হয়তো আবারও বলতে পারতেন....
© অলোক কুন্ডু

বুধবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৯

Subhash Bose :Poetry of Alok Kundu

সুভাষ বোস / অলোক কুন্ডু ©®

দেখলেই বোঝা যায় অসময়েও
মুনিম আগর‌ওয়ালার দিন
আজকাল বেশ ভালো যাচ্ছে
তার ক্যানিং স্ট্রিটের দোকানে ভিড় লেগেই আছে ।
ফুটপাতের ছবিঅলা ছাড়াও
ছেলে-ছোকরাদের অনন্ত আনাগোনায়
দেদার বিক্রি হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের মুখ
আর সঙ্গে সঙ্গে টালমাটাল হতে থাকছে
মুনিমের মুখের হাসিও ।

পাশের দোকানের বঙ্কু পোদ্দারদের
এ তল্লাটে তিন পুরুষের রঙের বেওসা ।
যত‌ই ইলেকশন এগিয়ে আসছে
মুনিমের খরিদ্দারের ভিড়
বঙ্কুর দোকানকে ছাপিয়ে চলে যাচ্ছে যেন
বঙ্কু বললো- তুর বাজারটা খুব জমেছে ভাই
                                                     যো বোল ?
এতো দেখছি সুভাষ বোসকে ভি ছাপিয়ে গেল রে।
মুনিমের হাসির সাউন্ড সিস্টেমের স্পিকারে তখন
ডলবি টেকনোলজির ধুম--
মুনিম পিচ্ আওয়াজ করে একটু দূরে
পানের পিক ফেলে এলো
টাকা গুনতে গুনতে
হাসি তার আর থামতেই চায়না ।

এবছর‌ও ২৩ শে জানুয়ারির আগেই
মুনিমের ব‌উ বলে দিয়েছিল
ইবারে কিন্তু ভালো দুটো শাড়ি দিবে
লড়কির জন্য ভি সিসা ওয়ালা লেহেঙ্গা জরুর চাই।
ফি-বছর ২৩ শে জানুয়ারি এলে
বাড়ির সিঁড়িতে গণেশজির পাশে টাঙানো ছবিটায়
ঝাড়পোচ হয় চন্দন লাগানো হয়
প্রতিদিন মালা লাগাতে লাগাতে
মনে মনে বলে 'বেস্ট সেলার বঙয়ালি বলতে তো
একজন‌ই আছেন ।'
-- প্রণাম করে আসছে কতকাল মনে নেই ।
শুধু জানে ছবিটা মুনিমের বাবার আমলের
বেওসায়ি হলেও ছবিটা কিন্তু
পাল্টানোর কথা ভাবেনি সে ।

একদিন এক সাংবাদিক বাবু এসেছিল
জিজ্ঞেস করেছিল রবীন্দ্রনাথ টেগোর
বিশ্ব কবিকে মুনিম চেনে কি না ?
ফুল দূধের চা খাইয়েছিল বাবুকে
বলেছিল কি যে বলেন রবি ঠাকুরকে কে না চেনে
কিন্তু সুভাষ বোসের কাছে কিছু নয়
সুভাষ বোসের ছবি যত ক্যালেন্ডার হয়
স্কুলের ছেলেমেয়েরা যত কেনে
সত্যি বলছি বাবু
আর কার‌ও ছবির অত বেওসা হয়না
সুভাষ বোস ভগবান আছে ভগবান ।

বঙ্কু মস্করা করে আজ বললো
-'কিন্তু এখন তো তোর দোকানের ভিড় সুভাষ বোসের নয় ?
এত ভিড় তো আগে ছিলনা কোনোদিন
এ ভিড় তো --
সুভাষ বোসকে ভি ছাপিয়ে গেল রে।'
টাকা গুনতে গুনতে আর একবার পানের পিক্ ফেলে মুনিম ।
আগের মতো হাসতে পারলো না
মুখটা এখন গম্ভীর হয়ে এলো
বললো -ভিড় তো বড় জোর ইলেকশন পর্যন্ত
জিতলে ভালো
কিন্তু হেরে গেলে কী হবে ভাব
এইসব ছবি একটাও বিক্রি হবে না রে ভাই
গোডাউনেই পড়ে থাকবে ।

ভিড় একটু পাতলা হয়েছে এখন
ওড়িয়া বামুন জগদীশের লাগানো
সদ্য মালা দেওয়া পিতাজির ছবির পাশে
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীমা স্বামীজি রবীন্দ্রনাথ 
ওদিকের দেওয়ালে বিশাল সুভাষচন্দ্র
তার দিকে চেয়ে আছেন 
মুনিম অবাক হয়ে দেখলো
ছবিগুলো থেকে আলোর জ্যোতি বেরিয়ে আসছে...

©® অলোক কুন্ডু

রবিবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৮

গুজরাটের পাটোলা
------------------------
৮০০ বছর আগে গুজরাটের সোলাঙ্কিদের রাজবংশের রানীদের শাড়ি তৈরি করতে মহারাষ্ট্রের কোলাপুর থেকে আমেদাবাদের ১৩০ কিমি দূরে পাটনে ( এখানকার দুর্গা মূর্তিও ৮০০ বছরের প্রাচীন ) চলে আসে । চীন থেকে ৮০০ বছর ধরে রেশমি সুতো আসছে পাটোলা শাড়ি তৈরির শিল্পীদের জন্যে সালভি পরিবারের হাতে । মোটামুটি ভালো পাটোলা শাড়ির দাম দেড় থেকে
আড়াই লাখ টাকা দাম লাগে । শোনা যায় সোনিয়া গান্ধীর যে ছবিটি রেগনের সঙ্গে তোলা হয়েছিলো সেখানে যে শাড়িটি তিনি পরে ছিলেন তার দাম অনেকটাই বেশি । শাড়িটি পাঁচ লাখে কিনেছিলেন রাজীব
গান্ধী । একটি শাড়ি আছে সুইজারল্যান্ডের
যাদুঘরে থাকলেও কে সেই ক্রেতা তার নাম
জানা যায়নি । এই শাড়ির শাড়ি একলাখ
থেকে শুরু । বিশেষ সুতো এর জন্যই আসে। আর এই সালভি পরিবার সেই বুনন তা ৮০০ বছর ধরে তাদের পরিবারের মধ্যেই রেখেছে । এই পরিবারের মেয়েদের পর্যন্ত আগে বোনা ঘরে যাওয়া নিষেধ আছে । তবে অনেক দিন ওই ভাবনা উঠে গেছে ।
এই শাড়ি বোনার আগে নকশা কাগজে কেটে নিতে হয় । যেহেতু সুক্ষ্ম কাগজ কাটতে একমাত্র জাপানিদেরই দক্ষতা
আছে তাই তারা কাগজের নকশা কেটেও এই শাড়ি বুনতে তারা পারেনি জাপানিরা।
পাটোলার বিশেষত্ব হচ্ছে এর সুতো আগে
ডিজাইন হয় পরে বোনা হয় এবং দুপিঠই এর সমান যে কারণে এটি ইউনেস্কোর খাতায় স্বীকৃতি লাভ করেছে । পাটোলায়
এদের একটা আস্ত মিউজিয়াম আছে ।

রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮

Chaniya Coli of Bhuj ©® Alok Kundu

চানিয়া চোলি, ল-গার্ডেন, ভুজৌড়ি ও রানী কি
হাজিরাতে কচ্ছের ক্র্যাফট / ©® অলোক কুন্ডু

গুজরাটের কচ্ছের ট্রাইবাল আর্টিস্টদের কাচ বসানো এমব্রয়ডারি কাজ যুক্ত মেয়েদের ঘাঘরার স্থানীয় নাম চানিয়া চোলি ( চ্যানিয়া চোলি ) চোলি অর্থাৎ ভারতীয় মহিলাদের সনাতন ড্রেসকোডের উপরাংশ অর্থাৎ ব্লাউজ । চানিয়া চোলি অথবা ঘাঘরা চোলি বা লেহেঙ্গা চোলি ভারতবর্ষের মধ্য ও উত্তর ভারত এবং নেপাল জুড়ে তিনপিসের ( ঘাঘরা চোলি দোপাট্টা/চুনরি) এই ট্র্যাডিশনাল ড্রেসটি উৎসব ও বিয়ে বাড়িতে মেয়েদের মহান পোশাক হিসেবে ১০ ম সেঞ্চুরি থেকে উঠে এসেছে এবং মোঘল আমলে এই পোশাকের রমরমা ও বৈচিত্র্যময়তায় প্রভাব পড়ে ।
তবে এই ঘাঘরা চোলির গুজরাটি সংস্করণ চানিয়া চোলি তৈরি করতে ২০ দিন সময়
লাগে । গুজরাটের কচ্ছে বহুল পরিমাণে ঘরে ঘরে তৈরি হয় । সকলেই জানেন কচ্ছে লবণ পাওয়া যায় , উটের আন্তর্জাতিক দৌড় প্রতিযোগিতা হয় , ঘরে ঘরে পালিত হয় মোষ,
তাই প্রচুর ঘি-দুধ পাওয়া যায় । ভুজে আমির
খান লগান করেছিলেন মনে আছে নিশ্চয়ই ।
প্রায় মরুভূমির দেশে দেখার জিনিস অনেক আছে । বিশেষকরে ভুজের ক্র্যাফট মার্কেট
সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত । এখানকার জিনিস ইউনেস্কোর ক্র্যাফট প্রদর্শনীতে স্থান করে
নিয়েছে । এখানকার বাঁধনি থেকে ভেজিটেবল ভাইয়ের সুতির কাপড় শাড়ি আজ ভারতের বাজার থেকে বিদেশের রপ্তানি হয় । শুধু শাড়ি কাপড় নয় এমনকি ঘাঘরাও নয় সোফা কভার থেকে বালিশের ওয়াড় ব্যাগ থেকে বটুয়া পর্দা থেকে জ্যাকেট শাল কোনো আইটেম‌ই তৈরি হতে বাকি নেই এই ভুজে। কিন্তু ট্যুরিস্টরা খুব একটা ভুজে যাননা । গেলেও রাত্রি বাস করে বেরিয়ে যান । কোঅপারেটিভ সিস্টেমে ভুজে
মেয়েরা ছেলেরা এই হাতের কাজ করে থাকে ।
সেখানে চানিয়াচোলি ছাড়াও অঢেল হ্যান্ডিক্র্যাফটের জিনিস পাওয়া যায় ।
শহর থেকে ১৫ কিমি দূরে ভুজৌড়িতে গড়ে উঠেছে ঝাঁ চকচকে দোকান থেকে গেরস্তের
বাড়িতে ক্র্যাফট আইটেমের বাজার । আজরখপুরে ঘরে ঘরে তৈরি হয় আজরখ
হ্যান্ড প্রিন্টের সিল্ক তসর শাড়ি সুতির ড্রেস
মেটিরিয়াল । ভুজ বাজারের ফল পট্টির
ভেতরেও এই সব ক্র্যাফট ও প্রিন্টের রেডিমেড
কিছু দোকান আছে । কচ্ছে তিনদিন লাগবে
একদিন প্রাসাদ মহল মন্দির মিউজিয়াম এইসব দেখে নিতে । একদিন নুনের বিচ রান । একদিন ভুজৌরিও আজরখপুর । কেনেন বা না কেনেন জিনিসপত্র দেখাটাই আপনার ট্যুরকে সমৃদ্ধ
করবে । এই সবই ডলারে বিক্রি হবে কচ্ছের
রান উৎসবে । অক্টোবর থেকেই তার তাঁবু
পড়তে শুরু করেছে । জলের ট্যাঙ্কার তেলের
টাঙ্কার বাথরুমের ঝকঝকে দেখে শীতে বুঝতেই
পারবেন না এটা একটা মরুভূমির দেশ ।
এলাহি করে সাজানো শুরু হয়েছে রান উৎসবের
অস্থায়ী পার্ক, দোকান, এসি ঘর ,ঝকঝকে রাস্তা।
একমাস ধরে এইসব থাকবে তবে মূল উৎসব
সাতদিনের । তাতেই লক্ষ লক্ষ ডলার আমদানি
হবে । হ্যাঁ যা বলছিলাম তা হলো এই ভুজৌড়িতেই
তৈরি হয় গুজরাটি চানিয়া চোলি । কলকাতায়
ডান্ডিয়া নাচের মেয়েদের এই ড্রেস পরতে দেখলেও নবরাত্রিতে লোকাল মেয়েরা লাঠি
ছাড়াই নিজেদের পোশাকে নাচ গান করে থাকেন। যদি আপনি ভুজৌড়ি না যেতে পারেন
তাড়াতাড়িতে তাহলে ভুজের ফল মার্কেটের ভেতরে কয়েকটা দোকান পাবেন । তা নাহলে
আমেদাবাদের ল গার্ডেনের ফুটপাত মার্কেটেও
ভুজের হ্যান্ডিক্র্যাফট অঢেল পেয়ে যাবেন ।
ওখানে চানিয়া চোলি থেকে ব্লাউজ সবকিছু
একটু দরদাম করে কিনতে হবে আপনাকে আর
এইসব কাপড় কিনতে চাইলে বা আরও একটু ভালো নিতে চাইলে ভুজৌড়ি অথবা আমেদাবাদের মানিকচকের রানী কি হাজিরাতে অনেক গুলো হোলসেল ও রিটেল দোকান
আছে । এইসব ইন্টারনেটে পাওয়া গেলেও লোকাল মানুষকে বলে জায়গা উদ্ধার করা খুব
সহজ কাজ নয় । এতদিন এই তিনটি জায়গাকে একসঙ্গে করে কেউ প্রকাশ করেনি । আমি এইসব খুঁজে পেতে ভুক্তভোগী এবং অনেক
সময় খরচ করে এইসব জায়গায় গেছি । সঙ্গে আমেদাবাদের ল-গার্ডেনের ও রানী কি হাজিরা
মার্কেটের ছবি দিলাম । ©® অলোক কুমার কুন্ডু



বৃহস্পতিবার, ১ নভেম্বর, ২০১৮

RANI KI VAV ,PATAN,GUJRAT

রানী কি ভাও ( Rani Ki Vav) ও পাটোলা
শাড়ির জন্য গুজরাটের পাটন বিখ্যাত - অলোক কুন্ডু

স্বাধীনতার বহু আগে পোরবন্দরে গান্ধীজি জন্মগ্রহণ করেছিলেন । পরে রাজকোটে গান্ধীজির বাল্যকাল কাটে । কিন্তু গান্ধীজি
সবরমতীর তীরে আশ্রম গড়ে যখন থাকতে লাগলেন তখন গান্ধীজি বলেছিলেন -"প্রথমত
আমি গুজরাটি দ্বিতীয়ত এই আশ্রম গড়তে
পয়সাঅলা কিছু মানুষের দরকার তা আমেদাবাদে আছে । আমেদাবাদে এখনও
অনেক কিছু করার আছে " সেই আমেদাবাদ বহু
বছর গুজরাটের রাজধানী ছিল এবং এখন‌ও আমেদাবাদ আর গান্ধীনগর গায়ে গায়ে ।
কোনটা আমেদাবাদ আর কোনটা গান্ধী নগর
বোঝা দায় । সে যাই  হোকনা কেন, আমেদাবাদের নির্মাতা আহমেদ শা, সোলাঙ্কিদের
পরাস্ত করে তাদের বৃহত্তর গুজরাটের রাজধানী পাটনকে তুলে আনেন সবরমতীর তীরে নাম দেন আহমেদাবাদ । আসলে মহারাষ্ট্রের কিছু অংশ নিয়ে ,সৌরাষ্ট্র সহ গুজরাটের রাজধানী ছিল পাটন । সোলাঙ্কি রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা বনরাজ চাওডা (৭৪৫ AD) Anhilpur-Patan নামে গুজরাটের রাজধানীর পত্তন করেন । ইন্টারনেট হ‌ওয়ায় আমরা মাত্র কয়েক বছর হলো এই পাটনের নাম রপ্ত করতে পেরেছি । তার আগে কেবলমাত্র ইতিহাসের ছাত্র ছাত্রীরাই ও পর্যটকদের মধ্যে পাটনের পরিচিত সীমাবদ্ধ ছিল । কিন্তু সাধারণ বাঙালির মধ্যেও পাটন বলতে নেপালের পাটনের নাম‌ই মনে
পড়ে । আমেদাবাদ ( আহমেদাবাদ বা আমদাবাদ ) থেকে পাটনের দূরত্ব আগে ছিল ১০৮ কিঃমিঃ ( গুগল ১৪৫ ) কিন্তু আমি
গেছি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ রুট ধরে মেহেসানা ও
মোদেরার সূর্য মন্দিরের মতো হেরিটেজ ছুঁয়ে ( আমেদাবাদ-পাটন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হাইওয়ে )
একদিকে ১৩৫ কিঃমিঃ হবে । একেবারেই গ্রাম বলা যায় । বিশেষ করে আদি পাটন , সিটি থেকে একটু দূরে তৈরি হয়েছে । আসল পাটন
প্রায় গ্রামের মতোই আছে । হাঁটা পথে (১) পাটোলা হাউস মিউজিয়াম (২) পাটন হেরিটেজ
মিউজিয়াম (৩) রানী কি ভাও ১০/১৫ মিঃ-এর মধ্যে হয়ে যাবে , দেখতে কিন্তু ২ ঘন্টার মতো
সময় দিতে হবে , কারণ রানী কি ভাওয়ের পিছনেই আছে সোলাঙ্কি রাজাদের আর এক স্টেপ ওয়েল বলা যায় প্রজাদের জন্য জলের
তালাও/তালাব/পুকুর /ভাও বাঁধানো ও একসময়ের ওই ভাওতেও মন্দির ছিল জলের
মধ্যে । চতুর্দিকে চ্যানেল করা মাঝে উঁচু জমি
তাতে মনে হয় এটিও ছিল জলের রিজার্ভার
এবং কাছেই ছিল সরস্বতী নদী । সেখান থেকে
জল আসতো । এখন নদী এক কিলোমিটার
দূরে । এখন তৈরি হয়েছে সেখানে একটি ফিল্টার
পানীয় জলের প্রকল্প এই দ্বিতীয় ভাওয়ের অনতিদূরে । যদিও দ্বিতীয় খোলা সাদামাটা
জলের বিস্তৃত ঘাট , খুব বেশি স্থাপত্য নেই ।
ছিল কিনা বোঝার উপায় নেই । তবে তথ্য
বলছে ওখানেও ঘাটে জলের ওপর মন্দির
ছিল , ভাঙা কিছু বাস্তু পড়ে আছে । মনে করা
হয় এখানে মহিলা ও পুরুষদের আলাদা ঘাট
ছিল জলের মধ্যে মন্দিরকে ঘিরে । আসলে
গুজরাটকে সুলতান মাহমুদ থেকে মহম্মদ গোরি, তৈমুর লঙ,হুমায়ূন থেকে ঔরঙ্গজেব এমনকি আকবর আক্রমণ করে দখল করতে চান । আফগানিস্তান মধ্য এশিয়া , দিল্লির সুলতান
ও বিভিন্ন প্রান্তিক রাজত্ব বহুকাল ধরে গুজরাটকে আক্রমণের দিশা করেন ও ধ্বংসলীলা চালিয়ে যান । গুজরাট নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি সুলতান
ও তাদের আমির ওমরাহ ও স্থানীয় শাসকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে ছিল । দীর্ঘ দিনের
লড়াই চলে তার মধ্যে দু/তিন বার মুঘল সাম্রাজ্যে
থেকে গুজরাট হাতছাড়া হয়ে যায় । কিছু বছর
আগে এই পাটনে সরপঞ্চ নির্বাচন নিয়ে হিন্দু-মুশলিম রায়ট হয়েছিল , যদিও সেইসব ঘটনা যেন আর না হয় দেখতে হবে গুজরাট প্রশাসন ও সরকারকে । আমি ট্যুরিস্ট হিসেবে পাটনকে দেখতে চাই তার মলিনতা
যেন আমার মন খারাপ করে না দেয় । পাটনের ২০১১-এর জনসংখ্যা ১,৩৩,৭৪৪ । হিউয়েন
সাঙ গুজরাটের বহু স্থানের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করেছেন কিন্তু তখন পাটন ছিলনা । আইহোল লিপি থেকে জানতে পারি নর্মদা থেকে কাবেরী পর্যন্ত চালুক্য রাজত্বের সীমান্ত ছিল । ৭৪৫ AD তে চালুক্য / সোলাঙ্কি রাজত্বের প্রতিষ্ঠা করেন বনরাজ চাওডা । উত্তর মহারাষ্ট্র ও বিদর্ভে বাকাটদের পতনের পর সোলাঙ্কি রাজত্ব দুর্ভেদ্য করতে তাঁরা ( ৯৪০ CE থেকে ১১২২ CE) তারা
পাওয়াগড়ে দূর্গ নির্মান করেন । ১৫ সেঞ্চুরিতে
মহম্মদ বেগাদা পাওয়াগড়‌ও দখল করে নেন ।
বর্তমানে ভদোদরা থেকে ট্যুর নিয়ে রোপ‌ওয়ে করে পাওয়াগড়ের ধ্বংসাবশেষ দেখে নেওয়া
যায় । পাটন হলো মাউন্ট আবু ও আমেদাবাদের মাঝে । পাটনের পথে পড়ে হিন্দু মন্দির স্থানীয়
মদেরা গ্রামে ( এটিও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত) । মদেরায় জানুয়ারি মাসে তিন দিনের
ক্ল্যাসিক্যাল ড্যান্সের ফেস্টিভ্যাল হয় । মদেরার
মন্দিরটি ভারতের দ্বিতীয় সূর্য মন্দিরের তকমা
পেয়েছে ও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে স্থান পেয়েছে
মন্দির তৈরি করেন সোলাঙ্কি/ চালুক্য রাজা
ভীম-১ । মোদেরার কাছেই আছে আর এক
সূর্য মন্দির ও রাজ প্রাসাদ পুষ্পবতী নদীর তীরে। মেহেসনাতে । মেহেসনার চামুণ্ডা মন্দির বিখ্যাত মূর্তি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত । তৈরি করেন Mehsaji । মোদেরার সূর্য মন্দিরের সঙ্গে আছে
সমবেত হল, সূর্য কুন্ড ও মন্দির এবং এইসব
ভগ্নাংশ নিয়ে একটি দুর্লভ মিউজিয়াম । সুন্দর বাগান আছে সবকটি হেরিটেজের সঙ্গে এগুলির
সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রীত্ব
কালে । সোলাঙ্কিরা ৮০০ বছর আগে সৌরাষ্ট্র
থেকে যে তাঁত শিল্পীকে এনেছিলেন রানীর
শাড়ি তৈরির জন্য তারা পাটনে থেকে গেছেন।
এঁদের শাড়ির নাম হলো পাটোলা । এঁদের পদবী
থেকে শাড়ির নাম । ক্রমে ৭০০ বংশধর মিলে সারা বিশ্বের বাজারে পাটোলা শাড়ি পাঠানো
ছিল এদের পারিবারিক ব্যবসা । প্রথম দিকে
এরা নিজের মেয়েকে এই শাড়ি তৈরির ব্যাকরণ
শেখাতো না । পরে তা আটকানো যায়নি । এখন
এঁদের পরিবারের ধন দৌলতের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা
ও অন্যান্য ব্যবসায় এরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে
পড়েছে । যার ফলে এখন একটা পরিবার এই
বিদ্যা ধরে রেখেছে পাটনে । যার মিনিমাম দাম
এক লাখ থেকে সাত/ আট লাখ । পাটনে ডুপ্লিকেট ছাপ মেরে পাটোলা বিক্রি হয় তার
দাম‌ও ১০.০০০/- হাজার । কিন্তু সেগুলি নামে
পাটোলা নয় এবং ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ ভুক্ত নয় ।
পাটোলা শাড়ি বাজারে পাওয়া যায় না । এঁদের
কাছে অর্ডার দিতে হয় । রাজা ভীম -২( পিতাপুত্র মিলে ১০২২-১০৬৪) হঠাৎ মারা যেতে রানী
উদয়মতী এই নান্দনিক আশ্চর্য এবং বিস্ময়কর
স্টেপ ওয়েল বা ধাপ কুয়োটি তৈরি করেন কিন্তু
তিনি সমস্তটা দেখে যেতে পারেননি । মূলা রাজা ও খেমরাজা দুই বংশধর রেখে যান । Rani Ki Vav সরস্বতী নদীর তীরে ( ১১ সেঞ্চুরিতে তৈরি)
বর্তমান ১০০ টাকার ল্যাভেন্ডার কালার ব্যাঙ্ক নোটের উল্টোদিকে রানী কি ভাওয়ের মোটিফ
মুদ্রিত হ‌ওয়ায় গুজরাটের ঐতিহাসিক মূল্যকে
ভারত সরকারের এক বিরল স্বীকৃতি হিসেবে
দেখছে গুজরাটিরা । ৬৬ মিটার চওড়া ও
১৪২ মিটার লম্বা এটি সাত তলা বিশিষ্ট সিঁড়ি
দিয়ে নীচে নেমে গেছে ( এখনকার মাপে ১০/১২
তলা নীচে হবে) তবে বিভিন্ন সময়ে পাটনে দেশী-বিদেশী সুলতানদের আক্রমণে রানী কি
ভাওয়ের উপরের অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে ।
হিন্দু ধর্মের দেবতা ও অপ্সরা মূর্তি দিয়ে সুনিপুণ ভাবে বালি পাথরে খোদাই করা এই তালাও
বা পুকুর । ২০১৪ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের ও ২০১৬
ভারতের শ্রেষ্ঠ পরিচ্ছন্নতা পুরস্কার পায় এই
সৌন্দর্য স্থাপত্য । দুর্গা কল্কি অবতার শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরামের মূর্তি গুলি করা বলছে যেন । অনুপম
খোদাইকৃত কিছু ঝাফরিও আছে দেওয়াল বরাবর । ৫০০ র বেশি মূল বড় মৌলিক ভাস্কর্য
প্যানেল ও ১০০০ এর বেশি মিনিয়েচার ভাস্কর্য
প্যানেল ছাড়াও থাম , সিলিং, জাফরি দেওয়ালে
ধর্মীয় মোটিফে ভারতীয় ধর্মীয় মাইথোলজির
বিকাশ ঘটেছে । আছে যোগিনী, নাগকন্যা, সোলহা-সিঙ্গার বিশিষ্ট স্টাইল , বিষ্ণুর দশাবতার। মোট ১৬ রকমের স্টাইলে ফেসিয়ালের দেখা মেলে এখানে ।  একেবারে শেষে একটি কুয়ো সংশ্লিষ্ট হয়েছে যার উপরের অংশের তিন দিক ঘেরা সেখানে পোড়া ইঁট লক্ষনীয় । এই ট্যাঙ্কটি উপর থেকে ক্যামেরা দিয়ে দেখতে হয় ঝুঁকে দেখা যায় না । সেখানে জল আছে। ৯. ৫ /১০ মিটার গোল আকৃতির ও ডিপ ২৩ মিটার। এন্সিয়েন্ট রাজস্থানী শিল্প রীতিতে এই আয়তাকার পুকুরের স্থাপত্য রূপ পেয়েছে । এই ধরনের ধাপ পুকুরের মধ্যে পৃথিবীর মধ্যে এটি সর্বশ্রেষ্ঠ । একে ১১ সেঞ্চুরির ওয়ান্ডার্স বলা হয়েছে । ৫০/৬০ বছর আগেও এখানকার জলে জন্মানো জড়িবুটি থেকে ভাইরাল রোগ সেরে যাওয়ার বহু প্রমাণ আছে । কিন্তু রানী কি ভাউ এখন সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচ্ছন্ন স্থান হয়েছে তাই এর বাইরে হয়েছে সুন্দর মনোরম মনোমুগ্ধকর বাগান । গাড়ি পার্কিং ঠান্ডা ফিল্টার করা পানীয় জলের ব্যবস্থা । রানী কি ভাও কে ঝকঝকে তকতকে করা হয়েছে । জায়গায় মাপ ১১.৬ একর । বাবার জোন
৩১০.০ একর । এর সমস্তটায় আজ আর যেতে দেওয়া হয়না স্যুইসাইড করা ও স্থাপত্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ভয়ে । ভেতরে একটি ট্যানেল ছিল যেটি এখন বুঝিয়ে বেলা হয়েছে পাথর ও কাদা দিয়ে নিরাপত্তার জন্য । ঐতিহাসিকরা মনে করেন আক্রমণ হলে রাজার সৈন্য সামন্ত নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা করা ছিল কেউ বলেন বর্ষায় জল আনার জন্য। তবে রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য‌ও একে ব্যবহার করার যতটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ । এটি ৬৪ মিটার লম্বা ও ২০ মিটার প্রশস্ত ছিল । করিডোর হিসেবেই এটি ব্যবহার হতো মনে হয় ।
ট্যানেলটি পাটনের একটি গ্রাম সিদপুর পর্যন্ত
গিয়ে মিশেছে । এই রানী কি ভাওতে সিঁড়ি ভেঙে
নামলে ঠান্ডা বাতাস অনুভব করবেন । কোনো রানী তার ভালোবাসার জন্য কোনো রাজার জন্য এমন নিরিবিলি সৌধ নির্মাণ করে গেছেন কিনা
সন্দেহ হয় । অনেকে বলেন বিধবা রানী এই
নিরিবিলি পুকুরে এসে রাজা ভীমের জন্য দুঃখ
ভাসাতেই এরকমটা করেছিলেন সেখানে ধর্মীয়
মোটিফে তিনি বুকের কষ্ট দেবতার কাছে অর্পণ
করতেন কিন্তু এই স্থাপত্য শেষ হ‌ওয়ার আগেই
রাণি মারা যান । যেহেতু এটি ভূমিকম্পের প্রন
এরিয়া তাই এর স্ট্রাকচার  মাঝে মাঝেই পরীক্ষা
করা হয় । ভুজের ভূমিকম্পের সময় খুব একটা
এর ক্ষতি হয়নি যা বিভিন্ন আক্রমণে এখানকার
ক্ষতি হয় । অনেকেই মনে করেন পাটনে এতবার
আক্রমণ হ‌ওয়া সত্বেও রানী কি ভাইয়ের উপরের
অংশ ছাড়া কিছু মাত্র ক্ষতি করতে পারেনি আক্রমণকারীরা । রাজা কর্ণ এই কাজটি শেষ করেন । Copyright  ©®Alok Kumar Kundu

বুধবার, ১০ অক্টোবর, ২০১৮

বেতারে মহিষাশুরমর্দিনী তৈরির ইতিহাস পর্ব

রেডিওর প্রাক্কালে প্রদীপের সলতে পাকানো থেকে আলো জ্বালানোর দেবদূত : অবহেলিত বাণীকুমার ও মহিষাশুরমর্দিনী প্রসঙ্গ একটি
ঐতিহাসিক দলিল ও তার সম্ভার...
©® অলোক কুন্ডু

শাহজাহানকে কে আর অতটা মনে রেখেছেন
যতটা উদ্ভাসিত তাজমহল । তেমনি বাণীকুমার
হয়ে গেছেন শাহজাহান । আর তাজমহলের রূপ
পেয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । ১৮৯৫ সালে
বঙ্গের কৃতী সন্তান আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু
প্রথম বেতার তরঙ্গ সম্প্রসারণ করে দেখালেন।
১৯২২ ইংল্যান্ডের রেডিও জগতে দেখা দিল বিবিসি । ১৯২৪ এদেশে প্রাইভেট রেডিও ক্লাব চালু হলে কানে হেডফোন লাগিয়ে একজন সেই রেডিও শুনতে পারতেন। মূলত ধনীদের মধ্যেই এই ধরনের রেডিও চালু ছিল --অনেকাল
ধরেই । প্রথমে মাদ্রাজ-পন্ডিচেরির পর ২৩.৭.১৯২৭ বম্বেতে এই রেডিও হাউসের
পত্তন হলো । পরে ২৬.৮.১৯২৭ হলো ওদের
শাখা কলকাতায়। নাম হয় -ইন্ডিয়ান স্টেটস্ ব্রডকাস্ট সার্ভিস । Reits Microphone এ তখন সম্প্রচার হতো , দু-ফুট দূরে বসতে
হতো মাইককে ছেড়ে । ১ এপ্রিল ১৯৩০ এই কোম্পানিকে পুরোপুরি অধিগ্রহণ করে নাম পরিবর্তন করলেন ব্রিটিশরা , হলো - ইন্ডিয়া ব্রডকাস্টিং কোম্পানি । হেড অফিস বম্বের  (মুম্বাই) ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং সার্ভিস যেটা
ছিল । তার নাম‌ও পরিবর্তন হয়ে গেছে ।
বাড়ি ভাড়া নিয়ে ১ নং গার্স্টিন প্লেসে
কলকাতায় তাদের নতুন সংস্থার শাখা ।
অধিকর্তা হিসেবে আসেন- স্টেপলটন সাহেব । ভারতীয় অনুষ্ঠানের তত্বাবধায়ক হন ক্ল্যারিনেট শিল্পী - নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার , সহচর হিসেবে
যোগ দেন সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল
( বুড়োদা)। ১৯৩০ এ যখন বৃটিশ সরকার ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি অধিগ্রহণ
করে নেয় এবং কর্মসূচি বর্ধিত করার কাজ
শুরু করে তখন নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার
সহকারী প্রোগ্রাম ডিরেক্টর হন । সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী অন্যতম অধিকর্তা হিসেবে
যুক্ত হন এই বেতার ব্যবস্থার সঙ্গে ।
অ্যানাউন্সার ছিলেন মোহনবাগানের রাজেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ওরফে রাজেন সেন । তখন‌ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র যোগ দেননি । তিনি তখন এদিকে সেদিকে নাটক করে বেড়াচ্ছেন ।
স্তোত্রপাঠে তেমন করে নিমগ্ন হননি ।
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের জন্ম হয় ৪.৮.১৯০৫ ও
তিনি প্রয়াত হন ৩.১১.১৯৯১ । জীবনে নাটক
বেতার নাটক ছাড়াও বিরুপাক্ষ ছদ্মনামে
তার অনেক ছোট ফিচার ও নাটকের ব‌ই
আছে । জীবদ্দশায় তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ
নাটক ও ব‌ই লিখেছেন । ছোট থেকেই
কলকাতার তেলিপাড়া লেনের রাজেন্দ্রনাথ দে নামক এক পন্ডিত ব্যক্তির কাছে তিনি
অল্পস্বল্প চন্ডীপাঠে তাঁর হাতেখড়ি নেন ।
তখনকার দিনের আবৃত্তিকার হিসেবে বীরেন
ভদ্র মশাইয়ের নামডাক হতে থাকে । নাটকের দিকেই তাঁর বেশি মোহ ছিল । পরে আকাশবাণীর
নাট্য বিভাগের দায়িত্ব‌ও সামলে ছিলেন ।
বীরুপাক্ষ ছদ্মনাম নিয়ে মঞ্চে ও রেডিওতে
মজার অনুষ্ঠান ও নাটক সম্প্রচারে তিনি বাঙালির মন জয় করে নিয়েছিলেন । পরে
রেলের ও স‌ওদাগরি অফিসের চাকরি ছেড়ে
রেডিওর সঙ্গে যুক্ত হলেও সরকার তাকে পেনশন
দেয়নি বলে শোনা যায় । ১৯৩১ রেডিওতে একটা
নতুন কিছু করার তাগিদে নৃপেন বাবু ও অন্যান্যদের অনুরোধে বাণীকুমারের পুরনো
লেখা বসন্তেশ্বরীতে গদ্য পাঠে যৎসামান্য অংশ নিয়েছিলেন বীরেন ভদ্র কিন্তু তখন‌ই তিনি তার জাত চিনিয়ে দেন রেডিওর কর্তাদের কাছে ।
১৯০৭ সালের ২৩ নভেম্বরে হাওড়ার কানপুর
গ্রামে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন বেতারের মহিষাশুরমর্দিনীর শ্রষ্ঠা বাণীকুমার ওরফে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য । পিতা সংস্কৃত-পন্ডিত ও ঐতিহাসিক, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য যিনি ঐতিহাসিক " রায় বাঘিনী"র ইতিহাসকার । বাণীকুমারের মাতা ছিলেন-অপর্ণা ভট্টাচার্য । বাণীকুমারদের আসল বাড়ি ছিল হুগলির আঁটপুরে । দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে থাকতেন বিধুভূষণবাবু । কার্যকারণে বাণীকুমারের পিতা একসময়
উঠে এলেন মধ্য হাওড়ার খুরুট ধর্মতলায় । নিলেন ভাড়া বাড়িও । এখানে পিতার টোলেই বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের প্রাথমিক শিক্ষা হয় ।
এরপর হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন বৈদ্যনাথ ওরফে বাণীকুমার । কিন্তু ভাড়া বাড়ি ছেড়ে অবশেষে তাঁরা হাওড়ার রামরাজাতলা-সাত্রাগাছি অঞ্চলে বট গাছের মোড়ে সান্যালদের বাড়ি যেখানে সেই বাড়িতে উঠে যান । বাণীকুমারের পিতা ও পিতামহ দুজনেই ছিলেন সংস্কৃত পন্ডিত, বাড়িতে তাই সংস্কৃতের বরাবরই চর্চা ছিল ।
কিন্তু সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে পন্ডিত বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য যুক্ত থাকায় ম্যাট্রিক পাশ করার পর ছেলেকে তিনি প্রেসিডেন্সিতে প্রথমে আই.এ
এবং তারপরে সেখানেই ইংরেজিতে বি.এ.
অনার্সে ভর্তি করে দেন ।  একে তো সংস্কৃত ঘরাণায় বাণীকুমারের বড় হয়ে ওঠা সেই সঙ্গে ইংরেজিতে নাটক নভেল জানায় তিনি কাব্যচর্চায় ও সাহিত্যে অতি দক্ষ হয়ে ওঠেন । হাওড়া
জেলা স্কুলে তাঁর শিক্ষক কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়, তাঁর‌ই উৎসাহে বৈদ্যনাথ লিখতে শুরু করে দেন। কবিতা ও অনুবাদ সাহিত্য ছাড়াও ছোট নাটিকা লেখায় তিনি একপ্রকার কিছু দিনের মধ্যেই সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠলেন । কলেজে পড়ার সময়ই সংস্কৃতে ব্যুৎপত্তির জন্য কলেজের সস্কৃতের অধ্যাপক বাগবাজারের পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে । কলেজ সমাপ্তির পর পিতার উৎসাহে সংস্কৃত বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ পড়াশোনা শুরু করে দেন এবং শাস্ত্রীমশাইয়ের টোল থেকে সরকারের দেওয়া কাব্য সরস্বতী উপাধি লাভ করেন । এর কিছুদিন পর তিনি চাকরি পান টাকশালে । পিতা আর দেরি না করে হাওড়ার সান্ত্রাগাছিতে থাকার সময়ই তাঁর বিয়ে দিয়ে
দেন গৌরীদেবীর সঙ্গে । বানীকুমার লিখে
গেছেন - "মহিষাশুরমর্দিনী আমার প্রথম
যৌবনের রচনা ।" মূল রূপটির বিশেষ
পরিবর্তন না ঘটলেও বেতারের মহিষাশুরমর্দিনীর মধ্যে শাশ্বত সত্য এক অতিথিবৎসল ভারতের শান্তিময় জীবনের মর্মকথা ধরা আছে ।
১৯২৮ সাল থেকেই বেতারের সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে । কলকাতার বেতার তখন আধুনিক
যুগের মনোরঞ্জনের একটি অতি আবশ্যিক ও উচ্চতর মাধ্যম । ইংরেজি ১৯২৮ সালের
২৬ শে আগষ্ট বেতারের আমন্ত্রণে বেতারজগৎ-এ
প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা । --"ধরার আঙিনা হ'তে ওই শোনো উঠিল আকাশবাণী" পরে যখন ইডেন গার্ডেনে ১৫.৯.১৯৫৮ তে  রেডিও অফিস উঠে এলো তখন তার নাম
হলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেওয়া সেই- আকাশবাণী । অবশ্য বৃটিশদের প্রশাসনের
সুবিধার জন্য তারা ১৯৩৬-এ গার্স্টিঙ প্লেসে
থাকার সময়ই রেডিও কোম্পানির নাম
পরিবর্তন করে সরাসরি শাসনে নিয়ে আসেন
ও নাম হয়- অল ইন্ডিয়া রেডিও । রেডিও
তখন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে বাণীকুমারের
ভাবনায় এলো কীভাবে রবীন্দ্রনাথের নাটক
ও ছোটগল্প শ্রুতিমধুরভাবে সম্প্রচার করা
যায় । এখানে বলে রাখা ভালো শুধু মহিষাশুরমর্দিনীতেই বাণীকুমার মেতে থাকলেন না অথবা ছিলেন না । রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প ও নাটক থেকে একের পর এক শ্রুতিনাটক তৈরি করতে শুরু করলেন তিনি। বেতারেই হলো তার ঘরবাড়ি । টাকশালে চাকরি শুরুর আগেই বন্ধুদের নিয়ে যৌথ ভাবে গড়ে তুলেছেন ,"চিত্রা সংসদ"  নামে একটি ছোট নাট্যদল । সেখানেই রাজেন্দ্র সেন বীরেন্দ্র ভদ্রকে দেখতে পান বেতারের কর্মাধ্যক্ষ শ্রী নৃপেন্দ্রচন্দ্র মজুমদার মহাশয় । ইতিপূর্বে টাকশাল থেকে ১ নং গ্রাস্টিন প্লেসে অফিসের পর প্রোগ্রামের আশায় আসতে শুরু করেছেন । ছোট ছোট কাজ পাচ্ছেন ।
খোদ বৃটিশ সরকারের কর্মচারী । পার্টটাইম কাজে তাই ছদ্মনামে মিন্ট অফিসের বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য পরিচিত হলেন বাণীকুমারে । শেষ পর্যন্ত নাট্য প্রেমিক, স্ক্রিপ্ট রাইটার ,কবি গীতিকার,
তিনটি ভাষায় পন্ডিত বাণীকুমার আকাশবাণীতে , "চিফ প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ"হিসেবে কর্মরত ছিলেন । ওইখানে ঘোষক হিসেবে আগেই যোগদেন রাজেন সেন । আর এক ঘোষক ও পাঠক বিজন বসু , গল্প দাদুর আসর চালাতে এলেন ১৯২৮-এ । এলেন সঙ্গীত শিল্পী সাগির
খাঁ, পাঞ্জাবি গাইয়ে হরিশ্চন্দ্র বালি । সঙ্গীতজ্ঞ রাইচাঁদ বড়াল । রেডিও স্টেশন চালানোর
মতো সমাজের গণ্যমান্য শিল্পী-সাহিত্যিকের
দল , এলেন শিশির কুমার মিত্র, নলিনীকান্ত
সরকারের মতো প্রশাসকরা । ড. ইন্দিরা বিশ্বাস বসু যিনি বেতারজগৎ ও অল ইন্ডিয়া রেডিও নিয়ে ডক্টরেট করেছেন বাস্তব তথ্য খানিকটা
তার থিসিস পেপারের সঙ্গে মেনে নিতে হয় ।
তিনি বলেছেন- বেতারে বাণীকুমার প্লে-আর্টিস্ট
হিসেবে প্রথম যোগদান করেন । মুন্ডক উপনিষদ ও মার্কন্ডেয় পুরাণের দেবীস্তুতি অর্থাৎ চন্ডীপাঠটি বাণীকুমারের হুবহু মুখস্থ ছিল । পাঠ‌ও করতে পারতেন । ১৯৭৮ সালে বহু বছর পরে প্রথম এইচ‌এমভি কর্তৃক ভূবনভোলানো মহিষাশুরমর্দিনীর রেকর্ড বের হলো , কপিরাইট র‌ইলো AIR -এর হাতে । ১৯৬৫ সালেও মহিষাশুরযর্দিনীর শো-গুলি লাইভ প্রোগ্রামে
হতো । গানের শিল্পীরা ছিলেন- সুপ্রীতি ঘোষ,কৃষ্ণা দাশগুপ্ত, শিপ্রা বসু , মানবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমলভূষণ, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়,অরুণকৃষ্ণ ঘোষ, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, ইলা বসু , আরতি মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, উৎপলা সেন ,ধীরেন
বসু, অসীমা ভট্টাচার্য । শিল্পী ও সহকারী মিলিয়ে প্রায় ৫০ জনের বঙ্গ বিজয়ী একটা দল তৈরি হয়েছিল সেই সময় এবং সেই দলের তিন
তারকা ছিলেন বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । শ্লোকের উচ্চারণ ও তার তর্জমাগুলি বাণীকুমার প্রস্তাবিত স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী হুবহু তুলে নিয়ে তাকে আরও মাধুর্যতর করে এবং স্বরক্ষেপণকে ব্যঞ্জনাময় করে তোলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র । যে কারণে প্রথমবার বাণীকুমার নিজেই যে চন্ডিস্তুতিগুলি বসন্তেশ্বরীতে
পাঠ করেছিলেন পরে সেগুলির সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেন বয়সে বড় ও পদাধিকারে নীচে থাকা
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে । এই অসাধারণ আয়োজনের রচনা ও প্রবর্তনা ছিল - বাণীকুমারের । বাঙালি
জাতি এমনকি হালের উইকিপিডিয়া পর্যন্ত বাণী কুমারের কাজকে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কাজ বলে
অনেক জায়গায় উল্লেখ করেছে । যখন প্রথম
এই ধরনের প্রোগ্রাম রেডিও নিতে চলেছে সেই
আসরে রাইচাঁদ বড়াল সাগির খাঁ নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ মজুমদার প্রেমাঙ্কুর আতর্থীদের সঙ্গে বাণী কুমারের যুক্ত ছিলেন । বিকেলের দিকে চা-সিঙ্গাড়া সহযোগে ১৯৩১ এই বেতারের আড্ডায় এক নম্বর গার্স্টিন প্লেসে আসর
বসতো কখনো কখনো বীরেন্দ্র কৃষ্ণ‌ও সেখানে
থাকতেন সেই সময় যদিও তিনি রেডিওতে
মহিলা মজলিসে যুক্ত হয়েছেন-১৯২৮এ।
কিন্তু চাকরি করতেন না এবং সারাদিন
রেডিওতে থাকতেন‌ও না । যাইহোক মহিষাশুরমর্দিনীর সঙ্গীত সর্জনা ছিল
স্বনামধন্য মিউজিক কম্পোজার পঙ্কজকুমার মল্লিকের এবং শুরু করেছিলেন মালকোষ
রাগ দিয়ে । সেই সুরকে আজ‌ও কার‌ও ছাপিয়ে
যাওয়ার সাধ্য হলনা । গ্রন্থনা ও স্তোত্রপাঠের
ক্যারিস্মা ছিল - বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ।
ইন্সট্রুমেন্ট বা বাজনাগুলি ছিল- হারমোনিয়াম,তানপুরা, চেলো, ভাওলিন, ভাইওলা, বাঁশি । পাঞ্জাবি গায়ক হরিশ্চন্দ্র বালি একটি গানে সুর সংযোগ করে ছিলেন । আর
একটি গানে সুর দিয়েছিলেন সাগির খাঁ সাহেব। খুশি মহম্মদ বাজিয়েছিলেন- হারমোনিয়াম,
আলী ছিলেন চেলোতে । বাঁশি বাজিয়ে ছিলেন একজন বিখ্যাত মুসলমান বাজনদার । ইন্সট্রুমেন্ট অধিকাংশ‌ই ছিলেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। যার ফলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্রের সংস্কৃত উচ্চারণ ঠিক মতো তাঁরা প্রথম প্রথম ধরতে পারতেন না । অসুবিধা হচ্ছিল
কিন্তু বারবার অনুশীলনের ফলেও লাইভ প্রোগ্রামেও সেই ভুল হয়ে গিয়েছিল কিন্তু একবার‌ও কেউ তা বুঝতে পারেননি যে
কোথায় সেই ভুল-ত্রুটিটি হয়েছিল ?!
লাইভ অনুষ্ঠানে শঙ্খ, বাঁশি ও স্লোক-স্তোত্র
পাঠ পরপর থাকায় কিছু ভুল বোঝাবুঝি
হয়েছিল কিন্তু কাঁচের ঘর থেকে বাণীকুমার
তা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন এবং সেই
সুরের মূর্ছনায় ততক্ষণে বাঙালির হৃদয় জয়
করা হয়ে গেছে । পরে তাই কোনো ভাবেই
বাঁশির সুরের সেই মুহূর্তকে আর বদল
করেননি পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার ।
তবে পরে অনেকবার স্ক্রিপ্টের সামান্য বদল করলেও বাণীকুমার অগ্রজ-বন্ধু বীরেন্দ্র
কৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে আলোচনা করে পঙ্কজকুমার মল্লিকের মতামত নিয়ে তা নতুনভাবে রিয়ার্সালে ঠিক করে নিতেন । বাণীকুমার ১৯২৮ এ
তার ২১ বছর বয়সে টাকশালের চাকরি
ছেড়ে দিয়ে স্ক্রিপ্ট রাইটার ও স্টাফ আর্টিস্ট
পদে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র চিরকাল তার মূল চাকরির সঙ্গে রেডিওর
দপ্তর সমানে চালিয়ে গেছেন । চাকরি ছেড়েছিলেন অনেক পরে এবং বেতারে
অনেক পরে যোগদান করার জন্য তিনি সরকারের পেনশন পাননি । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্রকে সরকারের এই অবহেলার জন্য
পরে সমালোচনার মুখে পড়তে হয় । বেশ কয়েকবছর চালিয়েও ছিলেন কিন্তু এই নিয়ে অমৃতবাজার পত্রিকায় বিস্তর চিঠি লেখা
হয় । এক প্রকার স্ক্যান্ডাল ছড়ায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে নিয়ে ,তারপর তিনি সরে যান
১৯৩৪ সালে । আর ১৯৩৬ নাগাদ শুরু হয়
মহিলা মহল বেলা দে-র তত্ত্বাবধানে ।
পাকাপাকি ফর্মেশন নেওয়ার আগে রেডিওর বিভিন্ন আড্ডা থেকে উঠে আসা বাঙালির
হৃদয়ের আসুমদ্রহিমাচল বিজয়ী ,
মহিষাশুরমর্দিনী সঙ্গীতালেখ্যটি বিভিন্ন ভাবে পরিবেশিত হয় , কখন‌ও বসন্তেশ্বরী নামেও ।
তাই মহিষাশুরমর্দিনীকে সম্পূর্ণ রূপে জানতে আমাদের চলে যেতে হবে সত্তরের দশকের বাঙালি সমাজে । সেই মধ্যবর্তী সময় থেকেই টেলিভিশন যখন বিভিন্ন বাড়িতে স্থান পেতে
শুরু করলো । এখন এরকম বাড়ি খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত যেখানে টিভি নেই । কিন্তু রেডিওর আদিকালে কিন্তু রেডিওকে ঘরে ঘরে পাওয়া
তো দূরের কথা সমস্ত বাড়িতেও পাওয়া মুস্কিল ছিল । যদিও আগে এক সময়ে রেডিওই ছিল খবর ও অন্যান্য অনুষ্ঠান সম্প্রচারের একমাত্র গণ ও মনোরঞ্জনকর মাধ্যম । এখন সে দায়িত্ব পালন করছে টেলিভিশন। রেডিও বলতে
নতুন প্রজন্ম বোঝে এফ‌এমকে । কোন অনুষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দৃশ্যের উপস্থিতি দর্শকমনকে আকৃষ্ট করে অনেক বেশি ।
সেজন্যই রেডিওর জৌলুষ এখন অনেকটাই স্তিমিত। হয়ত এর একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটে
যায় মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’
শোনার আগ্রহে ঝাড়পোছ হতে শুরু করে
দেয় অপোড়ো রেডিও । টেলিভিশনের চেয়ে আকাশবাণীর এই অনুষ্ঠানটি এখনও যে
লোকের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয় তা মহালয়ার ভোরেই স্পষ্ট বোঝা যায় ।
অনুষ্ঠানের শুরুটি - “আজ দেবীপক্ষের প্রাক-প্রত্যুষে জ্যোতির্ম্ময়ী জগন্মাতা মহাশক্তির শুভ আগমন-বার্ত্তা আকাশ-বাতাসে বিঘোষিত। মহাদেবীর পুণ্য স্তবনমন্ত্রে মানবলোকে জাগরিত হোক ভূমানন্দের অপূর্ব্ব প্রেরণা। আজ শারদ গগনে-গগনে দেবী ঊষা ঘোষণা করছেন মহাশক্তির শুভ আবির্ভাব-ক্ষণ।”
এরপর তিনবার শঙ্খধ্বনির পর শুরু হয় অনুষ্ঠান। সুপ্রীতি ঘোষের পরিশীলিত কন্ঠে গাওয়া সেই গান – “বাজল তোমার আলোর বেণু”।  সাধারণ মানুষের কাছে পঙ্কজকুমার
ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ যেভাবে এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র
সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত, সেই তুলনায়
একটু হয়তো আড়ালেই থেকে গেছেন
বাণীকুমার । অথচ মূল অনুষ্ঠানটির পরিকল্পনা
রচনা-প্রস্তাবনা এবং বারবার সংযোজন বিয়োজনের অধিকার দেখিয়েছেন সব‌ই বাণীকুমার । ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে প্রথম প্রচারিত হয় অনুষ্ঠানটি, কিন্তু তখন এর নাম
ছিল ‘শারদ বন্দনা’। ১৯৩৪-এর ৮ ই অক্টোবর ( ১৩৪১ বঙ্গাব্দ ) মহালয়ার সকাল ছয়টা থেকে সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল
অনুষ্ঠানটি। কিন্তু এটি ঘিরে তীব্র আপত্তি
ওঠে – রক্ষণশীল দলের কাছ থেকে থেকে। প্রতিবাদের মূল কারণ ছিল – এক অব্রাহ্মণ ব্যক্তির কন্ঠে কেন চণ্ডীপাঠ শোনা যাবে ?
রুখে দাঁড়ালেন বাণীকুমার স্বয়ং । গ্রন্থনা ও চণ্ডীপাঠ বীরেন্দ্রকৃষ্ণই করবেন এই সিদ্ধান্তে অটল থাকেন তিনি এবং এও বললেন তাহলে তিনিও এই অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে
মুক্ত করে নেবেন । আর‌ও একটি আপত্তি
ছিল মহালয়ার সকালে পিতৃপক্ষের সময়‌ই
কেন চণ্ডীপাঠ হবে ? যখন প্রতিমার বোধন‌ই
হয়না । অথচ ওই স্রোত্রগুলি সব‌ই দুর্গা মন্ত্র ।
এতেও তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণরা আপত্তি তুলেছিলেন । সেই জন্য ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠানটি ষষ্ঠীর ভোরে প্রচারিত হয়েছিল ।
কিন্তু পরিশেষে বাণীকুমারের সিদ্ধান্ত মেনেই ১৯৩৭ সাল থেকেই মহালয়ার ভোরে প্রচারিত
হয় – ‘মহিষাসুরমর্দিনী। ’ । প্রভাতী বিশেষ
এই অনুষ্ঠানের সময় বিভিন্ন সময় পরিবর্তিত
হয়েছে। কখন‌ও ৬.০০ থেকে ৭.৩০ । পরে শুরুর
সময়ে পরিবর্তন আনা হয় ৫.৩০ ও শেষে ৪.০০ থেকেই নির্দিষ্ট থেকে যায় সময় ১৯৫০ সালে । অনুষ্ঠানটি সফল ও আকর্ষণীয় করে তুলতে বাণীকুমারের সঙ্গে পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নাম অবশ্যই এক‌ই সারিতে স্মরণীয় হয়ে থাকার কথা । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক ও বাণীকুমার ছিলেন একই বৃন্তের তিনটি কুসুম । ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ গীতি আলেখ্যটি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ।
এ প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধে বাণীকুমার নিজেই লিখেছেন –“মহিষাসুরমর্দিনী” আমার প্রথম যৌবনের রচনা । কিন্তু মূল রূপটির বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও এই গ্রন্থের বর্তমান রূপ বহুতর তথ্য ভাবগর্ভ বিষয় এবং বেদ-পুরাণাদি-বিধৃত শ্লোকাবলী সংযোজনায় সমলংকৃত। প্রকৃতপক্ষে এই গ্রন্থ মার্কন্ডেয় সপ্তশতী চন্ডীর সংক্ষিপ্তসার বললেও অত্যুক্তি
হয় না, তদুপরি এর মধ্যে আছে মহাশক্তি-সম্বন্ধে বৈদিক ও তান্ত্রিক তত্ত্বের ব্যঞ্জনা এবং এর
অন্তরে নিহিত রয়েছে শাশ্বত ভারতের
মর্মকথা..." মূল রচনাটি লেখা শুরু হয়েছিল হাওড়ার সাত্রাগাছির বাড়িতে --১৯ সেপ্টেম্বর ১৯১৭ । পরে হাওড়ার ওই বাড়িতেই ১৯৩১
থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত খসড়াটি চন্ডীপাঠ থেকে
বসন্তেশ্বরী ও তারপর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’তে
পরিপূর্ণ রূপ পায় । এরপর বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য
ওরফে বাণীকুমার বাগবাজারে উঠে চলে যান।
দেশে জরুরী অবস্থা থাকাকালীন ১৯৭৬-এর ২৩ শে সেপ্টেম্বর মহালয়ার ভোরে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে সরিয়ে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান ড. গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের
রচনা-‘দেবীঙ দুর্গতিহারিণীম্ 'কে বিকল্প হিসেবে মহালয়ার অনুষ্ঠানে প্রচারিত করা হয় । রূপদান করেছিলেন পাঠে অভিনেতা মধ্যগগণের উত্তমকুমার ও বসন্ত চৌধুরী ছিলেন সঙ্গীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে এবং পরিচালনা করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় । এছাড়া প্রভৃতি স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ এই
অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন । অনেকে
মনে করেন দেশের এমার্জেন্সির সুযোগে
কংগ্রেস নেতা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মৃদু প্রভাব ছিল এই প্রোগ্রাম চেঞ্জের ব্যাপারে । যদিও এই বিষয়ে কাগজে প্রিয়রঞ্জনের নামে কোনোদিন কিছু বের হয়নি । কিন্তু ততদিনে বাণীকুমার রেডিও থেকে অবসর নিয়ে প্রয়াত হয়েছেন ।
বরং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে আগের দিন পর্যন্ত
কিছু জানতে দেওয়া হয়নি । ১৯৬৬ থেকে রেকর্ডেড প্রোগ্রাম হলেও যে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বরাবরের মতো শেষ ট্রামে আকাশবাণী
ভবনে , রাতেই বালিশ-বিছানা নিয়ে চলে আসতেন , তিনি কিন্তু ১৯৭৬ সালের মহালয়া বাড়িতে বসেই নতুন আলেখ্যটি শুনেছিলেন
এবং তাঁর পুত্রকে -"আক্ষেপ করে বলেছিলেন লোকে যদি নেয় নেবে তার কি বলার আছে ।" বাস্তবিক তিনি খুব দুঃখ পেয়েছিলেন কিন্তু ততদিনে বাণীকুমার‌ও প্রয়াত হয়েছিলেন
( ১৫ আগষ্ট ১৯৭৪) তাই সমস্ত দুঃখ একলাই ভোগ করেছিলেন । কিন্তু '' মহিষাশুরমর্দিনী ''  স্থানচ্যুত হওয়ায় জনরোষ ফেটে পড়ে মানুষ-জনতা । পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার
ঝড় বয়ে যায়। পোস্টকার্ডে এবং সরাসরি হাতে করে প্রতিবাদ পত্র আকাশবাণী ভবনে ও আনন্দবাজার অফিসে লোকে সেদিন‌ই পৌঁছে দিয়েছিল । এমনকি একদল মানুষ রেডিও অফিস ঘেরাও করে স্টেশন ডিরেক্টরের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করতে শুধু বাকি রেখেছিল । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বরাবরই আগের দিন একা রাত্রিবেলাতেই বেতারকেন্দ্রে চলে আসতেন
এবং ‘মহিষাসুরমর্দিনী ’ শুরু থেকে শেষ
পর্যন্ত উপস্থিত থেকে তারপরে যেতেন ।
টেপ রেকর্ডারে অনুষ্ঠান চললেও এ অভ্যাস
তিনি চালিয়ে গেছেন দীর্ঘকাল । কিন্তু ১৯৭৬
সালের পর থেকে তিনি কখনও রাত্রি বেলা
আর কখন‌ও যাননি । ওই জরুরী অবস্থার সময়েই অপসারিত হন পঙ্কজকুমার মল্লিক ‘সঙ্গীত শিক্ষার আসর’ থেকে । অবশ্য জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেবছর ষষ্ঠীর দিন পুণরায় বাণীকুমারের রচনার সম্প্রচারিত হয় পুরনো এবং চিরদিনের ‘মহিষাসুরমর্দিনী ।’ আর ১৯৭৭ থেকে স্বমহিমায় মহালয়ার ভোরে আবার ফিরে আসে সেই আদি অকৃত্রিম ‘মহিষাসুরমর্দিনী।’ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানটি রচনা ও তরঙ্গায়িত করে বাণীকুমার যে আসাধারণ কাজটি করেছিলেন পরবর্তীতে স্টেশন ডিরেক্টর দিলীপকুমার সেনগুপ্ত সে
প্রসঙ্গে বলেছেন – –“বাণীকুমার যদি আর
কোনো কাজ নাও করতেন, তাহলেও শুধু - ‘মহিষাসুরমর্দিনী’র জন্য মহালয়ার ‘নেপথ্য নায়ক’ হিসেবে চিরকাল অমর হয়ে থাকতেন ,
তাঁর কলম থেকে নিঃসৃত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাঙালি সংস্কৃতির মজ্জায় মজ্জায় থেকে গেছে"।
যে বাণীকুমারের মহিষাশুরমর্দিনীর বেতার সংস্করণ বঙ্গবাসী শুনতে পেয়েছিলেন এক অপ্রত্যাশিতভাবেই সেইতুল্য খ্যাতি স্বনামধন্য বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য ওরফে বাণীকুমারকে আজ‌ও
দেওয়া হয়নি । সবচেয়ে বিস্ময়কর অনেকেই আর তাঁকে মনে পর্যন্ত রাখেননি ,চেনা তো
দূরের কথা । এর একটি বিশেষ কারণ তিনি ছিলেন আকাশবাণীর একটি বিভাগের প্রযোজক
তাই বেতার জগৎ পত্রিকা ও অন্যান্য পত্রিকায় বাণীকুমার সম্পর্কে তেমন কোনো আর্টিকেল
না বেরনোর ফলে তিনি চিরকাল পর্দার পেছনে রয়ে গেছেন। নবীন প্রজন্মের কেউই তাঁর
সম্পর্কে কিছুই জানেন না । এমনকি তার
একক ও সম্মিলিত কোনো ভালো ফটোগ্রাফ‌ও কোথাও এখন পাওয়া যায় না । বাণী কুমারের ডায়রিতে ১৯৩২ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত মহিষাশুরমর্দিনীকে নানাভাবে ভাঙাগড়ার ইতিহাস যা ছিল তা আজ কোথায় আছে ঠিকমতো কারো জানা নেই এবং ওই প্রারম্ভিক সময়ে অজস্রবার বাণীকুমার তার স্ক্রিপ্ট ও গানের সময়ের কিছু পরিবর্তন করেছিলেন
যেটা বঙ্গীয় সমাজ কখন‌ও ধরতে পারেনি । বাণীকুমারের সাহিত্যিক নাতি চন্দ্রিল ভট্টাচার্য এক জায়গায় বলেছেন-" তার ঠাকুরদা কখন‌ও কম্প্রোমাইজ করেননি,তার ডায়রিতে প্রতিবার‌ই কিছু পরিবর্তন করতেন তাঁর সাধের মহিষাশুরমর্দিনীর । আসলে ওটা তিনি একটি মিথ তৈরি করে গেছেন প্রায় যা টানা ২৮ বছর লাইভ প্রোগ্রাম চলেছিল।" সত্যি এটা ভাবলে আমাদের অবাক লাগে --সরস্বতী সঙ্গীত বিচিত্রা দিয়ে "বেতার বিচিত্রা" নামের অনুষ্ঠানটি বাণীকুমার প্রোডিউসারের ভূমিকায় ১৯৩১
থেকে টানা ২১ বছর তিনি চালিয়ে গেছেন ।
ইতিমধ্যে হাওড়ার সাত্রাগাছি থেকে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য একসময় নতুন বাড়ি করে উঠে গিয়েছেন সেকথা বলেছি,কলকাতার বাগবাজার স্ট্রিটের কাছে ৪৭/১ বোসপাড়া লেনে ।
বর্তমানকে চেনাতেই হয়তো গত ২০১৭ সালে
ওই চৌমাথার মোড়ে কলকাতা কর্পোরেশনের স্থানীয় কাউন্সিলর বাপি ঘোষ ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে একটি স্মৃতিরক্ষা কমিটি গড়ে মর্মর মূর্তি বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয় । অথচ ওই এলাকায়
এতদিন তাঁর নামে কোনও স্মারক পর্যন্ত ছিল
না বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের মত । আপামর বাঙালির কাছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বলতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের নামই সর্বাগ্রে উঠে আসে , হয়তো তাই নেপথ্যে চলে যান বাণীকুমার
ওরফে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য । ২০১৭-তে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্যর জন্য ওই মূর্তি বসানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল গত বছর তার বাগবাজারের বাড়ির কাছে । প্রসঙ্গত জানা
যায় যে বাণীকুমারের পুত্র নৃসিংহকুমার
ভট্টাচার্য বর্তমানে কেষ্টপুরের বাসিন্দা ।
তাঁর নাতি স্বনামধন্য লেখক চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের কথা আগেই বলা হয়েছে । গত মহালয়ার
দিনই ওই মূর্তি বসানো সম্পূর্ণ হয়েছে বলে
বাপি ঘোষ কাউন্সিলর সংবাদপত্রে জানিয়েছিলেন । এই সঙ্গে আর‌ও জানা
যায় স্কুল বয়সে বাণীকুমার যেখানে থাকতেন , মধ্য হাওড়ার খুরুট ধর্মতলাতেও বাণীকুমারের পূর্ণাবয়ব একটি মূর্তি বসানো হয় গত
সেপ্টেম্বর ১৯১৭তে । মধ্য হাওড়ার খুরুট
ধর্মতলা বারোয়ারী তলায় ওই  মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন স্বনামধন্য সঙ্গীত শিল্পী
শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ও প:ব: সরকারের
ভারপ্রাপ্ত সমবায় রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী অরূপ রায়
মহাশয় । উপস্থিত ছিলেন হাওড়া কর্পোরেশনের মেয়র ও মেয়র পারিষদ যথাক্রমে
ডা: রথীন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও শ্যামল মিত্র
মহাশয় , এঁদের উদ্যোগেই হাওড়ার মূর্তিটি
স্থাপিত হয়েছে বলে শোনা যায় । ইতিমধ্যে
গঙ্গার অনেক জল গড়িয়েছে অবশেষে
১৯৭৯ বের হলো বাণীকুমারের জীবনের
সেরা কাজের সিডি । এইখানে একটু জানানো
দরকার "দেবিঙ দুর্গতিহারিনিম্ " কিন্তু কিছু
দিন আগে পর্যন্ত রেডিওতে ১৯৭৭ সাল
থেকে মহা ষষ্ঠীর সকালে আকাশবাণী থেকে
সম্প্রচার করা হতো , কারণ মহিষাশুরমর্দিনীর
কাছেপিঠে না আসতে পারলেও সেটির
সঙ্গে উত্তমকুমার হেমন্ত লতা এবং এইচ‌এমভির
সত্ত্বা জড়িয়ে ছিল লঙ-প্লেইঙ রেকর্ড‌ও ছিল ।
আবার ফিরে আসি আমার মূল আলোচ্য
বিষয় বাণীকুমারের প্রসঙ্গে । যদি আরও
কিছু পিছিয়ে যাই তাহলে দেখতে পাই ,
কলেজে পড়তে পড়তে তিনি জড়িয়ে পড়েন তৎকালীন সাহিত্য জগতের সঙ্গে ।
প্রেসিডেন্সী কলেজ ম্যাগাজিনে, প্রকাশিত
হয় মহাকবি ভাস রচিত "শোণিত পারণা" নাটকের বঙ্গানুবাদ । অধ্যাপক অশোকনাথ
শাস্ত্রী কৃত এই বঙ্গানুবাদ নাটকের রূপারোপ করেছিলেন বাণীকুমার। এই রূপারোপ সম্বন্ধে অশোকনাথ শাস্ত্রী , এই নাটকের মুখবন্ধে লিখেছিলেন- " সংস্কৃত দৃশ্যকাব্যে কেবল অঙ্কবিভাগ আছে---দৃশ্যবিভাগ নাই । কিন্তু সাধারণের বোঝার জন্য , বাণীকুমার
দৃশ্যবিভাগ তৈরি করে দিয়েছিলেন ।
কলেজে পড়ার সময়ই এই সম্মান
বাণীকুমারকে সাহিত্যে আরও আগ্রহী করে তোলে । নাটকের panorama scene এর
দর্শনীয় প্রেক্ষিতটি বাণী কুমারের ওই সময়েই তৈরি হয়ে যায় । পিতা নিজে পণ্ডিত-সাহিত্যিক হলেও ছেলের সাহিত্যচর্চাকে খুব একটা সুনজরে দেখেননি । তাই স্নাতক হবার পরই সংসারের দিকে মন ফেরাতে বিবাহ সম্পন্ন করে দেন পুত্র বাণী কুমারের । বৈদ্যনাথ ছদ্মনামেই যাবতীয়
সাহিত্য রচনা করে গেছেন। সংসারের
প্রয়োজনে মহিষাশুরমর্দিনীর লেখককে
চাকরি নিতেও হয় কলকাতার টাকশালে
একথাও জানানো হয়েছে । ১৯২৭ সাল ১নং গাস্টিং প্লেসের যখন ইংরেজদের নতুন  গণমাধ্যমের কর্তারা তখন নিত্যনতুন অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য লোক খুঁজছিলেন
আর তখন‌ই এই সূত্রেই ওই সময়ে একটি বেতারনাটকের সূত্রে কলকাতার বেতার
কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়ে যায়। বাণীকুমার তার লোভনীয় টাকশালের চাকরি ছেড়ে ১৯২৮ সালে যোগ দেন ভবিষ্যতহীন রেডিওতে । টাকশালের স্থায়ী সরকারি চাকরি ছেড়ে, রেডিওর চাকরির অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়ানো বিফলে যায়নি বাণীকুমারের । সেই যুগের রেডিওর প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠান-বিভাগেই ছিল তাঁর ঐকান্তিক উদ্ভাবনার পরিচয় । ১৯৩১-এর জানুয়ারিতে “সরস্বতী সঙ্গীত বিচিত্রা” দিয়ে “বেতার বিচিত্রা” অনুষ্ঠানের সূচনা। এই বিভাগেই বসন্তেশ্বরী  অনুষ্ঠানের রচনা ও চন্ডীপাঠ করেছিলেন বাণীকুমার নিজেই ।
রাইচাঁদ বড়াল ছিলেন তার সুরকার ও
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন গদ্যাংশ কিছু
শ্লোক পাঠে এবং সংযোজনায় ।
তা ছাড়াও তাঁর প্রযোজনায় সম্প্রচার করা
হয়েছে আরও বহু জনপ্রিয় বেতার অনুষ্ঠান। ১৯৩২ সালে রচিত হয় শারদ-আগমনী গীতি-আলেখ্য দেবীপক্ষের সূচনার বার্তা বহন করতেই করা হয়েছিল । কলকাতা বেতার কেন্দ্রে অসংখ্য অনুষ্ঠান করলেও বাণীকুমার ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে মানুষ মনে রেখেছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র জন্য। পঙ্কজ মল্লিক
অবশ্য বহুমূখী প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন,
যিনি বম্বে-বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় সুরকার গায়ক নায়কও ছিলেন । কিন্তু তবু যেন ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র জন্য এখনও এই ত্রয়ীকে এক‌ই ফ্রেমে আমাদের মনে পড়ে যায় । কিন্তু তবুও বাণীকুমার ওই দুজনের থেকে অনেকটাই আজ অবহেলিত। বাণীকুমার নিজের লেখাতেই জানিয়েছেন,‘‘এ-কথা বলা বাহুল্য যে,
আমাদের কয়জনের আন্তরিক সাধন-দ্বারা
এই মহিমাময় চণ্ডী-গাথা সকল শ্রেণীর
জনবর্গের প্রশংসনীয় হয়েছে ।...
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলিকাতা বেতারের তথা বাঙালায় একটা কীর্তি-স্থাপন করেছে । ’’
বলাই যায় বেতার সম্প্রচারের ৯০ বছরের ইতিহাসে এই রকম অনুষ্ঠান আর
দ্বিতীয় নির্মিত হয়নি, যার জনপ্রিয়তার ধারে কাছে আজ পর্যন্ত কোনো অনুষ্ঠান আসতে পারেনি । ইতিপূর্বে বলেছি ১৯৭৬-এ আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ একবার ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ বাতিল
করে দিয়ে মহানায়ক উত্তমকুমারকে দিয়ে
ভাষ্য পাঠ করিয়ে নতুনভাবে এই অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন যার নাম ছিল “ দেবীঙ দুর্গতিহারিণী”, কিন্তু সেই পরিবর্তন বাঙালী
মেনে নেয়নি। অনুষ্ঠান শেষে ব্যাপক জনরোষ দেখা দেয়। মজার ব্যাপার ছিল এই যে এই
নতুন অনুষ্ঠানের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলেই সেই সময়কার সাংস্কৃতিক-জগতের
অতি নমস্য ও জনপ্রিয় ব্যক্তি! তা সত্ত্বেও প্রত্যাখ্যানের সুর এতটাই চড়া ছিল যে
খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা মহানায়ক
উত্তমকুমারকে ব্যাপক তিরষ্কার হজম
করতে হয় তার অগণিত ভক্তের কাছ থেকে।
শেষে উত্তমকুমারকেও ক্ষমা চাইতে হয় ।
সেই ‘জরুরী অবস্থা’-র জমানাতেও জনগণের প্রবল প্রতিবাদে মহাষষ্ঠীর সকালে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ সম্প্রচার করতে বাধ্য
হয়েছিল সরকারি প্রচার মাধ্যম ‘আকাশবাণী’। পরের বছর থেকে আবার ফিরে আসে বাণীকুমার-পঙ্কজকুমার মল্লিক-বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাঙালি প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিনা বিজ্ঞাপনেই এই অনুষ্ঠান শুনে চলেছেন ! এটা একটা বিস্ময়কর ও অভাবনীয় ব্যাপার । ১৯৭৬ এর সেই মহালয়ার সকালে
ক্ষুব্ধ রেলকর্মীরা যাত্রিদের জন্য হাওড়া স্টেশনেরর মাইকে ওল্ড ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-
তাদের ক্যাসেট চালিয়ে দিয়েছিলেন এবং
হাওড়া স্টেশনের উপস্থিত যাত্রীরা যেন প্রাণে
বেঁচেছিলেন । প্রতি বছর‌ গঙ্গায় তর্পন করতে আসা অগণিত যাত্রীর জন্য রেল কর্তৃপক্ষ
বরাবর ওই মহিষাসুরমর্দিনী চালিয়ে থাকেন সরাসরি রেডিও থেকে । বিভিন্ন সংবাদপত্র
থেকে জানা যাচ্ছে যে গতবছর ২০১৭ তে
আকাশবাণী থেকে যে মহিষাশুরমর্দিনী
অনুষ্ঠানটি শোনা গিয়েছিল সেটি ছিল ১৯৬৬
সালে সম্প্রচারিত হ‌ওয়ার আগের রিয়ার্সালের
খসড়া । যা আকাশবাণীর বর্তমান অধিকর্তা
ও অন্যান্যদের মনে হয়েছে বাণীকুমারের
নানা সময়ের খসড়া ও বহুলাংশে প্রচারিত এবং
এটাই সবচেয়ে সৌন্দর্যমন্ডিত (১৯৭৩ এর সংস্করণ যা থেকে রেকর্ড,সিডি ইত্যাদি
হয়েছে এবং যেটি শুনে থাকি আমরা ) ।
১৯৬৬ সালের খসড়াটি বাণীকুমারের
সবথেকে সুন্দর রচনা । তাই এবছর‌ও ওই খসড়াটিই ভোর চারটার ৮/১০/১৮ সোমবার
সম্প্রচার করা হয় । আকাশবাণীর তথ্যসংগ্রহকারী নিখিলরঞ্জন প্রামাণিক এবং বর্তমান (২০১৮) স্টেশন ডিরেক্টর শ্রী সৌমেন
বসু ওই খসড়াটিকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলেছেন ।
তবে সেই ১৯৩২-৩৩ এ মহিষাশুরমর্দিনীর রেডিওর যিনি কপিয়েস্ট ছিলেন তিনি তিরিশের দশকের থেকেই (শ্রীধর ভট্টাচার্য ) প্রতিটি লাইভ প্রোগ্রামের কপি প্রতিটি শিল্পীকেই সরবরাহ করতেন বলে অনেক কপি করতেন ।
একইসঙ্গে তিনি খসড়া গুলিও নিজের কাছে রাখতেন । তার পুত্র সনৎ ভট্টাচার্যের কাছ
থেকে এই মহামূল্যবান খসড়াটি গত দু'বছর আগে পাওয়া গেছে যা বাণীকুমারের মহিষাশুরমর্দিনীর একটি কিছুটা পরিবর্তিত
( এডিট করা) কপি । ফিল্মের সাহায্যে এই
কপি করা হতো বলে মনে করা হচ্ছে । মহিষাশুরমর্দিনী সম্পর্কে অনেক বাস্তব
কাহিনী লোকমুখে চালু আছে । বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র ও বাণীকুমার দুজনেই দুটি ধার্মিক
পরিবার থেকে রেডিওতে এসেছিলেন যার
ফলে মহিষাশুরমর্দিনী সম্পর্কে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র সকলকে বলতেন আমি ব্রাহ্মণ সন্তান
না হলেও কিন্তু ঐকান্তিক ভাবে ওই সময়ে শ্লোকগুলি যেন আমার কাছে মন্ত্রের স্বরূপে
দেখা দেয় । তিনি সমস্ত শিল্পীকে অত ভোরে
স্নান ও গঙ্গায় স্নান করে গরদ বস্ত্রে
আকাশবাণীতে প্রবেশের একটি প্রথা করে দিয়েছিলেন । অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও প্রযোজনা বাণীকুমারের হলেও শ্রী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র
অনেকটা দায়িত্ব নিতেন কারণ তখন বাঙালির
মন আজকের মতো এতটা বিষিয়ে যায়নি ।
ফুল মালা দিয়ে সেদিন রীতিমতো
সাজানো হতো ধুপধূনো জ্বালিয়ে পরিবেশ
আগে থাকতেই একটা শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার
মধ্য দিয়ে তৈরি করে তবে আসরে বসতেন
বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র । কোনো অনুষ্ঠানটি যে
একটি পবিত্রতার অঙ্গ হতে পারে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র সেটি সকলকে শিখিয়েছিলেন । কিন্তু এই
আয়োজন না হলেও হয়তো মহিষাশুরমর্দিনীর
কোনো প্রকার ভেদরেখা তৈরি হতো না কারণ সেই হিসেবে বাঙালি এই প্রভাতী অনুষ্ঠানকে কখন‌ও পুজো-অর্চনা করার মতো একটা বিতর্কিত গোঁড়ামির পর্যায়ে নিয়ে যায়নি ।
সে কারণে বীরেন্দ্র ভদ্র মশাই নিজে আকাশবাণীতেই আগের রাতে শেষ ট্রামে
চলে এসে বিশ্রাম নিয়ে , রাত দুটোতেই তৈরি
হতে শুরু করতেন । এমনকি মুসলমান বাজনদাররা পর্যন্ত হাসতে হাসতে অক্ষরে
অক্ষরে সেই নিয়মাবর্তিতা মেনে চলতেন ।
আসলে কাজের প্রতি সম্মান বোধ এত তীব্র
ছিল বলেই আজ‌ও এই সম্প্রচার স্রোতস্বিনী ।
বাণীকুমার প্রসঙ্গে আবার ফিরে আসি
তার পুত্র নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্য লিখেছেন-
" তাঁর বেতার নাট্য রূপান্তর , পরশুরামের
চিকিৎসা সাধন নাটকটি বেতারস্থ হ‌ওয়ার
পর‌ই তৎকালীন বেতার অধিকর্তা তাকে
বেছে নেন সেটা ছিল ১৯২৮ । ১৯৩২-১৯৩৬
এই পাঁচ বছর ছিল আঁতুড়ঘর । ১৯৩৭
প্রথম তার লক্ষ্য স্থির করে কিন্তু যেহেতু
১৯৩২ থেকে এর নানা প্রক্রিয়ায় শুরু তাই
আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ ১৯৩২ কে প্রতিষ্ঠা দিবস
হিসেবে ধরে নেন । বসন্তেশ্বরী হিসেবেই ষষ্ঠীর সকালে রেডিওর বিশেষ প্রভাতী অনুষ্ঠান হয়েছিল । পন্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের পরামর্শে  ১৯৩৭ সালে বাণীকুমার‌ই নাম
পরিবর্তন করে -মহিষাশুরমর্দিনী নাম দেন
ও সেইসঙ্গে সংস্কৃত উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে
তার অনুবাদ গ্রন্থনার উপর জোর দেওয়া
হয় । শিল্পী ও কলাকুশলীদের বাড়ি থেকে
তুলে নিয়ে আসা হতো , আকাশবাণী গাড়ি পাঠাতো । এক একটি গাড়িতে ৩/৪ কে আনা হোত । এক কথায় বলা যায় বৃটিশ সরকারের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা ছাড়া যে এরকম অনুষ্ঠান
করা অসম্ভব ছিল সেকথা বলাই বাহুল্য ।
তবে ১৯৩১ সালে প্রাথমিক ভাবে যে চন্ডীপাঠের অনুষ্ঠানটি হয়েছিল সেখানে সুর দিয়েছিলেন রাইচাঁদ বড়াল । রচনা ও তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে বাণীকুমার শ্লোকগুলি উচ্চারণ করেছিলেন
তিনি নিজে আর কিছু গদ্যাংশ ও স্তোত্রপাঠ
এবং সংযোজনা করেছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ
ভদ্র ।  বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বলেগেছেন - " বাণীকুমার স্বল্প দৈর্ঘ্যের নাটিকা আলেখ্য ও বেতার উপযোগী সহস্রাধিক রচনা লিখে
গেছেন । বেতারে মহিষাসুরমর্দিনী সম্প্রচার
করার আগে বাণীকুমার লিখেছিলেন-" বসন্তেশ্বরী"যা লিখতে সময় লেগেছিল
দু বছর তখন‌ও তিনি হাওড়ার সাত্রাগাছিতেই থাকতেন যা ১৯৩২ সালে প্রথম সম্প্রচারিত হয়েছিল । মার্কেন্ডেয় পুরাণের দেবীস্তুতি থেকে তিনি পুণরায় মহিষাসুরমর্দিনীও রচনা করেছিলেন। ব্যাসের মার্কেন্ডেয় পুরাণের ৭০০ কাব্যাঞ্জলি থেকে সমস্ত বাঙালির কাছে মা
দুর্গার স্থিতি প্রলয়কে এই অল্প কিছু শ্লোকের মাধ্যমে এবং বঙ্গানুবাদ সহ নির্বাচন করে তার
সঙ্গে উপযুক্তভাবে গীত রচনা করে পরিবেশন
করা খুব একটা সহজ ছিল না । প্রথমে রাইচাঁদ বড়াল পরে পঙ্কজ কুমার মল্লিক ও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে বসে একটি মহাকাব্যের নির্যাসটুকু আম জনতার দুর্গার বিশ্বাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া মাত্র ৯০ মিনিটে মধ্য সেটাও বোধহয়
খুব কঠিন ছিল , যা কিনা ব্যাসদেব রচনা করেছিলেন আদিযুগে ( ৪০০-৬০০ এ.ডি.-এর মধ্যে) যা ৫.৩০ টায় বদলে ১৯৫০ থেকে
টানা ভোর ৪.০০ তে সম্প্রচারিত হয়ে থাকে
এবং যা সরাসরি ১৯৬৫ পর্যন্ত ২৯ বছর সম্প্রচারিত হতো । মোট গানের সংখ্যা-১৮ ।
তার মধ্যে সংস্কৃতে লেখা গান ৪ খানি ও বাংলা-১৪ । ফোক, ক্লাসিক্যাল ও আধুনিক
সুরের মূর্ছনায় যা চিরজীবী হয়ে ওঠে ।
১৯৩৭ থেকে পাকাপাকি ভাবে এই প্রোগ্রামটি
৯০ মিনিটের গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে যায় ।
দেবী পক্ষের শুরুতে স্তবস্তুতির মাধ্যমে
বেতারে দেবীর বোধন করা যায় কিনা সে বিষয়েও কথা উঠেছিল কিন্তু যেহেতু অধ্যাপক অশোকনাথ শাস্ত্রী মহাশয়ের মত ছিল তাই
তখনকার রেডিও কর্তৃপক্ষ সেটি বৈদ্যনাথ
ভট্টাচার্যের উপর‌ই ছেড়ে দিয়েছিলেন ।
একবার অশোকনাথ শাস্ত্রীর অনুরোধে
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠের নাট্যরূপ
দিয়েছিলেন বাণীকুমার এবং তার নামকরণ করেছিলেন-" সন্তান ।" বিষয়টি বাণীকুমারকে এক‌ই সঙ্গে ব্যথিত করেছিল ও বিখ্যাত
করেছিল। কারণ সেখানে একটি পত্রিকা থেকে
বন্দেমাতরম্ গানটির উপর ও নাটকটির কিছু
সংলাপের উপর তারা আপত্তি তোলেন এবং
বৃটিশ সরকারের নির্দেশে বেশকিছু অংশ
বাণী কুমারকে বাদ দিতে হয়েছিল । এটি
হয়েছিল বাণীকুমারের নাট্যরূপ নির্দেশনায় রঙমহলে । এছাড়াও বাণীকুমার পরবর্তী
সময়ে রেডিওতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বেঁচে
ছিলেন । সিনেমার গান‌ও লিখেছেন

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...