বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০

শতবর্ষে ছাপচিত্রি শিল্পী হরেন দাস : অলোক কুন্ডু






⛔ শিল্পী হরেন দাস : অলোক কুন্ডু

(১) 🎨 • ইউরোপ ও পৃথিবীতে অষ্টাদশ শতককে দিগদর্শনের দশক বলা যেতে পারে। যেখানে মুদ্রণ শিল্প ও ছোটগল্প থেকে কল্পনা নির্ভর অবাস্তব রোমান্টিক কাহিনীর উদ্ভাবনার কাল বা আঁতুড়ঘরের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় শিল্পকলার বিস্তার ও উদ্ভাবন তারও আগে। শিল্পকলার মন্ময়তার কথা বলতে গেলে পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলতে গেলে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রভাব আলোচনা করতে গেলে ইউরোপের প্রভাব ফেলে দেওয়া যায়না। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা সর্বোপরি পেন্টিং সম্পর্কে বলতে গেলে ইউরোপীয় অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ছাপচিত্র আবিষ্কার হয় অষ্টম শতাব্দীতে, চীনে। ভগবান বুদ্ধের বাণী ও ছবি আজ্ঞা ও উপদেশ গ্রথিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছাপচিত্র আধুনিক হয়ে মাথা তোলে, টেকনোলজির সাহায্য নেয় জাপান, স্পেন জার্মানিতে। আমাদের দেশে ১৫৭৯-এ কেরালার খ্রীস্টানদের কাছ থেকে যীশুর ছবি ও বাণী ভারতে ছাপচিত্রের প্রচার পায়। ১৮১৬ সালে সমগ্র বাংলাদেশে অন্নদামঙ্গল কাব্যে ছাপচিত্রের গরিমা মানুষ বুঝতে পারে এখানে। ১৮৫৩ সালে কলকাতার বউবাজারে বটতলার বইয়ে ছাপচিত্রের আকাশে নক্ষত্র সমাবেশের আয়োজন দেখা যায়। উত্তর ও মধ্য কলকাতা জুড়ে শিল্পী ও কর্মকার ছুতোর সম্প্রদায়ের জোটবদ্ধতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে শিল্পীরা নিজেরাই লোক শিল্পীদের মতো করে নিজেদের শিল্প গড়ে নেয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা স্টুডিওতে (১৯১৬) মুকুল দে ছাপচিত্রের চর্চা শুরু করেন ( উল্লেখ্য মুকুল দে আইনস্টাইনের দু ঘন্টা ধরে পোট্রেট করেছিলেন।)

(২) 🎨• অবনীন্দ্রনাথের নতুন চিত্রধারণার বিরুদ্ধে ধিক্কার বিস্তৃত হচ্ছে এখানে। অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথের নামকরণের দ্বারাই প্রবাসীর উন্মোচন হচ্ছে। মর্ডান রিভিউতে " সীতা " ছেপে বের হচ্ছে সঙ্গে ভারতীয় শিল্প সুষমার একনিষ্ঠ প্রচারক এক আইরিশ যুবতীর ( নিবেদতা ) প্রশংসিত বিবরণ থাকছে সঙ্গে। বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভে ১৯০১-এ জাপানি চিত্রকর ওকাকুরা কাকুজো এলেন জাপানি ওয়াস পদ্ধতি নিয়ে। শিল্পের সংস্কারবাদী চিন্তাধারার প্রয়োগ এবং ঔপনিবেশিক বিস্তারবাদের নকল ও অনুকৃতি ধারাকে রুখে দিয়ে ভারতীয় ধারার সংস্কার সাধন করে ভারতীয় বোধের পুনুরুত্থানে এগিয়ে এলেন আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ,ই.বি. হ্যাভেল। তিনি অবনীন্দ্রনাথকেই ভারতীয়ত্ব ধারার পথপ্রদর্শক রূপে চিহ্নিত করলেন। হ্যাভেল চলে যেতে আর্ট স্কুল থেকে বিদগ্ধ ছাত্র নন্দলাল, অসিতকুমার হালদারদের নিয়ে (১৯১৫) বেরিয়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথ। খুললেন ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি। দক্ষিণে রবি বর্মার ইউরোপীয় ঘরানার ভারতীয় মিথ ও পুরাণের পুনর্জন্ম শুরু ঘটে গেছে। অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরে রাধাকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ওমর খৈয়াম উঠে এলো। ঈশ্বরী প্রসাদের মতো মাটি থেকে উঠে আসা পাটনা ঘরণার শিল্পী ও শান্তিনিকেতনের রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো ছাপচিত্রি আর্ট স্কুলের নতুন দলকে আবিষ্কার করলেন। এই
সবকিছু হরেন দাসকে উদগ্রীব ও উৎসাহী করে তুললো। ১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংয়ের উপর জোর দেওয়া হলো, তারপরও তার প্রভাব পড়লো। ভারতে তখন শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাব। কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের উদ্যোগপর্বে সেই অন্ধকার অনেকটা কেটে যায়।

(৩) 🎨• ১৯০১ সরকারি আর্ট স্কুল। ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ শাসনে, উৎপাদন নির্ভর সৃষ্টি করার উপর জোর। প্রভূত্ববাদ ঘিরে ফেলেছে চতুর্দিক। ভারতের বাইরে, গৃহযুদ্ধের পরিবেশ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এখানে আমাদের উপনিবেশ ও ইংরেজ শাসনে দেশীয় জনজীবন প্রাণান্তকর, যন্ত্রণাকাতর। মুৎসুদ্দি, ফড়ে, বনিয়া সামন্ততান্ত্রিক স্থানীয় জমিদার রাজাদের অস্থিরতাময় অভিভাবকত্ব ও স্বজন-পোষণ ঘিরে ফেলেছে নাগরিকদের মনোজগত। শাসনের অমার্জিত জাঁতাকলে পড়ে এদেশের সামাজিক অবস্থান দিশেহারা। বিশ্বযুদ্ধের তটস্থতা, ভয়াল মন্দতা একদিকে। অন্যদিকে একের পর এক নিরাশাবাদীতা নিয়ে বাঙালি জীবনযুদ্ধ জারি রেখে ক্ষীণভাবে অগ্রসর হচ্ছে। বঙ্গভঙ্গ, স্বাধীনতা আন্দোলন, চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দা। এইসব মিলেমিশে বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের এক প্রাণান্তকর অবস্থা। পারিপার্শ্বিক সমাজ চেতনায় নানা জটিলতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে মহা-মন্বন্তর ও দুর্ভিক্ষদশা এবং গণমৃত্যুর বিভীষিকায় নাগরিক দুর্দশা মানুষের চিন্তা চেতনায় বিকাশের বদলে ঘাটতি শুরু হয়েছে। ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ যুগের শিল্প রীতির পরিচর্যায় (১৭৫৭-১৯৪৭) বৈদেশিক শাসক শ্রেণির রুচি প্রভাব পড়তে শুরু করলো ভারতের ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক চিন্তা ভাবনায়। ভারতে পাশ্চাত্য ধারার ছবি আঁকিয়েদের আগমনে পুরোদস্তুর সংঘাতময় শিল্পের এক ঘরানা এদেশে সৃষ্টি হলো। ইউরোপীয় শিল্পচিন্তার বদলে যা অনেকটা ইংল্যান্ডীয় অনুকরণ। ঠিক সেইসময় শিল্প ও শিল্পতত্বের সন্ধানে তখন কলকাতার নামডাক শুরু হলো। ইংরেজরা তাদের প্রয়োজনেই ভারতের চারটি স্থানে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল আর্ট স্কুল খুলে দিলেন। শৌখিন কারুশিল্পের মর্যাদা ও সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলাকে অস্বীকারের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ভাবা শুরু হলো ঘর সাজানোর পদ্ধতি। জ্ঞান ও রুচিবোধ কিছুটা বাড়লো জমিদার বাড়িতেও। আলোছায়ার সংঘাতময় বিন্যাস বিস্তৃত হলো। জাপানি ওয়াসপদ্ধতিও এলো কলাভবন হয়ে। অজন্তা, কাপড়, রাজপুত ও মুগল যুগের শিল্পের সঙ্গে বিলিতি আধিপত্যর সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান ক্রমশ বাড়তে থাকলো। আর্ট কলেজের শিক্ষায় হান্টার সংযুক্ত করলেন প্রকৃতিবাদী শিক্ষা। সনাতন শিল্পশৈলীর প্রভাবকে হান্টার সুযোগ করেদিলেন। ভারতীয় শিল্পের পুনর্জীবন ঘটলো।

(৪) 🎨• অবশ্য এই সময় ভারতের ঊনিশ শতককে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাহেবদের অবদান অনস্বীকার্য। কলাভবন ও বেঙ্গল স্কুলের জনপ্রিয়তায় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ছাত্রদের মধ্যে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকায় ছাত্রদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। ইউরোপীয় নানা ঘরাণার সঙ্গে জাপানি ওয়াস পদ্ধতি জেনে নিতে চাইছে নবীন ছাত্রদল। অবনীন্দ্রনাথের ভারতীয় নস্টালজিক স্টাইলাইজেশনে সৃষ্টির নব উন্মোচন হলো। অনুপম সৌন্দর্যবোধে আকৃষ্ট হলেন ছাত্ররা। উন্মোচন হয়েছে অবনীন্দ্রনাথের নতুন শিল্পরীতির । জাতীয়তাবাদী ভূমিকা ছবি আঁকায় ছায়া ফেললো। রাজপুত, মুগল আমলের রীতিনীতি, কাঁঙড়া শিল্প রীতির কারুকাজ, পারসিক, জাপানি, তিব্বতী জাপানি ছাপাই ও ওয়াসপদ্ধতি মিলেমিশে ভারতের প্রাচীন শিল্প ভেঙে
তৈরি হলো শিল্পের সমাবেশ।

(৫) 🎨 •আমরা যারা ছবি আঁকার সঙ্গে পরিচিত তারা সকলেই জানি শিল্পী হরেন দাস তাঁর শিল্পকৃতি নিয়ে অমর হয়ে আছেন। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস শিল্পী হরেন দাসের নাম ৯০ ভাগ ভারতবাসী শোনেন নি। যদিও একসময়ে কলকাতার জি.সি.লাহা-য় পাওয়া যেত হরেন দাসের ছাপচিত্রের বই। যদিও আর্ট কলেজের ছাত্রদের কাজের সুবিধার জন্য হরেন দাস সামান্য দামে ওই বই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তবুও শিল্পীকে বহু মানুষ এখনও চেনেন না। এই না জানাটা আমাদের কাছে খুবই লজ্জার এবং দোষের। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবে এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে যে একজন সামান্য রাজনৈতিক নেতা এখানে যত খ্যাতি পেয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বদের তত সম্মান জোটেনি। হরেন দাসকে জানতে চাইলে আপনারা এখন আমাজন থেকে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ছাপচিত্রের সম্ভারগুলির বই (১৯৪৫-১৯৯০) সংগ্রহে রাখতে পারি। প্রিন্ট মেকিং শিক্ষণীয় বিষয়ের ছাত্রদের অবশ্যই তা সংগ্রহ করার মতো।

(৬) 🎨• এমনিতেই ১৯২১ আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক সময়। যদিও ১৯১৯ থেকে শান্তিনিকেতনে
রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে অসিতকুমার হালদারকে প্রধান করে আঁকাআঁকির পর্ব চালু হয়েছিল তবু ১৯২০-তে নন্দলাল বসুর সেখানে যোগদান ও ১৯২১ থেকে কলাভবনের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায় ১৯২১ এ জন্মগ্রহণ করে ১৯৯৩-এ প্রয়াত হন। হরেন দাসও (১৯২১-১৯৯৩) তাই। কিন্তু কেউ বড় একটা হরেন দাসকে আজও চেনেন না। অবশ্যই দুজনের এখানে তুলনা টানবার জন্য এই লেখার অবতারণা নয়।

(৭) 🎨• হরেন দাস একজন স্বনামধন্য ভারতীয় চিত্রকর। প্রধানত ছাপচিত্রির পরিচিতি নিয়ে তাঁর সৃষ্টির ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি বন্দিত হয়েছে। কাঠ খোদাই, লিনোকাট, এইচিং। ছাপচিত্রের সমূহ প্রক্রিয়ায় তিনি একজন লিথোগ্রাফের মাষ্টার পেন্টার হিসেবে ভারত ছাড়াও জাপান, জার্মানি, চিলি, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড ও আর্জেন্টিনাতেও আলোচিত হয়েছেন। যদিও বাটালি, নরুন, হাতুড়ি নিয়ে উডকাট বা কাঠখোদাই করে তার শিল্পরূপগুলি প্রকাশিত করেছেন এবং তাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বিদ্যাসমূহের প্রকাশভঙ্গি থেকে তিনি সচেতন ভাবে কাঠখোদাইয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেছিলেন। ছাপচিত্রের ক্রিয়াকৌশলে ঋদ্ধ এবং কাঠখোদাইয়ের একজন দক্ষতম কারিগর-শিল্পী তিনি। এক অনুপঙ্খ নিরীক্ষার মাধ্যমে তা অর্জন করেছিলেন। ছাপচিত্রের একজন মেধাবী চিত্রি হিসেবে, শিল্পী হরেন দাস সেই অনুপঙ্খ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যা একরকম বিরল। তিনি নিজের জাত চিনিয়ে গেছেন তাঁর মৌলিক সৃষ্টির মায়ামুগ্ধতার দুয়ার খুলে দিয়ে।

(৮) 🎨• বিষয় নির্বাচন, ড্রইং, ট্রেসিং, খোদাই, প্রিন্টিং
ও স্টাইল এই ৬ টি বিষয়ে সমান দক্ষতা ছাড়া একজন বিরল ছাপচিত্রি হওয়া যায় না। হরেন দাস ছিলেন সেই উচ্চাঙ্গের শিল্পী। ছবি তৈরির আর্থিক ভার কমের কারণে একসময় লোকশিল্পের সঙ্গে খোদাই শিল্পী ও শিল্পের পরিচিতি গড়ে ওঠে। নকশা অলঙ্করণ, অলঙ্কার, গৃহসজ্জায় এই শিল্পীদের কদর বেড়ে যায়। ইউরোপে এই শিল্পের পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে ছাপাই ছবির দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। বইয়ের ছবি ও ফটোগ্রাফ প্রিন্ট থেকে একটি চিত্রের একাধিক সংস্করণের কারণে মধ্যযুগে ছাপচিত্রের বিস্তার ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বেড়ে যায়, আসে ইনটাগলিও পদ্ধতি। কখনও জলরঙের ওয়াস দিয়ে চতুর্থস্তর হয়ে ওঠে আরও মোহময়। ছাপচিত্রকে বলা, 'শূন্যতার জয়।' ইংরেজিতে বলা হয় "ডেলিকেট ট্রানপারান্সি।"
আদিম যুগ থেকে ছাপচিত্র মানুষের সঙ্গী হয়ে থাকার জন্য আজও এই শিল্প ব্যতিক্রমী হলেও তা উঠে যায়নি। হরেন দাস মাল্টিকালার ইম্প্রেশনে আপন দক্ষতার শীর্ষদেশ অতিক্রম করেছিলেন। প্রত্যেকটি রঙের জন্য মূল অঙ্কনকে সতন্ত্রভাবে বিচ্ছিন্ন করে পুণরায় একসূত্রে গ্রথিত করার মধ্য দিয়ে যে মধুর ব্যঞ্জনা, যে সঞ্চার, যে ধ্বনির সৃষ্টি করেছিলেন, সতন্ত্রভাবে ব্লকের ব্যবহার করেছিলেন তা আমাদের অবাক করে বইকি।

(৯) 🎨•হরেন দাস যখন শিল্পকলা চর্চায় ছাত্র হয়ে দিনাজপুর থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে এলেন তখন এবং তার বহু আগে থেকেই দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপ ও ভারতবর্ষ জুড়ে নানাবিধ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষন্নতা দেখা দিয়েছে। এখানকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও প্লেগ-ম্যালেরিয়া মহামারীতে জনজীবন প্রায়ান্ধকারে নিমজ্জিত। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই দুঃখের সঙ্গী। আরও বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে জনজীবনে হতাশা নেমে এসেছে তখন।

(১০) 🎨• হরেন দাসের শিক্ষা এখান থেকেই পরিপূর্ণতা পেল। তার ছাপচিত্র ইউরোপীয় ও জাপানি ধারায় আত্মীকরণ করলো। পরম মোহনীয়তাকে তিনি করলেন বিষয়বস্তুর মূল উদ্ভাবনী শক্তি। উৎকৃষ্ট উৎকীর্ণ পদ্ধতিতে তাঁর শিক্ষা এতটাই নিবিষ্ট হলো যে তাকে উৎকর্ষতার বিচারে সৌন্দর্য নির্মাণের দিগদর্শন বলা হলো। ওয়াটার,অয়েল,গুয়াস,ওয়াস পেন্টিং, কালীঘাট চিত্রকলা, পুনর্জাগরণবাদী অগ্রগতি,
পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে অনুপ্রাণনা। সংস্কারবাদী মনোনয়ন। এই সমস্ত মিলে শিল্পীর যুবা মনে বাছাই পর্বের অবতারণা শুরু। বিভিন্ন ভাবের সঞ্চারে তাঁর মনে বিচিত্র চিত্র ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু
এতকিছুর মধ্যে তিনি তার শিক্ষাগুরু কলাভবনের
রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকেই আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁর কাছেই শেখা শুধুমাত্র সাদাকালো নয় ছবির শূন্যতার বিভাজনে ছবিতে ঢালতে হবে আরও
রঙ, জীবনের রঙও। অবশ্য হরেন দাসের পূর্বসূরীদের সময় থেকেই শিল্পীরা নতুন ভাবে সাহস উদ্ধার করতে পেরেছিলেন এখানে। কারণ ইতিমধ্যেই জাপানে, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে ভারতীয় চিন্তাধারার চিত্রকলা ধিকৃত হয়েছে। সমালোচিত হয়েছে। বিষয়ের অস্পষ্টতা, শিল্পের মায়া ধরতে অক্ষম, ধর্মীয় চিন্তায় মগ্ন, কারুকার্য প্রিয়তা ও অপূর্ণতা এইসব সমালোচনায় ইংল্যান্ড, জাপান ও জার্মানিতে ধিক্কার পড়ে গেছে। সেই সমস্ত ঘেন্না ইতিমধ্যে মিটিয়ে দিয়েছেন অসিত হালদার, নন্দলাল বসু ও হরেন দাসের গুরু রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরা।

(১১) 🎨• আমাদের পক্ষে তাঁর গুণাগুণ বিচারে তাই কখনও স্পর্ধা দেখাতে পারি না। ছাপচিত্রের যে ৪/৬ প্রস্ত সমৃদ্ধ ব্যাকরণ থাকে বিখ্যাত চিত্রকর হরেন দাস তার প্রতিটি স্তরকে সন্নিবেশিত করেছেন তাঁর আপন ভালবাসা দিয়ে। নারী থেকে গ্রামগঞ্জের সরলতা, গল্পগাথা, যাত্রাপালার আলো আঁধার, প্রামাণ্য বাস্তব গ্রামীণ জীবন ও জীবিকা তুলে এনেছেন। নিজের দেখা গ্রামীণ ঘটনা প্রবাহকে মনোমুগ্ধকর ভাবে চিত্রিত করেছেন। গ্রামীণ শ্রমের মর্যাদাকে যে দক্ষতা দিয়ে, ললিতকলার সমধিক ভাব বিন্যাস সৃষ্টি করে তাকে ড্রইংয়ের পটুত্বের মহিমায় রঞ্জিত করেছেন শুধু তাই নয়, রঙ-রূপের ব্যঞ্জনার বৈভবে, বর্ণ বিভাজনের মুন্সিয়ানায়, বর্ণময়তার শুদ্ধতায়, শিল্পকলার সমূহ সম্ভার ঢেলে দিয়েছেন। ঐতিহ্যমন্ডিত শিল্পরীতির প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর প্রতিটি সতন্ত্র সজ্জায়। ট্র্যাডিশনাল প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার না করার সিদ্ধান্ত তাঁকে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অনাবিল সৌন্দর্য রীতিগুলি দাঁড় করানোর নান্দনিক চিন্তায় তিনি যে জাপান ও ইউরোপীয় আধারে আবদ্ধ থাকেননি, তা তাঁর পূর্বাপর সমস্ত প্রতিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আকারপ্রকার চয়নে তার মনোজগতের নান্দনিক রস ফুটে উঠেছে। কখনও দুরন্ত সাহসী অভিযান নেই তাঁর মধ্যে। অভিযোগের বার্তাবহন নেই, বিতর্ক নেই,
নগ্নিকার আবির্ভাব নেই। ছায়া প্রচ্ছায়ার সৃষ্টিতে কল্পনাশক্তির অনবদ্যতা লক্ষ্য করার মতো । লৌকিক ভারতীয়তাকে সঙ্গী করেছেন জীবনের বাস্তববোধ থেকে। পাশ্চাত্যর আধুনিক রীতির সমন্বয় রক্ষা করেছেন, মিশিয়ে দিয়েছেন ইউরোপ জাপান ও কলাভবনে তাঁর গুরুর শিক্ষাকে। মগ্নচেতনার মুগ্ধতাগুলি দিয়ে মণিমুক্তোর মতো তৈরি করেছেন তাঁর ছবির পটগুলিকে যা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় এবং রচনার মৌলিকত্বে অহংকারি। সৌন্দর্য চেতনা শিল্পের মস্ত গুণ। শঙ্কা ও সংকটের গতিপ্রবাহ বুঝতে পারা শিল্পীর আরও বড় চেতনা। শিল্পের অক্ষয় উৎস্যকে উদযাপন করার মধ্য দিয়ে তিনি কোনও দুঃখবোধকে জাগ্রত করে প্রেক্ষাপট সাজাননি । শিরোনামে অভিহিত করার খুব প্রয়োজন থাকেনা তাঁর ছবিগুলিকে তবুও নাম তাঁর বুঝি এক ভূষণরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি বর্ণের সংঘাত সৃষ্টি নেই তাঁর ছবিতে। জীবিকা যে জীবনের মহানবস্তু, প্রান্তিক জীবন চর্চার অঙ্গ, এইসবকিছুকে তার স্বভাবসিদ্ধ আবেগে প্রাণঢালা অভিব্যক্তিতে হরেন দাস এক স্বপ্নের মতো আলোর আভার মধ্যে সমস্ত সারল্যে তা উপস্থাপিত করে গেছেন। সাধারণ মানুষের গণসংস্কৃতির ধারা আমাদের ভারতীয় ধারণায় হরেন দাস বিধিবদ্ধ করে গেলেন। দেবতারা ক্যালেন্ডার ও কাঁচবাধানো থেকে নেমে এসে কোথাও গণকৃষ্টির হাত ধরে হরেন দাসের যাত্রাপালায় হ্যাজাকের পূর্বাপর রঙিন আলো জ্বেলে দিলেন। ( ছাপচিত্রি সুশান্ত চক্রবর্তী হরেন দাসের অনলাইন প্রদর্শনী সার্থক হোক এই কামনা করি) ©® অলোক কুন্ডু।












সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০

কলা আলোচক: পার্বতী মুখোপাধ্যায় [] অলোক কুন্ডু

⛔ তখনও হাওড়ার রবীন মন্ডল পুরোপুরি শিল্পী হয়ে যাননি।পার্বতী মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একই পাড়ার কাছাকাছি থাকতেন। সবাই মিলে গান্ধীজির বক্তৃতা শুনতে গিয়ে রবীন মন্ডল দা দাঁড়িয়ে গান্ধীজির ছবি এঁকে ফেললেন। সুদর্শন ধুতি পাঞ্জাবি পরা পার্বতী মুখোপাধ্যায়য়ের দাদা প্রভাত মুখোপাধ্যায় ছিলেন হাওড়ার ১২ জুলাই কমিটির প্রধান। করতেন সিপিএম পার্টি। পার্বতী দা হাওড়ায় করতেন কংগ্রেস। পার্বতী দা-র স্ত্রী ছিলেন হাওড়ার ব্যাঁটরা বিবিপিসি-র প্রধান শিক্ষিকা, সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। পার্বতী মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিন কলকাতা করপোরেশনের মিউটেশন অফিসার ছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার কলা সমালোচক, শিল্পী অহিভূষণ মালিকের স্নেহধন্য। কলকাতার পুরনো দিনের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মলনের একজন সদস্য। অহিভূষণ মালিকের ইচ্ছাতেই পার্বতীদা নানা সময়ে শিল্পের ক্রমবিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখে গেছেন। আসলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেই বেশি ভালোবাসতেন। শেষে আর কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। রবীনদা যখন কয়লাঘাটের রেলের অফিসে চাকরি করতেন, তখন ওখানে একটা জায়গায় রবীন-দারা আড্ডা দিতেন। ওখানে আসতেন প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরী, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, পার্বতী মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় হয় আরও বহু মানুষ। ওখানেই তৈরি হয় ক্যালকাটা পেন্টার্স, রবীন মন্ডলের উদ্যোগে। পার্বতী দার অফিসে বসেও ওঁদের চায়ের আসর বসতো মাঝেমধ্যে। ক্রমশ হাওড়ার পার্বতী মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন বিখ্যাত কলা-আলোচক। দেশ ও বিভিন্ন পত্রিকায় শিল্পকলা নিয়ে গুরুগম্ভীর লেখার প্রয়োজন হলে পার্বতীদার ডাক পড়তো। রাজনীতির সঙ্গে সামান্য পরিচিতি থাকলেও তিনি কখনও মাঠে নেমে রাজনীতি করেননি। যদিও ওঁর সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টির একটা ক্ষীণ যোগ ছিল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কাছের বন্ধু। ১৯৯০ সাল নাগাদ কলকাতার গড়িয়াহাটে ফ্ল্যাট করে হাওড়ার বসবাস উঠিয়ে দেন। হাওড়ায় পড়ে থাকে গোরা বাজারে মস্ত জমিদার বাড়ি। অবসর নিয়ে লেক মার্কেটের সামনে তৈরি করলেন সাধের আর্ট গ্যালারি, দ্য লিটল গ্যালারি। ২০.৩ ১৯৯২-এ পার্বতী দার গ্যালারির উদ্বোধন হলে এই প্রতিবেদককে খবর পাঠালেন। গেলাম গড়িয়া হাটের ফ্ল্যাটে। বৌদি আমাকে বরাবর তুই বলেই সম্বোধন করেছেন। পার্বতী দার সঙ্গে আনন্দবাজারেও গেছি। 
বড় বড় বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে উঠাবসা পার্বতী দা বেশ কিছু বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন। ওই আর্ট গ্যালারিও উঠে গেছে কবেই। ©® অলোক কুন্ডু

গিলছি কিন্তু খাচ্ছি না: অলোক কুন্ডু

⛔ বলি, আমার কাছে কি চাও গো ? কেন এলে গো কিছু ধারটার চেয়োনা, আবার যেন। অনেক তো করেছো গো। মনে নেই না ? হবেই তো মনে থাকার কথা ছিলনা, ঠিক ঠিক বলেছো। জীবনটাকে বর্ষার পরের শুখনো এবড়োখেবড়ো মাঠ করে দিলে, এখন কীভাবে মনে থাকবে বলো ? ও কি বলছো গিলছো কিন্তু খাচ্ছে না। হ্যাঁ তাতো হবেই বাছা। এখন চোখেও কম দেখি, কানেও তো কম শুনি। তাই কী বললুম আর কী শুনলে এই দুয়ের মধ্যে একটু বিবেচনা কোরো বাবারা। গুণ থাকলে নিজগুণে ক্ষমা কোরো আর কি। জানোই তো এখন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সমাজ, পলিটিক্যাল হোমওয়ার্ক, ব্রেনওয়াশ যার যেমন হয় গো। সে যদি কিছু বলতেই হয় টিভির লোক ডাকো, মিডিয়া ডাকো, সাংবাদিকদের যত ইচ্ছে খাবলাও। খিস্তি-খেউড়ের এমন জমকালো ময়দান আর কোথাও পাবেনা ইহজীবনে। যত পারো ভাববাচ্যে গাল দাও। বক্তিমে ঝাড়ো। পরে ক্ষমা চেয়ে বরং এক বাক্স করে বিরিয়ানি দিও। সাত খুন মাফ। তাই বলে যেন আবার আমার ফ্ল্যাটে এসোনা। এলে এই ভাঙা তক্তাতেই এসো। দিনকাল আর ভালো নেই বলবো না, বলবো ঠিক নেই। কে যে ঠিক করবে, সেই আশা এখন তলিয়ে ভেলি গুড়ের মতো শক্ত। ভেবো না, নকশাল মাওবাদী পুঁজিবাদি মূর্দাবাদী সুবিধাবাদী সব ঠিক ছিল। নিরাশাবাদী খুঁজতে বেরিয়েছো যদি তবে আমার নাম তুলে রাখো। বলবে যে নকশালরা ভালো ছিল, মুর্দাবাদী ভালো ছিল। কিন্তু আবার এখন এইসবের মধ্যে রামবাদী এনে ফেলেছো, রাম যে কি দোষ করলো কে জানে গো। কথায় কথায় রামের শ্রাদ্ধ লেগে আছে। বামপন্থীরা নিজেদের বলে বেড়ায় তারাই সবথেকে ভালো। উফ এইসব বললেই ৩৪ বছরের রামায়ণ আসবে, না ওসব থাক। সব ভাইয়া আলাদা কিছু নেই। সব শিয়ালের এক রা বলছি না ভালো খারাপ বুঝতে পারলে বোঝো। সবাই চায় তার তার রাজনীতি শিক্ষে করুক সবাই, ঝান্ডা ধরুক। ঝান্ডা না ধরলে মহা বিপদ। ডান্ডার বাড়ি এমন দেবে যে কোনও " পোতিবাদ" করা ভুলে যাবে। পরকে ভয় দেখাও, তটস্থ করে রাখো, এ এক চরম মহাবিদ্যা। কে কীভাবে শিখলো তা নিয়ে কেউ জানতে যখন চাইছে না তখন বরং তরজাটুকু থামালে রাতে সবাই একটুকু ঘুমোতে পারে। তরজা থামাও আর অতিষ্ঠ কোরোনা গো। অমন সাধের বোকাবাক্স খুলে কি একঘন্টায় চুল করতে দেবে। মারদাঙ্গা হৈচৈ দুরন্ত যে দুটো ভাল কিছু শুনবো তার কোনও উপায় নেই। স্বামীজি বেঁচে থাকলেও আচরণ শেখাতে কিছুতেই পারতেন না। কিন্তু দেখ গিয়ে সকলের আচরণের কত ভেদাভেদ, প্রভেদ, বিভেদ। সমাজ খাও দেশ খাও পয়সা খাও। যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে। কারও জল কামান আছে তো কেউ ইটবৃষ্টিতে দেবে একদম ঠেসে। এইসব ভবিতব্য মনে কর। সৃষ্টি-প্রলয় যেমনটা। এক মায়ের পেটে দুই ছেলে দিওয়ার দেখেছিলে ? কী সিটি পড়লো বলো তো! থামতে আর চায়না। মেরা পাশ মা হ্যায়। হাততালি পয়সার ঝনঝনানি। তা বলে কেউ কুড়োতে যেত না। আর এখন খুচরো দিলেই রায়ট লেগে যায় যায়। অমন উচ্চতার অমিতাভও যায় যায় আর কি খুচরো মাপতে। এমন ডায়লগ দিয়েছিল যে হাইট একবারে সমান। এখন কে যে অমিতাভ আর কে যে শশীকাপূর বোঝা দুষ্কর। কিন্তু তখন থেকে ফ্ল্যাট ,সাধারণ বাড়ি, রেলের গাড়ি বারান্দা দেখতে দেখতে বড় হওয়া। কোথায় বাবার আমলের পিয়াসা আমাদের মুকদ্দর কী সিকন্দর। মুগলে আজম না আনারকলি, উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে বেমক্কা ঝগড়া কিছুটা থেমেছে এখন। কী সাংঘাতিক হিন্দু - মুসলমান ভাগের দ্বন্ধ অবধি দুদ্দাড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সামাল দিতে চতুর্দিক কাঁপছে, গ্রামের পর গ্রাম। এইবার গ্রামে একসঙ্গে এতদিনকার বাস উঠলো বলে। তুমি কি জানো এই সাধারণ আয় আর ঘুষের আয়ের কতটা তফাত হয়। টেন্ডার থেকে আয়, আর মজুরি সমান হয় কখনো ? মাষ্টারের টিউশনি আর বেকারের ছেলেপড়ানো। বলবে হায় বাবা! হ্যায় রাম!  দেখলে রামের নাম মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মুন্নি বদনাম হুই। গন্ধি বাত গন্ধি বাত। কী পারতেন কেশব নাগ ? এইসব সমস্যা মেলাতে। আরে স্বাস্থ্য-সাথীর টাকা পাবো বলে অসুখ করাতে ছুটবো নাকি? ১০ কোটির বাইরে থেকে যদি সুস্থ থাকতে পারি তার দাম স্টার ইন্সুরেন্স পর্যন্ত কভারেজ দিতে পারবে না। আসলে কভারেজ কত টাকার না জেনে লাইন দিতে পারিনি গো। ছাড়ো ওই সব। আমার গাড়ি বাড়ি বাংলো হ্যায়। মেরা পাশ মা হ্যায়, বৃদ্ধাশ্রমের মা, তাড়িয়ে দেওয়া মা, ভাগের মা, তোলাবাজ দাদা, তোলাপৌঁছনোর ভাই, তোলাদাতাকে কমানো যাচ্ছেনা, বাড়বে বলেই ধারণা। কারণ আজকে এই আম্ফান তো কালকে ওই ঝড়। চতুর, ভালো, নরম, গরম চলছে ---এরা সব লোক গো। নিরপেক্ষ মানুষ ,দলীয় মানুষ , মধ্যবর্তী মানুষ। এদিক দেখ মানুষ মানুষ। ওদিক দেখ মানুষ মানুষ। উত্তরে দেখ। দক্ষিণে দেখ মানুষ মানুষ। হেই সামালো মানুষ মানুষ। গাল পেতে দে মানুষ মানুষ। কাস্তে তে দে সান মানুষ মানুষ। গান্ধীবাদ মাইনাস মানুষ মানুষ। মার্কসবাদী মানুষ মানুষ। হাইপার মানুষ। কংগ্রেস ফিনিশ অথবা ফিনিক্স। হাইপ তোলা মানুষ চতুর্দিকে। কেউ বলেনা আমি মায়ের ছেলে। সব মানুষের মধ্যে দুটো দল থাকবেই। এক ঝাড়িকল দলের, অন্যদল বঞ্চিতদের। যাচ্ছে কারা মানুষ মানুষ। বাঁচতে কারা মানুষ মানুষ। 
নাচছে কারা মানুষ মানুষ। খাচ্ছে কারা মানুষ মানুষ। ফন্দি ফিকির মানুষ মানুষ। বুঝতে পারা পাবলিক, ঘোট পাকানো পাবলিক। শিক্ষিত হয়ে বেকার থেকে যাও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বেকার অশিক্ষিতের সাত লাখের চাকরি। আন্দোলনকারীরা চাকরির আশা গুণছে। আদালত আছে বিচারের কিন্তু তোমার তারিখ পেছোবার কোথাও কিছু করার নেই। ধার্মিক, তার সঙ্গে বক ধার্মিক, সাজুগুজু ধার্মিক। গড়বড়ে লোক। চটপটে লোক। ধামাধরা লোক। পোঁ-ধরা লোক। কেউ তাস খেলে। সাপ খেলা চলছে চলবে। কেউ কবিতায় আছে বরাবর, কেউ পার্টি ধরে কবি হয়েছে। কেউ বলে ইডি। কেউ বলে সিবিআই। কারও চায়ের ঠেক আছে তো কেউ নিরুপায় ভবঘুরে। কারো ধার চাই। ভাঙা ঘর, দিন আনে দিন খায় কেউ। কেউ ফ্ল্যাটে বসে দাবায় খুশি, ওপাশে বউটা সিরিয়ালে বেশি মেলামেশা। তা হোক কারও পেছনে তো লাগেনা। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যালয় পরিদর্শক সমিতি বলে একটা বামপন্থী সংগঠনের নাম শুনেছেন কখনও, এদের জন্ম, খাওয়াদাওয়া, ওঠাপড়া সূর্য উদয়-অস্ত সব কিছু ছিল লোকের পেছনে লাগো, বাড়ি থেকে হিংসে নিয়েই এরা বের হতো, এখন মাজা ভেঙে পড়ে আছে। পেছনে লাগো আর পেছনে লাগো, তবে পেছনে লাগার দল একদিন শেষ হবেই। আজ মঞ্চ আছে কাল ঘেরাও করে কাটাবে। আবার তৈরি হবে নতুন পেছনে লাগার নতুন দল। আসলে কেউ বেশ্যায় যায় বুক ফুলিয়ে। গাড়ি চেপে হোটেলের ঘর নেয়। দেখবে এদের সবার কিন্তু ভীষণ মিল গো। কিন্তু সেলফি করলে দেখবে সব উল্টো। কিছুতেই কেউ আর হাত মেলাতে পারেনা। কয়েকজন যারা সাতেপাঁচে থাকেনা তারা পার্কে আড্ডা দেয়। সময় কাটায় আর মুন্নি বদনাম হুইর গল্প জোড়ে তাছাড়া করার কিছু নেই। তুমি ধারটার চেও না বুঝলে। সাবধানে যেও রাত হয়েছে। সত্যি বলছি মানুষের মন আর সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলীনের মতো নয় গো। হিংসে নিয়ে জন্মায় হিংসে নিয়েই মরে যায়। উৎপল দত্তর কল্লোল বন্ধ করে দিয়ে কি লাভ হয়েছিল সেদিন? কেউ পরে অনুশোচনাও করলো না। পরে কি হলো ? উত্তমকুমার রবীন্দ্রসদনে ঠাঁই পেলনা গো। রাজনীতির গুষ্টির পিন্ডি। এখন জনগণের যত্ন কে করবে। আর কেউ নেই গো তোমার যত্ন করার। এখন যত্ন আমার নিজের নিজের! আমার বলতে, আমার কোলে ঝোল ঝাল অম্বল টেনে টেনে চেটে চেটে তোমাকে ঘুগনী চাটা শালপাতাটা এগিয়ে দেবে। আর যদি রাজনৈতিক দলে ভিড়ে একবার যেতে পারো তবে তো আর কথাই নেই...

শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০

আগে রবীনদাকে দেখিয়ে নাও: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় • অলোক কুন্ডু

⛔ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কয়েকজন অনুগামী তাঁর ৪০ বছরের ১৫০ টি আঁকা ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী করবেন বলে ভাবলেন, তখন প্রথমেই মনে পড়লো ফ্রেন্ড, ফিলোজফার বয়সে ৪ বছরের বড় প্রখ্যাত শিল্পী রবীন মন্ডলের কথা, তখনও দুজনেই তো পৃথিবীতে বহাল তবিয়তে আছেন। আসলে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়ায় থাকাকালীন রবীন মন্ডলের ড্রইংয়ের ভক্ত হয়ে পড়েন। তার আগে থাকতেই অবশ্য তাঁর আঁকাআঁকির সঙ্গে একটা পরিচিয় ঘটেছিল। খুব কাছ থেকে সৌমিত্র, শিল্পী রবীন-দার বাড়িতে বসে থেকে, আঁকা প্রত্যক্ষ করেছেন। নিজের খাতা ডায়রিতে আঁকা শুরুও করেন কম বয়স থেকে। জীবনে চারবার বাড়ি বদলাতে তাঁর অনেক খাতা, ডায়রি বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে গেছে। জলরঙেও কিছু এঁকেছেন তার সবকিছু আর তখন কাছে নেই। পরে কয়লাঘাটে যে দোকানে রবীন মন্ডলের কাছে যোগেন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, শুভাপ্রসন্নরা আড্ডা দিতে আসতেন, সৌমিত্র, বিখ্যাত আর্টিস্টদের ওই ঠেকেও গেছেন বহুবার। ছবি সম্পর্কে তাই একটা আইডিয়া যে তাঁর কাছে ছিলনা তা কিন্তু নয়। আইডিয়া থাকলেও সৌমিত্রর ছবি আঁকা একদমই তাঁর নিজের মতো করে এঁকেছেন। এছাড়া তিনিও তো মাষ্টার আর্টিস্ট সত্যজিৎ রায়ের পাশে গিয়ে দেখেছেন সবকিছুই। নিজের বাড়ির ড্রইংরুমের দেয়ালে তাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী রবীন মন্ডলের পেন্টিং টাঙাতে কখনও ভোলেননি, সৌমিত্র। তাঁর প্রয়াণের পরও কন্যা পৌলমী তা ফেলে দেবেন না। যখন গত ৯.১.১৪ তে আই.সি.সি.আর-এ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ড্রইং ও পেইন্টিংগুলি নিয়ে বড়সড় প্রদর্শনী হয়েছিল, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রসেনজিৎ, অরিন্দম শীল, যোগেন চৌধুরী ওয়াসিম কাপূর এবং আরও অনেকে। সেইসব ছবিগুলো জড় করে পি. সি চন্দ্র গ্রুপ পরে বই প্রকাশ করেছিল গত ১৫.১.২০১৯-এ "ছায়া ও ছবি" নামে। সৌমিত্র, তাঁর আঁকা গুলোকে বলেছিলেন, "আমার খেলা।" সাংবাদিকরা যখন ওই দুটি স্থানে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, কীভাবে ছবি আঁকায় এলেন সৌমিত্র দা ? এদের মধ্যে শিল্পী ও শিল্প সমালোচক  শঙ্কর মজুমদারও ছিলেন। আপনি তো সিনেমার নায়ক, নাটক করেন, অজস্র লেখালেখি করেন, কবিতা লেখেন, পত্রিকা বের করেন, সৌমিত্র হেসে বলেছিলেন, "দেখ, রবীন-দার সঙ্গে হাওড়ায় থাকতে আলাপ। ভীষণ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওঁর মতো না পারলেও একটু আধটু সকলের মতো আঁক কাটাকাটি করতাম চিরকাল।" সৌমিত্র বক্তব্য রাখতে গিয়ে, প্রদর্শনীর উদ্বোধনে বলেছিলেন ," হাওড়ায় আমি ও রবীন-দা একই পাড়ায় থাকতাম। পরে রবীন দা আমার নাটকে অনেক হেল্প করেছিলেন। তবে আমার দুজন ইন্সপেরেশনের, একজন হলেন, রবীন দা আর অন্যজন হলেন বেঙ্গল স্কুল ঘরাণার শিল্পী চৈতন্য চট্টোপাধ্যায়। ওঁর ছবি আছে একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের দোতলায়। ঠাকুর ভাসান হচ্ছে, ছবিতে অন্ততপক্ষে ৫০ জন চরিত্র আছে। কী নিখুঁত, কী অসাধারণ আবেদন সেই ছবিতে। সম্পর্কে আমার ভগ্নিপতি। ওঁর দুই ছেলে আমার তো ভাগ্নে, ওরা খুব ছবি আঁকতো। তারাও আমার অনেকটা ইন্সপেরেশন ছিল। ওরা দুজনে খাতায় আঁক কাটাকাটি করতে করতে চট জলদি ছবি এঁকে ফেলতো। ওদের দেখে দেখে কিছুটা চর্চা হয়েছিল তখন।" তাছাড়া চৈতন্য চট্টোপাধ্যায় শেষদিকে ওই রিয়েলিস্টিক আঁকার বদলে খাতায় কলম দিয়ে লেখা ও আঁকার সংমিশ্রণে অদ্ভুত ছবি আঁকতেন। তার প্রতিও সৌমিত্র আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। যদিও যোগেন চৌধুরী ও ওয়াসিম কাপূর ওই পেন্টিং ও ড্রইংকে সৌমিত্রর আর্টওয়ার্ক নামে অভিহিত করেছিলেন তাদের বক্তব্যে। রবীন মন্ডল, আজীবন বন্ধু সৌমিত্রর পেন্টিং সম্পর্কে অবশ্য কিছু বলেননি। কেন এঁকেছেন জিজ্ঞেস করাতে সৌমিত্র বলেছেন, নাটকের স্টেজ, চরিত্র ও ফরমেশন করতে আঁকাআঁকি করতেই হয়েছে। মেকআপের ছবি আঁকা আমার অভ্যাস। কোনির মেকআপের ছবি এঁকে অভিনয় করেছিলাম। তাছাড়া কসটিউম ডিজাইন নাটকের বড় একটা ভাবনা।" সৌমিত্র ফ্রন্টলাইনকে বলেছিলেন, " I did it for fun.  আবার অন্যদের বলেছেন, " আঁকার শিক্ষা আমার নেই। আমার ছবি জড় করে প্রদশর্নী করার আইডিয়া একদমই আমার নয়। সেই সাহসও হয়নি। কয়েকজনের ইচ্ছাতে প্রদর্শনী হচ্ছে। বিশেরভাগ ছবি পেন দিয়ে কাল ও ডার্ক ফ্ল্যাট টোনের। মুখ অথবা মুখোশের মতো মুখ।" অবশ্যই এইসব কোনও কম্পোজিশন নয়, রিয়ালিস্টিক মোটেই নয়। সরঞ্জাম সহকারে ছবি আঁকার কথা বলেননি। মিশ্র মাধ্যমে ছবিকে দাঁড় করিয়েছেন। সৌমিত্র বলেছিলেন, "অধিকাংশ ছবি কেউ আমাকে পোস্টকার্ড পাঠালে, সেটাই ক্যানভাস করেছি। তাছাড়া আমি নাটকের লোক, ছবিতে তাই মুখোশের রূপান্তর ঘটেছে।" সৌমিত্র বলেছিলেন তাঁর ছবি : "অভাবিত। ভাবনা থেকে নয়। হঠাৎ আঁকা।" হাওড়ায় থাকার সময় রবীন-দার ড্রইং দেখেই তো বন্ধুত্ব করেছিলেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তখন বরং রবীন মণ্ডলকে লোকে চেনে। সৌমিত্রর তখন কোনও খ্যাতি নেই। রবীন মন্ডলের পায়ের অসুস্থতাজনিত কারণে ছোটবেলায় তিনি স্কুলে যাননি। তাই হয়তো এতবড় শিল্পীকে আমরা পেয়েছিলাম। সৌমিত্র, রবীনদার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, "আমার আরও একজন ইন্সপেরশন আছেন, ক্যালকাটা পেন্টার্সের রবীন দা। হাওড়ায় থাকার সময় আমরা একই পাড়ায় থাকতাম। মনে আছে গান্ধীজি বক্তৃতা দিচ্ছেন, আমরা শুনতে গেছি। বক্তৃতা শুনতে শুনতে রবীনদা গান্ধীজির ছবি এঁকে ফেললেন। তাই যখন আমাকে বলা হ'ল যে আমার আঁকা ছবিগুলি নিয়ে একটা প্রদর্শনী করার তখন ওদের বললাম, আগে রবীনদাকে দেখাও এইসব। উনি রাজি হলে তবেই প্রদর্শনী করা যাবে। (৪.১২.২০)। ©® অলোক কুন্ডু। 



বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০২০

যুক্তফ্রন্টের ভাবনায় কালো ছায়া: আলোক কুন্ডু


🌏•নির্বাচনে জেতা ও সরকার টিঁকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে ফ্রন্টের সুবিধা অসুবিধা দুই থাকে। নমনীয় একজন বিচক্ষণ নেতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। বড় যে দল তাদের সহ্যশক্তি বেশি থাকা দরকার হয়ে পড়ে। সকলকে নিয়ে চলার ক্ষমতাই হ'ল যুক্তফ্রন্টের মহাগুণ। এই মূহুর্তে কেন্দ্র সরকার যেদিকে যাবেন যুক্তফ্রন্ট ছাড়া সরকার গড়া মুস্কিল। তবে আমি রাজ্যের যুক্ত ফ্রন্ট নিয়ে আলোচনা করবো। 

⛔• আমি রাজ্য রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করবো। সারা ভারতের রাজ্যগুলিতে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে এখন এত নেতা, এত দল হয়ে গেছে যে, কেউ দীর্ঘদিন একদলীয় ভাবে শাসন আর ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না। একদলীয় রাখতে গেলে সেখানে পরিবারের লোকেরা ঢুকবেই। বন্ধুবান্ধব ঢুকবেই। সংঘাতের কারণ সেখান থেকেই প্রথম আসে। অন্ধ্রের এন. টি. রামা রাওয়ের এই একদলীয় শাসন কীভাবে ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে তা সকলেই জানেন। রামচন্দ্রন-জয়ললিতাও তাই। কিন্তু তাদের একটা সুবিধা ছিল তারা নিজেরা ছিলেন "গণনায়ক। " তবে এই ফরম্যাট দুবার হলেও তিনবার সফল হওয়া কঠিন। একদলীয় যুক্ত ফ্রন্ট সোনার পাথরবাটি অনেকটা। এখানে বড় দল সমস্ত ক্ষমতা ভোগ করতে চাইবে আর সেখান থেকেই সমস্ত ক্ষয়ক্ষতি শুরু। ছোটদলকে জব্দ করার প্রবণতা যত বাড়তে থাকবে, ছোট দলগুলো সহ্যশক্তি তত হারাবে। আবার হঠাৎ করে ভুঁইফোঁড় নেতা ভোটে জিতে এলেও তাদের কিন্তু দশটা ভোট জোগাড় করার ক্ষমতা থাকে না পরন্তু তারা সরকারের কাছ থেকে জনগণের কাছ থেকে, ক্ষমতা চলে যাওয়ার ভয়ে, দ্রুত বড়লোক হওয়ার চেষ্টা করে যায়। তাই এদের যুক্ত করে যদি একদলীয় যুক্ত ফ্রন্ট হয় সেখানেও বিপর্যয় আসতে পারে। কারণ এইসব ভুঁইফোঁড়দের কোনও আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে আসতে হয়নি। এক প্রকার বিরোধিতা করার জন্য এরা একত্রিত হয়। বিরোধিতা শেষ হলে এরা বিরোধিতা করার অর্থ হারিয়ে ফেলে ক্ষমতা থেকে উপার্জন করতে শুরু করে দেন। 

⛔• দক্ষিণের নায়করা ছায়াছবির মায়াময় জগতের সুযোগ তারা বহুদিন পেয়েছিলেন। যার ফলে তারা ক্ষমতাও ভোগ করেছেন অফুরন্ত। যা এখন আর সম্ভব নয়। এখন ১৯৭৭ এর বামেদের মতো ভেতরের তাগিদ থেকে ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি কোথাও নেই। কিন্তু মুসলিম সমাজ থেকে ফ্রন্ট তৈরি হওয়ার প্রবণতা থাকলেও এতদিন তৈরি হয়নি। সেই অর্থে বিজেপির ওপর হিন্দুত্ববাদের কাদা লেপটে দিলেও
অধিকাংশ হিন্দু তা মানেন না। কারণ হিন্দুদের মধ্যে বিভিন্ন দল করা লোক অনেক বেশি। কিন্তু মাদ্রাসা থেকে পীরের থানার থেকে যদি রাজনৈতিক দল তৈরির প্রবণতা তৈরি হয় তা কতটা এই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্রে টিঁকে থাকবে হিন্দুদের সমস্ত মানুষকে বাদ দিয়ে তা তারাই জানে। আবার রাজনীতিতে হবেনা পারবে না বলে কোনও কথা নেই। এটা হলে একটা সংঘাত হওয়ার সংঘর্ষ হওয়ার কালো দিক লক্ষ্যনীয়। 

⛔• হঠাৎ উঠে আসা নেতৃত্ব কখনও কোথাও টিঁকে থাকেনি কারণ হঠাৎ করে জনগণের ইচ্ছা জাগ্রত করা যত সহজ তাকে প্রতিপালন করা রক্ষা করা মূল উদ্দেশ্যে সফল করে তোলা ভীষণ কঠিন ব্যাপার। হঠাৎ করে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বিপদগামী হতে পারে যদি না প্রজাপালন কি বস্তু জানা না থাকে। তাই জনগণের উদ্দেশ্যে সব সময় নিজেদের সীমিত ক্ষমতার কথা বলা প্রচার করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ এখন মানুষ সব বুঝতে পারে। ভুল বুঝিয়ে দল বা ফ্রন্ট তৈরি করলেও বড়জোর দশবছর তারা টিঁকে থাকতে পারবেন। ফ্রন্ট বা নতুন দল তৈরি করলেও আসল কথা হ'ল তাদের "জনগণের দল" গড়ে তুলতে হবে। যদি পরিবারের ব্যবসা বাড়িয়ে নেয় কেউ। যদি পরিবার হঠাৎ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যায় দশ-বিশটা ব্যবসা-বাড়ি হয়ে যায় কারও। তবে সেই দল বা ফ্রন্টকে মানুষ চিনে নেবে সহজে। 

⛔• যতই পুত্র চন্দনের নামে সামান্য বিস্কুট কারখানার নামে বা বেঙ্গল ল্যাম্প কেলেঙ্কারির নামে দিনের পর দিন বরুণ সেনগুপ্ত লিখে যান না কেন সকলেই জানেন জ্যোতি বসু সরকারকে সামনে রেখে কিছু মাত্র ঝেড়ে কামান নি। বরং নিজের ও পরিবারের অনেক স্বার্থত্যাগ আছে তাঁর মধ্যে। অজয় মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অতুল্য ঘোষ, প্রমোদ দাশগুপ্ত, বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, বিনয় চৌধুরী, অনিল বিশ্বাস তো এক প্রকার দারিদ্র্যের বা মধ্যবিত্ত জীবন প্রতিপালন করেছেন একমাত্র বিধান রায় ছাড়া। শখ-আহ্লাদ করে দম্ভ নিয়ে নিজের জীবনী লিখে সময় নষ্ট করেননি,  এইসব নেতৃত্ব। এই বিষয়টা গভীর ভাবে লক্ষ্যনীয়। প্রধান নেতা সব সময় গান্ধীজি, নেতাজি, প্রমোদ দাশগুপ্ত, প্রফুল্ল সেন হবেন। নিজের ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই তাদের। জয়প্রকাশ নারায়ণের মতো আদর্শের হবেন। কানাইয়া কুমারের মতো দার্শনিক বক্তৃতা না জানলেও চলবে। তাঁরা সার্কাসের ট্রাপিজের খেলায় পারদর্শী হলেও সবকিছু ভুলতে হবে তাঁদের। যাদের কথা বললাম, এঁরা ২৪ ঘন্টার কর্মী ছিলেন। সরকারের কাজ বা দলের কাজ ছাড়া এদের কারও ব্যক্তিগত জীবন ছিলনা। যদিও এদের মধ্যে ফ্রন্ট অনেকে গড়েন, ফ্রন্ট গড়েও ভিন্ন কারণে টেঁকাতে পারেননি। 

⛔• পশ্চিমবঙ্গে দুবার নির্বাচনে মানুষ গন্ডি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল ভোট দিতে। একবার ১৯৭৭ ও একবার ২০১১। ১৯৭৭ ছিল ২০১১-এর থেকেও চমকপ্রদ। শুধুমাত্র জনগণের রুখে দাঁড়ানোর শক্তি তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ২০১১-তে নির্বাচন কমিশন সর্বশক্তিমান হয়ে ঢাল হয়ে উঠেছিল। ভোট করিয়েছিল স্বচ্ছতার সঙ্গে। নির্বাচন কমিশন ডি. এম. / এস. পি-দের পা কাঁপিয়ে দিয়েছিল। কমিশনের উদ্যোগে জাল ভোটার নষ্ট হয়েছিল, লাখ লাখ রেশন কার্ড ধরা হয়েছিল, লাখ লাখ ডুয়ো ভোটার নিশ্চিহ্ন করেছিল কমিশন। ভোটার তালিকা পরিবর্তন করেছিল। ভোটার লিস্ট তাজা করে দিয়েছিল, সিস্টেমকে দিল্লি বসে একমাস ধরে মনিটরিং করেছিল। এমনকি ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচন থেকেই বুথের কাছে গন্ডগোল ঠেকিয়ে দিয়েছিল। যাদবপুরে সি. আর. পি. এফ. গুলি করে সি. পি. এম ক্যাডারকে মেরে দিয়েছিল পর্যন্ত। তাই ২০১১-এর মতো নিরপেক্ষ, অবাধ স্বচ্ছ নির্বাচন আজ ইতিহাস হয়ে আছে, এই রাজ্যে। ১৯৭৭ ও ২০১১ দুবারই কিন্তু নির্বাচনের আগে ফ্রন্ট হয়েছিল। ১৯৭৭-এ দেখা গেলেও ২০১১-তে মানুষ ফ্রন্টের ব্যাপারটি বোঝেনি। কারণ ২০১১ তে মানুষ মমতা ব্যানার্জীকেই একমাত্র নেতা মনে করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন দলের বুদ্ধিজীবীরা দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে এসেছিলেন, এর গুরুত্ব কিন্তু খুব কম ছিলনা। বরং নন্দীগ্রাম লড়াইয়ে তারাই মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু দল ঘোষণা করেননি তাই তারা নিজে থেকে কোথাও নির্বাচনে লড়েননি। এস.ইউ.আই.সি খানিকটা স্পষ্ট করেছিলেন। কংগ্রেস ফ্রন্টে এসেছিল। ২০১১-এর নির্বাচনের আগে স্টেটসম্যান, আনন্দবাজার, বর্তমান, প্রতিদিন, ভোরের বার্তা, সকালবেলা, আবার যুগান্তর, এখন খবর, প্রাত্যহিক খবর, ৩৬৫ দিন মিলে প্রিন্ট মিডিয়ার জোট গড়েছিল। তেমনি ১৯৭৭ দেশের অধিকাংশ খবর কাগজ কংগ্রেসের বিরুদ্ধে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৭-এর ফ্রন্ট ৩৪ বছর টিঁকে থাকলেও ২০১১-এর পর বুদ্ধিজীবীদের ভাল অংশ সরকারকে সমর্থন প্রত্যাহার করে। গণতান্ত্রিক আদর্শগত কারণে। কংগ্রেস বেরিয়ে যায় নীতিগত কারণে। এস ইউ আই সিও থাকেনি। সুনন্দ সান্যাল তরুণ সান্যালের মতো বিশাল মাপের বুদ্ধিজীবীরা সমর্থন ত্যাগ করেন। 

⛔• দুবারই বুদ্ধিজীবীরা জনমতের সঙ্গী হয়েছিল এবং রাজ্য সরকারের প্রভূত দোষ ছিল। তখন সাধারণ মানুষ অর্থাৎ আমজনতা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। জনসংখ্যার অধিকাংশই তখন সরকার বিরোধী জনস্রোত তৈরি করেছিল। কিন্তু এই জনস্রোতকে বিধিবদ্ধভাবে জুড়তে একদিকে জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগ অন্যদিকে ক্ষমতা ধরে রাখতে ধৈর্যশীল নেতা জ্যোতি বসুর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৭৭-এর আগে থেকে যারা একসঙ্গে লড়েছিল তারাই জ্যোতি বাবুর মতো নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন। তাছাড়া জ্যোতিবাবুরা অন্তত তিনবার ঠেকে শিখেছিলেন। বুদ্ধবাবু কিন্তু শুধুমাত্র সততা দিয়ে বামফ্রন্টের ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেন না। 
এমনকি আমার মনে হয় বুদ্ধবাবুর মধ্যে দাম্ভিকতা ছিল। যা জ্যোতিবাবুর ছিলনা। বুদ্ধবাবু চূড়ান্ত অহংকারী ছিলেন। নিজের এমন কোনও যোগ্যতা ছিলনা যাতে সরকারে নতুন চমকপ্রদ কর্মসূচি নেওয়া যায়। তাছাড়া তিনি দলের দাস হয়ে পড়েন। শুধুমাত্র বামপন্থী আচরণ বজায় রাখলেই হবেনা, কারণ কোনও একটা ওল্ড ম্যানিফেস্টো দিয়ে দেশ শাসন করা যায় না। পার্টি শাসন আর রাজ্য শাসন দুটো পরস্পর বিরোধী। বুদ্ধবাবুর সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক নেতা জ্যোতিবাবু না থাকায় অন্য দলগুলো তাকে অমান্য করতে শুরু করেন। ছোটখাটো দলও তেজি ঘোড়ার ভাব দেখানো শুরু করে। সবথেকে বড় কথা কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও তাদের মস্তবড় অপদার্থ চেলা পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যালয় পরিদর্শক সমিতি শিক্ষা প্রশাসনকে ধ্বংস করে দেয়। বিদ্যালয় পরিদর্শকরা স্কুল পরিদর্শনের দিন শিক্ষককে দিয়ে তার বাড়িতে/ বাসায় খাতাপত্র নিয়ে এসে স্কুল পরিদর্শন করে দুপুরে ঘুমের দেশে চলে যেতে থাকেন। মাত্র ১০% পরিদর্শনে স্বচ্ছতা দেখা যায়, ১০% পরিদর্শক তার নিজের কর্তব্যে শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলে সরকার ক্ষয় বুঝতে পারেনি। পেনশন, অন্যান্য ফাইল, শিক্ষকদের নিয়োগের কাগজপত্রের ফাইল, বেতন আটকে রাখার প্রবণতা, ঘুষের কারবারে প্রশাসন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। বিদ্যালয় পরিদর্শকদের বামপন্থী দল এই ভেঙে পড়ায় হাত গুটিয়ে বসে থাকে। অথচ তাদের মধ্যে যারা কাজের লোক এবং হাজার হাজার শিক্ষক ও তাদের পরিবার ক্রমশ সরকারের বিক্ষুব্ধ হয়ে যায়। এমনকি বাড়ির কাছে ধামাধরাদের পোস্টিং দেওয়া, ফাঁকিবাজ ক্যাডার তৈরিতে সহায়তা এবং দুদিন অন্তর অফিসের মধ্যে পার্টি মিটিং, মিছিল সমাবেশে যোগদান, তাদের কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সরকারের কাজের থেকে বামপন্থী সংগঠন বেশি হয়ে দাঁড়ায়। কো-অর্ডিনেশন কমিটির ব্যবস্থাতে অন্যান্য অফিসেও একই কারবার হতে থাকে। এমনকি হাওড়া ট্রেজারির কো-অর্ডিনেশন সদস্যরা দুবার এই প্রতিবেদকের
প্রাপ্য লাখ টাকার বিল দুবার নষ্ট করে দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখে। অন্যায়ভাবে হ্যারাসমেন্ট করা তখন সরকারীভাবে প্রথা হয়ে দাঁড়ায়। জনগণের কাজের সুরাহার থেকে কর্মচারীদের দিয়ে দলের বাড়বাড়ন্তে বামেদের মধ্যে জনগণের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। জনগণ কাজ না পেয়ে ক্রমশ পিছিয়ে যেতে থাকে তাদের প্রিয় সরকারের কাছ থেকে। যাদের ভোট দিয়ে তারা এনেছিল তারাই বিরোধী হয়ে যায় পরে। বেশিরভাগ দায় কো-অর্ডিনেশন কমিটি ও বুদ্ধবাবুর পুলিশ প্রশাসনিক গাফিলতি মানুষকে বিদ্রোহী করে তোলে। সরকারি অফিসে গেলে কাজ পাওয়া যেত না মোটেই। দিনের পর দিন ঘুরতে ঘুরতে মানুষ মমতা ব্যানার্জীর সঙ্গী হয়ে পড়েন। এটাকেই বলা হয় নেগেটিভ রাজনীতি। 

⛔• যে কোনও দল চাইবে, নাগরিক তার মতো আচরণ করুক আর নাগরিক চাইবে সরকার তার মতো আচরণ করুক, এই দ্বন্দ্ব চিরকালের। এই যে টানাপোড়েন এই সেতু রক্ষা করেছিলেন জ্যাতি বসুর মতো মানুষ ছিলেন বলে। তাঁর শিক্ষা, তাঁর প্রজ্ঞা, তাঁর বিলাতি পড়াশোনা, তাঁর চিন্তা চেতনা মোটেই উর্বর মস্তিষ্কের ছিল না। তিনি ঠকে, অভিজ্ঞতা দিয়ে, ৭২-এর রিগিংয়ের থেকে শিক্ষা নিয়ে, জেলে গিয়ে, মাঠে ময়দানে বক্তৃতা করে, ঘরের খেয়ে বক্তৃতা দিয়ে, ব্যাপক জনসংযোগ তৈরির মাধ্যমে, শ্রমিক আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির আন্দোলন, নকশাল আন্দোলনের ক্ষতিবহনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন জ্যোতিবাবু। তাই বামেদের জড় করার প্রধান সংগঠক তিনি না হলেও টিঁকিয়ে রাখার বড় গুণ তাঁর মধ্যে ছিল। 

⛔• প্রকৃতপক্ষে এই মূহুর্তে আর.এস.পি. বলে একটা দলের কোনও অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গে নেই। উঠে গেছে আর. সি.পি.আইও। বামপন্থী দলগুলোর অস্তিত্ব যা বাংলার গর্ব ছিল তা এখন বিহারে, পাঞ্জাবে, মহারাষ্ট্রে, গুজরাটে ও দক্ষিণ ভারতে বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছুটা উত্থান হয়েছে। কেরল একমাত্র টিকিয়ে রেখেছে বরাবর বামপন্থী মেজাজ। বামপন্থীদের হাজার ভুল হলেও এরা লড়াই করতে পারে। তবে এদের মধ্যে যে পচন সৃষ্টি হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরে। কেশপুর যার এপি সেন্টার ছিল। তা ২০১১-তে নন্দীগ্রাম আর নেতাই মিলে বিস্ফোরণের রূপ নয়। কিন্তু যদি আপনারা দেখেন দেখবেন বর্ধমানেও বামেরা গ্রাম ঘিরে ফেলেছিল। ২০০৬ - বর্ধমানের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রার্থীকে বাড়িতে না পেয়ে বামেরা তার বউকে খুন করে দেয়। আমাকে বর্ধমানের এক কংগ্রেসি স্কুল শিক্ষক বলেছিলেন তার দাদা পঞ্চায়েত দাঁড়িয়ে ছিল তার বদলা হিসেবে ওই মাধ্যমিক শিক্ষকের বউদির কাপড় খুলে নিয়ে তিন কিমি দূরে ছেড়ে দিয়েছিল। ভদ্রমহিলা ব্লাউজ ও শায়া পরে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরেছিলেন। আর একটা ঘটনা বলি নিজে ভুক্তভোগী। ২০১২ পঞ্চায়েত নির্বাচন রায়না ছিলাম। তখন বামেদের ক্ষমতা নেই। একটা বুথের কথা বলছি এখানে। তাদের ১৪ জন ভোটার তখন মাত্র। সবাই সরে গেছে। নির্বাচনের আগের রাতে আমাদের ঘুম হয়নি আমাদের সঙ্গে থাকা পুলিশপার্টিরও নয়। কারণ সারারাত ওই ভোটারদের বাড়িতে ইঁট পড়ছে। অন্ধকারে দুবার গেছি পুলিশ নিয়ে। সকালে একবার। শেষে ১৪ জনকে সঙ্গে করে সিকিউরিটি দিয়ে ভোট দেওয়াতে হয়েছিল। তাদের রাজত্বকালে তারাও ঠিক অনুরূপ কান্ড করেছিল হয়তো। এটা বললাম কীভাবে ক্ষমতা ধরে রাখা হয় গ্রামে তার একটা উদাহরণ। কিন্তু ২০১১ এর নির্বাচনের আগে সিপিএম এবং বামপন্থীরা স্কুল কলেজ কোঅপারেটিভ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে হারতে থাকেন ২০০৫ থেকেই। এই লোকাল নির্বাচনগুলি হচ্ছে মাপকাঠি। একে অবজ্ঞা করলেই সেই দল ভুগবে। ২০০৬ থেকে এইসব ছোট নির্বাচনে আর ভীতি প্রদর্শন করে প্রতিরোধ করা হয়নি। কিন্তু ২০০৬, ২৩৫ করতে পেরেছিল তাদের ভোটিং মেশিনারি দিয়ে।এই বাজিমাত একবছর পর থেকে বামেদের ওই যুক্তফ্রন্টে কোনও কাজে লাগেনি। অনিল বিশ্বাস মশাই ওই ছোট ছোট নির্বাচনগুলি করিয়ে জনগণের নাড়ি পরীক্ষা করতেন এবং ওইসব স্থানে ভোট হতো জবরদস্তি ছাড়া স্বাধীনভাবে। এই অ্যাসিড টেস্ট করার পরই কিন্তু বিরোধীরা ২৩৫:৩৫ হয়ে যায়। 

⛔• ১৯৭৭ তে ফ্রন্ট করে নির্বাচনে লড়ার কারণে কিন্তু বামেরা অনেকদিন টিঁকে ছিল। অনেকগুলো সাইনবোর্ডের দল সঙ্গে থাকলেও বিভিন্ন নেতা এসে মনোবল জোরদার করেছিল। দুর্নীতি ছিল না তা নয়। 
তবে প্রথম প্রথম জনগণের জন্য ভূমিসংস্কার বামেদের সত্য সত্যিই অনেকটা পথ এগিয়ে দিয়েছিল। জনগণের জন্য বহু আইন একমাত্র বাম আমলেই হয়েছিল তবু সরকারের সেই কল্যাণময় ভূমিকা সরকারি কর্মকর্তারা সঠিক ভাবে পালন করতে দেয়নি। সঙ্গে সঙ্গে সিপিএম অন্য দলেকে বাড়তে দেয়নি। যুক্ত ফ্রন্ট রাখতে গেলে অন্যকে বাড়তে দিতে হবে। একা ক্ষমতায় থাকবো অথবা আমি বা আমরাই সব এই নীতির জন্য বামপন্থীদের 
নৌকো ডুবে গিয়েছিল। 

⛔ ২০১১ তেও মনে হয়েছিল যুক্ত ফ্রন্ট করেই সরকারের অগ্রগতি হবে। কিন্তু তা হয়নি মোটেই। 
আবার ২০২০-তে এসে পশ্চিমবঙ্গে একটা যুক্তফ্রন্ট
পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে চলেছে। তৃণমূলের মধ্যে ভাঙন হলে তবেই এই পরিস্থিতি হবে তা ১০০ ভাগ নাও হতে পারে। তৃণমূল কংগ্রেস বাম ও কংগ্রেসকে কিছু সিটি ছেড়েও দিতে পারে, এটা যুক্তফ্রন্ট মনোভাবের অঙ্গ। আবার মুসলিম সমাজের থেকে যে একটি দল উঠে আসছে তাদের সঙ্গে তৃণমূল বা বিজেপি ফ্রন্ট ভেতর করতে পারে। একদল বলছেন, বিজেপি, শুভেন্দু ও মুসলিম সমাজের অলিখিত ফ্রন্ট হতে পারে। তবে মুসলিম সমাজের যে দল উঠে আসছে তারা আগে থাকতে কারও সঙ্গে ফ্রন্ট করবে না। তবে তারা অনেকগুলো জায়গায় ফ্যাক্টর হবে। 

⛔• এখানে লক্ষ্যনীয় বিজেপি কতটা কার্যকর হয়ে উঠতে পারবে। কারণ ২০১৫ থেকে বিজেপি যত গালাগালি খেয়েছে কোনও দলের ভাগ্যে এত গালাগালি জোটেনি। কিন্তু এত গালাগালির পরও হাথরস নিয়ে সারা ভারতের বিপক্ষে থাকলেও তারা কিন্তু বিহারে জিতেছে। পশ্চিমবঙ্গে আসল লড়াই একমাত্র তাদের সঙ্গে। এখানে একটা বিষয়টা মনে রাখা জরুরি সেটা হলো কটা আসন বিজেপি তোলে আর কটা পায় মুসলিম সমাজের নতুন দল। এদের ওপর পশ্চিমবঙ্গের আগামী রাজনীতি নির্ভর করছে। 
এছাড়াও শুভেন্দুর পেছনে যেসব নেতার সমর্থন আছে তাদেরকেও শক্তিশালী হিসেবে শুভেন্দু পেতে চায়। শুভেন্দু তৃণমূল থেকে বের হলে তার অনুগামীদেরও আগামী নির্বাচনে লড়াইয়ে চাইবে। এই লড়াইয়ে যে তাকে সহযোগিতা করবে তার দিকেই শুভেন্দুর সমর্থন যাবে। এখন কে কার সঙ্গে থাকবে বা আছে খুব জটিল বিষয়। 
( সঙ্গের ছবিটি প্রতিকী) 
©® অলোক কুন্ডু 

মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২০

ডিসেম্বর-২০ সতর্কতার সময়: অলোক কুন্ডু

🌏 এখন কি তবে করোনা চলে গেছে? এই প্রশ্ন সরাসরি করলে থাপ্পড় খেতে পারি। খেতে পারি কেন খাওয়াই উচিত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস করোনা শুধুমাত্র আমিই বহন করেছি অর্থাৎ আমিই সব সময় আলোচনা করেছি। কিন্তু ক্ষতিকর কতগুলো বিষয় পড়ে আছে সেদিকে আলোকপাত করা তবু কর্তব্য। সতর্ক থাকাও জরুরি। 

⛔ 🙋 আমি রোজ দেখতে পাচ্ছি এক ভদ্রলোক মাস্ক পরে বাজার যান, রাস্তায় ঘোরেন। বিশাল ব্যবসা আছে শুনেছি। পয়সার অভাব নেই। মাস্কের দাম ১০ টাকা। তাও বেশিরভাগ সময় মুখের নীচে শোভা পায়। অর্থাৎ মাস্ক পরলেও তা না পরার সামিল। প্রকৃত মাস্ক পরার পয়সা থাকলেও তা কিনবেন না। 
🙋 ধরুন আমার বা আমার পরিবারের "ফুল করোনা", "হাফ-করোনা" হয়ে গেছে তাই আমার আর রাখঢাক করার দরকার নেই। জনে জনে বলছি 👫👬👭 ও এমন কিছুই নয়। জ্বর এর থেকেও কাবু করে দিত গো। ভয় ! ধ্যাত্ ভয় আবার পায় কেউ ? দুহাতে করোনাকে ধুয়ে আছড়ে ধেসে দিয়েছি। ধুর মশাই আপনি যেমন। এত ভয়ের কি আছে ? এই দেখুন গো আমাকে ! ইতিমধ্যেই ভয়কে তো জয় করে ফেলেছি। ফেলেছি কিনা? একদম ঘাবড়াবেন না। দ্বিতীয় ভদ্রলোক যেই লেকচার শুনলেন, মনে মনে অমনি এমন দুরন্ত সাহস পেলেন যে গলায় ঝোলানো ৯০ বার কাচা ৫ টাকার আকাশি সার্জিক্যাল মাস্কটার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করে দিলেন। নর্দমায় আশ্রয় হলো তার। পরে যে ছিলেন এটাই তো মাস্কটার ভাগ্য ভালো। 
🙋 এখন সাহসী লোকের সংখ্যা বাঙালি তথা ভারতীয়দের মধ্যে খুবই বেড়ে গেছে। এতো খুব আনন্দের কথা। আমেরিকানরা বাঙালিদের থেকেও বিশাল সাহসী ছিল কিন্তু রোগও প্রচুর ছিল। আসলে খাদ্যাভ্যাসের জন্য আমরা যে সাহসী হয়েছি এটা আজ জানাজানি হয়ে গেছে। তবু খাদ্যাভ্যাসের জন্যই আমরা সাহসী কিনা সঠিক জানা না থাকলেও যথেচ্ছভাবে জীবন অতিবাহিত করা ব্রাজিল, আমেরিকায় করোনা বেশি মাথা চাড়া দিয়েছে।
🙋 তুচ্ছতাচ্ছিল্য না করেও আমার কাছাকাছি ৫/৭ জন যে মারা গেলেন তারা ভেবেই নিয়েছিলেন তাদের কিছুতেই হবে না। 
🙋 যারা মারা গেলেন নিশ্চিত তাদের অন্য অসুখ বিসুখ ছিল। কত ডাক্তারও তো মারা গেলেন। তাদের অসুখ কি তাঁরা তবে জানতেন না তবে ? তাদের মধ্যে তবে কি একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতা ছিল। প্রচুর ছোটবড় রাজনৈতিক নেতাও মারা গেলেন। পুলিশও। 
🙋 এখন পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে বোঝা গেল যে সেফ হোম বাড়িতেই সব থেকে ভালো তাই সরকারের সেফ হোম উঠে গেছে ভালো হয়েছে। এই "জনতা সেফ হোম"-এর জন্যও সংক্রমণ ছড়াচ্ছিল। কারণ ওখানে সাহায্যকারীরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনোভাবের ছিলেন। বন্ধ হয়ে ভাল হয়েছে। 
🙋 দোকানদাররা সব সময় শীত গ্রীষ্ম ( আমাদের দেশের) ১২ মাস ধুলোধোঁয়া খেয়ে খেয়ে তাদের ভয়াবহ করোনা আর কব্জা করতে পারেনি এটা প্রমাণিত। এরা তুচ্ছতাচ্ছিল্য দলের কিন্তু এরা প্রমাণ করেছেন যে এদের সঙ্গে মাস্ক পরার হাত ধোয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে শুধুমাত্র দোকানদার নয়
প্রথমে যে বলেছিলাম ৫ ও ১০ টাকার মাস্ক পরিহিতদের কথা ওরাও তুচ্ছতাচ্ছিল্য দলের লোক কিন্তু দৈহিকভাবে শক্তিশালী। 
🙋 তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ টিভি কাগজে মিডিয়াতে রৈখিক সমীকরণের গাণিতিক যোগের মোট পরিমাণ কমে যাওয়া। কমে যাওয়া নানা কারণে হতে পারে সতর্কতা ও শক্তিশালী ব্যক্তিদের রোগ ধরা, দুর্বল লোকেদের চিহ্নিতকরণ। 
এই তিনটি বিষয়ে সরকার, ডাক্তারবাবু ও গোষ্ঠীর কোনও কাজ নেই। যদি কিছু হয় তা অলক্ষ্যেই হচ্ছে। এইটা দেখার কোনও পরিমাপ না থাকলেও এই সত্য অস্বীকার করে লাভ নেই। 
🙋 আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছেন না এটাও চোখে দেখছি। কেউ কেউ গাড়ি নিজে চালালেও প্রতিদিন স্যানিটাইজ করছেন। জুতো রোদে দিচ্ছেন। সতর্কতা কারও দেখা যায় কারও দেখা যায় না। তবু তুচ্ছতাচ্ছিল্য-এর কাছে সতর্কতা প্রথম দিন থেকে হেরে যাচ্ছে। 
🙋সতর্কতা একটা শৃঙ্খলাবোধের বিষয়। এটা তার মধ্যে ছোট থেকেই আছে। সতর্কতা জীবনের একটা শিক্ষা। এই শিক্ষা মোটেই করোনার দান নয়। তবু সমস্ত সতর্কতাও ফেল করে যায় যখন জীবনে দুর্ঘটনা আসে। করোনা একটা বড় দুর্ঘটনা। সতর্কতা নিলেও করোনা হবেনা এই গ্যারান্টি নেই কারণ দীর্ঘ দিন সতর্কতা নিতে নিতে তা একঘেঁয়ে হয়ে যায়। 
🙋আসলে যেখানে আমাদের সতর্কতা করার ছিল পয়সা থাকলেও না থাকলেও মাস্ক যেটা পরেছি তা আসলে না পরার সামিল। আচ্ছা তাহলেও হাত কি ধুয়ে দিতে যতটা করার ছিল, মনে হয় না। সকলে নয়। তবু না-এর দলের সংখ্যা গরিষ্ঠ। ১০% সবটাই মেনেছে ২০% হাত ধুয়েছে ৬০% লোক বাজার ধুয়েছে। আজ শুনলাম একটা বাড়িতে জুতো স্যানিটেশন হয়েছে কিনা এক মহিলা জানতে চাইছেন কারও কাছে, এই সংখ্যাও ২০% এর বেশি নয়। সকলে বলতেই পারেন তবু সকলের হয়নি কিন্তু। 
হবেনা যারা ৩০ দিন বের হচ্ছেন। তাদের আর হবে না। 
🙋 পড়ে গেল দুরূহ পরিস্থিতি। আমাদের এই সতর্কীকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে পথচলা ২০২১-এর জানুয়ারি পর্যন্ত গড়িয়ে যাবেই। এখনই সবচেয়ে দুরূহ সময় দেখা দিতে পারে। কারণ আমরা ভেবেছিলাম ইদ দুর্গাপুজো দেওয়ালী ও এটির পর ব্যাপক হারে করোনা ছড়াবে। কিন্তু আদপে তা হয়নি। 
তাই আমাদের মনের সতর্কতা মার খেতে বাধ্য এবং তুচ্ছতাচ্ছিল্যের অগ্রগতি হতেও বাধ্য আমাদের মধ্যে। 
এটাই পিক সময়। একঘেঁয়েমি ও ইঞ্জেকশনের আশায় আমরা আমাদের ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু স্পোর্টসে এমনকি ফুটবলেও ফিনিশিং পয়েন্ট ও বক্সেই মাথা ঠান্ডা রেখে অ্যাথলেটিক্স ও ফুটবলে এমনকি কম ওভারের ক্রিকেটেও শেষ ওভার, ফিনিশিং পয়েন্ট ও গোলপোস্টের অশেষ ক্ষমতা। 
🙋 ফেব্রুয়ারিতে ইঞ্জেকশন আসছে ধরে নিয়ে এক সপ্তাহের লকডাউন ফিরিয়ে আনলে মনে হয় সবচেয়ে ভাল হোতো। নতুন ভাবে নতুন বছর শুরুর প্রক্রিয়া আনন্দের সঙ্গে শুরু হোক। ডিসেম্বর সবথেকে সতর্কতার সময়। 
 
⛔ভ্যাকসিনের প্রতিকী ছবি
©® অলোক কুন্ডু

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...