শুক্রবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২০

#স্বামী_বিবেকানন্দের_শিকাগো_বক্তৃতা


নানারূপে স্বামীজি : প্রসঙ্গ স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার পূর্বাপর
©® অলোক কুন্ডু
■ ২৩ বছরে ঘর ছেড়েছিলেন ৩৯ বছরে তার মৃত্যু হয় । বিশ্ব ধর্ম সভা থেকে রামেশ্বরমে এসে নামার ১০ বছর পর তাঁর ইহোলোক ছেড়ে যাওয়া । কতকিছু ভেবেছিলেন কিন্তু অধিকাংশ কাজ, এমনকি তাঁর লেখা পড়েও এখনও বাস্তবায়ন
করা যায় নি, এত‌ই বিস্তৃত সেই ভাবনাগুলো ছিল। শিকাগো এসে কোথায় থাকবেন সেই আস্তানার ঠিকানা হারিয়ে ফেলে কনকনে ঠান্ডায় তাকে
বাইরে অনাথ অবস্থায় রাত কাটাতে হয়েছিল।
■বিশ্ব ধর্মসভা থেকে ফিরে রামেশ্বরমে নেমে মাদুরাই থেকে যখন তিনি কখনো গাড়িতে কখনো ট্রেনে করে আসছিলেন ,তার আগে ও পরে স্বামীজি সম্পূর্ণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আসলে স্বামীজি খুব তাড়াতাড়ি করেছিলেন তার ঘর ছাড়ার বিষয়টিকে মজবুত করতে। নিজের জন্য না ভারতবাসীর জন্য তার কায়িক পরিশ্রম তখন থেকেই হচ্ছিল কিন্তু নিজের শরীরের কথা তিনি ভাবেননি। বক্তব্য রাখলে কিছু উপার্জন হতো, আশ্রয় পেতেন দুমুঠো খেতে পেতেন বিদেশে। ■যখন তিনি ভারতবর্ষে পরিব্রাজক। স্বামীজি যেখানে পেরেছেন থেকেছেন যা তাকে পাঁচজন এনে দিয়েছেন তাই তিনি খেয়েছেন। এমনিতে আমেরিকা থেকে ফেরার সময়‌ই তিনি জাহাজ যাত্রায় কাহিল হয়ে পড়েন। তবুও দক্ষিণভারতের মাদ্রাজ ও মাদুরাইতে জায়গায় জায়গায় তোরণ করা হয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানাতে। কথা ছিল বক্তব্য রাখবেন, কিন্তু পারেননি। এতটাই অবসন্ন। দেশমাতৃকা ছেড়ে বাঙালি খাবার ছেড়ে কতদিন ঘুরছেন। জাহাজের ধকল তো কম নয়। তবু মাদ্রাজিরা যুবকরা ঘোড়ারগাড়ির ঘোড়াকে বিচ্ছিন্ন করে খুলে দিয়ে যখন তার গাড়িকে মানুষ দিয়ে টানানো হয়েছিল তখন আপত্তি থাকলেও যুবকদের এই প্রাণশক্তির কথাটা তিনি তার ১০ বছর বেঁচে থাকার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ভেবেছিলেন। ফেরার ট্রেন থামিয়ে স্টেশনে মানুষের আবদার রাখতে স্বামীজি অনেকদিন ট্রেন থেকে নামতেই পারেননি। স্বামীজির জন্যে স্টেশনে মঞ্চ, গেট ফুল কাতারে কাতারে জনসমুদ্র। একটু সুস্থ হতেই আবার বেরিয়ে পড়েছিলেন পরহিতার্থে।
■ কিন্তু এই বিবেকানন্দের নিন্দুকেরা তাঁকে কী না বলতে বাকি রেখেছিলেন। তাই স্বামীজি এক সময় দুঃখ করে বলেছেন--" তারা বলতো
বিবেকানন্দ জুয়াচোর, এক আধটি নয় এই
স্বামীর অনেকগুলি স্ত্রী ও একপাল ছেলেপুলে আছে "। স্বামীজি দুঃখ করে বলেছিলেন -
" মানুষের সাহায্য আমি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান
করি, আমি আমার দেশকে ভালবাসি আর 
বড় একান্তভাবেই ভালবাসি "। স্বামীজির ৩৯
বছরের ঝঞ্ঝাময় জীবন ঘটনা ও বার্তাবহুল হয়ে
আজকেও বেঁচে আছে। পড়লে চোখে জল এসে যাবে।
■ পুরাণে আছে সন্ন্যাসীর জীবন অতি কঠিন । সে যা পাবে তাই খেয়ে ও পরে এলাকার পর এলাকা ঘুরে দেখবেন। সাধারণ মানুষের জীবনকে দেখাই তার জীবনের আদর্শ হবে। স্বামীজি একরকম অনাহারে তার সন্ন্যাস জীবন কাটিয়ে এই ভারতের আসমুদ্র হিমাচল ঘুরে ঘুরে অভাবি মানুষের সুখদুঃখকে নিজের জীবনের সঙ্গে নিয়ে তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। তখনকার দিনে কোনো মানুষের সাহস ছিল না ৬৩ দিন ধরে বোম্বাই , চীন , ভ্যাঙ্কুভার হয়ে প্রায় সামান্য খরচ সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার কথা। আজ থেকে ১২৭ বছর আগে ১৮৯৩ সালের ৩১মে স্বামীজি আজকের মুম্বাই থেকে জাহাজে উঠেছিলেন । পথে চীন জাপান ও কানাডায় তিনি নেমেছিলেন। পরে জামেসদজি টাটার সঙ্গে তখন‌ই আলাপ হয়েছিল জাহাজে। কিন্তু তাতে স্বামীজির কিছু তখন সুবিধা না হলেও বেলুড় মঠ ও দ্বিতীয়বার বিদেশে যেতে তা তাঁকে সাহায্য করেছিল। সিকাগো ধর্মসভার দশ বছরেই তাঁর মৃত্যু হয়। অবসরের জন্য কোনো সময় তিনি একেবারেই পাননি।  যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে থেকে আমরা পাই অন্য শ্রীরামকৃষ্ণকে। তেমনি বিবেকানন্দকে পুস্তকে সেইভাবে পাইনি। তবে হাতের গোড়ায় পেয়েছি ইদানিংকালে সাহিত্যিক শংকরের কাছ থেকে  স্বামীজিকে অন্যভাবে জানার। শংকর শঙ্করিপ্রসাদ বসু দীর্ঘ দিন দুজনেই হাওড়ার রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের সঙ্গে
যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই বিবেকানন্দ চরিত্র চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন তারা । তাই শংকরের থেকে
স্বামীজির সম্পর্কে গভীর ভাবে আমরা কিছুটা 
অধ্যয়ন করতে পেরেছি । কিন্তু শ্রীম"র জন্য
তবু আমরা শ্রীরামকৃষ্ণকে বেশ কিছুটা জানতে
পারলেও স্বামীজি আমাদের সে সুযোগ নিজেই
দেননি। ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামীজির গান থেকে
তার প্রবন্ধ তার পত্রাবলী থেকে স্বামীজিকে কিছুটা জানা যায়। তবু যেন আমাদের মনে সংশয় থেকেই যায় । মনে হয় বিবেকানন্দ এদেশে এখনও অবহেলিত রয়ে গেছেন । "আমি বিবেকানন্দ বলছি "-স্বামীজির জীবনের দুঃসময়ের ফসল ।
■ স্বামীজির রচনাবলীতে আছে-" বহুজন হিতায়
বহুজন সুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবনের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে,
বিধবার অশ্রু মুছাতে,পুত্রবিয়োগ-বিধুরার প্রাণে
শান্তিদান করতে,অজ্ঞ ইতর সাধারণকে জীবন সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক
মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানলোক দিয়ে সকলের
মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্ম-সিংহকে জাগরিত করতে
জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে ।" তাই যখন আমরা দেখতে পাই পিতার মৃত্যুর পর দিশেহারা ছিলেন তিনি, একদিকে আত্মীয় স্বজনদের স্বার্থপরতা অন্যদিকে মা-দু ভাইয়ের আহার জোগাড় করা , বাসস্থান রক্ষা করার ভাবনা আগে!  না কি ? শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারাপ্রচার করা ? কোনটা প্রধান তাঁর কাছে হবে ? সন্ন্যাসীর কঠোরতায় নির্মমভাবে স্বামীজি ভাবলেন যে,  ত্যাগ‌ই হলো
তার জীবনের প্রধান অধ্যায় , বেদনায় কাতর 
হয়ে না পড়ে ভয়ানক দুঃখ কষ্টকেই সহ্য করে
নিয়েছিলেন তিনি । তাই অনেক কষ্টে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল -" জীবনে যাকে নিজের পথ নিজেকেই করে নিতে হয় ,সে একটু রুক্ষ হবেই ।" কিন্তু বাস্তবে তো স্বামীজি তা মোটেও ছিলেন না। ছিলেন দিলখোলা সাদাসিধে মানুষ । হাঁস,ছাগল কুকুরদের সঙ্গে তাদের ভাষায় আদান প্রদানের কথাতো এখন‌ও বেশ রসালো ভাবেই শোনা যায়। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাদের মতো করেই । শুনলেই হাসি এসে যাবে এইরকম সব অদ্ভুত তাদের  নামকরণ করেছিলেন তিনি।
■ স্বামীজি বলেছিলেন-" এই বিশ্বাস আমি দৃঢ়ভাবে পোষণ করে আসছি এবং এখনও করি যে, যদি আমি সংসার ত্যাগ না করতাম ,তবে আমার গুরু পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে বিরাট সত্য প্রচার করতে জগতে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন ,তা প্রকাশিত হতে পারতো না।" এখানে আমরা এক প্রচন্ড শক্তিশালী দৃঢ়চেতা মানুষরূপে স্বামী বিবেকানন্দ পেয়ে যাই। স্বামীজি বলেছিলেন "এই ভারতে তাকে অনেকে চেনেনা বোঝে না তাতে কি ?! আমি যুবদলকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে নেমেছি,যারা সর্বাপেক্ষা দীনহীন অবহেলিত পদদলিতদের...তাদের দ্বারে দ্বারে--সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, শিক্ষা ধর্ম বহন করে নিয়ে যাবে --এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা ও ব্রত। এটি আমি সাধন করব অথবা মৃত্যুকে বরণ করব।"
■ যেমনটি পুরাণে বলা আছে সেই কপর্দকহীন সন্ন্যাসীদের রূপের মধ্যে যে স্বামীজি বিজয়ী হবার স্বপ্ন দেখতেন তা তাঁর রচনায় মেলে ব‌ইকি।
তিনি বলেছেন-" আমার ভয় নেই, মৃত্যু নেই,
ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই...বিশ্বপ্রকৃতির সাধ্য
নেই যে,আমাকে ধ্বংস করে। প্রকৃতি
আমার দাস। হে পরমাত্মন্, হে পরমেশ্বর
তোমার শক্তি বিস্তার কর।" কী অভাবনীয়
প্রত্যয়ী তিনি, কে তার সেই পরমেশ্বর ? 
স্বামীজির ধর্ম তো হিন্দু নয় তবু একদিন কী
হলো দুর্গাপূজার রীতিনীতি নিয়ে লেখা ব‌ই
আনালেন। মূর্তি পুজোর বিরোধী স্বামীজি,
অনুমতি দিলেন মঠে দুর্গাপুজো হবার। আসলে
একটু আনন্দ হবে ঢাক বাজবে অনেক মানুষের আগমন হবে তার সঙ্গে তার বানানো রেসিপি অনুসারে খিচুড়ি ভোগ আজও বেলুড় মঠে চলে আসছে। তিনি হিন্দুত্বের পুজো করেননি তাদের আনন্দের পুজো করেছিলেন--এই আপ্তবাক্য যেন আমরা ভুলে না যাই।
■ শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি দেখেছিলেন কাপড়চোপড়
ছাড়া পঞ্চবটিতে বসে ধ্যানমগ্ন, রাতবিরেতে
উলঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণ ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর বেশবাস,
মা মা বলে মন্দিরে ঢুকে গেছেন। পুজো করতে করতে মা কালীকে নয় নিজের মাথায় ফুল দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কালীমূর্তি কি তবে তথাকথিত কোনো ভগবানরূপী দেবতা ছিলেননা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছেও? সবার কাছে দক্ষিণেশ্বরের তিনি কালী মূর্তি হলেও। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু পরবর্তীতে কালীর বদলে শ্রীরামকৃষ্ণকেই দেবতার আদলে বসিয়ে তিনি পুজো করেছেন, যা বেলুড় গিয়ে আমরা আজকে দেখতে পাই। মূর্তির থেকে রক্তমাংসের মানুষকে, যাকে তিনি দেখেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁকেই পুজোর মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় রীতিনীতিতে কষাঘাত করেছিলেন। হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে ১১১ বছর আগে এসে শ্রীরামকৃষ্ণকে পুজো করতে গিয়ে মন্ত্র বললেন -" শ্রীরামকৃষ্ণায়‌ তে নয়:..।"
■ স্বামীজি জরথ্রুষ্টের মতবাদ ভালো করে জেনে ছিলেন । তাই ভারতীয় ঋষির সনাতন ধ্যানচিন্তা কে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আহুরা মাজদা সম্প্রদায়ের মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে খুঁজতে তাদের ধ্যানমগ্নতায় আরও বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কখন‌ই ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনাকে তিনি খারাপ বলেননি অথচ সেখানে তিনি নিজেকে কখনও বিকিয়েও দেননি।
প্রতিটি ভারতবাসীকে ভাইয়ের মতো ভেবে সম্বোধনে বলেছিলেন -"ওঠো জাগো...।" তাইতো তিনি আমাদের কাছে স্বামী বিবেকানন্দের মতো
এক পরম দয়াময় দৃঢ়চেতা ভাবগম্ভীর মানবপূজারী হতে পেরেছেন। তিনি তো নিজে
দেখেছেন তার গুরুদেব,( লোকেরা তাকে পাগলঠাকুর‌ও ভালোবেসে বলেছেন) তাকে
বার বার বলেছেন--" যা না যা... মায়ের কাছে
যানা একবারটি...এ বার‌ও পারলি নে...যা যা।"
■ সত্যি তো শ্রীরামকৃষ্ণ তো মন্ত্রপড়া, ঘন্টা বাজানো,চামরদোলানো কোনো সাধারণ পুরুত ছিলেন না। কেশবচন্দ্র সেন, বিদ্যাসাগর কেউ তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি এমন তো নয়।
স্বামীজি যখন ভ্যাঙ্কুভারে তখন জামসেদজি টাটার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ওই একই জাহাজে
স্বামীজি যখন প্রথম আমেরিকা যাচ্ছিলেন। পারস্য উপসাগরীয় আহুরা-মাজদার উপাশকদের আগুনের সামনে উপাসনার মধ্যে দিয়ে যে জীবনের শুদ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায় সেই ধর্মের উৎসাহ থেকে তিনি যে বেলুড় মঠের ধ্যানমগ্নতা খুঁজে পেয়েছিলেন সে কথা ভাবলে ক্ষতি কি ? বেলুড়ের অলঙ্কার নক্সায় মোটিফে পার্সি,খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু,বৌদ্ধরীতি অবলম্বন করা হয়েছে । শ্রীরামকৃষ্ণের যত মত তত পথকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে দিয়েছিলেন । বলেছিলেন - শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী আমাকে প্রচার করতেই হবে।
যৌবনে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে প্রভাবিত নরেন্দ্রনাথ, মূর্তি পুজোকে পৌত্তলিক জ্ঞান করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের উদার এবং সমন্বয়ী
চিন্তার সঙ্গে "কালীঘরে যাওয়া " শক্তিকে
প্রাধান্য দেওয়া নরেন্দ্রর চোখে বিসদৃশ্য 
লাগতো। তরুণ,সংশয়ী, নরেন্দ্রনাথের এই
ভাব বেশি দিন টিকে ছিল না।
■ ১৮৮৮ সালে তিনি নিজ শিষ্য সদানন্দকে বলেছিলেন  - " আমার জীবনে একটা মস্ত বড় ব্রত আছে। এ ব্রত পরিপূর্ণ করার আদেশ আমি গুরুর
কাছে পেয়েছি ---আর সেটা হচ্ছে মাতৃভূমিকে
পুনরুজ্জীবিত করা । " শ্রীশ্রী মা একদিন গল্পছলে
এক শিষ্যকে বলেছিলেন -" যা সব শুনছি, সাহেব পুলিশরা এসে একদিন না একদিন নরেনকে গারদে পুরে দেয় । " এ থেকে প্রমাণিত হয় স্বামীজির কাছে বিপ্লবীরা আসতেন পরামর্শের
জন্য। বিবেকানন্দের আয়ুষ্কাল রবীন্দ্রনাথের অর্ধেক মাত্র। বিবেকানন্দ নবীন ভারতবর্ষের কোনো বিষয় ও সংঘাত দেখে যেতে পারেননি তাই
রবীন্দ্রনাথ যতটা পেরেছেন স্বামীজি ততটা করে
যেতেও পারেননি । তাছাড়া স্বামীজির বিপ্লববাদ
ছিল শুধুই মানুষের চরিত্র গঠনের । ধর্ম, শিক্ষা, ও ক্ষুধা সম্পর্কে নিশ্চিত দিগদর্শনের নির্দেশ ।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশের -" দাজ স্পেক জরাথ্রুষ্ট " ব‌ইয়ে এক সন্তপ্রতিম মানুষের বর্ণনা আছে । বিজন পর্বতে তিনি দশবছর স্ব-নির্বাসিনে ছিলেন গভীর ধ্যানে। তারপর তিনি জনপদে এসেছিলেন মানুষকে তার কথা বলতে । সেই জরথ্রুষ্টের ধর্মীয় মতবাদের প্রথমে আছে মহিলাদের অগ্রাধিকার । " যত্র নার্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা ।" যেখানে নারী সম্মান পান, সেখানে দেবতার অবস্থান ।" স্বামী বিবেকানন্দ‌ও দেখলেন তাঁর সময়ে নারীরা সমাজে অবহেলিত , 
বঞ্চিত ও অত্যাচারিত । গভীর দুঃখে ও যন্ত্রণায় বিবেকানন্দ ,তিনি বললেন, ভগবানের প্রতিমা স্বরূপা নারী এখন শুধুমাত্র সন্তান ধারণের যন্ত্রে পরিণত। নারীকে তার শিক্ষা ও স্বাধীনতার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। যতক্ষণ তা সম্ভব হবে না, ততক্ষণ জাতি হিসেবে আমরা উঠে দাঁড়াতে পারবোনা ।" বিবেকানন্দ বললেন-" নারীকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে ।" স্বামীজি শিক্ষার সঙ্গে চরিত্র গঠনের কথা বলতেন । সার্বিক  
ব্যক্তিত্বের বিকাশ চেয়েছিলেন স্বামীজি। এইখানে রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের কাছে সমগ্র নারীজাতি ও বাঙালিরা চিরঋণী। পরবর্তীকালে নারী সমাজের যে অগ্রগতি হয়েছে, সেদিন এই দুই মহারথী পাশে এসে না দাঁড়ালে তা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলনা। এই প্রসঙ্গে শ্রীমার সঙ্গে বিবেকানন্দের একটি সম্পর্কের কথা বলি।বিবেকানন্দ তাঁর অনুকরণীয় ভাষায় বলেছেন--
শ্রীরামকৃষ্ণ থাকুন বা যান ক্ষতি নেই, কিন্তু মা ঠাকরণ না থাকলে সর্বনাশ, তিনি শক্তির আধার । মাঝেমধ্যে‌ই তিনি গুরুভাইদের বলছেন, "তোরা মাকে চিনতে পারিসনি। মাকে চিনতে চেষ্টা কর । "সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কেও এক‌ই কথা খাটে , সুভাষচন্দ্র তার জীবনে নারীর গুরুত্বপূর্ণ হ‌ওয়ার কথা বলতে গিয়ে,মা প্রভাবতীদেবী ও দেশবন্ধু-পত্নী বাসন্তী দেবী,মেজ-ব‌উদিদি বিভাবতীদেবী ও পত্নী এমিলিয়রের কিছু ত্যাগ ও গুণের কথা বলেছিলেন। স্বামীজি আবার একথাও ভেবেছিলেন যদি নারীরা সংসার ত্যাগ করে
সন্ন্যাসীনী হতে চান সে অধিকার‌ও তাদের দিতে হবে। সেই দিশা খুঁজে দিয়েছিলেন স্বামীজি নিজেই । এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বামীজির দৃষ্টি ছিল সবদিকে। তিনি বলেছেন-" আমরা নির্বোধের মতো,জড় সভ্যতার বিরুদ্ধে চিৎকার করিতেছি...
বাহ্য সভ্যতা আবশ্যক , যাহাতে গরীব লোকের
জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়। অন্ন ! অন্ন!
যে ভগবান আমাকে অন্ন দিতে পারেন না,
তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন--ইহা
আমি বিশ্বাস করিনা ।" এমনকি রাজনীতিকেও তিনি ছেড়ে দেননি-" এই ঘোর দুর্ভিক্ষ , বন্যা রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বলো ? খালি আমাদের হাতে শাসনের ভার দাও, বললে কি চলে ? মানুষ কাজ যদি করে তাকে কি মুখ ফুটে বলতে হয় ? " যা আজ হবে যা হতে যাচ্ছে দেখা যাবে অল্প সময়ের মধ্যেই স্বামীজি সব বলে গেছেন । ( কেউ যেন এই প্রসঙ্গে ভারতীয় রাজনীতি না জুড়ে দেন, কংগ্রেসর তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে স্বামীজি ওইসব বলেছিলেন)। তিনি বলেছেন শিক্ষা অর্জনের অধিকার সকলের‌ই থাকা উচিত। আর শিক্ষিত
না হ‌ওয়ার জন্য তিনি আত্মজিজ্ঞাসা করেছেন , এই জন্য কে দায়ী ? উত্তর দিয়েছেন নিজেই, বলেছেন -" ইংরাজরা দায়ী নয় , আমরাই 
দায়ী।" স্বামীজী সবথেকে জোর দিয়েছেন
শিক্ষার অধিকারের উপর যা আমরা ২০০৯ -এ
এসে বুঝতে পেরেছি । স্বামীজিই বলেছেন
  - "দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে তবে শিক্ষাকেই তার কাছে পৌঁছাতে হবে ।"
স্বামীজির কথা কখনো কখনো ঝাঁঝালো হয়েছে
যা এখনকার দিনে তার মূল্যায়ণ অমর হয়ে
আছে বলা যেতে পারে -" দিবারাত্রি ভন্ডামি,
মিথ্যাচার ও প্রতারণার জীবন যাপন কর--
তোমার ক্ষতগুলি যতদূর পারো ঢাকিয়া 
রাখো । তালির উপর তালি দাও , শেষে
প্রকৃত জিনিসটিই যেন নষ্ট হ‌ইয়া যায় , আর 
তুমি কেবল একটি জোড়াতালির সমষ্টিতে
পরিণত হ‌ও । "
■আজ থেকে ১২৭ বছর আগে ১৮৯৩ সালের ৩১ মে স্বামীজি আজকের মুম্বাই থেকে জাহাজে উঠেছিলেন। মাদুরাইয়ের রাজার ইচ্ছেতেই স্বামীজি খানিকটা আমেরিকা যেতে সাহস পান। জাহাজের ভাড়া উঠলেও কীভাবে কী করবেন স্বামীজি কিছুই জানতেন না। আসলে স্বামীজি খানিকটা সরল প্রকৃতির ছিলেন, সে কারণে জীবনে তাঁকে ঠকতেও হয় এবং আমেরিকায় 
প্রভূত শত্রুতায় মধ্যে গিয়ে তাঁকে পড়তেও হয়েছিল। প্রধানত পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের উদ্যোগেই তিনি সেখানে যেতে পেরেছিলেন। স্বামীজির আমেরিকা বক্তৃতা প্রসঙ্গে ও আমেরিকা প্রসঙ্গে এসে আমি এখানে --রামেশ্বরমের কিছু 
কথা বলবো কারণ তখনকার দিনে দক্ষিণের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তার কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। মা সারদা মোটামুটি ভারতের ধর্মীয় স্থানগুলি ভ্রমণ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের জন্য। মা সারদা দীর্ঘদিন ধরেই রামেশ্বরমে যেতে চাইতেন স্বামীজির গুরু ভাইদের কাছে। কারণ তিনি শুনেছিলেন ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় রামেশ্বরমে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার রামশিলাই কামারপুকুরে পূজিত হয়ে থাকে । শ্রীশ্রীমায়ের মাদুরাই ভ্রমণ সে সময় দ্য হিন্দু পত্রিকা বিষদে লিখেছিল (১৯১০-১১) । যাইহোক স্বামীজি আমেরিকা থেকে ফিরে শ্রীলঙ্কা 
হয়ে রামশ্বরমের যে পামবাম দ্বীপে প্রথম পা রেখেছিলেন সেখানে মা, মাদুরাই থেকে স্টিমারে গিয়ে নামেন। এখানেই স্বামীজি ফিরে এসে ভারতবর্ষে নেমে প্রথম বক্তৃতাটি করেন এবং তা ছিল অগ্নিবর্ষী ভাষায়। বর্তমানে রামশ্বরম মিউনিসিপ্যালিটি কয়েকটি রাস্তা স্বামীজির নামে পরে প্রচলিত করে এবং সেখানে স্বামীজির মূর্তির‌ও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে তারা। সেখানে আজ শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ‌ও হয়েছে তবে সেটি রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত নয়। থাকার ব্যবস্থা‌ও আছে । সকলেই জানেন রামেশ্বরম আসলে কিন্তু শিবের মন্দির। এই মন্দির তিনটি দালানে বিভক্ত ও ভারতে অদ্বিতীয়। প্রায় প্রতিদিনই শিবলিঙ্গে 
বেশ কিছু সোনাদানা পড়ে ভক্তদের কাছ থেকে। এখানে শ্রীশ্রীমায়ের একটি বাক্য আজও মনে রাখার মতো,তিনি বলেছিলেন -" যেমনটি রেখে গিয়েছিলুম তেমনটি আছে ।" সঙ্গের ভক্তরা তা শুনেছিলেন। তিনি যে শ্রীরামকৃষ্ণের কথাই বলতে ছেয়েছিলেন তা কার‌ও অজানা নয় । পামবাম দ্বীপ ও ওই মন্দির রামনাদের রাজা ভাস্কর সেতুপতির অধীনে ছিল আর ওই রাজা ছিলেন স্বামীজির মন্ত্রশিষ্য যিনি স্বামীজিকে আমেরিকা যাওয়ার জাহাজ খরচ দিয়েছিলেন। শ্রীশ্রীমা গেলে রাজা 
টেলিগ্রাম করে মন্দির কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন,- 
" আমার গুরুর গুরু পরম গুরু মা সারদা যাচ্ছেন, তাঁর থাকার ও গর্ভগৃহে প্রবেশের সব ব্যবস্থা করতে হবে এবং মা যদি দান সামগ্রী থেকে (সোনার হাজার হাজার উট ঘোড়া হাতী পশু পাখি রথ পালকি হার আংটি চূড় বালা মণিমুক্ত হীরা জহরত) কিছু দয়াবশত নিতে চান তাও তাঁকে উপহার দিতে হবে।" যে ঘর কাউকে খুলে দেখানোর নিয়ম ছিলনা। সেই ঘরে মা প্রবেশ করে অবাক হলেও তার চোখে মুখে নির্লোভ ভাব ফুটে 
ওঠে এবং তিনি কোথাও কিছু স্পর্শ করে দেখতে চাননি,নিতে চাননি। শ্রীরামকৃষ্ণ ওখানে শিবমূর্তিতে বিরাজমান বলে তো মাও অদ্ভূতভাবে বিশ্বাস করেছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন - " তুমি শিব তুমি শক্তি নারায়ণ তুমি/ তুমি রাম তুমি কৃষ্ণ অখিলের স্বামী ।" ১৮৩৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৮৬৩ ( সংখ্যার মজাটি ও ম্যাজিক লক্ষ করার মতো) সালে এসেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। ১৮ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্ম। নরেন তার্কিক, যুক্তিবাদী। গুরু শিষ্যের দুজনের জীবন
যেন এক গভীর রহস্যময়তার আবরণে ঢাকা। একে বলা হয় " লস অফ্ আইডেন্টিটি । " একজন গেঁয়ো বিদ্যালয় শিক্ষাহীন মানুষ শুনে শুনে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ বেদ বেদান্ত গুলে খেয়ে নিয়েছেন। সহজ কথায় এমন যুক্তি দেন যে মেধায় আঘাত করে। কিন্তু মা কালী তার সঙ্গে রয়েছেন। মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী হয়েও কখনও মা কালীর বদলে নিজের মাথায় ফুল দেন। চরিত্র সম্পূর্ণ রহস্যময় ,তাঁকে বিচার করা অসম্ভব। অন্যজন সুপুরুষ , শিক্ষিত ভারতীয় ও ইউরোপীয় দর্শনে হাবুডুবু খান, পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্ব । মূর্তি পূজো মানেন না অদৈতবাদের একনিষ্ঠ প্রচারক। দুজনেই গান ভালোবাসেন। দুজনেই খেতে ভালোবাসেন। একজন গান শুনতে একজন গান গাইতে চান। নরেন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন-ধর্মোন্মাদ, অপ্রকৃতিস্থ তাঁর হাতের ছোঁয়াতেই তার নিজের চৈতন্য উদয় ও আত্মদর্শন হয়েছিল শেষে। ‌ঠাকুর বলেছিলেন আমি ম্যাদামারা ভক্ত পছন্দ করিনা, ফ্যাসফ্যাসে ফলারের মতো ব্যক্তিত্ব চাইনা। যুক্তিবাদী কেশবচন্দ্রের কথা বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ শুনিয়েছিলেন , " কেশবের একটা শক্তি তাতেই এত , তোর আঠারোটা শক্তি আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮০০ খৃষ্টাব্দের ১৮৩৬ আর ১৮৬৩ - র এই সংখ্যাতত্ত্বটি সম্যক বুঝেছিলেন। ১৮৩৬-এ বৃটিশরা এদেশে শিক্ষানীতি চালু করেছিলেন মেকলে সাহেবের সৌজন্যে। কী অসামান্য যুগের যোগাযোগ ! ৫ বছর পর গদাধর ১৮৪০ সালে গিয়েছিলেন পাঠশালায় এবং- "যে বিদ্যে শিক্ষেয় শ্রাদ্ধ করাতে আর চাল কলা বেঁধে আনতে হবে সে শিক্ষেয় তার কাজ নেই ।" এহেন গুরুবাণী ও তার মন্ত্র নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া সহজ কিন্তু কীভাবে পাবেন সেখানে পাত্তা ১২৭-বছর আগে প্রচন্ড ঠান্ডায় ঠিকানা লেখা কাগজটা স্বামীজি হারিয়ে ফেললেন। ফুটপাতে কোনরকমে কুঁকড়ে সারারাত
পথ কুকুরের সঙ্গে। আর ঘুম ভেঙ্গেই আমেরিকাবাসী এক অপরিচিত মেমসাহেব দেখতে পেলেন! একি ? একজন মানুষ এইভাবে শুয়ে আছেন ? আশ্রয় পেলেন মহানুভব সেই আমেরিকান ধর্মপ্রাণা মেমসাহেবের কাছে। এক কথায় এই যোগাযোগ অসম্ভব। 
■ নরেন্দ্রনাথ আমেরিকায় গিয়ে পড়লেন অকূল সাগরে যখন বুঝলেন যে তিনি কোনও প্রাচীন ধর্মমত সংগঠনের এমনকি মিশনের‌ও প্রতিনিধি নন। ভারতবর্ষের কোনও মন্দির মসজিদ চার্চ তাকে প্রতিনিধিও করেনি। কিন্তু তিনি জানতেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা। ঠাকুর তার আশ্চর্য দর্শনের কথা বলছেন তাঁর শিষ্যদের কাছে -" আশ্চর্য দর্শন সব হয়েছে। অখন্ড সচ্চিদানন্দ 
দর্শন। তার ভিতর দেখেছি, মাঝে বেড়া দেওয়া 
দুই থাক। একধারে কেদার, চুনি আর ,আর অনেক সাকারবাদী ভক্ত আর বেড়ার একধারে 
টকটকে লাল সুরকির কাঁড়ির মতো জ্যোতি:। তার মধ্যে বসে নরেন্দ্র --সমাধিস্থ । না নরেন্দ্রনাথকে এইসব শ্রীরামকৃষ্ণ বলেননি ,বলেছিলেন শিষ্যদের কাছে। কারণ স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে তখন অজ্ঞানপ্রায়। 
■ আবার ফিরে আসি স্বামীজির আমেরিকা যাত্রার পূর্বাপরে । তাঁর ইচ্ছে শক্তি ছিল প্রবল । জাহাজপথে চীন জাপান ও কানাডায় তিনি নেমেছিলেন যেতে যেতে। কানাডা থেকে পরে ট্রেনে চিকাগোতে পৌঁছে বুঝতে পারলেন যে পৃথিবীর প্রথম ধর্মসভায় তিনি কোনো দেশের প্রতিনিধি নন । কোনো স্পনশর‌ও তার নেই যে এইরকম ধর্ম মহাসমাবেশে তিনি প্রবেশাধিকার পাবেন। আমেরিকাও তার কাছে নিতান্তই অচেনা । তিনি (১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ধর্ম মহাসভার সম্মেলন মোট ১৭ দিন ) তার বেশ কয়েকদিন আগেই সেখানে পৌঁছেছিলেন। খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি বস্টনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন । স্বামীজি আমেরিকা যাওয়ার পর জানতে পারলেন যে তার কাছে ওই মহা সম্মেলনে ঢোকার জন্য কোনো ডেলিগেট পাশ নেই। বক্তৃতা করা তো বহু দূরের ব্যাপার, প্রবেশাধিকার পর্যন্ত পাবেন না। তখন তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের কাছে যান। সকলে যখন তাকে দেশে ফিরে আসার কথা বলছেন, তখন তিনি মনে প্রবল জোর নিয়ে মনে মনে স্থির করেন এসেছেন যখন যাহোক একটা হবেই। তখন‌ও ১১ সেপ্টেম্বর আসতে দেরি আছে । সাহসে ভর করে রাইটের কাছে যান তিনি। রাইট সাহেব স্বামীজিকে হার্ভার্ডে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন , কারণ তিনি বুঝতে পারেন এই যোগী মানুষটির ভিতর কিছু এমন আছে যা অন্যদের মধ্যে নেই। এই সময় অর্থ থেকে থাকা খাওয়া এইসব কারণে সবেতেই তাঁর শোচনীয় অবস্থা। এক গরীব দেশের অচেনা ভিখিরি হয়ে তাকে নানা সমস্যার মধ্যে থাকতে হয়েছে। মূল সমস্যা তার সম্মেলনে প্রবেশাধিকার কীভাবে হবে। অবশেষে তিনি নিজের যোগ্যতায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় করলেন মহাসম্মেলনের প্রবেশপত্র। এই বক্তৃতায় মূল তিনটি বিষয়ে স্বামীজি সবাইকে ছাপিয়ে যান। এক সাত হাজার মানুষের সমাবেশে দু মিনিট যাবদ হাততালিতে সমাবেশ ডুবে যায়। তার সেই কথা -আমেরিকাবাসী আমার ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ। আসলে স্বামীজির ডেলিগেট তখন‌ও মজবুত হয়নি। সভার শুরুতে কম বিবেচনার মধ্যে যেহেতু তিনি পড়েন তাই তাকেই তিন চারজনের পর‌ই ডাকা হয়। এমন মানুষরাই বক্তব্য প্রথম দিকে রাখা হয়। যারা খুব কমজোরি। স্বামীজির সেই হিসেবে বলতে ওঠেন বেলা তিনটার পরে। কী বিষয় নিয়ে বললে তিনি ভারতের ধর্ম তাঁর যোগদানের উদ্দেশ্যে এবং সঙ্গে সঙ্গে তেমনি খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের যে পৃথিবী ব্যাপী তখন অহংকারের প্রদর্শন চলছে তাকেও অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে ব্যাখ্যা করাও জরুরি বলে মনে করে দিয়েছিলেন রাইট সাহেব‌ও । এই কথাটা স্বামীজির মনে ধরেও ছিল আগেই। 
■ তাই তিনি জরথ্রুষ্টবাদীদের ভারতে আশ্রয় দেওয়া দিয়ে মূল বক্তব্য শুরু করেন। সারা পৃথিবীর ধর্মকে আশ্রয় দেওয়ার কথা তিনি বলেছিলেন। আর তিনি কুয়োর ব্যাঙ ও সাগরের ব্যাঙের গল্পটা উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন। কানাডার ভ্যানকুভারে ইতিমধ্যে জরথ্রুষ্টবাদী জামেসদি টাটার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। ধীরে ধীরে ১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অনেক ধর্মীয় আলোচকদের মতামত চুলচেরা অনুভূতি আর আলোচনা আর তেমন পাত্তা পেলনা । ২৭ সেপ্টেম্বর শেষ দিন ঘুরে ফিরে স্বামীজির বাণীই উচ্চারিত হতে থাকলো। বিভিন্ন ট্যাবলয়েডে স্বামীজির " আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ" তখন তোলপাড় করছে সারা বিশ্বকে। আসলে যখন 
১১ সেপ্টেম্বর তাঁকে বক্তৃতা করতে ডাকা হয় তখন পর্যন্ত তার পরিচয় হয়েছে মাত্র চারজনের সঙ্গে। কিন্তু তিনি প্রস্তুত ছিলেন না মোটেই প্রথম দিনেই বলতে। তবুও বলতে উঠবার আগে মা সরস্বতীকেই একমাত্র তিনি ভেবেছিলেন। তিনি প্রার্থনা করেছিলেন যেন গুছিয়ে বলতে পারেন। বলতে উঠে স্বামীজির সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। খ্রিস্টানদের দেশে বসে কুয়োর ব্যাঙের গল্পটা তিনি যে দুর্দান্তভাবে পরিবেশ করে ভারতীয় ধর্মীয় চিন্তা চেতনাকে তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা আসলে রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতার সাথে আজ মিলে যায়। নাকি রবীন্দ্রনাথ এই ভাবনা স্বামীজির কাছ থেকে পেয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। ২৭ তারিখের পর যে কদিন আমেরিকায় তিনি ছিলেন সকলেই তার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনতে চাইছিলেন। এতে তার কিছু উপার্জন হতো। তারপর তার‌ও বেশ কয়েকমাস পর তিনি কলম্বোয় জাহাজ থেকে নেমে ছিলেন । প্রকৃতপক্ষে স্বামীজি তখন অসুস্থ । সেখান থেকে নৌকো করে একবেলা কাটিয়ে রামেশ্বরমে এসেছিলেন। রাজা কিছুতেই নৌকো থেকে স্বামীজিকে নামতে দিতে চাননা। ইতিমধ্যে সেখানে বজরা করে রাজার পৌঁছতে, তিন ঘণ্টা লেগেছে। স্বামীজী নৌকোয় ঠায় তিনঘন্টা আটকে। রাজা না পৌঁছলে কেউ স্বামীজিকে নামতে দিতে চান না। তাছাড়া জায়গায় জায়গায় স্বামীজি বলবেন তার জন্য মঞ্চ হয়েছে। সেইসব রাজা ছাড়া আর কেউ তেমন জানেন না। তিন হাজার মানুষের জমায়েত সাগর তীরে। রাজার ইচ্ছে স্বামীজি প্রথম পা ফেলুন রাজার ডান হাতে, তার পর মাটিতে। দুজনেই অনড় নিজের নিজের মতে। স্বামীজি শেষে রাজাকে বোঝালেন, যে রাজার পেছনে, পাড়ে প্রায় কয়েক হাজার প্রজার সামনে রাজাকে এই অপমান ( শাস্তি ) স্বামীজি দিতে পারবেন না।
তিনি একজন রাজার হাতে তাঁর পা রাখতে অপারগ। এটা রাজাকে এক প্রকার অপমান‌ই করা হবে। শেষে রাজার হাত ধরে স্বামীজি নেমেছিলেন । স্বামীজি নেমে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ইংরেজি আমলে ভারতবর্ষের প্রথম 
বিশ্বজয়। কিন্তু স্বামীজি অসুস্থ। আমেরিকায় ও জায়গায় জায়গায় বহু বক্তৃতা দিয়েছেন ওখানে শুধুমাত্র নিজের থাকার খরচ চালাতে। তার ওপর অন্যরকম খাদ্য যা দীর্ঘ দিন বাঙালির মুখে রুচবে না তার ওপর শীত । স্বামীজির ঘুমে চোখ ঢুলে
আসছে। ১০/১২ জায়গায় বক্তৃতা করার কথা ছিল। স্বামীজি বড় জোর ১/২ মঞ্চে উঠলেন। চার পাঁচ দিন পরে তিনি এলেন মাদ্রাজে। তাঁকে ঘোড়ায় টানা রথে করে ট্রেন থেকে শহরে রাখার কথা। মাদ্রাজিরা ঘোড়ার গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে দিয়ে যুবকরা নিজেরাই টানলো সেই রথ । দুদিনের ট্রেন এলো চারদিন পরে কলকাতায়। পথে স্টেশনে স্টেশনে কাতারে কাতারে লোক। সবাই চান স্বামীজি সেখানে নামুন প্রতিটি জায়গায় সেই ব্যবস্থা। কিন্তু স্বামীজি নামতে পারেননি শরীরের জন্য। ট্রেনে শিয়ালদা নামতে নামতে এখানেও পৌঁছলো সে খবর। এখানেও শিয়ালদা থেকে রথে করে ছেলেরা টানলো স্বামীজিকে বসিয়ে রেখে গতকাল ছিল ১১.৯.১৯ সেই দিনের ১২৭ বছর গেছে। এখন সেখানে মিচিগানের ওই জায়গায় হলটি স্বামীজির নামে উৎসর্গিত করা হয়েছে। সামনের রাস্তাটি স্বামীজির নামে। একটি মূর্তিও আছে সেখানে। জয়তু স্বামীজি। 
■©® অলোক কুন্ডু 



  


রবিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০

শিক্ষক দিবস / অলোক কুন্ডু

■ আমরা ভারতবাসী, আমরা শুধু ভালোটুকুই
মনে রাখবো , প্রণাম রাধাকৃষ্ণান। 
অলোক কুন্ডু

■ এরকম শিক্ষককে আমি জানি যাদের শিক্ষকতা করার মতো আচরণ যথেষ্ট ভালো , ক্লাসে ভালো পড়ান কিন্তু জাতীয় শিক্ষকের সম্মান মোটেও তাদের দেওয়া হয়নি। জাতীয় শিক্ষকের সম্মান পাননি এরকম একজন শিক্ষকের নাম অন্তত জানি যিনি হাওড়ার প্রয়াত ইন্দুভূষণ চট্টোপাধ্যায় , যিনি হাওড়ার দুটি স্কুলের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আমার প্রধান শিক্ষক। খুব লজ্জার বিষয় তৎকালীন বেলুড় মঠের নিস্ক্রিয় মনোভাবের জন্য তিনি হাওড়ার বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশনের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত থেকেও ( স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ) দলিলে স্বাক্ষর থাকা, পাঁচজন প্রতিষ্ঠাতাদের এক নম্বরে নাম থাকা সত্বেও, অছি হ‌ওয়া সত্বেও শুধু ভোটাভুটিতে তাকে হারিয়ে বিবেকানন্দ আশ্রম থেকে তাঁর নাম কেটে দেওয়ার অভিমানে প্রতিষ্ঠিত স্কুল ছেড়ে তিনজন ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও চারজন শিক্ষককে নিয়ে হাওড়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন থেকে বেরিয়ে এসে হাওড়ায় শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেন কিন্তু তিনি কোনোদিন জাতীয় শিক্ষক হননি। কখনও বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন থেকে বিতাড়িত হ‌ওয়ার অভিমান লিখে যেতে পারেননি
এতটাই শ্রীরামকৃষ্ণ-স্বামীজি ভক্ত ছিলেন। সামান্য গ্র্যাজুয়েট হ‌ওয়ার কারণে তার প্রধান শিক্ষক হয়ে ওটা আটকে যায়, সেই নিয়ে যখন কথা ওঠার কথা নয় তা উঠে যায়। তবে অনেকে তাঁবেদারি করে জাতীয় শিক্ষক হয়েছেন এরকম চোখে বিস্তর দেখেছি। এমন‌ও দেখেছি জাতীয় শিক্ষক হয়েও নিজের আচরণ পাল্টাতে পারেননি অনেক জাতীয় শিক্ষক। কী বলবেন তাঁদেরকে ? তাদের জীবনের আচরণ কোনো দিন পাল্টাতে পারেননি তবুও তারা জাতীয় শিক্ষক । এখানে আমি কয়েকটি বিশেষ গুণের কথা লিখছি যে গুণগুলি সকলের থাকেনা। সেই গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলি থাকলে ( অন্তত ১০ টা গুণ থাকেই) তবেই তিনি জাতীয় শিক্ষক। তা নাহলে বুঝতে হবে তিনি শুধুমাত্র শিক্ষক। ১. নিজের অনেক জমি থাকলেও যিনি স্কুলের জন্যে এক টুকরো জমি দেননি তিনি কীভাবে জাতীয় শিক্ষক হবেন বা হলেন ? ২. সিগারেট খাওয়া ছাড়েন নি যিনি তিনি কীভাবে
জাতীয় শিক্ষক হলেন কিংবা হবেন ? ৩. রাজনীতি করা ছাড়েননি তিনি কীভাবে তবে জাতীয় শিক্ষক হলেন বা হবেন ? ৪.কোনো স্কুল প্রতিষ্ঠার সংগে তার নাম একবারও  শোনা যায়নি যখন তবে তিনি কীভাবে জাতীয় শিক্ষক হলেন অথবা হবেন ?
৫. বাড়ি বাড়ি গিয়ে কখনো কোন‌ও একটি ছাত্রেরও খোঁজ নেননি যিনি তিনি কীভাবে হয়ে গেলেন জাতীয় শিক্ষক বা হ‌ওয়ার জন্য বিবেচনাধীন হলেন ? ৬.পরিবেশ রক্ষায় কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কোনোদিন কি?  কিংবা গাছ লাগিয়ে তার নেতৃত্ব দিয়ে গোটা পরিবেশ পাল্টে দিতে পেরেছিলেন কি ? যদি না পেরে থাকেন তবে কিসের তিনি জাতীয় শিক্ষক ? ৭. একটি ছেলেকেও বিনা পয়সায় টিউশন দিয়েছিলেন বা দেননি ? তাহলে কেন হবেন তিনি জাতীয় শিক্ষক। ৮. এমন কিছুই কৃচ্ছ সাধন করেননি তবু হয়ে গেছেন জাতীয় শিক্ষক, হ‌ওয়া মোটেই উচিত ছিল না। ৯. স্কুলের সময়ের বাইরে অর্থাৎ আগে-পরে কতদিন স্কুলে এসেছেন এবং পরে থেকে গিয়েছেন কি ? এটা না করেও তবে যদি কেউ জাতীয় শিক্ষক হিসেবে ঘুরে বেড়ান তবে বুঝতে হবে তিনি তাঁবেদার একজন। ১০. বিনা পয়সার কোচিন দিয়ে ছাত্রদের সাহায্যে এগিয়ে যাননি যিনি তিনি কীভাবে জাতীয় শিক্ষকের আবেদন করবেন ? ১১.নিজের পরিবার আর রাজনীতির বাইরে কোনো কিছুই করেননি তবু তিনি জাতীয় শিক্ষক হয়ে গেলেন বিষয়টি অদ্ভুত নয় কি ? ১২.ছাত্রদের গায়ে হাত তুলেছেন অথবা রাশভারী অথবা ছাত্ররা সেই শিক্ষককে ভয় পেয়েছেন অতিরিক্ত শৃঙ্খলার জন্যে তবে তিনি কীভাবে হবেন জাতীয় শিক্ষক ? ১৪. কখনও অন্যান্য কলিগদের সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিলেন একটাও উদাহরণ আছে ? ১৫. সমাজের বন্ধু হতে পারার জন্যে গ্রামে ধোঁয়াহীন চুল্লির ব্যবহার কিংবা গোবর গ্যাসের ব্যবহার,সূর্য চুল্লির ব্যবহার শিখতে সমাজকে উদ্ভুদ্ধ করেছেন কি ? ১৬. খেলাধুলোয় ছাত্র ছাত্রীদের অনন্য করে গড়ে তুলতে তার সহায়তা ছিল কি শিক্ষকের ? ১৬. ব্লাড ডোনেশন, চক্ষু অপারেশন,বিনা ব্যয়ে চিকিৎসার জন্যে উদ্যোগে
কোনও ক্যাম্প হয়েছিল ? যদি না হয়ে থাকে
তাহলে কীভাবে জাতীয় শিক্ষকের মর্যাদা পেয়ে গেলেন? ১৭. হাতে কলমে আবর্জনা পরিষ্কার , ময়লা পরিষ্কার করার মতো কাজ করে স্কুল
এলাকাকে পাল্টে দেওয়ার নজির আছে কি ? ১৮.স্কুলে আঁকাজোকা কোনও বড় ব্যাপার নয়,
স্বাস্থ্য দিবস পালন কোথাও বড় ঘটনা নয়। শিক্ষক
এমন কিছু করেছেন কি?  যার ফলে সমাজ অবাক হয়ে গেছে সেই কাজ দেখে ? ১৯.নিজের 
জন্যে না ভেবে পরের হিতেই নিজের জীবনকে 
বিলিয়ে দিয়েছেন ? ২০. এইসব কোন‌ও কৃচ্ছসাধন নেই কিন্তু তারা দেখবেন কেউ গানের বড় শিল্পী, কেউ বড় আবৃত্তিকার, কেউ ২০টা বই লিখেছেন, কেউ ডক্টরেট করেছেন, কেউ রক্তদান শিবিরে বক্তৃতা করেছেন, কেউ প্রতিযোগিতায় বিচারক ,
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে দশ কথা বলতে জানেন তাতে সমাজের অবাক হ‌ওয়ার কিছু থাকেনা যদিও কিন্তু
ফাঁকতালে এইসব শিক্ষকরা গন্ডায় গন্ডায় জাতীয় শিক্ষক হয়ে গেছেন। কেউ কেউ ভালো জীবন যাপন করেন। ভালো জীবন যাপন করা দোষের নয়। কেউ কেউ পাথরের বাড়িতে থাকেন। কেউ কেউ জাতীয় শিক্ষকের টাকা ফিক্সড করে দিয়েছেন। কেউ কেউ জাতীয় শিক্ষক হয়ে আর ওদিকে পা মাড়াননি। কেউ কেউ শিক্ষক সংগঠনের মাথা হিসেবে মিটিং এ নিজের লোককে দিয়ে জাতীয় শিক্ষকের মনোনয়ন করিয়ে নিয়েছেন। তাবলে কি কোনো গুণী মানুষ ত্যাগী শিক্ষকরা জাতীয় শিক্ষক হননি, নিশ্চিত হয়েছেন। অনেক জাতীয় শিক্ষকের মধ্যে তাঁরাই হলেন আসল জাতীয় শিক্ষক যার জন্যে তাদের ছাত্রদের চোখে জল এসে যায়। মাথা হেঁট হয়ে প্রণাম করতে ইচ্ছে করে। যার কর্তব্যের জন্য সমাজ খুশি হয়।
আমার জাতীয় শিক্ষক হাওড়ার শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক সামান্য গ্র্যাজুয়েট, ইন্দুভূষণ চট্টোপাধ্যায় যিনি কোনো দিন সরকারি ভাবে জাতীয় শিক্ষকের সম্মান পাননি। হাওড়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন।ও শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
■ সম্মাননীয় রাধাকৃষ্ণন জানতেন না তার জন্মদিন উপলক্ষে সারাদেশে কয়েক লক্ষ পেন কেনাবেচা হতে পারে। গান্ধীজি এক সময়ে বলেছিলেন দেশের লোক বা আমি সোনার গয়না
চাইনা। কেউ এমন কিছু আমাকে উপহার দিন যাতে তা দেশের জনগণের কাজে লাগে। গান্ধিজি সেই পেন উপহার পেয়েছিলেন। বাঙালি শিল্পপতি কলকাতায় পেন তৈরির কারখানা খুলেছিলেন।
ড.রাধাকৃষ্ণান‌ও জানতেন না যে তাঁর জন্মদিনে গান্ধিজির সেই পরামর্শ হয়ে উঠবে এক অনন্য উপহার। শিক্ষক দিবস উদযাপনে নানা উপহার দেওয়া নেওয়াটা বেশ ভালো রকম উদযাপনের অঙ্গ হয়েছে । এই দেওয়া নেওয়ার মধ্যেও শিক্ষক দিবসের আরেকটি সৌন্দর্য বিকশিত হয়। ‌আমি এরকম একটি সৌন্দর্যের কথা জানাবো আজ।
হাওড়ার শিবপুরে , বি.গার্ডেন চিত্তরঞ্জন আদর্শ প্রাইমারি স্কুলে এক অভিনব বিষয় হয়ে আসছে যা আজ পর্যন্ত কোন‌ও খবর কাগজে প্রকাশিত 
হয়নি। আজকাল দেখি ব্যাঙের ছাতা গজালেও
খবর হয়ে যায়। সে যাই হোক গে। অথচ বিষয়টি
রীতিমত খবর। এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষক দিবসের দিন খানিকটা ব্যতিক্রমী। যেমন এখানে হিন্দু-মুসলিম ছাত্রদের সংখা প্রায় কাছাকাছি।
এছাড়াও নিম্ন আয়ের ঘরের ছাত্র-ছাত্রীদের
সংখ্যাও কম নয়। এক সময় গেস্টকিন উইলিয়ামসের জন্যে এখানে উচ্চ আয়ের মানুষের বসবাস গড়ে উঠলেও শ্রমিক ও অন্য অনেক কারণে এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষের একটা জন বিস্ফোরণ হয়েছিল পাশাপাশি বস্তি এলাকা থাকায়। সরকার প্রচুর কোয়ার্টার করে তার কর্মচারীদের জন্য এই জায়গায়। দ্বিতীয় হুগলী সেতু হ‌ওয়ার আগে পর্যন্ত এই বিদ্যালয়ে
ছাত্র-ছাত্রীদের প্রচুর ভিড় ছিল। এখন নিম্ন
আয়ের সঙ্গতিহীন ঘরের ছেলেমেয়েদের জন্য
এই বিদ্যালয়ের প্রাথমিক বিভাগটি বেশ ভর্তি থাকে শুধু নয়, শিক্ষার একটি আদর্শ স্থান
অরুণ বসু এই স্কুলের শিক্ষক থাকাকালীন ( অনেক দিন অরুণবাবুর সঙ্গে দেখা নেই)  বিদ্যালয়টিকে যে যত্ন‌আত্তি করতেন তার ফলে বিদ্যালয়টি আত্মপরিচয়ে ছাত্র-শিক্ষকের মধুর সম্পর্ক বজায় আজ‌ও রেখে চলতে পারছে। সব মিলিয়ে হাওড়া শহরের বুকে এহেন একটি হাই অ্যাটাচ স্কুলের প্রাথমিক বিভাগে শিক্ষক দিবসের দিনে প্রায় অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রীরা সঙ্গে করে নিয়ে আসে এক একজন ৯/১০ টি করে পেন। সামর্থ্য অনুযায়ী সংখ্যার হিসেবে কম-বেশি হতে পারে ‌। 
১০০ উপস্থিত হলে প্রায় ৭০০/৮০০ পেন জড় হয় স্কুলে । (কেউ কেউ ৯/১০টির জায়গায় ২/৩ টিও নিয়ে আসে) নতুন পেন উপহারের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা এক একজন ৫ টাকা থেকে ২০-২৫ টাকা দামের পেন কিনে আনে। অভিভাবকদের মধ্যে উৎসাহের শেষ থাকেনা বলে তারাও যে যেমন পারেন এর মধ্যে অংশগ্রহণ করে থাকেন। দেখা গেছে সারা দেশেই এইদিন পেনের জমকালো একটা ব্যবসা হয়। পেন হলো একটি সহজ ও নিষ্পাপ উপহার। যা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে একজন শিশুর মধ্যে দানশীল হ‌ওয়া ও স্বজন গড়ার গুণ তার মধ্যে তৈরি হতে শুরু করে উপহার দেওয়ার মানসিকতার সঙ্গে শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা গড়ে তোলোর যে আয়োজন তার একান্ত প্রয়োজন আছে বলে করা হয় এবং মানসিক বিকাশ কর্তব্য বোধ তৈরি হয়। এই দিনে তা একজন তা সহজেই গড়ে তুলতে পারে।
সবচেয়ে বড় কথা এত নিষ্পাপ উপহার আর হয়না। এখন এই দিনকে ঘিরে উপহার দেওয়াটা  ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে একটা প্রতিযোগিতা
তৈরি হয়েছে বেশ কয়েক বছর ধরে। সে কারণে অনেক বিদ্যালয়ে নোটিশ দেওয়া শুরু হয়েছে ছাত্র ছাত্রীরা উপহার আনবে না। এবছর তো এইসব মানা গেলনা। শিক্ষক দিবসের উপহার এত‌ই নিষ্পাপ ও সরল বেমানান । আসলে বাণিজ্যিক সংস্থা ও আর্থিক সঙ্গতিপূর্ণ অভিভাবকদের জোড়া ফলায় বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতা একটা খারাপ বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছে যা বাঞ্ছনীয় নয়। আসলে এই উপহার নিয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকারা নিজেদের মধ্যে একটি জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন যা মোটেই শোভন 
নয়। সব শিক্ষক জনপ্রিয় হবেন একথার গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। শিক্ষার্থীদের কাছে জনপ্রিয়তা ও যোগ্য শিক্ষক এইভাবে বিচার পাওয়া মুশকিল। সুকুমারমতী ছাত্র ছাত্রীদের কাছে যা ভালো লাগবে শিক্ষকদের কাছে তা নাও লাগতে পারে। কোন‌ও শিক্ষক ২০ টা পেন কোনো শিক্ষক ১০ পেন বা অন্য উপহার পেলে টিচার্স রুমে নিজেকে ছোট মনে করার ভাবনা থেকে শিক্ষক শিক্ষিকাদের মননের উন্নয়ন ঘটাতেও হবে । পাঠদানের মাধ্যমে নিজেকে জনপ্রিয় করে গড়ে তুলতে হবে। যোগাযোগ এখানে একটা সেতু তৈরি হয়। আবার এও নিশ্চিত গণিতের শিক্ষক শিক্ষিকাদের জনপ্রিয়তা অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন। সে যাইহোক নিজেদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে না গিয়ে সারা বছর ছাত্র‌দের জন্য প্রাণপাত করাই প্রকৃত শিক্ষকের কাজ ও কর্তব্য । বরং আসুন হাওড়ার শিবপুরের বি.গার্ডেন গেস্টকিন উইলিয়াম গেটের সামনের চিত্তরঞ্জন স্কুলের প্রাইমারির ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে উপহারের পাঠ নি‌ই । যাঁরাই সেদিন ওই স্কুলে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে যোগদান করেন অভিভাবক হলেও তিনিও কয়েকটি পেন উপহার পান। শিক্ষক-শিক্ষিকারা, অতিথিরা এক একজন ৫০/৬০ টি করে পেন উপহার পান । এমনকি অতি
নিম্ন আয়ের অভিভাবক যখন দেখেন। তার পুত্র ও কন্যা লজেন্স-বিস্কুট নিয়ে খুব আনন্দমুখর হয়ে স্কুল থেকে ওইদিন বেরিয়ে আসছে তা দেখে অভিভাবকদেরও মুখ তৃপ্তিতে ভরে ওঠে । তারাও
জানতে চান সকল অতিথি ও শিক্ষক শিক্ষিকাকে
পেন দেওয়া গেছে তো ? কলকাকলিতে তখন
ভরে ওঠে বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। উপহার দেওয়ার আনন্দ‌ই যে শিক্ষক দিবসের গরিমা হয়ে ওঠে তার তৃপ্তির হাসিতে ভরে ওঠে আকাশ। 
■ ১৮৮৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্ম । শুধু জাতীয় শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষক দিবসের তাৎপর্যময় দিনটি যে জড়িয়ে আছে তা তো নয় । বর্তমান দিনে ড.রাধাকৃষ্ণনের শিক্ষক দিবসের চাওয়াটি আজ সমাজ পরম পাওয়া হিসেবে বুঝতে পেরেছে। ছাত্রদের কাছে আজ দিনটি খুশির দিন হিসেবে পরিগণিত হয়েছে মনে হয় এই অবিরল আনন্দের ধারা থেকেই শিক্ষক দিবসের তাৎপর্য বোঝা যায়। শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখেছি শিক্ষকরা দলে দলে রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হতে পারেন না। এই প্রোপোজাল তৈরি করতে গিয়ে দেখেছি উপরে
লিখিত গুরুত্বপূর্ণ গুণগুলি যে যে শিক্ষকের থাকবে তাকেই রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্যে বিবেচনা করা উচিত‌। তাঁর ছাত্রদের উদ্যোগে যে জন্মদিন পালনের উদ্দেশ্য ছিল রাধাকৃষ্ণান সেই ইচ্ছেকে শিক্ষক দিবসের মর্যাদায় উত্তীর্ণ করেছিলেন। তাঁর অবদান ভারতে এক মহত্তম ঘটনা।
■ ফিলিপ স্যামুয়েল স্মিথ পুরস্কার ও গ্রিফিথ পুরস্কারে ভূষিত দেশে- বিদেশে বন্দিত বাঙালি দার্শনিক যদুনাথ সিংহ ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে বীরভূমের কুরুমগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং বাংলা মাধ্যমে বীরভূমের স্কুল, বর্ধমান হয়ে কলকাতা চলে আসেন এবং ১৯১৫ ফিলজফিতে
অনার্স, ১৯১৭ এম.এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশাল প্রশ্ন চিহ্ন তার থিসিসটি জমা হয়েছিল কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে কবে ? হাইকোর্টের মহাফেজখানায় ও কলকাতা ইউনিভার্সিটির মহাফেজখানায় তা কে খনন করবে ? রাধাকৃষ্ণন কলকাতায় অধ্যাপনা 
করতে আসেন ১৯২১-১৯৩২ পর্যন্ত । দুজনের
এক‌ই বিষয়। একজন শিক্ষক রাধাকৃষ্ণন অন্যজন ছাত্র, পিএইচডি থিসিস জমা করেছেন
একজন খ্যাতনামা রাধাকৃষ্ণন ,অন্যজন অল্পখ্যাত যদুনাথ সিংহ। একজনের ইচ্ছে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছনো অন্যজনের ইচ্ছে ব‌ই লেখা এবং তার আবিস্কার সকলের কাছে পৌঁছনো। কিন্তু যদুনাথ সিংহ পিএইচডি সম্মান লাভ করেন ১৯৩৪ সালে আর ১৯৩২ - এ কলকাতা ছাড়লেন রাধাকৃষ্ণন। অর্থাৎ রাধাকৃষ্ণনের উপস্থিতিতে যদুনাথ পিএইচডি
সম্মান জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মর্ডান রিভিউ পত্রিকায় জানুয়ারি ১৯২৯ সালে যদুনাথের চিঠি প্রকাশিত হলো , উদ্দেশ্য রাধাকৃষ্ণন । তাহলে পাঠক ধরে নিতে পারেন যে যদুনাথের থিসিস জমা দেওয়ার কাজ চলছিল। ১৯২৯ তখন রাধাকৃষ্ণন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে
উপস্থিত আছেন । প্রেমচাঁদ-রাইচাঁদ বৃত্তি পাওয়া ( পি এইচ ডি করার জন্য) যদুনাথ সিংহ তার শিক্ষক রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে চিঠি লিখলেন 
যে ১৯২৪ এবং ১৯২৬-এ তার পিএইচডি পেপারের যে অংশ মীরাট কলেজের ম্যাগাজিনে প্রকাশ পেয়েছিল তা রাধাকৃষ্ণনের দুটি ব‌ইতে হুবুহু দুটি চ্যাপ্টারে সংকলিত হয়েছে। বিশেষ করে রামানুজমের বেদান্তের উপর যে ব‌ইটি রাধাকৃষ্ণান বিখ্যাত হয়েছিলেন তার দুটি চ্যাপ্টার হুবহু যদুনাথের লেখা থেকে রিপ্রিন্ট করা হয়েছে। রাধাকৃষ্ণান যদুনাথের চিঠি যুদ্ধ থেকে কিছুদিন বাদে সেই প্রসঙ্গে যখন রাধাকৃষ্ণন চুপ করে গেলেন তখন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের প্রবাসীতে রাধাকৃষ্ণননকে আক্রমণ করে থিসিস চুরির 
দায়ে ফেলা হলো ‌এবং সংবাদ প্রকাশিত হলো।
দেখা যাচ্ছে এক অদ্ভুত কারণে ১৭ বছর পর
যদুনাথের পিএইচডি হয় তিনি এম এ হন ১৯১৭
তে। এই কারণে যদুনাথের গড়িমসি ছিল কিনা
তা জানা যায় না। এই যদুনাথ-রাধাকৃষ্ণন পর্বটি
জনৈক উৎপল আইচের আনন্দবাজারে সম্পাদক
সমীপেষুতে ৭.৯.১৮ তারিখে চিঠি প্রকাশিত হ‌ওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পুণরায় জনমানসে প্রতিক্রিয়া দেখা যায় ও শিক্ষিত সমাজে আলোড়ন শুরু হয়ে যায়। আসলে যদুনাথের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণানের একটি এই লেখা নিয়ে একটি কোর্ট কেস হয়। কোর্ট কেসটি করেন যদুনাথ সিংহ রাধাকৃষ্ণানের বিরুদ্ধে। কী সেই কোর্ট কেস। একটি স্যুট ফাইল হয়। যদুনাথ সিংহ রাধাকৃষ্ণনের চিঠি যুদ্ধ মর্ডান রিভিউতে থেমে যায় কারণ রাধাকৃষ্ণন আর উত্তর দেননি। তখন যদুনাথ তখনকার দিনে ২০,০০০/- টাকার ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করেন রাধাকৃষ্ণনের বিরুদ্ধে। যদুনাথের লেখা থেকে টুকে রাধাকৃষ্ণন তার দুটি ব‌ইয়ের দুটি চ্যাপ্টার হুবহু তৈরি করেন বলে রিট দাখিল করেন ‌১৯২৯ সালের আগস্টে। রাধাকৃষ্ণনের ব‌ই প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে রামানুজমের 
ফিলজফির ওপর। রাধাকৃষ্ণন ভার্সেস যদুনাথ
মামলা পেন্ডিং থাকা অবস্থায় রাধাকৃষ্ণন অন্য
একটি মামলা করেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ও
তার প্রবাসীর বিরুদ্ধে। এই মামলাটিতে রাধাকৃষ্ণন এক লক্ষ টাকার মানিহানি মামলা করেন। পরিশেষে তিনজনের সম্মিলিত সন্তোষ জনক মিউচুয়াল বিনা আপত্তিতে দুটি মামলাই
হাইকোর্টৈর বাইরে নিষ্পত্তি হয়। যদুনাথ পিএইচডি প্রাপ্ত হন। রাধাকৃষ্ণন কলকাতা ত্যাগ করেন।  দেশে বিদেশে যদুনাথের ও রাধাকৃষ্ণনের
ব‌ই, দর্শন ও হিন্দু দর্শনের ব‌ই বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে সমাদৃত আজও । ১৮৮৮ সালে দার্শনিক ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ড.সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের জন্ম দক্ষিণ ভারতে যিনি চারবছরের বড় যদুনাথের থেকে । রাধাকৃষ্ণনের শিক্ষা খ্রিস্টান মিশনারি শিক্ষায় তখন থেকেই তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষ এবং শিক্ষিত । যদুনাথের নাম পড়ে থাকে অনেক পেছনে। প্রচারের সমস্ত আলো এসে পড়ে আমাদের প্রাক্তন রাষ্টপতির । তার জন্মদিনকে কেন্দ্র করেই আজকের শিক্ষক দিবস
আমরা ভারতবাসী আমরা শুধু ভালোটুকুই
মনে রাখবো , প্রণাম রাধাকৃষ্ণন। 
©® অলোক কুন্ডু

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০২০

জাতীয় শিক্ষক

আমার জাতীয় শিক্ষক 
********************
এ রকম জাতীয় শিক্ষককেও আমি জানি যারা 
তাদের জীবনের আচরণ কোনো দিন পাল্টাতে 
পারেননি তবুও তারা জাতীয় শিক্ষক ।
১. নিজের অনেক জমি থাকলেও স্কুলের জন্যে এক টুকরো জমি দেননি ২. সিগারেট খাওয়া ছাড়েন নি 
৩. রাজনীতি করা ছাড়েননি ৩. কোনো স্কুল 
প্রতিষ্ঠার সংগে তার নাম একবারও  শোনা যায়নি 
৪. বাড়ি বাড়ি গিয়ে কখনো কোনো একটি ছাত্রেরও খোঁজ নেননি ৫. পরিবেশে রক্ষায় কোনো উদ্যোগ 
কিংবা গাছ লাগিয়ে তার নেতৃত্ব দিয়ে গোটা পরিবেশ পাল্টে দিতে পারেন নি । ৬  একটি ছেলেকেও বিনা পয়সার টিউশন দেননি ।  ৭. এমন কিছুই কৃচ্ছ সাধন করেননি যে জাতীয় শিক্ষক হতে পারেন ৮. স্কুলের সময়ের বাইরেও আগে স্কুলে এসেছেন এবং পরে
থেকে গিয়েছেন এটাও করেননি ৯. বিনা পয়সার কোচিন দিয়ে ছাত্রদের সাহায্যে এগিয়ে যাননি 
১০. নিজের পরিবার আর রাজনীতির বাইরে
কোনো কিছুই করেননি ১১. ছাত্রদের গায়ে হাত তুলেছেন ১২. ছাত্ররা সেই শিক্ষককে ভয় পেয়েছেন অতিরিক্ত শৃঙ্খলার জন্যে ১৩. কখনও অন্যান্য কলিগদের সাহায্যে এগিয়ে যাননি ১৪. সমাজের 
বন্ধু হতে পারেননি ১৫. খেলাধুলোয় ছাত্রদের অনন্য করেও গড়ে তুলতে তার সহায়তা নেই ১৬. নিজের 
জন্যে না ভেবে পরের হিতেই নিজের জীবন কে 
বিলিয়ে দেননি ১৭. কোনো কৃচ্ছসাধন নেই কিন্তু 
তারা কেউ গান জানেন কেউ আবৃত্তি করতে পারেন কেউ বই লিখেছেন কেউ ডক্টরেট করেছেন কেউ রক্তদান শিবিরে বক্তৃতা করেছেন । কেউ কেউ 
ভালো জীবন যাপন করেন কেউ কেউ পাথরের 
বাড়িতে থাকেন কেউ কেউ জাতীয় শিক্ষকের টাকা ফিক্সড করে দিয়েছেন কেউ কেউ জাতীয় শিক্ষক 
হয়ে আর ওদিকে পা মাড়াননি । কেউ কেউ শিক্ষক সংগঠনের মাথা হিসেবে মিটিং এ নিজের লোককে 
দিয়ে জাতীয় শিক্ষকের মনোনয়ন করিয়ে নিয়েছেন । তাবলে কি কোনো গুণী মানুষ ত্যাগী শিক্ষকরা 
জাতীয় শিক্ষক হননি । নিশ্চিত হয়েছেন । অনেক জাতীয় শিক্ষকের মধ্যে তাঁরাই হলেন আসল জাতীয় শিক্ষক যার জন্যে তাদের ছাত্রদের চোখে জল
এসে যায় । আমার জাতীয় শিক্ষক হাওড়ার 
শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের প্রয়াত প্রধান শিক্ষক 
সামান্য গ্র্যাজুয়েট ইন্দুভূষণ চট্টোপাধ্যায় যিনি 
কোনো দিন সরকারি ভাবে জাতীয় শিক্ষকের 
সম্মান পাননি । হাওড়ার বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশন
ও শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে 
জড়িত ছিলেন ।

সোমবার, ১৭ আগস্ট, ২০২০

অটলবিহারী বাজপেয়ী

রাজনীতি কত নোংরা আপনি দেখে গেছেন
সর্বশ্রেষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ! তবু তো ২০০৪ এ হেরে গেলেন আপনি । হায় রাম । হিন্দি সিনেমা -"পরমানু "
টা আর দেখা হলোনা আপনার । আপনার
গায়ে বাবরি মসজিদ ছিটে দাগের মতো হয়তো
লেগে রয়েছে , ওর আকার এত বড় যে আপনার
সর্বশিক্ষা অভিযানের রূপান্তর ,আপনার রাস্তাঘাট, আপনার পোখরান বিস্ময় ,আপনার যুক্তির পান্ডিত্যের রূপোলি উপমা , আপনার 
নদী সংযুক্তিকরণ , আপনার ইজরাইল চুক্তি,
আপনার কার্গিল জয় তার কাছে কিছু না 
আর তা ছাপিয়ে যখন সামনে আসে যে আপনি নাকি স্বাধীনতা সংগ্রামী নয় আসলে ফ্যাসিস্ট
তখন এই ভারতবাসীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে
থাকলেও চলে । আপনাকে মুচলেকা দিয়ে
ছেড়েছে এই ভারত । আপনি আর দুঃখে কবিতাও লিখতে পারেননি শেষদিকে । 
শেষদিকে আর কারও সঙ্গে মিশতে 
চাইতেন না । না হাজার চেষ্টা করেও কেউ আপনার পালিতা কন্যার নামে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেওয়া প্রমাণ করতে পারেনি ।
চেষ্টা করেছিল । মনে আছে আপনার ।
বলরাজ সাহানির মতো তুখোড় নাট্য ব্যক্তিত্বকে রাস্তায় রাস্তায় আপনার বিরুদ্ধে নাটক অভিনয়
করিয়ে জ‌ওহরলালজি এইসব ফন্দি এঁটে
ছিলেন । আপনার সুচারু যুক্তিযুক্ত বক্তব্য 
কোনো কাজে আসেনি পাঁচ বার আপনি হারের নায়ক । কাজ দেখে নয় রাজনৈতিক মানুষ 
চায় এই ভারত । রাজনীতিবিদ হয়েও 
রাজনৈতিক লড়াই কত নোংরা হয় তা আপনাকে
আমৃত্যু ছুঁয়ে গেছে বার বার । দিল্লী থেকে
জয়পুরের রাস্তায় মাইল মাইল জমি
নেই আপনার ট্রাস্টের নামে । দিলখোলা
আমুদে মানুষ ছিলেন বলে আপনি দক্ষ
সংগঠক‌ও ছিলেন না । আপনি সংগঠনকেও
মজবুত করতে জানতেন না । তবু আপনি
সহজ সরলভাবে জীবনের মূল্যবোধ অটল ছিলেন অটল হয়েই চলেগেলেন।
KISHAN CREDIT CARD । CROP INSURANCE । FOOD FOR ALL ।
কালাম সাহেব যে যোগ্য রাষ্ট্রপতি সে
ভাবনাও আপনার‌ই , তবু আপনি কতবার
নির্বাচনে হেরে গেলেন স্যার । সব কাজে আপনাকে প্রয়াণের দিনে আমাদের মনে পড়েছে , কিন্তু আমরা আপনাকে জেতাতে পারিনি । একদিক দিয়ে দেখলে আপনি একজন হেরো
মানুষ । কারণ জীবিত অবস্থায় সবাই চাইতো
আপনি যেন কিছুতেই পার্লামেন্টে ঢুকতে না 
পারেন । কারণ এই ভারতে আপনার যুক্তির
কাছে কেউ কোনদিন জিততে পারতো না ।
তাই সারাজীবন দেশের সেবা করে গেলেন ।
দেশ আপনাকে যে ভারতরত্ন দিয়েছে তার
থেকে আপনাকে জর্জরিত করেছে অনেক ।
শুধু মৃত্যুর পর‌ই জিতলেন কারণ আপনি
নির্বাচনে দাঁড়ালে হারানো যেতনা বলে আপনার
বিরোধী দলের কতরকমের ফন্দি আর যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তার 
ঠিক নেই ।

®অলোক কুন্ডু

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২০

#Kargil

আজ স্বাধীনতা দিবস / অলোক কুন্ডু

আমি এখন কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়ালে প্রবেশ করেছি 
যেখানে মুসলমান শিখ হিন্দু ধর্মের ৫২৭ জন শহীদ জ‌ওয়ান চিরনিদ্রায় শুয়ে রয়েছেন
ইচ্ছে হলে আমার পেছনে আপনারাও আসতে পারেন
শত শহীদের রক্তমাখা এই ভূমিতে দাঁড়িয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যাবে আপনার‌ও।
একজন জ‌ওয়ান এসে জানালেন কেউ যেন আমরা কথা না বলি 
ওদের ঘুম ভেঙে গেলে ওরা কার‌ও কথা শুনবে না
মাতৃভূমি বাঁচাতে ওরা যে বলিপ্রদত্ত।
২৬ শে জুলাই ওরা সকলেই জানতো আর হয়তো ফিরে আসবে না।
তাই ৫২৭ জন সকলের সঙ্গে গলায় গলা জড়িয়ে নিল 
বন্ধুদের কাছে শেষ ইচ্ছা জানিয়ে গেল।
কেউ একজন সুবেদার শোনাচ্ছেন সেই দিনের কথা
অকুতোভয় ৫২৭ জন সেনা জ‌ওয়ানের সেই লোমহর্ষক কাহিনী
কেউ কেউ অবাক হয়ে বফর্সকে দেখছে।
স্বেচ্ছায় শহীদ হ‌ওয়ার ব্রত নিয়েছিল যারা
তাদের ত্যাগ আর তীতিক্ষাকে গোলাপি পাথরে মুড়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এখানে
৫২৭ জনের নাম খোদাই করা শহীদস্তম্ভকে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করছে অনেকে
প্রতিটি শহীদ স্তম্ভ প্রতিদিন মোছামুছি হয়
মন্দিরের থেকেও বড় তীর্থস্থান ভারতভূমি কার্গিলক্ষেত্র।
নাছোড়বান্দা সৈন্যদের তেজের গল্প 
মুখ থেকে সকলের হৃদয় হয়ে যেন সারা ভারতবর্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে 
সে কাহিনী ব্যালাডের মতো
জলপাই রঙের পদাধিকারীকে ঘিরে ধরেছে শ্রোতারা 
শুনতে শুনতে টপটপ করে চোখের জল পড়ছে কজন মহিলার পুরুষদের‌ও
সেই গর্বিত কাহিনী বলে যাচ্ছেন যিনি তার চোখ‌ও চকচক করছে
চোখের জল কিছুতেই রোখা যাচ্ছে না 
বাকরুদ্ধ সকলে পিন পড়লেও শোনা যাবে।
পাহাড়ের ওপর থেকে পাকিস্তানের জঙ্গি ও সেনারা ঘিরে নিয়েছে কার্গিল 
রকেটের সঙ্গে মূহুর্তেই ছুটে আসছে হাজার হাজার বুলেট
ঝাঁজরা হয়ে যাবে জেনেও পাহাড়ের ওপরে উঠে যাচ্ছে  
অকুতোভয় একদল ভারতসন্তান 
ওপরদিকে পাকিস্তানের সেনারা গুলিবন্দুক বোঝাই করে রেখেছে
কেউ কেউ মা গো বলে মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে যাচ্ছে ধুপধাপ করে 
যারা উঠতে চেষ্টা করেছিল আর‌ও ওপরে
ওরা ছিন্নভিন্ন হয়ে শুয়ে পড়লো দেখতে দেখতে
আর‌ও একদল মরিয়া হয়ে উঠে যাচ্ছে
তারপর আর‌ও একদল তারপর আর‌ও
শেষে পাহাড়ের ওপর উঠে গিয়ে টুঁটি চেপে ধরেছে বাকিরা 
ততক্ষণে ৫২৭ জনের শরীর বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে গেছে 
ছড়িয়ে ছিঠিয়ে পড়ে রয়েছে তরতাজা প্রাণ ভেসে যাচ্ছে রক্তে 
সতীর্থদের কাঁধে প্রাণহীন ৫২৭ জন ধীরে ধীরে নেমে এসেছিল সন্ধ্যায় 
কফিনে বন্দি হয়ে ফিরে গিয়েছিল বাড়ি
তাদের‌ই কথা শুনতে শুনতে বাকরুদ্ধ সকলে এখন
একজন বয়স্কা মহিলা এইমাত্র মাগো বলে ডুকরে কেঁদে উঠলেন
ধীর পায়ে ওয়ার মেমোরিয়াল থেকে বেরিয়ে আসছি 
লাউড স্পিকারে মৃদু স্বরে বাজছে হিন্দি সিনেমার গান- " এ মেরি জমিন মেহবুব মেরি"
একজন সেনা প্রত্যেকের হাতে একটি করে জাতীয় পতাকাযুক্ত স্মারক তুলে দিচ্ছেন
আজ স্বাধীনতা দিবস।
©® অলোক কুন্ডু

কার্গিল

■ ৭৪-তম স্বাধীনতা দিবস ও কার্গিল শ্রদ্ধা
■৩৭০ ও ৩৫/A প্রত্যাহারের মাত্র ১২ দিন আগে লাদাখ ও কাশ্মীরের একাংশ থেকে ঘুরে 
এসেছি , কলকাতার ডলফিন ট্রাভেলের সঙ্গে ‌। সবে ঘুরে আসার স্মৃতি টাটকা সবজির মতো
সবুজ হয়ে আছে । আমরা শ্রীনগর এয়ারপোর্টে
১৫.৭.১৯ -এ নেমে ওদের তিনটি ট্রাভেলরে চেপে র‌ওনা দিয়ে পুরনো কাশ্মীরকে আবার যে 
ফিরে দেখবো সে আশা কখনও না থাকলেও
স্বপ্ন একটা থেকেই গিয়েছিল । একটু ফ্রেস
হয়ে নিতে, ডলফিনের কাশ্মীর ডেরা অর্থাৎ
ডাললেকের গা-ঘেঁষে হোটেল প্যারাডাইসে গিয়ে নামলাম বেলা তখন ১ টা বেজেছে।
কতদিন পরে সেই স্বপ্নের ডাললেকের ধারে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। সেদিনটা সোনমার্গে 
আমাদের স্টে করার কথা। আগামী কাল, পরের দিন জোজিলা হয়ে কার্গিল যাবো শুধু
তাই নয় কার্গিলে থাকবো এবং যাওয়ার পথে
কার্গিল যুদ্ধক্ষেত্রে ওয়ার মেমোরিয়ালের বীরভূমি ও বিজয় স্মারক দর্শন হবে, যা মন্দিরের থেকে কম কিছু নয়। মনে মনে এইসব ভেবে বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো । আমরা সবাই মিলে ৩২/৩৩ জন আছি । সোনমার্গে স্টে করে পরের দিন কার্গিলের পথে যাত্রা শুরু হল নয়নাভিরাম দৃশ্যের পর দৃশ্য। নিসর্গের মনভোলানো রূপের পর রূপান্তরিত প্রকৃতি খুলে দিচ্ছে একের পর দিগন্তের ভূমিতল। 
এ শুধু চোখ ও মনকে সৌন্দর্য সঞ্চয়ের সময় বলে ধরে নিতে হবে । আমার বাড়ি কোথায় 
কে আমি এইসব স্বার্থপর ভাবনাগুলো যেন ডাললেকের জলে বিসর্জন দিয়ে এসেছি । পথের আর এক সৌভাগ্য অর্জন যা কোনোভাবেই দ্বিতীয়বার হ‌ওয়ার নয়।
শ্রীনগর থেকে সোনমার্গের আগে পর্যন্ত গ্রাম শহর মিলিয়ে নানা ছোটবড় জনপদ পড়ে । আধা শহর‌ও দেখা দেয় , কোথায় ধান, গম ও অন্যান্য চাষবাস হয়েছে। আমাদের তিনটে ট্রাভেলার হু হু করে ছুটে চলেছে জনপদ ধরে, ক্ষেতখামারের পাশ দিয়ে। কোনও বাড়ির বারান্দায় দু-তিনজন যুবতি এ-ওর গায়ে ঢলে পড়েছে। কখনও স্কুল কলেজ দেখতে দেখতে গেছি। সৌন্দর্য বিন্যাসের যেন বড় অভাব মাঝের জায়গায়। আপনার মন খারাপ করে দেবে। খুব অভাবি মনে হবে। ডাললেক , নাগিন লেকের সঙ্গে আশপাশের সমস্ত জনপদটাই সমতল। বড় দোতলা বাড়ি যেমন পড়ে তেমনি মলিন ছন্নছাড়া গ্রাম‌ও দেখতে পাওয়া যায়। ছিমছাম কোথাও নেই এই মাঝের ৫০ কিলোমিটার।প্রেতের মতো বাসস্ট্যান্ড। গাছহীন ভূমিও চোখে পড়বে। সবুজ, নবীন ক্ষেতের গা ঘেঁষে যেসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাড়ি গড়ে উঠেছে যেন তার কোথাও কোনও বিন্যাস নেই। কাশ্মীরের সেই সৌন্দর্য যা আমার বড় প্রিয়। ধুলোময় রাস্তা , জনহীন পথ, ফাঁকা দোকানপাট, খরিদ্দার নেই। এইসব জানলার গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছিল হুটহাট করে। থামিয়ে নেমে দেখতে চাওয়ার বাসনা হলেও আমাদের গাড়ি ছুটছে গতবছর। এহেন কাশ্মীর দেখে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। এত পয়সা পেয়েছে কাশ্মীর! কোথায় সেইসব গেল? মনের মধ্যে এই প্রশ্ন আসতেই, ফারুক আবদুল্লার মুখটা ভেসে উঠে মিলিয়ে গিয়েছিল। মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল এ বুঝি বা বাঙলার কোনও গ্রাম পার হচ্ছি । হেলেপড়া টিনের গ্র্যারেজ, গাছের গুঁড়িতে স্কুলের ছেলেমেয়েরা বসে আছে। লজঝড়ে, ঝড়ঝড়ে বাস দাঁড়িয়ে আছে। যেন যাওয়ার কোনও তাড়া নেই। দুটো কলা গাছ। ওদিকে শীতমহল্লার দু চারটে গাছ দাঁড়িয়েছিল। দূরে দূরে পর্বতশ্রেণির কাছাকাছি চিনার গাছের ছায়ার দুটো বালিকা কিছু খেলছিল। চৌকোনো দাগের ঘরে একপা দিয়ে ঘুঁটি সরাতে সরাতে এগোচ্ছে। দাগ‌ওলা ঘরের পাশে উবু হয়ে বসে চার-ছটি মেয়ে, হাতে চাটনির মতো কিছু। তবু যেন সেইসব নেহাত চাকচিক্যহীন গ্রামের মানুষের চোখেমুখে মানুষের ক্ষতি করার বাসনা দেখেছিলাম বলে, মনে পড়ছে না । একজন বুড়ি কাঁথা বিছিয়ে দাওয়ায় বসে ঠায় চেয়ে ছিল রাস্তায়। আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল কোথাও। বুড়িটার মুখের চামড়া কুঁচকে দাগ হয়েছে। কত বয়স হবে ১০০ ? ফর্সা টকটকে রঙ। কানে ইয়া বড় বড় ঝুমকো দুলছে। ওরা আমাদের মতো কৌতূহলী নয়। কানেকানে ফিসফিস করছেনা কেউ । মোড়ে মোড়ে সকলে দাঁড়িয়ে। কেউ পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে যেতে পারবেনা। ধৈর্যের পরীক্ষায় ও পাশের আশায় যেন ঠায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওরা। কেউ স্কুটারে কেউ গাড়িতে, তো কেউ রাস্তার এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য যেন কেউ আগ্রহী নয়। এসবই আমার ভাবনা। কিন্তু বাস্তব বড় তেঁতো।
গা সয়ে গেছে যেন এইসব নাকাবন্দী জীবন যাপনে। আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে 
কাঁধ মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় জানপ্রাণ 
ঢেলে দিচ্ছে স্থানীয় পুলিশ ও তাদের ইন্সপেক্টররা । উর্দি ভিজে ঘাম বুকেপিঠে জড়িয়ে রয়েছে আষ্টেপৃষ্ঠে। পাবলিকদের মধ্যে কোনও টানাপোড়েন নেই। ওরা সবাই আটকে পড়েছে, অমরনাথের যাত্রীদের যাওয়ার রুটের মাঝে পড়ে গেছে বলে। আমরাও সঙ্গী এখন অমরনাথ যাত্রীদের। গাড়িতে বসে আছি। যেতে যেতে থামছে। তো আবার চলতে শুরু করেছে । হাসছি রগঢ় করছি নিজেদের মধ্যে। বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে রাজনীতির কথা হচ্ছে। ওর কোনও দিকে থাকার মন নেই । ব্রেক, গিয়ার আর পুলিশের আঙুলের দিকে মন দিয়ে রেখেছে স্পষ্ট, একাগ্রতা মানুষের আপাদমস্তকে কাজ করে। আধাসেনায় এখন মোড়া রয়েছে কাশ্মীরের শহর গ্রাম গঞ্জ। বাসের লটবহরের সঙ্গে সতর্ক প্রহরা । কাশ্মীরের মধ্যবয়সী পুলিশরাও ঘেমেনেয়ে চান । দেখে মনে হচ্ছে ওরাও ভীষণ কর্তব্যপরায়ণ , নিজের এলাকা দিয়ে অতিথিদের পাশ করানোর গুরুদায়িত্ব ওদের কাঁধে। রুমালে মুখ মুচছে টকটকে গাল খাঁকি পোষাক চামড়ার ব্লেট , বাজুতে বুকে ব্যাজ নিয়ে রাজপুত্তুরের থেকে কম নন এরা সৌন্দর্যের আলোচনা ওদের নিয়ে। হুহু করে বাসের ঝাঁক এগিয়ে চলেছে সোনমার্গের দিকে। যেন জলের মধ্যে মাছের সারি দুলছে। আমাদের তিনজন ড্রাইভার,তারা চশমেসাই পেরতে পেরতে আমাদের গাড়িগুলিকে ভিড়িয়ে দিয়েছিল একেবারে হাই অ্যালার্ট টপ সিকিউরিটিতে মোড়া অমরনাথের গোটা তিরিশ কি তার‌ও বেশি ভেইকেলের সঙ্গে। আমরা চলেছি বাসের লেজ ধরে ধরে। কিন্তু ওইসব বাসে দু তিনরকম স্টিকার মারা তবুও আমরাও চলন্ত অবস্থায় ওই এক‌ই সম্মান পাচ্ছি । বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জ‌ওয়ানদের দৃষ্টি জানলার মুখগুলোকে তীক্ষ্ণভাবে দেখে নিচ্ছে । বারবার ক্যামেরা লুকোতে হচ্ছে । একটা ক্যামেরায় ভিডিও সমানে চলছে (পরে এইসব দেশের স্বার্থে মুছে দিয়েছি) পেরিয়ে যাচ্ছি ডাললেক, নাগিন লেক, ইউনিভার্সিটি পোস্ট অফিস। হজরতবাল রোড ধরে বরাবর চলেছি, যেতে হবে ৮০ কিমি। হজরতবালের সৈয়দ-এ-আলম মসজিদ , হেল্থ সেন্টার, গেস্ট হাউস পার্ক, তাজদার মসজিদ, নাসিম মোটরস, অসংখ্য পেট্রোল পাম্প পড়ছে সোনমার্গ পর্যন্ত ৮০ কিমি এই পথে। গমের সবুজ ক্ষেত কোথাও কোথাও আর‌ও সবুজ ধানক্ষেত, কিছু অন্য সবজি ক্ষেত বাজারের মধ্যে ফাঁকা দোকান। কোথাও ভিড় বাদুড়ঝোলা বাস দাঁড়িয়ে লোক নামাচ্ছে। পেরিয়ে গেলাম তাজদার কলোনির মোড়,
জাকুরা পুলিশ থানা। পথে পড়লো লালবাবাসাহিব গুরুদ্বার, জামিয়া মসজিদকে ডানদিকে রেখে বাসের দল ও সুরক্ষা বাহিনীর অধীনে চলেছি আমরা, এবড় পাওনা। এ যে এমন উপরি পাওনা চিরকালীন অভিজ্ঞতা।
অবাক হয়ে ফিসফিস কথাবার্তা হচ্ছে বাসের ভেতর। মাঝেমধ্যে আমার ব‌উয়ের কিছু রসালো কথায় সারাবাস যোগ দিয়ে পরক্ষনেই চুপ। থেমে গেছে গাড়ি। ক্যামেরার মুখের লুকোচুরি হচ্ছে। কখন যেন কঙ্গনে ঢুকে পড়েছি এখান থেকে শুরু হয়ে গেছে লে-শ্রীনগর হাইওয়ে। এইপথের ওপরে পড়বে কার্গিল। গন্ডরবাল জেলার মধ্যে সোনমার্গ তখনও সমতল। একটু একটু চড়াই উঠছে তবে বাঁকের পাহাড় নয়। কাশ্মীর যেন কাশ্মীর নয়
চারপাশে চাষের জমি। গ্যারেজের কাছে ক্যানাস্তারা পেটাবার শব্দ। পথের পাশে নির্বাক দাঁড়ানো কাশ্মীরী কলেজ ও স্কুল পড়ুয়া ছেলে
মেয়েরা। বোরখা হিজাব খুব একটা দেখা যাচ্ছে না। প্রায় মেয়ে ও মহিলাদের মাথায় গলায় গায়ে ওড়নায় মোড়া , পথে ঠান্ডার কোনও টের নেই। পলিটেকনিক কলেজ, গুলাববাগের সরকারি বালিকা বিদ্যালয় দোকানপাট থেকে থেকে পার হচ্ছে হু হু করে।  ডানদিকে সিন্ধুর কোনও শাখা ধরে নিয়েছে গাড়ি। পথের শোভায় ঝিলমের উপনদীও কোথাও কোথাও যুক্ত হয়েছে। এদিকে পহেলগামের লিডারের শোভা নেই। মাঝখানে
রাজাধাবার কাছে ৩.৩০ এর সময় আমাদের
খাওয়ানো হবে বলে তিনটি ট্রাভেলার গাড়ি বাসের সিকিউরিটি লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন
হয়ে ডানদিক করে সামনে বহে চলা তীব্র খরস্রোতা নদীর গর্জনের কাছে থেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘিরে ধরলো আধা সামরিক বাহিনী শেষে স্থানীয়রা বোঝাতে এবং বাসে অমরনাথের সিকিউরিটি চেকিং স্টিকার না থাকায় ওরা নিষ্কৃতি দিল। আমাদের ফেলে পথে মিলিয়ে গেলে অমরনাথের লটবহর। ওরা গেল কিছু দূরে অবস্থিত বালতালের অমরনাথের ছাউনিতে । কিন্তু সারাপথে নিরাপত্তা রক্ষিরা একমাস ঠায় দাঁড়িয়ে ডিউটিরত ২৪ ঘন্টা। কী অসম্ভব তাদের সদাজাগ্রত ডিউটি ও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, অবিচল থামের মতো দেশের সুরক্ষা মাথায় নিয়ে সারাদিন সারারাত সমগ্র পথজুড়ে এরা পাহারায় । এইবারের মতো ৭৩ বছরে এরকম নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা কোনও দিন দেখেনি কাশ্মীরের জনগণ। তারাও বেশ অবাক হয়েছে, মিডিয়ায় হৈচৈ হচ্ছে। তবু তারা এই ঝঞ্ঝাট মেনে নিচ্ছে কারণ তাদের সারাবছরের রুজিরোজগার জড়িত। তাই অতিথিদের ফিরে যাওয়া ও আসার নির্বিঘ্ন পথ করে দিতে ঘন্টার পর ঘন্টা পথের কষ্ট তারা সয়ে নিচ্ছে। কাগজে টিভিতে নেতারা বিস্তর সমালোচনা করছে এই নিরাপত্তার। তবু কিছু বলার নেই আধা সামরিক বাহিনী ও কাশ্মীরী পুলিশ যৌথভাবে এই নিরাপত্তার কোনও ত্রুটি রাখেনি। এই দেখার প্রমাণ আমাদের ডলফিন ট্রাভেলের সবাই । সেনাবাহিনীকে তাদের অসীম ধৈর্য্যকে তারিফ করতে করতে চলেছি আমরা। তখনও কেউ জানেনা যে এই নিরাপত্তার আয়োজন আসলে ৩৭০ ধারা রদের। এই নিরাপত্তার কারণে আমাদের ড্রাইভাররা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দোষ দিচ্ছে, তারাও আন্দাজে বলছে। তবু আমাদের কাছে এ এক নতুন অভিযান। নতুন এক অভিজ্ঞতা। মিলিটারি, সামরিক সাজ-সরঞ্জামাদি ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেছে। এতক্ষণ যাচ্ছিল লাম আগে পেছনে অন্তত ৩০ রকমের সামরিক গাড়ি,জ্যামার বম ডিসপোসাল, ভিডিও,টিভ, রেডক্রস,কাশ্মীরী পুলিশের গাড়ি। থামলেই তাদের অবিরাম গাড়ি থেকে ঝপাঝপ নেমেপড়া, হুইসেল হুইসেলে কান পাতা দায়। হাতে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নানা সাইজের। রাস্তার মোড়ে মোড়ে অধীর জনতা গাড়ি আটকে। হেঁটেও যাওয়ার অনুমতি নেই।
নজিরবিহীন নজরদারি। পথে ১০০ হাত অন্তর দু-তিন জন করে জ‌ওয়ান আগলাচ্ছে স্হানীয় শৃঙ্খলা। আগামী কাল পথে পড়বে দ্রাস যেখানে শীতকালে মাইনাস ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে তাপমাত্রা নেমে যায় পৃথিবীর দ্বিতীয় ঠান্ডি জায়গা হিসেবে বিখ্যাত। এখান থেকে মানুষের শরীরে রক্তের শক্তিশালীতা বেশি করে থাকতে হবে । বাড়িতে যেদিন ফিরে এলাম সেইদিন কার্গিল দিবস পালিত হচ্ছে সারা দেশে। টিভি খুলে মনে হলো আমরা কার্গিলেই তো আছি। তখন‌ও আমরা
কেউ জানিনা যে কী হতে যাচ্ছে কাশ্মীর ও লাদাখজুড়ে । ছটা ডিভাইসে হাজার ছবি শতশত ভিডিও তুলে এনেছি। এমনকি মিনি ডিভির ক্যাসটগুলো সিডি করতে কবে দেব ভাবিনি। ১৯৪৭ ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হলো এবং ধর্মীয় পথে বিশেষ করে পাকিস্তানের উদয় হলো । সংখ্যালঘু হিন্দু নিয়ে বৃহত্তর কাশ্মীর রাজতন্ত্র নিয়ে থেকে গেল। তাতে লাদাখের মতো বৃহত্তম জনপদ‌ও কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। লে ও কার্গিল যে লাদাখ রিজিয়নের বৃহত্তম জনপদ আগে থাকতেই ছিল সেকথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা। কার্গিলের দূরত্ব দ্রাস থেকে ৬০ কিমি। ২৩৪ কিমি দূরত্ব লে থেকে এবং ২০৪ কিমি দূরত্ব শ্রীনগর থেকে। তবে কার্গিল পুনরুদ্ধারের আগে এই কার্গিল জনপথের কাছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অনেকবার এল‌ওসি ক্রস করে চলে এসে গোলাগুলি চালিয়ে ছিল। পারভেজ মুশারফ কার‌ও কথাই শোনেন নি। সেনাবাহিনীর প্রধান তখন তিনি। আসলে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট অঞ্চলের মধ্যে স্কার্দু হয়ে কার্গিল থেকে প্রাচীন কালে যে সিল্ক রুট চালু ছিল কারকোরাম পর্বত শ্রেণির অঙ্গ হিসেবে ওটাই ছিল পাকিস্তানে প্রবেশের সহজ পথ এশিয়ার অন্যান্য জায়গা এবং চীন আফগানিস্তানে যাওয়ার আদি পথ । সেই পথ এখন পাকিস্তানের হাইওয়ে । কার্গিলের আশেপাশে পাকিস্তানের বর্ডার লাইন কখনও কখন‌ও খুব কাছে চলে এসেছে । পাকিস্তান হয়ে নদী ঢুকেছে এখানে। এখনও দু দেশে আত্মীয় স্বজনের লুকোছাপা যাতায়াত প্রবহমান এই কার্গিলে। ভারত, কার্গিলের রাস্তা ঘুরিয়ে জাস্করের দিকে ভারতে অবস্থিত সঙ্গমস্থল বরাবর এন এইচ-১ তৈরি করেছে নতুন করে এবং লের দিকে নতুন যোগাযোগ তৈরি করেছে যদিও একমাত্র বাসরুট
চালু আছে মানালি বাস টার্মিনাস থেকে লে 
পর্যন্ত। দু দিক দিয়ে লে যাওয়া যায়। মানালি থেকে রোটাংপাস হয়ে আর আমরা যাচ্ছি অন্য পথে। মানালি থেকে রোজ বাস ভোর ৪.৩০ ছাড়ে দুই দিক থেকে। কার্গিল ও লাদাখ বাঁচাতে ভারতের নতুন তৈরি পথ জোজিলা যুক্ত করে। আসলে কার্গিল যুদ্ধের স্থান থেকে কার্গিল ব্লক হেডকোয়ার্টারের দূরত্ব ৩০/৪০ কিমি হবে । পাকিস্তান চেয়েছিল এই লে-শ্রীনগর রোডকে কেটে দিয়ে লাদাখকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে এবং তারা প্রায় সফল‌ও হয়েছিলেন এবং প্রায় দখল নিয়েছিল এই সংযোগকারী ন্যাশনাল হাইওয়েকে। দু মাস তিন সপ্তাহ দু দিন তুমুল লড়াই চলেছিল।
৫২৭ জন বীর সেনা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন আহত হয়েছিলেন ঢের বেশি। হিসেব মতো ১৩৬৩ জন। যদিও ১৯৪৭-৪৮ ভারত পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল হিন্দু রাজা হরি সিংয়ের আমন্ত্রণে কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে। তখনই ১৯৪৯ সালে সিল্করুটকে তখনই ভারত সিল করে দেয়। ১৯৯৯ সালের ২ মে থেকে ২৬ জুলাই কার্গিলকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল পাকিস্তানের সেনারা। পাহাড়ের 
উপর থেকে চোখ রাখা যায় এই কার্গিল-লে হাইওয়েকে প্রায় সোজা ১০০ কিমি পথ। এখনও আমাদের পথের ধারে দু চারটি এদিকে ওদিকে কামান পাকিস্তানের দিকে তাক করা আছে কিন্তু কোনও চৌকি নেই পাহার‌ও নেই। আমরা যখন লাদাখে ৮ দিন ছিলাম তখন‌ই ভারতীয় সেনাবাহিনীর পজিশন শুরু হয়ে গেছে কিন্তু কেউ কিছু বোঝেনি। বিপুল সংখ্যায় সেনাবাহিনী লাদাখ ঘিরে রেখেছে । হ্যাঁ যা বলছিলাম কার্গিল যুদ্ধের সময় বফর্স কামান
এবং আকাশ পথে আক্রমণ করে কার্গিলকে ভারত কব্জায় নেয়। বুক পেতে দিয়ে সেনারা মার খেতে খেতে পাহাড়ে শেষ পর্যন্ত উঠে যায়।ভারতের এই কার্গিল পুনরোদ্ধারের নাম ছিল -"বিজয়" । ১৭৩ কিমি দূরে বাতালিক সেক্টরের স্কার্দু থেকে পাকিস্তান যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে আর বহুমুখী আক্রমণে। পারভেজ মুশারফ আসলে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সর্বময় কর্তা হতে যে চেয়েছিল কার্গিল দখল করে তিনি সেটা পাকিস্তানবাসীকে একটা বার্তা দিতে চয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় জ‌ওয়ানদের জেদের কাছে সামরিক বাহিনী তাদের জ‌ওয়ানের মৃত্যুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে দুরন্ত সাহসের কাছে পাকিস্তান শেষে হার মানে। অবশেষে কার্গিল ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় পাকিস্তান। হাই অলটিচ্যিউট যুদ্ধ হিসেবে কার্গিলের যুদ্ধ পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছে । বেইমান পাকিস্তানী সেনারা নিয়ম ভেঙে অযাচিতভাবে পাহাড়ের ওপর থেকে কার্গিলের রোড বরাবর গোলাবারুদ ছোঁড়া এবং পাহাড়ের ওপর থেকে ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচের সুবিধার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করেছিল ২০ বছর আগে। শেষে ভারতীয় জ‌ওয়ানরা মরবে জেনেও বুক পেতে দিয়ে পাহাড়ের মাথায় উঠে যায় এবং 
নিজেদের ভূমির দখল নেয় । তখন থেকেই
পাহাড়ের উঁচু স্থানগুলোতে নতুনভাবে চৌকি
তৈরি হয়েছে । মুশারফ জমানায় কার্গিল কলঙ্ক
পাকিস্তানের এক দুর্বল রণনীতির দৃষ্টান্ত
হয়ে আছে। যদিও পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট ন‌ওয়াজ সরিফ কার্গিল যুদ্ধের দায় নেননি । পরে ইউএনও সাহায্যে শান্তি চুক্তিতে পাকিস্তান 
স্বাক্ষর করে। আমি কার্গিল যখন যাই তখন ওখানে সামরিক বাহিনীর মহড়া চলছে (১৬.৭.১৯)। গান বাজনা ঝালানো চলছে। কোথায় নাচ হবে তার দাগ দেওয়া চলছে। দ্রাসের কার্গিল ওয়ার মেমোরিয়াল রঙ হচ্ছে, সমাধিস্থলে তখন দেশাত্মবোধক গানের মহড়ায় আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। চোখ ভিজে যাচ্ছে শুনতে শুনতে, রেকর্ড পড়তে পড়তে। নাচের দলের জন্য জায়গার মাপজোখ চলছে মহিলাদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর। শিবিরের চতুর্দিকে সাজো সাজো 
রব। মিলিটারি ব্যান্ডে বন্দে মাতরম বেজে চলেছে, নিজের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনাকে প্রশমিত করে ওয়ার মেমোরিয়াল ঘুরে 
দেখলাম। জীবন যেন ধন্য হয়ে গেল। শত শহীদের রক্তমাখা ওইভূমি ছেড়ে যেতে
মন চাইছে না মাত্র ৫ হাত দূর থেকে বফর্সকে
সকলে অবাক হয়ে মিলিয়ে নিচ্ছে। আমরা যাবো কার্গিল শহরের দিকে, হিন্দু মুসলমান শিখ সব ধর্মের যে ৫২৭ জন শহীদ জ‌ওয়ান মৃত্যু বরণ করেছিল। শোনা গেল তারা স্বেচ্ছায় এই ব্রত মেনে নিয়েছিল। তারা সকলেই জানতো আর ফিরে আসবে না। তাদের ত্যাগ আর তীতিক্ষাকে কিছুতেই মেলাতে পারছিনা আমাদের এই স্বার্থপর ধান্দাবাজ রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রের বাবুগিরিসুলভ আচরণসুলভে। নাছোড়বান্দা সৈন্যদের তেজের গল্প মুখ থেকে মুখে ছড়াচ্ছে। চোখের জল রোখা যাচ্ছে না কিছুতেই। মেজরদের ঘিরে ধরে বড় পদাধিকারীকে ঘিরে ধরে এক এক জায়গায় দর্শকরা আরও গর্বিত কাহিনী শুনতে চান। কথা শুনতে চায়নি জ‌ওয়ানরা এমনই তেজদীপ্ত তারা। ওপরে ওত পেতে লুকিয়ে আছে জেনেও স্বেচ্ছায় একটা রাইফেল নিয়ে কয়েকজন ধোঁকা দিতে উঠে গিয়েছিল যাতে তারা গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেলেও পেছনের বাহিনী পাহাড়ের মাথা দখল নিতে পারে। এই দুঃশাসহের মর্ম কাটমানি খাওয়া শখের নেতারা কিই বা বুঝবে। এইসব শুনতে শুনতে মাথা নীচু হয়ে গেছে। বাকরুদ্ধ সকলে। বাসে উঠে কিছুক্ষণ নিথর হয়ে গেল শরীর।
শ্রীনগর থেকে জোজিলা পাস হয়ে পড়বে 
দ্রাস। দ্রাসের ঠান্ডা পৃথিবী বিখ্যাত। তার পরেই পড়ে বিখ্যাত কার্গিল শহীদ মিউজিয়াম।  আমাদের সেদিন থাকার ছিল কার্গিল শহরে। একটু দূরে। কার্গিল শহরের আগে এই বীরভূমি
যেন মন্দিরের পুজো নিতে ব্যস্ত। যেখানে মৃত্যুকে জয় করে দুমাস বাদে পাহাড়ে উঠে যায় সেনাবাহিনী, উপর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি সহ্য করে কে আগে জান দেবে এই প্রতিযোগিতায় নামে তারা। শেষে সেনারা বিজয় ছিনিয়ে নেয় সঙ্গে বফর্স কামান ও উপরে বায়ুসেনার রকেট । জয় এসেছিল ২৬ শে জুলাই আমরা গিয়ে পড়েছি ১৬/৭/১৯।মিলিটারি ব্যান্ডের জবরদস্ত মহড়া চলছে তখন। এখানেই তারা শায়িত রয়েছেন সারসার,
অসীম সাহসী ৫২৭ জন ভারতীয় বাহিনীর জ‌ওয়ানের জীবন, যারা সবাইমিলে হিন্দু মুসলমান শিখ নেপালির ঊর্দ্ধ্বে চিরকাল থেকে
গেলেন । ©® অলোক কুন্ডু

Independence Day

■একটি কাল্পনিক পতাকা উত্তোলন
■ অলোক কুন্ডু

এমন ভাবখানা দেখালেন যেন আপনি ও             
আপনারাই স্বাধীনতা এনেছেন
এমন অংহকারি ভঙ্গিতে পতাকা তুললেন
যেন আপনারাই সিপাহি ছিলেন এদেশের ।

দড়িটা ঠিকমতো খুলছিল না বলে
প্রাইমারির মাষ্টারমশাই বেচারাকে
মনে করলেন আপনার বাড়ির চাকর 
আপনার তাকানোয় স্বাধীনতা গুমরে উঠলো ।

কাদায় আপনার নতুন জুতো জোড়ায়
দাগ লেগে গেল বলে বেজায় বিরক্তি এখন চোখেমুখে
ওদের দেওয়া চা মিষ্টি ছুঁয়েও দেখলেন না
ক্লাস ফোরের মেয়েটা ফিরিয়ে নিয়ে গেল ।

পতাকার মাঝে বাঁধা ফুলগুলো ছড়ায়নি কেন
এই কৈফিয়তে মাষ্টারের কান তখন লাল
মিহি গলায় তবু সম্মান দিতে কার্পণ্য ছিলনা এতটুকু
লা-ওপালার কাপ ডিস কিনে এনেছিলেন যত্নে ।

আপনার ধোপদুরস্ত পোশাক থেকে 
সুগন্ধিগুলো ঠিকমতো ছড়াচ্ছিল কি না 
আর সেই গন্ধে আশপাশ কেমন ম ম করছিল
তাও যাচাই করে নিচ্ছিলেন সুদক্ষ নিরিক্ষায় ।

জোড়হাত করে এতক্ষণ যে ছেলেমেয়েগুলো
দাঁড়িয়েছিল অবাক বিস্ময়ে গাইছিল গান
তাদের দিকে একবারও ফিরে তাকালেন না
আপনার বক্তৃতায় ১৯৪৭ থেকে ২০২০ চলছে ।

তটস্থ দাঁড়িয়ে তখনও প্রাইমারির ছেলেমেয়েগুলো
আপনার দুর্বোধ্য বক্তব্যের উচ্চারণ ততক্ষণে
পেরিয়ে যাচ্ছে মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত
মাইক দেখে ঢুকে পড়া আগুন্তক শ্রোতা‌।

একটা তেরঙ্গা কাটা ঘুড়ি সভার কাছে আসতেই 
ছেলেমেয়েগুলো লাইন ভেঙে দিল হুড়মুড় করে 
উপস্থিত সকলকে অবাক করে কাটা ঘুড়ি তখন
পতাকার সাথে জড়িয়ে উড়তে শুরু করেছে।

আপনি তবুও বলে চলেছেন স্বাধীনতার মানে 
বলে চলেছেন সংবিধান থেকে শিক্ষা
স্বাস্থ্য থেকে সিয়াচেন সম্প্রীতি থেকে সততা  
সভ্যতা না শৃঙ্খলা কোনটা বেশি দামি।

প্রসঙ্গের অবতারণায় তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে অভিভাবকদের মুখ থেকে মুখের জড়তা
গোবেচারা মানুষ গুলো কীভাবে জানবে এইসব
আপনিও ঘেমে নেয়ে ততক্ষণে ভেবেছেন কেমন দিলেন এদের।

৭৪ বছর ধরে শুনে যাওয়া সেইসব কথাগুলো 
ততক্ষণে পতাকা থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া কাটা ঘুড়ির মতো বাতাসে লাট খেতে লাগলো
ছেলের দল চিৎকার করে উঠলো--ভো কাট্টা ।
©® অলোক কুন্ডু
( সঙ্গের ছবি: লাদাখ থেকে তোলা গতবছর)

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...