নানারূপে স্বামীজি / অলোক কুন্ডু
⛔ স্বামীজিকে বাঙালিরা মর্যাদা যত না দিয়েছে তার থেকে বেশি মর্যাদা দিয়েছে অবাঙালিরা। দক্ষিণ ভারত তার মধ্যে অন্যতম। দেখা যায় বরাবর বাঙালিরা সিদ্ধান্ত হীনতায় ভোগে। জয়প্রকাশ নারায়ণ এখানে আসার পর এমার্জেন্সির বিষয় তবেই বুঝেছে। এমনকি পশ্চিম ভারত যা স্বামীজির জন্যে ভেবেছে (বিবেকানন্দ শিলা তৈরি অবধি ) স্বামীজিকে
নিয়ে তার কনা মাত্র আমরা ভাবিনি। বাঙালি
পরে ভাবে--সত্যজিৎ রায়ের বেলায়ও তাই। রামমোহন রায়কে তো অসহ্য যন্ত্রণা দিয়েছে বাঙালি। লেডিরাণু আর রবীন্দ্রনাথকে অবধি বেচে বাঙালি বেস্ট সেলার হয়েছে, সেই রবীন্দ্রনাথের চুল দাড়ি ছিঁড়েছে নিবেদিতাকে নিয়ে কিছু বাঙালি কুইঙ্গিত করতেও ছাড়েনি। বেলুড় মঠ করার জন্য স্বামীজিকে বাঙালির
থেকে বেশি দান দিয়েছে অন্যরা। সুভাষচন্দ্রের
বাঙালি বলতে দেশবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ও স্বামীজি
এই তিনজন। সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনে আজও যে ছবি বিক্রির ব্যবসা হয় ক্যানিং স্ট্রিট থেকে তার সিংহভাগ কেনে অবাঙালি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা। আর শোভাবাজার রাজ বাড়িতে স্বামীজিকে যে প্রথম নাগরিক সম্মাননা জানানো হয়েছিল তার মূল ছবিটি চূড়ান্ত অবহেলায় রাজবাড়ির দালানে ও স্বামীজির
একটি ছবি মলিন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। আমাদের হাওড়ার অবনীমলের কাছে বেঁটে মতো বেঢপ (পা ছোট) একটি স্বামীজির মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে (হয়তো আরও অনেক হয়েছে) বহুকাল পরে স্বামীজীর নিজের বাড়ি স্বামীজির আদর্শের যোগ্য
হয়েছে। আর একটা চোখে দেখা ঘটনা বলি আমি হাওড়ার বিকে পাল স্কুলের কাছে একটি পুরাতন বই ও খবর কাগজ ওলার কাছে প্রায় বই কিনি (ও বাড়ি থেকে ওজন দরে যেগুলি কিনে আনে), এক বছর আগে তার কাছেই পেয়েছি স্বামীজির রচনাবলীর
একটি খন্ড। বইটি কেনার সময় জানতে চেয়েছিলাম দোকানদার কোথায় বইটি পেয়েছে, তিনি জানান এই সব বই নতুন ফ্ল্যাটে উঠে চলে যাওয়ার সময় বিক্রি করেছে তারা। সত্যই কি আমরা সঠিক সময়ে সবকিছু বুঝে উঠতে পারিনা? বাঙালির বুদ্ধিতে অতিরিক্ত রাজনীতির মেধ জমাই কি এর মূল কারণ ??
⛔ ২৩ বছরে ঘর ছেড়েছিলেন ৩৯ বছরে তার মৃত্যু হয়। বিশ্ব ধর্মসভা থেকে রামেশ্বরমে এসে সেখানে নামার ১০ বছর পর তাঁর ইহোলোক ছেড়ে যাওয়া। কতকিছু ভেবেছিলেন কিন্তু অধিকাংশ কাজ, তার লেখা পড়া বাস্তবায়ন করা যায় নি। শিকাগোয় এসে আস্তানার ঠিকানা হারিয়ে ফেলে কনকনে ঠান্ডায় তাকে সারারাত বাইরে অনাথ অবস্থায় কাটাতে হয়েছিল। বিশ্ব ধর্মসভা থেকে ফিরে রামেশ্বরমে নেমে মাদুরাই থেকে যখন তিনি কখনো গাড়িতে কখনো ট্রেনে করে আসছিলেন,তার আগে ও পরে স্বামীজি সম্পূর্ণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আসলে স্বামীজি খুব তাড়াতাড়ি করছিলেন তার ঘর ছাড়ার বিষয়টিকে মজবুত করতে। নিজের জন্য নয়। ভারতবাসীর জন্য তার কায়িক পরিশ্রম তখন থেকেই হচ্ছিল। কিন্তু নিজের শরীরের কথা তিনি ভাবেননি। পরিব্রাজক স্বামীজি যেখানে যেমন পেরেছেন থেকেছেন যা তাকে পাঁচজন এনে দিয়েছেন তাই তিনি খেয়েছেন।
⛔ এমনিতে আমেরিকা থেকে ফেরার সময়ই তিনি জাহাজ যাত্রায় কাহিল হয়ে পড়েন। পয়সার জন্য আমেরিকা ও ইউরোপের অন্যত্র খাওয়া থাকার জন্য তিনি প্রচুর বক্তৃতা দিয়ে উপার্জন করার জন্য কাহিল হয়ে পড়েছিলেন। তবুও দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজে ও মাদুরাইতে জায়গায় জায়গায় তার জন্য অভাবনীয় উদ্যোগ নিয়ে তোরণ করা হয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানাতে, যেখানে তিনি কিছু বলবেন এমন আশাও ছিল উদ্যোক্তাদের। কথা ছিল অন্তত ৫/৬ জায়গায় তিনি বক্তব্য রাখবেন, কিন্তু পারেননি। তবু মাদ্রাজিরা তার রথের ঘোড়া খুলে দিয়ে যখন তার গাড়িকে নিজেরাই টানলেন তখন স্বামীজির আপত্তি থাকলেও যুবকদের এই শক্তির কথাটা তিনি তার ১০ বছর বেঁচে থাকার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ভেবেছিলেন । ট্রেন থামিয়ে স্টেশনে স্টেশনে কাতারে কাতারে মানুষের আবদার রাখতে স্বামীজি অনেক জায়গায় ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনে তৈরি মঞ্চে বক্তব্য রাখতে জায়গা ছেড়ে উঠতেও পারেননি । একটু সুস্থ হতেই আবার বেরিয়ে পড়েছিলেন পরহিতার্থে । কিন্তু বিবেকানন্দকে নিয়ে নিন্দুকেরা তাঁকে কী না বলতে বাকি রেখেছিলেন। তাই স্বামীজি এক সময় দুঃখ করে বলেছেন--" তারা বলতো বিবেকানন্দ জুয়াচোর, এক আধটি নয় এই স্বামীর অনেকগুলি স্ত্রী ও একপাল ছেলেপুলে আছে "। স্বামীজি দুঃখ করে বলেছিলেন -
" সেইসব মানুষের সাহায্য আমি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করি , আমি আমার দেশকে ভালবাসি আর
বড় একান্তভাবেই ভালবাসি "।
⛔স্বামীজির ৩৯ বছরের ঝঞ্ঝাময় জীবন ঘটনাবহুল জীবন ও বার্তাবহুল হয়ে
আজকেও বেঁচে আছে। পুরাণে আছে সন্ন্যাসীর জীবন অতি কঠিন। সে যা পাবে তাই খেয়ে ও পরে এলাকার পর এলাকা ঘুরে দেখবেন। সাধারণ মানুষের জীবনকে দেখাই তার জীবনের আদর্শ হবে। স্বামীজি একরকম অনাহারে তার সন্ন্যাস জীবন কাটিয়ে এই ভারতের আসমুদ্র হিমাচল তিনি ঘুরে ঘুরে অভাবি মানুষের সুখদুঃখকে নিজের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। তখনকার দিনে কোনো মানুষের সাহস ছিল না ৬৩ দিন ধরে বোম্বাই, চীন, ভ্যাঙ্কুভার হয়ে, প্রায় সামান্য খরচ সঙ্গে নিয়ে, আমেরিকা যাওয়ার কথা। পরে জামেসদজি টাটার সঙ্গে তখনই আলাপ হয়েছিল। কিন্তু তাতে স্বামীজির কিছু তখন সুবিধা না হলেও বেলুড় মঠ ও দ্বিতীয়বার
বিদেশে যেতে তা তাঁকে সাহায্য করেছিল। সিকাগো ধর্ম সভার দশ বছরেই তাঁর মৃত্যু হয়। কোনো সময় তিনি একেবারেই পাননি। যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে থেকে আমরা পাই অন্য শ্রীরামকৃষ্ণকে। তেমনি বিবেকানন্দকে
আমরা পুস্তকাকারে সেইভাবে পাইনি।
⛔ তবে হাতের গোড়ায় পেয়েছি সাহিত্যিক শংকরের কাছ থেকে স্বামীজিকে অন্যভাবে জানার। দীর্ঘ দিন তিনি হাওড়ার রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের সঙ্গে
যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই বিবেকানন্দ চরিত্র চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি। তাই শংকরের থেকে স্বামীজির সম্পর্কে গভীর ভাবে আমরা কিছুটা অধ্যয়ন করতে পেরেছি। কিন্তু শ্রীম"র জন্য তবু আমরা শ্রীরামকৃষ্ণকে বেশ কিছুটা জানতে পারলেও স্বামীজি আমাদের সে সুযোগ নিজেই দেননি। ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামীজির গান তার প্রবন্ধ তার পত্রাবলী তাঁকে কিছুটা জানা যায়। তবু যেন আমাদের মনে সংশয় থেকেই যায় । মনে হয় বিবেকানন্দ এদেশে এখনও অবহেলিত রয়ে গেছেন। "আমি বিবেকানন্দ বলছি "-স্বামীজির জীবনের দুঃসময়ের ফসল। স্বামীজির রচনাবলীতে আছে-" বহুজন হিতায় বহুজন সুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবনের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে,বিধবার অশ্রু মুছাতে,
পুত্রবিয়োগ-বিধুরার প্রাণে শান্তিদান করতে,অজ্ঞ ইতর সাধারণকে জীবন সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানলোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্ম-সিংহকে জাগরিত করতে
জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে।" পিতার মৃত্যুর পর দিশেহারা ছিলেন তিনি, একদিকে আত্মীয় স্বজনদের স্বার্থপরতা অন্যদিকে মা-দু ভাইয়ের আহার জোগাড় করা , বাসস্থান রক্ষা করার ভাবনা আগে না কি ? শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারাপ্রচার করা ? কোনটা প্রধান তাঁর কাছে হবে ? সন্ন্যাসীর কঠোরতায় নির্মমভাবে স্বামীজি ভাবলেন যে, ত্যাগই হলো তার জীবনের প্রধান অধ্যায়, বেদনায় কাতর হয়ে না পড়ে ভয়ানক দুঃখ কষ্টকেই সহ্য করে নিয়েছিলেন তিনি। তাই অনেক কষ্টে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল -" জীবনে যাকে নিজের পথ নিজেকেই করে নিতে হয় ,সে একটু রুক্ষ হবেই ।"
⛔ কিন্তু বাস্তবে তো স্বামীজি ছিলেন দিলখোলা সাদাসিধে মানুষ । হাঁস,ছাগল কুকুরদের সঙ্গে তাদের ভাষায় আদান প্রদানের কথাতো এখনও বেশ রসালো ভাবেই শোনা যায়। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাদের মতো করেই। শুনলেই হাসি এসে যাবে এইরকম সব অদ্ভুত তাদের নামকরণ করেছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন-" এই বিশ্বাস আমি দৃঢ়ভাবে পোষণ করে আসছি এবং এখনও করি যে, যদি আমি সংসার ত্যাগ না করতাম তবে আমার গুরু পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে বিরাট সত্য প্রচার করতে জগতে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন তা প্রকাশিত হতে পারতো না।" এখানে আমরা এক প্রচন্ড শক্তিশালী দৃঢ়চেতা মানুষরূপে স্বামীজিকে পাই। স্বামীজি বলেছিলেন এই ভারতে তাকে অনেকে চেনেনা বোঝে না তাতে কি ?!" আমি যুব-দলকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে নেমেছি,যারা সর্বাপেক্ষা দীনহীন অবহেলিত পদদলিত...তাদের দ্বারে দ্বারে--সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, শিক্ষা ধর্ম বহন করে নিয়ে যাবে --এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা ও ব্রত । এটি আমি সাধন করব অথবা মৃত্যুকে বরণ করব । যেমনটি পুরাণে বলা আছে সেই কপর্দকহীন সন্ন্যাসীদের রূপের মধ্যে যে স্বামীজি বিজয়ী হবার স্বপ্ন দেখতেন তা তাঁর রচনায় মেলে বইকি। তিনি বলেছেন-" আমার ভয় নেই, মৃত্যু নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই...বিশ্বপ্রকৃতির সাধ্য নেই যে,আমাকে ধ্বংস করে । প্রকৃতি আমার দাস। হে পরমাত্মন্, হে পরমেশ্বর তোমার শক্তি বিস্তার কর ।" কী অভাবনীয় প্রত্যয়ী তিনি , কে তার সেই পরমেশ্বর ? স্বামীজির ধর্ম তো হিন্দু নয় তবু একদিন কী হলো দুর্গাপূজার রীতিনীতি নিয়ে লেখা বই আনালেন। মূর্তি পুজোর বিরোধী স্বামীজি অনুমতি দিলেন মঠে দুর্গাপুজো হবার। আসলে একটু আনন্দ হবে ঢাক বাজবে অনেক মানুষের আগমন হবে তার সঙ্গে তার বানানো রেসিপি অনুসারে খিচুড়ি ভোগ। তিনি হিন্দুত্বের পুজো করেননি তাদের আনন্দের পুজো করেছিলেন।
⛔ শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি দেখেছিলেন কাপড়চোপড় ছাড়া পঞ্চবটিতে বসে ধ্যানমগ্ন, রাতবিরেতে উলঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণ ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর বেশবাস,মা মা বলে মন্দিরে ঢুকে গেছেন। পুজো করতে করতে মা কালীকে নয় নিজের মাথায় ফুল দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কালীমূর্তি কি তবে তথাকথিত কোনো ভগবানরূপী দেবতা ছিলেননা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছেও ? সবার কাছে দক্ষিণেশ্বরের তিনি কালী মূর্তি হলেও স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু পরবর্তীতে কালীর বদলে শ্রীরামকৃষ্ণকেই দেবতার আদলে বসিয়ে তিনি পুজো করেছেন, যা বেলুড় গিয়ে আমরা আজকে দেখতে পাই। মূর্তির থেকে রক্তমাংসের মানুষ যাকে তিনি দেখেছেন তাকে পুজোর মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় রীতিনীতিতে কষাঘাত করেছিলেন।
⛔ হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে ১১১ বছর আগে এসে শ্রীরামকৃষ্ণকে পুজো করতে গিয়ে লিখলেন -" শ্রীরামকৃষ্ণায় তে নয়: ।" স্বামীজি জরথ্রুষ্টের মতবাদ ভালো করে জেনে ছিলেন। তাই ভারতীয় ঋষির সনাতন ধ্যানচিন্তা কে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আহুরা মাজদা সম্প্রদায়ের মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে খুঁজতে তাদের ধ্যানমগ্নতায় আরও বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন । কখনই ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনাকে তিনি খারাপ বলেননি অথচ সেখানে তিনি নিজেকে বিকিয়েও দেননি । ভারতবাসীকে ভাইয়ের মতো ভেবে সম্বোধনে বলেছিলেন -"ওঠো জাগো...। " তিনি তাই আমাদের কাছে স্বামী বিবেকানন্দের মতো এক পরম দয়াময় দৃঢ়চেতা ভাবগম্ভীর মানবপূজারী হতে পেরেছেন । তিনি তো নিজে দেখেছেন তার গুরুদেব,(লোকেরা তাকে পাগলঠাকুরও ভালোবেসে বলেছেন) তাকে বার বার বলেছেন--" যা না যা... মায়ের কাছে যানা একবারটি...এ বারও পারলি নে...যা যা ।" সত্যি তো শ্রীরামকৃষ্ণ তো মন্ত্রপড়া ঘন্টা বাজানো চামরদোলানো কোনো সাধারণ পুরুত ছিলেন না। কেশবচন্দ্র সেন, বিদ্যাসাগর কেউ তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি এমন তো নয়। স্বামীজি যখন ভ্যাঙ্কুভারে তখন জামসেদজি টাটার সঙ্গে তাঁর দেখা হয় । ওই একই জাহাজে স্বামীজি যখন প্রথম আমেরিকা যাচ্ছিলেন ।
⛔ পারস্য উপসাগরীয় আহুরা-মাজদার উপাশকদের আগুনের সামনে উপাসনার মধ্যে দিয়ে যে জীবনের শুদ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায় সেই ধর্মের উৎসাহ থেকে তিনি যে বেলুড় মঠের ধ্যানমগ্নতা খুঁজে পেয়েছিলেন সে কথা ভাবলে ক্ষতি কি ? বেলুড়ের অলঙ্কার নক্সায় মোটিফে পার্সি,খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু,বৌদ্ধরীতি অবলম্বন করা হয়েছে । শ্রীরামকৃষ্ণের যত মত তত পথকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করেদিয়েছিলেন । বলেছিলেন - শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী আমাকে প্রচার করতেই হবে। যৌবনে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে প্রভাবিত নরেন্দ্রনাথ মূর্তি পুজোকে পৌত্তলিক জ্ঞান করতেন শ্রীরামকৃষ্ণের উদার এবং সমন্বয়ী চিন্তার সঙ্গে "কালীঘরে যাওয়া " শক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া নরেন্দ্রর চোখে বিসদৃশ্য লাগতো। তরুণ,সংশয়ী, নরেন্দ্রনাথের এইভাব বেশি দিন টিকে ছিল না। ১৮৮৮ সালে নিজ শিষ্য সদানন্দকে বলেছিলেন - " আমার জীবনে একটা মস্ত বড় ব্রত আছে। এ ব্রত পরিপূর্ণ করার আদেশ আমি গুরুর কাছে পেয়েছি--আর সেটা হচ্ছে মাতৃভূমিকে পুনরুজ্জীবিত করা। " শ্রীশ্রী মা একদিন গল্পছলে এক শিষ্যকে বলেছিলেন -" যা সব শুনছি, সাহেব পুলিশরা এসে একদিন না একদিন নরেনকে গারদে পুরে দেয় । " এ থেকে প্রমাণিত হয় স্বামীজির কাছে বিপ্লবীরা আসতেন পরামর্শের জন্য।
⛔ বিবেকানন্দের আয়ুষ্কাল রবীন্দ্রনাথের অর্ধেক মাত্র। বিবেকানন্দ নবীন ভারতবর্ষের কোনো বিষয় ও সংঘাত দেখে যেতে পারেননি তাই রবীন্দ্রনাথ যতটা পেরেছেন স্বামীজি ততটা করে যেতেও পারেননি। তাছাড়া স্বামীজির বিপ্লববাদ ছিল শুধুই মানুষের চরিত্র গঠনের । ধর্ম, শিক্ষা, ও ক্ষুধা সম্পর্কে নিশ্চিত দিগদর্শনের নির্দেশ। জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশের -" দাজ স্পেক জরাথ্রুষ্ট " বইয়ে এক সন্তপ্রতিম মানুষের বর্ণনা আছে। বিজন পর্বতে তিনি
দশবছর স্ব-নির্বাসিনে ছিলেন গভীর ধ্যানে। তারপর তিনি জনপদে এসেছিলেন মানুষকে তার কথা
বলতে। সেই জরথ্রুষ্টের ধর্মীয় মতবাদের প্রথমে আছে মহিলাদের অগ্রাধিকার। " যত্র নার্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা।" যেখানে নারী সম্মান পান, সেখানে দেবতার অবস্থান ।" কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দ দেখলেন
তাঁর সময়ে নারীরা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত ও অত্যাচারিত । গভীর দুঃখে ও যন্ত্রণায় বিবেকানন্দ,
তিনি বললেন, ভগবানের প্রতিমা স্বরূপা নারী এখন শুধুমাত্র সন্তান ধারণের যন্ত্রে পরিণত । নারীকে তার শিক্ষা ও স্বাধীনতার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
যতক্ষণ তা সম্ভব হবে না , ততক্ষণ জাতি হিসেবে আমরা উঠে দাঁড়াতে পারবোনা ।" বিবেকানন্দ বললেন-" নারীকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।" স্বামীজি শিক্ষার সঙ্গে চরিত্র গঠনের কথা বলতেন। সার্বিক ব্যক্তিত্বের বিকাশ চেয়েছিলেন স্বামীজি।
এইখানে রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের কাছে সমগ্র নারীজাতি ও বাঙালিরা চিরঋণী। পরবর্তীকালে নারী সমাজের যে অগ্রগতি হয়েছে, সেদিন এই দুই মহারথী পাশে এসে না দাঁড়ালে তা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলনা। এই প্রসঙ্গে শ্রীমার সঙ্গে বিবেকানন্দের একটি সম্পর্কের কথা বলি। বিবেকানন্দ তাঁর অনুকরণীয় ভাষায় বলেছেন--শ্রীরামকৃষ্ণ থাকুন বা যান ক্ষতি নেই, কিন্তু মা ঠাকরণ না থাকলে সর্বনাশ, তিনি শক্তির আধার। মাঝেমধ্যেই তিনি গুরুভাইদের
বলছেন, "তোরা মাকে চিনতে পারিসনি। মাকে চিনতে চেষ্টা কর। "সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কেও একই কথা খাটে , সুভাষচন্দ্র তার জীবনে নারীর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে,মা প্রভাবতীদেবী ও দেশবন্ধু-পত্নী বাসন্তী দেবী,মেজ-বউদিদি বিভাবতীদেবী ও পত্নী
এমিলিয়রের কিছু ত্যাগ ও গুণের কথা বলেছিলেন। স্বামীজি আবার একথাও ভেবেছিলেন যদি নারীরা সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসীনী হতে চান সে অধিকার তাদের দিতে হবে। সেই দিশা খুঁজে দিয়েছিলেন
স্বামীজি নিজেই। এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বামীজির দৃষ্টি ছিল সবদিকে।
⛔ তিনি বলেছেন-" আমরা নির্বোধের মতো,জড় সভ্যতার বিরুদ্ধে চিৎকার করিতেছি...বাহ্য সভ্যতা আবশ্যক , যাহাতে গরীব লোকের জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়। অন্ন ! অন্ন! যে ভগবান আমাকে অন্ন দিতে পারেন না, তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন--ইহা আমি বিশ্বাস করিনা ।" এমনকি রাজনীতিকেও তিনি ছেড়ে দেননি-"এই ঘোর দুর্ভিক্ষ, বন্যা রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বলো ? খালি আমাদের হাতে শাসনের ভার দাও, বললে কি চলে ? মানুষ কাজ যদি করে তাকে কি মুখ ফুটে বলতে হয় ? "যা আজ হবে যা হতে যাচ্ছে দেখা যাবে অল্প সময়ের মধ্যেই স্বামীজি সব বলে গেছেন । (কেউ যেন এই প্রসঙ্গে ভারতীয় রাজনীতি না জুড়ে দেন, কংগ্রেসর তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে স্বামীজি ওইসব বলেছিলেন) । তিনি বলেছেন শিক্ষা অর্জনের অধিকার সকলেরই থাকা উচিত। আর শিক্ষিত না হওয়ার জন্য তিনি আত্মজিজ্ঞাসা করেছেন, এই জন্য কে দায়ী ? উত্তর দিয়েছেন নিজেই, বলেছেন -" ইংরাজরা দায়ী নয় , আমরাই দায়ী।" স্বামীজী সবথেকে জোর দিয়েছেন শিক্ষার অধিকারের উপর যা আমরা ২০০৯ -এ এসে বুঝতে পেরেছি। স্বামীজিই বলেছেন - "দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে তবে শিক্ষাকেই তার কাছে পৌঁছাতে হবে।"
⛔ স্বামীজির কথা কখনো কখনো ঝাঁঝালো হয়েছে যা এখনকার দিনে তার মূল্যায়ণ অমর হয়ে আছে বলা যেতে পারে -" দিবারাত্রি ভন্ডামি, মিথ্যাচার ও প্রতারণার জীবন যাপন কর--তোমার ক্ষতগুলি যতদূর পারো ঢাকিয়া রাখো। তালির উপর তালি দাও, শেষে প্রকৃত জিনিসটিই যেন নষ্ট হইয়া যায়, আর
তুমি কেবল একটি জোড়াতালির সমষ্টিতে
পরিণত হও। "
⛔©® অলোক কুন্ডু