নানারূপে স্বামীজি : প্রসঙ্গ স্বামীজির শিকাগো বক্তৃতার পূর্বাপর
©® অলোক কুন্ডু
■ ২৩ বছরে ঘর ছেড়েছিলেন ৩৯ বছরে তার মৃত্যু হয় । বিশ্ব ধর্ম সভা থেকে রামেশ্বরমে এসে নামার ১০ বছর পর তাঁর ইহোলোক ছেড়ে যাওয়া । কতকিছু ভেবেছিলেন কিন্তু অধিকাংশ কাজ, এমনকি তাঁর লেখা পড়েও এখনও বাস্তবায়ন
করা যায় নি, এতই বিস্তৃত সেই ভাবনাগুলো ছিল। শিকাগো এসে কোথায় থাকবেন সেই আস্তানার ঠিকানা হারিয়ে ফেলে কনকনে ঠান্ডায় তাকে
বাইরে অনাথ অবস্থায় রাত কাটাতে হয়েছিল।
■বিশ্ব ধর্মসভা থেকে ফিরে রামেশ্বরমে নেমে মাদুরাই থেকে যখন তিনি কখনো গাড়িতে কখনো ট্রেনে করে আসছিলেন ,তার আগে ও পরে স্বামীজি সম্পূর্ণ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আসলে স্বামীজি খুব তাড়াতাড়ি করেছিলেন তার ঘর ছাড়ার বিষয়টিকে মজবুত করতে। নিজের জন্য না ভারতবাসীর জন্য তার কায়িক পরিশ্রম তখন থেকেই হচ্ছিল কিন্তু নিজের শরীরের কথা তিনি ভাবেননি। বক্তব্য রাখলে কিছু উপার্জন হতো, আশ্রয় পেতেন দুমুঠো খেতে পেতেন বিদেশে। ■যখন তিনি ভারতবর্ষে পরিব্রাজক। স্বামীজি যেখানে পেরেছেন থেকেছেন যা তাকে পাঁচজন এনে দিয়েছেন তাই তিনি খেয়েছেন। এমনিতে আমেরিকা থেকে ফেরার সময়ই তিনি জাহাজ যাত্রায় কাহিল হয়ে পড়েন। তবুও দক্ষিণভারতের মাদ্রাজ ও মাদুরাইতে জায়গায় জায়গায় তোরণ করা হয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানাতে। কথা ছিল বক্তব্য রাখবেন, কিন্তু পারেননি। এতটাই অবসন্ন। দেশমাতৃকা ছেড়ে বাঙালি খাবার ছেড়ে কতদিন ঘুরছেন। জাহাজের ধকল তো কম নয়। তবু মাদ্রাজিরা যুবকরা ঘোড়ারগাড়ির ঘোড়াকে বিচ্ছিন্ন করে খুলে দিয়ে যখন তার গাড়িকে মানুষ দিয়ে টানানো হয়েছিল তখন আপত্তি থাকলেও যুবকদের এই প্রাণশক্তির কথাটা তিনি তার ১০ বছর বেঁচে থাকার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে ভেবেছিলেন। ফেরার ট্রেন থামিয়ে স্টেশনে মানুষের আবদার রাখতে স্বামীজি অনেকদিন ট্রেন থেকে নামতেই পারেননি। স্বামীজির জন্যে স্টেশনে মঞ্চ, গেট ফুল কাতারে কাতারে জনসমুদ্র। একটু সুস্থ হতেই আবার বেরিয়ে পড়েছিলেন পরহিতার্থে।
■ কিন্তু এই বিবেকানন্দের নিন্দুকেরা তাঁকে কী না বলতে বাকি রেখেছিলেন। তাই স্বামীজি এক সময় দুঃখ করে বলেছেন--" তারা বলতো
বিবেকানন্দ জুয়াচোর, এক আধটি নয় এই
স্বামীর অনেকগুলি স্ত্রী ও একপাল ছেলেপুলে আছে "। স্বামীজি দুঃখ করে বলেছিলেন -
" মানুষের সাহায্য আমি অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান
করি, আমি আমার দেশকে ভালবাসি আর
বড় একান্তভাবেই ভালবাসি "। স্বামীজির ৩৯
বছরের ঝঞ্ঝাময় জীবন ঘটনা ও বার্তাবহুল হয়ে
আজকেও বেঁচে আছে। পড়লে চোখে জল এসে যাবে।
■ পুরাণে আছে সন্ন্যাসীর জীবন অতি কঠিন । সে যা পাবে তাই খেয়ে ও পরে এলাকার পর এলাকা ঘুরে দেখবেন। সাধারণ মানুষের জীবনকে দেখাই তার জীবনের আদর্শ হবে। স্বামীজি একরকম অনাহারে তার সন্ন্যাস জীবন কাটিয়ে এই ভারতের আসমুদ্র হিমাচল ঘুরে ঘুরে অভাবি মানুষের সুখদুঃখকে নিজের জীবনের সঙ্গে নিয়ে তাকে উপলব্ধি করেছিলেন। তখনকার দিনে কোনো মানুষের সাহস ছিল না ৬৩ দিন ধরে বোম্বাই , চীন , ভ্যাঙ্কুভার হয়ে প্রায় সামান্য খরচ সঙ্গে নিয়ে আমেরিকা যাওয়ার কথা। আজ থেকে ১২৭ বছর আগে ১৮৯৩ সালের ৩১মে স্বামীজি আজকের মুম্বাই থেকে জাহাজে উঠেছিলেন । পথে চীন জাপান ও কানাডায় তিনি নেমেছিলেন। পরে জামেসদজি টাটার সঙ্গে তখনই আলাপ হয়েছিল জাহাজে। কিন্তু তাতে স্বামীজির কিছু তখন সুবিধা না হলেও বেলুড় মঠ ও দ্বিতীয়বার বিদেশে যেতে তা তাঁকে সাহায্য করেছিল। সিকাগো ধর্মসভার দশ বছরেই তাঁর মৃত্যু হয়। অবসরের জন্য কোনো সময় তিনি একেবারেই পাননি। যেমন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে থেকে আমরা পাই অন্য শ্রীরামকৃষ্ণকে। তেমনি বিবেকানন্দকে পুস্তকে সেইভাবে পাইনি। তবে হাতের গোড়ায় পেয়েছি ইদানিংকালে সাহিত্যিক শংকরের কাছ থেকে স্বামীজিকে অন্যভাবে জানার। শংকর শঙ্করিপ্রসাদ বসু দীর্ঘ দিন দুজনেই হাওড়ার রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ আশ্রমের সঙ্গে
যুক্ত ছিলেন। তখন থেকেই বিবেকানন্দ চরিত্র চর্চায় নিমগ্ন ছিলেন তারা । তাই শংকরের থেকে
স্বামীজির সম্পর্কে গভীর ভাবে আমরা কিছুটা
অধ্যয়ন করতে পেরেছি । কিন্তু শ্রীম"র জন্য
তবু আমরা শ্রীরামকৃষ্ণকে বেশ কিছুটা জানতে
পারলেও স্বামীজি আমাদের সে সুযোগ নিজেই
দেননি। ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামীজির গান থেকে
তার প্রবন্ধ তার পত্রাবলী থেকে স্বামীজিকে কিছুটা জানা যায়। তবু যেন আমাদের মনে সংশয় থেকেই যায় । মনে হয় বিবেকানন্দ এদেশে এখনও অবহেলিত রয়ে গেছেন । "আমি বিবেকানন্দ বলছি "-স্বামীজির জীবনের দুঃসময়ের ফসল ।
■ স্বামীজির রচনাবলীতে আছে-" বহুজন হিতায়
বহুজন সুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম। পরের জন্য প্রাণ দিতে, জীবনের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে,
বিধবার অশ্রু মুছাতে,পুত্রবিয়োগ-বিধুরার প্রাণে
শান্তিদান করতে,অজ্ঞ ইতর সাধারণকে জীবন সংগ্রামের উপযোগী করতে, শাস্ত্রোপদেশ বিস্তারের দ্বারা সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক
মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানলোক দিয়ে সকলের
মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্ম-সিংহকে জাগরিত করতে
জগতে সন্ন্যাসীর জন্ম হয়েছে ।" তাই যখন আমরা দেখতে পাই পিতার মৃত্যুর পর দিশেহারা ছিলেন তিনি, একদিকে আত্মীয় স্বজনদের স্বার্থপরতা অন্যদিকে মা-দু ভাইয়ের আহার জোগাড় করা , বাসস্থান রক্ষা করার ভাবনা আগে! না কি ? শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারাপ্রচার করা ? কোনটা প্রধান তাঁর কাছে হবে ? সন্ন্যাসীর কঠোরতায় নির্মমভাবে স্বামীজি ভাবলেন যে, ত্যাগই হলো
তার জীবনের প্রধান অধ্যায় , বেদনায় কাতর
হয়ে না পড়ে ভয়ানক দুঃখ কষ্টকেই সহ্য করে
নিয়েছিলেন তিনি । তাই অনেক কষ্টে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল -" জীবনে যাকে নিজের পথ নিজেকেই করে নিতে হয় ,সে একটু রুক্ষ হবেই ।" কিন্তু বাস্তবে তো স্বামীজি তা মোটেও ছিলেন না। ছিলেন দিলখোলা সাদাসিধে মানুষ । হাঁস,ছাগল কুকুরদের সঙ্গে তাদের ভাষায় আদান প্রদানের কথাতো এখনও বেশ রসালো ভাবেই শোনা যায়। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন তাদের মতো করেই । শুনলেই হাসি এসে যাবে এইরকম সব অদ্ভুত তাদের নামকরণ করেছিলেন তিনি।
■ স্বামীজি বলেছিলেন-" এই বিশ্বাস আমি দৃঢ়ভাবে পোষণ করে আসছি এবং এখনও করি যে, যদি আমি সংসার ত্যাগ না করতাম ,তবে আমার গুরু পরমহংস শ্রীরামকৃষ্ণদেব যে বিরাট সত্য প্রচার করতে জগতে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন ,তা প্রকাশিত হতে পারতো না।" এখানে আমরা এক প্রচন্ড শক্তিশালী দৃঢ়চেতা মানুষরূপে স্বামী বিবেকানন্দ পেয়ে যাই। স্বামীজি বলেছিলেন "এই ভারতে তাকে অনেকে চেনেনা বোঝে না তাতে কি ?! আমি যুবদলকে সঙ্ঘবদ্ধ করতে নেমেছি,যারা সর্বাপেক্ষা দীনহীন অবহেলিত পদদলিতদের...তাদের দ্বারে দ্বারে--সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, নীতি, শিক্ষা ধর্ম বহন করে নিয়ে যাবে --এটাই আমার আকাঙ্ক্ষা ও ব্রত। এটি আমি সাধন করব অথবা মৃত্যুকে বরণ করব।"
■ যেমনটি পুরাণে বলা আছে সেই কপর্দকহীন সন্ন্যাসীদের রূপের মধ্যে যে স্বামীজি বিজয়ী হবার স্বপ্ন দেখতেন তা তাঁর রচনায় মেলে বইকি।
তিনি বলেছেন-" আমার ভয় নেই, মৃত্যু নেই,
ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই...বিশ্বপ্রকৃতির সাধ্য
নেই যে,আমাকে ধ্বংস করে। প্রকৃতি
আমার দাস। হে পরমাত্মন্, হে পরমেশ্বর
তোমার শক্তি বিস্তার কর।" কী অভাবনীয়
প্রত্যয়ী তিনি, কে তার সেই পরমেশ্বর ?
স্বামীজির ধর্ম তো হিন্দু নয় তবু একদিন কী
হলো দুর্গাপূজার রীতিনীতি নিয়ে লেখা বই
আনালেন। মূর্তি পুজোর বিরোধী স্বামীজি,
অনুমতি দিলেন মঠে দুর্গাপুজো হবার। আসলে
একটু আনন্দ হবে ঢাক বাজবে অনেক মানুষের আগমন হবে তার সঙ্গে তার বানানো রেসিপি অনুসারে খিচুড়ি ভোগ আজও বেলুড় মঠে চলে আসছে। তিনি হিন্দুত্বের পুজো করেননি তাদের আনন্দের পুজো করেছিলেন--এই আপ্তবাক্য যেন আমরা ভুলে না যাই।
■ শ্রীরামকৃষ্ণকে তিনি দেখেছিলেন কাপড়চোপড়
ছাড়া পঞ্চবটিতে বসে ধ্যানমগ্ন, রাতবিরেতে
উলঙ্গ শ্রীরামকৃষ্ণ ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর বেশবাস,
মা মা বলে মন্দিরে ঢুকে গেছেন। পুজো করতে করতে মা কালীকে নয় নিজের মাথায় ফুল দিয়েছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। কালীমূর্তি কি তবে তথাকথিত কোনো ভগবানরূপী দেবতা ছিলেননা শ্রীরামকৃষ্ণের কাছেও? সবার কাছে দক্ষিণেশ্বরের তিনি কালী মূর্তি হলেও। স্বামী বিবেকানন্দ কিন্তু পরবর্তীতে কালীর বদলে শ্রীরামকৃষ্ণকেই দেবতার আদলে বসিয়ে তিনি পুজো করেছেন, যা বেলুড় গিয়ে আমরা আজকে দেখতে পাই। মূর্তির থেকে রক্তমাংসের মানুষকে, যাকে তিনি দেখেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁকেই পুজোর মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় রীতিনীতিতে কষাঘাত করেছিলেন। হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরে ১১১ বছর আগে এসে শ্রীরামকৃষ্ণকে পুজো করতে গিয়ে মন্ত্র বললেন -" শ্রীরামকৃষ্ণায় তে নয়:..।"
■ স্বামীজি জরথ্রুষ্টের মতবাদ ভালো করে জেনে ছিলেন । তাই ভারতীয় ঋষির সনাতন ধ্যানচিন্তা কে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আহুরা মাজদা সম্প্রদায়ের মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কারণে খুঁজতে তাদের ধ্যানমগ্নতায় আরও বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। কখনই ভারতবর্ষের আধ্যাত্মিক চিন্তা চেতনাকে তিনি খারাপ বলেননি অথচ সেখানে তিনি নিজেকে কখনও বিকিয়েও দেননি।
প্রতিটি ভারতবাসীকে ভাইয়ের মতো ভেবে সম্বোধনে বলেছিলেন -"ওঠো জাগো...।" তাইতো তিনি আমাদের কাছে স্বামী বিবেকানন্দের মতো
এক পরম দয়াময় দৃঢ়চেতা ভাবগম্ভীর মানবপূজারী হতে পেরেছেন। তিনি তো নিজে
দেখেছেন তার গুরুদেব,( লোকেরা তাকে পাগলঠাকুরও ভালোবেসে বলেছেন) তাকে
বার বার বলেছেন--" যা না যা... মায়ের কাছে
যানা একবারটি...এ বারও পারলি নে...যা যা।"
■ সত্যি তো শ্রীরামকৃষ্ণ তো মন্ত্রপড়া, ঘন্টা বাজানো,চামরদোলানো কোনো সাধারণ পুরুত ছিলেন না। কেশবচন্দ্র সেন, বিদ্যাসাগর কেউ তো তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাননি এমন তো নয়।
স্বামীজি যখন ভ্যাঙ্কুভারে তখন জামসেদজি টাটার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। ওই একই জাহাজে
স্বামীজি যখন প্রথম আমেরিকা যাচ্ছিলেন। পারস্য উপসাগরীয় আহুরা-মাজদার উপাশকদের আগুনের সামনে উপাসনার মধ্যে দিয়ে যে জীবনের শুদ্ধতা খুঁজে পাওয়া যায় সেই ধর্মের উৎসাহ থেকে তিনি যে বেলুড় মঠের ধ্যানমগ্নতা খুঁজে পেয়েছিলেন সে কথা ভাবলে ক্ষতি কি ? বেলুড়ের অলঙ্কার নক্সায় মোটিফে পার্সি,খ্রিষ্টান, মুসলিম, হিন্দু,বৌদ্ধরীতি অবলম্বন করা হয়েছে । শ্রীরামকৃষ্ণের যত মত তত পথকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করে দিয়েছিলেন । বলেছিলেন - শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী আমাকে প্রচার করতেই হবে।
যৌবনে ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে প্রভাবিত নরেন্দ্রনাথ, মূর্তি পুজোকে পৌত্তলিক জ্ঞান করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণের উদার এবং সমন্বয়ী
চিন্তার সঙ্গে "কালীঘরে যাওয়া " শক্তিকে
প্রাধান্য দেওয়া নরেন্দ্রর চোখে বিসদৃশ্য
লাগতো। তরুণ,সংশয়ী, নরেন্দ্রনাথের এই
ভাব বেশি দিন টিকে ছিল না।
■ ১৮৮৮ সালে তিনি নিজ শিষ্য সদানন্দকে বলেছিলেন - " আমার জীবনে একটা মস্ত বড় ব্রত আছে। এ ব্রত পরিপূর্ণ করার আদেশ আমি গুরুর
কাছে পেয়েছি ---আর সেটা হচ্ছে মাতৃভূমিকে
পুনরুজ্জীবিত করা । " শ্রীশ্রী মা একদিন গল্পছলে
এক শিষ্যকে বলেছিলেন -" যা সব শুনছি, সাহেব পুলিশরা এসে একদিন না একদিন নরেনকে গারদে পুরে দেয় । " এ থেকে প্রমাণিত হয় স্বামীজির কাছে বিপ্লবীরা আসতেন পরামর্শের
জন্য। বিবেকানন্দের আয়ুষ্কাল রবীন্দ্রনাথের অর্ধেক মাত্র। বিবেকানন্দ নবীন ভারতবর্ষের কোনো বিষয় ও সংঘাত দেখে যেতে পারেননি তাই
রবীন্দ্রনাথ যতটা পেরেছেন স্বামীজি ততটা করে
যেতেও পারেননি । তাছাড়া স্বামীজির বিপ্লববাদ
ছিল শুধুই মানুষের চরিত্র গঠনের । ধর্ম, শিক্ষা, ও ক্ষুধা সম্পর্কে নিশ্চিত দিগদর্শনের নির্দেশ ।
জার্মান দার্শনিক ফ্রেডরিক নিটশের -" দাজ স্পেক জরাথ্রুষ্ট " বইয়ে এক সন্তপ্রতিম মানুষের বর্ণনা আছে । বিজন পর্বতে তিনি দশবছর স্ব-নির্বাসিনে ছিলেন গভীর ধ্যানে। তারপর তিনি জনপদে এসেছিলেন মানুষকে তার কথা বলতে । সেই জরথ্রুষ্টের ধর্মীয় মতবাদের প্রথমে আছে মহিলাদের অগ্রাধিকার । " যত্র নার্যস্ত পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতা ।" যেখানে নারী সম্মান পান, সেখানে দেবতার অবস্থান ।" স্বামী বিবেকানন্দও দেখলেন তাঁর সময়ে নারীরা সমাজে অবহেলিত ,
বঞ্চিত ও অত্যাচারিত । গভীর দুঃখে ও যন্ত্রণায় বিবেকানন্দ ,তিনি বললেন, ভগবানের প্রতিমা স্বরূপা নারী এখন শুধুমাত্র সন্তান ধারণের যন্ত্রে পরিণত। নারীকে তার শিক্ষা ও স্বাধীনতার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। যতক্ষণ তা সম্ভব হবে না, ততক্ষণ জাতি হিসেবে আমরা উঠে দাঁড়াতে পারবোনা ।" বিবেকানন্দ বললেন-" নারীকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে ।" স্বামীজি শিক্ষার সঙ্গে চরিত্র গঠনের কথা বলতেন । সার্বিক
ব্যক্তিত্বের বিকাশ চেয়েছিলেন স্বামীজি। এইখানে রাজা রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের কাছে সমগ্র নারীজাতি ও বাঙালিরা চিরঋণী। পরবর্তীকালে নারী সমাজের যে অগ্রগতি হয়েছে, সেদিন এই দুই মহারথী পাশে এসে না দাঁড়ালে তা কোনোভাবেই সম্ভব ছিলনা। এই প্রসঙ্গে শ্রীমার সঙ্গে বিবেকানন্দের একটি সম্পর্কের কথা বলি।বিবেকানন্দ তাঁর অনুকরণীয় ভাষায় বলেছেন--
শ্রীরামকৃষ্ণ থাকুন বা যান ক্ষতি নেই, কিন্তু মা ঠাকরণ না থাকলে সর্বনাশ, তিনি শক্তির আধার । মাঝেমধ্যেই তিনি গুরুভাইদের বলছেন, "তোরা মাকে চিনতে পারিসনি। মাকে চিনতে চেষ্টা কর । "সুভাষচন্দ্রের সম্পর্কেও একই কথা খাটে , সুভাষচন্দ্র তার জীবনে নারীর গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কথা বলতে গিয়ে,মা প্রভাবতীদেবী ও দেশবন্ধু-পত্নী বাসন্তী দেবী,মেজ-বউদিদি বিভাবতীদেবী ও পত্নী এমিলিয়রের কিছু ত্যাগ ও গুণের কথা বলেছিলেন। স্বামীজি আবার একথাও ভেবেছিলেন যদি নারীরা সংসার ত্যাগ করে
সন্ন্যাসীনী হতে চান সে অধিকারও তাদের দিতে হবে। সেই দিশা খুঁজে দিয়েছিলেন স্বামীজি নিজেই । এত অল্প সময়ের মধ্যে স্বামীজির দৃষ্টি ছিল সবদিকে। তিনি বলেছেন-" আমরা নির্বোধের মতো,জড় সভ্যতার বিরুদ্ধে চিৎকার করিতেছি...
বাহ্য সভ্যতা আবশ্যক , যাহাতে গরীব লোকের
জন্য নূতন নূতন কাজের সৃষ্টি হয়। অন্ন ! অন্ন!
যে ভগবান আমাকে অন্ন দিতে পারেন না,
তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত সুখে রাখিবেন--ইহা
আমি বিশ্বাস করিনা ।" এমনকি রাজনীতিকেও তিনি ছেড়ে দেননি-" এই ঘোর দুর্ভিক্ষ , বন্যা রোগ-মহামারীর দিনে কংগ্রেসওয়ালারা কে কোথায় বলো ? খালি আমাদের হাতে শাসনের ভার দাও, বললে কি চলে ? মানুষ কাজ যদি করে তাকে কি মুখ ফুটে বলতে হয় ? " যা আজ হবে যা হতে যাচ্ছে দেখা যাবে অল্প সময়ের মধ্যেই স্বামীজি সব বলে গেছেন । ( কেউ যেন এই প্রসঙ্গে ভারতীয় রাজনীতি না জুড়ে দেন, কংগ্রেসর তৎকালীন অবস্থার প্রেক্ষিতে স্বামীজি ওইসব বলেছিলেন)। তিনি বলেছেন শিক্ষা অর্জনের অধিকার সকলেরই থাকা উচিত। আর শিক্ষিত
না হওয়ার জন্য তিনি আত্মজিজ্ঞাসা করেছেন , এই জন্য কে দায়ী ? উত্তর দিয়েছেন নিজেই, বলেছেন -" ইংরাজরা দায়ী নয় , আমরাই
দায়ী।" স্বামীজী সবথেকে জোর দিয়েছেন
শিক্ষার অধিকারের উপর যা আমরা ২০০৯ -এ
এসে বুঝতে পেরেছি । স্বামীজিই বলেছেন
- "দরিদ্র বালক যদি শিক্ষালয়ে আসিতে না পারে তবে শিক্ষাকেই তার কাছে পৌঁছাতে হবে ।"
স্বামীজির কথা কখনো কখনো ঝাঁঝালো হয়েছে
যা এখনকার দিনে তার মূল্যায়ণ অমর হয়ে
আছে বলা যেতে পারে -" দিবারাত্রি ভন্ডামি,
মিথ্যাচার ও প্রতারণার জীবন যাপন কর--
তোমার ক্ষতগুলি যতদূর পারো ঢাকিয়া
রাখো । তালির উপর তালি দাও , শেষে
প্রকৃত জিনিসটিই যেন নষ্ট হইয়া যায় , আর
তুমি কেবল একটি জোড়াতালির সমষ্টিতে
পরিণত হও । "
■আজ থেকে ১২৭ বছর আগে ১৮৯৩ সালের ৩১ মে স্বামীজি আজকের মুম্বাই থেকে জাহাজে উঠেছিলেন। মাদুরাইয়ের রাজার ইচ্ছেতেই স্বামীজি খানিকটা আমেরিকা যেতে সাহস পান। জাহাজের ভাড়া উঠলেও কীভাবে কী করবেন স্বামীজি কিছুই জানতেন না। আসলে স্বামীজি খানিকটা সরল প্রকৃতির ছিলেন, সে কারণে জীবনে তাঁকে ঠকতেও হয় এবং আমেরিকায়
প্রভূত শত্রুতায় মধ্যে গিয়ে তাঁকে পড়তেও হয়েছিল। প্রধানত পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের উদ্যোগেই তিনি সেখানে যেতে পেরেছিলেন। স্বামীজির আমেরিকা বক্তৃতা প্রসঙ্গে ও আমেরিকা প্রসঙ্গে এসে আমি এখানে --রামেশ্বরমের কিছু
কথা বলবো কারণ তখনকার দিনে দক্ষিণের মানুষের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তার কথা একটু বলে নেওয়া দরকার। মা সারদা মোটামুটি ভারতের ধর্মীয় স্থানগুলি ভ্রমণ করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্যদের জন্য। মা সারদা দীর্ঘদিন ধরেই রামেশ্বরমে যেতে চাইতেন স্বামীজির গুরু ভাইদের কাছে। কারণ তিনি শুনেছিলেন ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় রামেশ্বরমে গিয়েছিলেন এবং সেখানকার রামশিলাই কামারপুকুরে পূজিত হয়ে থাকে । শ্রীশ্রীমায়ের মাদুরাই ভ্রমণ সে সময় দ্য হিন্দু পত্রিকা বিষদে লিখেছিল (১৯১০-১১) । যাইহোক স্বামীজি আমেরিকা থেকে ফিরে শ্রীলঙ্কা
হয়ে রামশ্বরমের যে পামবাম দ্বীপে প্রথম পা রেখেছিলেন সেখানে মা, মাদুরাই থেকে স্টিমারে গিয়ে নামেন। এখানেই স্বামীজি ফিরে এসে ভারতবর্ষে নেমে প্রথম বক্তৃতাটি করেন এবং তা ছিল অগ্নিবর্ষী ভাষায়। বর্তমানে রামশ্বরম মিউনিসিপ্যালিটি কয়েকটি রাস্তা স্বামীজির নামে পরে প্রচলিত করে এবং সেখানে স্বামীজির মূর্তিরও রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে তারা। সেখানে আজ শ্রীরামকৃষ্ণ মঠও হয়েছে তবে সেটি রামকৃষ্ণ মিশন দ্বারা পরিচালিত নয়। থাকার ব্যবস্থাও আছে । সকলেই জানেন রামেশ্বরম আসলে কিন্তু শিবের মন্দির। এই মন্দির তিনটি দালানে বিভক্ত ও ভারতে অদ্বিতীয়। প্রায় প্রতিদিনই শিবলিঙ্গে
বেশ কিছু সোনাদানা পড়ে ভক্তদের কাছ থেকে। এখানে শ্রীশ্রীমায়ের একটি বাক্য আজও মনে রাখার মতো,তিনি বলেছিলেন -" যেমনটি রেখে গিয়েছিলুম তেমনটি আছে ।" সঙ্গের ভক্তরা তা শুনেছিলেন। তিনি যে শ্রীরামকৃষ্ণের কথাই বলতে ছেয়েছিলেন তা কারও অজানা নয় । পামবাম দ্বীপ ও ওই মন্দির রামনাদের রাজা ভাস্কর সেতুপতির অধীনে ছিল আর ওই রাজা ছিলেন স্বামীজির মন্ত্রশিষ্য যিনি স্বামীজিকে আমেরিকা যাওয়ার জাহাজ খরচ দিয়েছিলেন। শ্রীশ্রীমা গেলে রাজা
টেলিগ্রাম করে মন্দির কর্তৃপক্ষকে বলেছিলেন,-
" আমার গুরুর গুরু পরম গুরু মা সারদা যাচ্ছেন, তাঁর থাকার ও গর্ভগৃহে প্রবেশের সব ব্যবস্থা করতে হবে এবং মা যদি দান সামগ্রী থেকে (সোনার হাজার হাজার উট ঘোড়া হাতী পশু পাখি রথ পালকি হার আংটি চূড় বালা মণিমুক্ত হীরা জহরত) কিছু দয়াবশত নিতে চান তাও তাঁকে উপহার দিতে হবে।" যে ঘর কাউকে খুলে দেখানোর নিয়ম ছিলনা। সেই ঘরে মা প্রবেশ করে অবাক হলেও তার চোখে মুখে নির্লোভ ভাব ফুটে
ওঠে এবং তিনি কোথাও কিছু স্পর্শ করে দেখতে চাননি,নিতে চাননি। শ্রীরামকৃষ্ণ ওখানে শিবমূর্তিতে বিরাজমান বলে তো মাও অদ্ভূতভাবে বিশ্বাস করেছিলেন। স্বামীজি বলেছিলেন - " তুমি শিব তুমি শক্তি নারায়ণ তুমি/ তুমি রাম তুমি কৃষ্ণ অখিলের স্বামী ।" ১৮৩৬ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৮৬৩ ( সংখ্যার মজাটি ও ম্যাজিক লক্ষ করার মতো) সালে এসেছিলেন নরেন্দ্রনাথ। ১৮ বছর বয়সে তিনি ব্রাহ্ম। নরেন তার্কিক, যুক্তিবাদী। গুরু শিষ্যের দুজনের জীবন
যেন এক গভীর রহস্যময়তার আবরণে ঢাকা। একে বলা হয় " লস অফ্ আইডেন্টিটি । " একজন গেঁয়ো বিদ্যালয় শিক্ষাহীন মানুষ শুনে শুনে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ বেদ বেদান্ত গুলে খেয়ে নিয়েছেন। সহজ কথায় এমন যুক্তি দেন যে মেধায় আঘাত করে। কিন্তু মা কালী তার সঙ্গে রয়েছেন। মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী হয়েও কখনও মা কালীর বদলে নিজের মাথায় ফুল দেন। চরিত্র সম্পূর্ণ রহস্যময় ,তাঁকে বিচার করা অসম্ভব। অন্যজন সুপুরুষ , শিক্ষিত ভারতীয় ও ইউরোপীয় দর্শনে হাবুডুবু খান, পাহাড়ের মতো ব্যক্তিত্ব । মূর্তি পূজো মানেন না অদৈতবাদের একনিষ্ঠ প্রচারক। দুজনেই গান ভালোবাসেন। দুজনেই খেতে ভালোবাসেন। একজন গান শুনতে একজন গান গাইতে চান। নরেন্দ্রনাথ যাকে বলেছিলেন-ধর্মোন্মাদ, অপ্রকৃতিস্থ তাঁর হাতের ছোঁয়াতেই তার নিজের চৈতন্য উদয় ও আত্মদর্শন হয়েছিল শেষে। ঠাকুর বলেছিলেন আমি ম্যাদামারা ভক্ত পছন্দ করিনা, ফ্যাসফ্যাসে ফলারের মতো ব্যক্তিত্ব চাইনা। যুক্তিবাদী কেশবচন্দ্রের কথা বলতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ শুনিয়েছিলেন , " কেশবের একটা শক্তি তাতেই এত , তোর আঠারোটা শক্তি আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ ১৮০০ খৃষ্টাব্দের ১৮৩৬ আর ১৮৬৩ - র এই সংখ্যাতত্ত্বটি সম্যক বুঝেছিলেন। ১৮৩৬-এ বৃটিশরা এদেশে শিক্ষানীতি চালু করেছিলেন মেকলে সাহেবের সৌজন্যে। কী অসামান্য যুগের যোগাযোগ ! ৫ বছর পর গদাধর ১৮৪০ সালে গিয়েছিলেন পাঠশালায় এবং- "যে বিদ্যে শিক্ষেয় শ্রাদ্ধ করাতে আর চাল কলা বেঁধে আনতে হবে সে শিক্ষেয় তার কাজ নেই ।" এহেন গুরুবাণী ও তার মন্ত্র নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া সহজ কিন্তু কীভাবে পাবেন সেখানে পাত্তা ১২৭-বছর আগে প্রচন্ড ঠান্ডায় ঠিকানা লেখা কাগজটা স্বামীজি হারিয়ে ফেললেন। ফুটপাতে কোনরকমে কুঁকড়ে সারারাত
পথ কুকুরের সঙ্গে। আর ঘুম ভেঙ্গেই আমেরিকাবাসী এক অপরিচিত মেমসাহেব দেখতে পেলেন! একি ? একজন মানুষ এইভাবে শুয়ে আছেন ? আশ্রয় পেলেন মহানুভব সেই আমেরিকান ধর্মপ্রাণা মেমসাহেবের কাছে। এক কথায় এই যোগাযোগ অসম্ভব।
■ নরেন্দ্রনাথ আমেরিকায় গিয়ে পড়লেন অকূল সাগরে যখন বুঝলেন যে তিনি কোনও প্রাচীন ধর্মমত সংগঠনের এমনকি মিশনেরও প্রতিনিধি নন। ভারতবর্ষের কোনও মন্দির মসজিদ চার্চ তাকে প্রতিনিধিও করেনি। কিন্তু তিনি জানতেন শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কথা। ঠাকুর তার আশ্চর্য দর্শনের কথা বলছেন তাঁর শিষ্যদের কাছে -" আশ্চর্য দর্শন সব হয়েছে। অখন্ড সচ্চিদানন্দ
দর্শন। তার ভিতর দেখেছি, মাঝে বেড়া দেওয়া
দুই থাক। একধারে কেদার, চুনি আর ,আর অনেক সাকারবাদী ভক্ত আর বেড়ার একধারে
টকটকে লাল সুরকির কাঁড়ির মতো জ্যোতি:। তার মধ্যে বসে নরেন্দ্র --সমাধিস্থ । না নরেন্দ্রনাথকে এইসব শ্রীরামকৃষ্ণ বলেননি ,বলেছিলেন শিষ্যদের কাছে। কারণ স্বামীজি শ্রীরামকৃষ্ণের স্পর্শে তখন অজ্ঞানপ্রায়।
■ আবার ফিরে আসি স্বামীজির আমেরিকা যাত্রার পূর্বাপরে । তাঁর ইচ্ছে শক্তি ছিল প্রবল । জাহাজপথে চীন জাপান ও কানাডায় তিনি নেমেছিলেন যেতে যেতে। কানাডা থেকে পরে ট্রেনে চিকাগোতে পৌঁছে বুঝতে পারলেন যে পৃথিবীর প্রথম ধর্মসভায় তিনি কোনো দেশের প্রতিনিধি নন । কোনো স্পনশরও তার নেই যে এইরকম ধর্ম মহাসমাবেশে তিনি প্রবেশাধিকার পাবেন। আমেরিকাও তার কাছে নিতান্তই অচেনা । তিনি (১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছিল ধর্ম মহাসভার সম্মেলন মোট ১৭ দিন ) তার বেশ কয়েকদিন আগেই সেখানে পৌঁছেছিলেন। খরচ বাঁচানোর জন্য তিনি বস্টনে থাকার সিদ্ধান্ত নেন । স্বামীজি আমেরিকা যাওয়ার পর জানতে পারলেন যে তার কাছে ওই মহা সম্মেলনে ঢোকার জন্য কোনো ডেলিগেট পাশ নেই। বক্তৃতা করা তো বহু দূরের ব্যাপার, প্রবেশাধিকার পর্যন্ত পাবেন না। তখন তিনি হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের কাছে যান। সকলে যখন তাকে দেশে ফিরে আসার কথা বলছেন, তখন তিনি মনে প্রবল জোর নিয়ে মনে মনে স্থির করেন এসেছেন যখন যাহোক একটা হবেই। তখনও ১১ সেপ্টেম্বর আসতে দেরি আছে । সাহসে ভর করে রাইটের কাছে যান তিনি। রাইট সাহেব স্বামীজিকে হার্ভার্ডে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেন , কারণ তিনি বুঝতে পারেন এই যোগী মানুষটির ভিতর কিছু এমন আছে যা অন্যদের মধ্যে নেই। এই সময় অর্থ থেকে থাকা খাওয়া এইসব কারণে সবেতেই তাঁর শোচনীয় অবস্থা। এক গরীব দেশের অচেনা ভিখিরি হয়ে তাকে নানা সমস্যার মধ্যে থাকতে হয়েছে। মূল সমস্যা তার সম্মেলনে প্রবেশাধিকার কীভাবে হবে। অবশেষে তিনি নিজের যোগ্যতায় অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জোগাড় করলেন মহাসম্মেলনের প্রবেশপত্র। এই বক্তৃতায় মূল তিনটি বিষয়ে স্বামীজি সবাইকে ছাপিয়ে যান। এক সাত হাজার মানুষের সমাবেশে দু মিনিট যাবদ হাততালিতে সমাবেশ ডুবে যায়। তার সেই কথা -আমেরিকাবাসী আমার ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ। আসলে স্বামীজির ডেলিগেট তখনও মজবুত হয়নি। সভার শুরুতে কম বিবেচনার মধ্যে যেহেতু তিনি পড়েন তাই তাকেই তিন চারজনের পরই ডাকা হয়। এমন মানুষরাই বক্তব্য প্রথম দিকে রাখা হয়। যারা খুব কমজোরি। স্বামীজির সেই হিসেবে বলতে ওঠেন বেলা তিনটার পরে। কী বিষয় নিয়ে বললে তিনি ভারতের ধর্ম তাঁর যোগদানের উদ্দেশ্যে এবং সঙ্গে সঙ্গে তেমনি খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের যে পৃথিবী ব্যাপী তখন অহংকারের প্রদর্শন চলছে তাকেও অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে ব্যাখ্যা করাও জরুরি বলে মনে করে দিয়েছিলেন রাইট সাহেবও । এই কথাটা স্বামীজির মনে ধরেও ছিল আগেই।
■ তাই তিনি জরথ্রুষ্টবাদীদের ভারতে আশ্রয় দেওয়া দিয়ে মূল বক্তব্য শুরু করেন। সারা পৃথিবীর ধর্মকে আশ্রয় দেওয়ার কথা তিনি বলেছিলেন। আর তিনি কুয়োর ব্যাঙ ও সাগরের ব্যাঙের গল্পটা উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন। কানাডার ভ্যানকুভারে ইতিমধ্যে জরথ্রুষ্টবাদী জামেসদি টাটার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। ধীরে ধীরে ১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর অনেক ধর্মীয় আলোচকদের মতামত চুলচেরা অনুভূতি আর আলোচনা আর তেমন পাত্তা পেলনা । ২৭ সেপ্টেম্বর শেষ দিন ঘুরে ফিরে স্বামীজির বাণীই উচ্চারিত হতে থাকলো। বিভিন্ন ট্যাবলয়েডে স্বামীজির " আমেরিকার ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ" তখন তোলপাড় করছে সারা বিশ্বকে। আসলে যখন
১১ সেপ্টেম্বর তাঁকে বক্তৃতা করতে ডাকা হয় তখন পর্যন্ত তার পরিচয় হয়েছে মাত্র চারজনের সঙ্গে। কিন্তু তিনি প্রস্তুত ছিলেন না মোটেই প্রথম দিনেই বলতে। তবুও বলতে উঠবার আগে মা সরস্বতীকেই একমাত্র তিনি ভেবেছিলেন। তিনি প্রার্থনা করেছিলেন যেন গুছিয়ে বলতে পারেন। বলতে উঠে স্বামীজির সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। খ্রিস্টানদের দেশে বসে কুয়োর ব্যাঙের গল্পটা তিনি যে দুর্দান্তভাবে পরিবেশ করে ভারতীয় ধর্মীয় চিন্তা চেতনাকে তিনি যেভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন তা আসলে রবীন্দ্রনাথের ভারততীর্থ কবিতার সাথে আজ মিলে যায়। নাকি রবীন্দ্রনাথ এই ভাবনা স্বামীজির কাছ থেকে পেয়েছিলেন সে প্রসঙ্গ এখানে থাক। ২৭ তারিখের পর যে কদিন আমেরিকায় তিনি ছিলেন সকলেই তার জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা শুনতে চাইছিলেন। এতে তার কিছু উপার্জন হতো। তারপর তারও বেশ কয়েকমাস পর তিনি কলম্বোয় জাহাজ থেকে নেমে ছিলেন । প্রকৃতপক্ষে স্বামীজি তখন অসুস্থ । সেখান থেকে নৌকো করে একবেলা কাটিয়ে রামেশ্বরমে এসেছিলেন। রাজা কিছুতেই নৌকো থেকে স্বামীজিকে নামতে দিতে চাননা। ইতিমধ্যে সেখানে বজরা করে রাজার পৌঁছতে, তিন ঘণ্টা লেগেছে। স্বামীজী নৌকোয় ঠায় তিনঘন্টা আটকে। রাজা না পৌঁছলে কেউ স্বামীজিকে নামতে দিতে চান না। তাছাড়া জায়গায় জায়গায় স্বামীজি বলবেন তার জন্য মঞ্চ হয়েছে। সেইসব রাজা ছাড়া আর কেউ তেমন জানেন না। তিন হাজার মানুষের জমায়েত সাগর তীরে। রাজার ইচ্ছে স্বামীজি প্রথম পা ফেলুন রাজার ডান হাতে, তার পর মাটিতে। দুজনেই অনড় নিজের নিজের মতে। স্বামীজি শেষে রাজাকে বোঝালেন, যে রাজার পেছনে, পাড়ে প্রায় কয়েক হাজার প্রজার সামনে রাজাকে এই অপমান ( শাস্তি ) স্বামীজি দিতে পারবেন না।
তিনি একজন রাজার হাতে তাঁর পা রাখতে অপারগ। এটা রাজাকে এক প্রকার অপমানই করা হবে। শেষে রাজার হাত ধরে স্বামীজি নেমেছিলেন । স্বামীজি নেমে ঐতিহাসিক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ইংরেজি আমলে ভারতবর্ষের প্রথম
বিশ্বজয়। কিন্তু স্বামীজি অসুস্থ। আমেরিকায় ও জায়গায় জায়গায় বহু বক্তৃতা দিয়েছেন ওখানে শুধুমাত্র নিজের থাকার খরচ চালাতে। তার ওপর অন্যরকম খাদ্য যা দীর্ঘ দিন বাঙালির মুখে রুচবে না তার ওপর শীত । স্বামীজির ঘুমে চোখ ঢুলে
আসছে। ১০/১২ জায়গায় বক্তৃতা করার কথা ছিল। স্বামীজি বড় জোর ১/২ মঞ্চে উঠলেন। চার পাঁচ দিন পরে তিনি এলেন মাদ্রাজে। তাঁকে ঘোড়ায় টানা রথে করে ট্রেন থেকে শহরে রাখার কথা। মাদ্রাজিরা ঘোড়ার গাড়ি থেকে ঘোড়া খুলে দিয়ে যুবকরা নিজেরাই টানলো সেই রথ । দুদিনের ট্রেন এলো চারদিন পরে কলকাতায়। পথে স্টেশনে স্টেশনে কাতারে কাতারে লোক। সবাই চান স্বামীজি সেখানে নামুন প্রতিটি জায়গায় সেই ব্যবস্থা। কিন্তু স্বামীজি নামতে পারেননি শরীরের জন্য। ট্রেনে শিয়ালদা নামতে নামতে এখানেও পৌঁছলো সে খবর। এখানেও শিয়ালদা থেকে রথে করে ছেলেরা টানলো স্বামীজিকে বসিয়ে রেখে গতকাল ছিল ১১.৯.১৯ সেই দিনের ১২৭ বছর গেছে। এখন সেখানে মিচিগানের ওই জায়গায় হলটি স্বামীজির নামে উৎসর্গিত করা হয়েছে। সামনের রাস্তাটি স্বামীজির নামে। একটি মূর্তিও আছে সেখানে। জয়তু স্বামীজি।
■©® অলোক কুন্ডু