বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০

ক্ষুধিত পাষাণ ও চারুলতা

⛔ তফাৎ যাও... সব ঝুট হ্যায়। হ্যাঁ "ক্ষুধিত পাষাণ"- এর থেকেও তখন এই উচ্চারণে বাজার মাতোয়ারা। যারা দেখে ফেলেছেন অথচ মেহের আলী পড়েননি তারাও ততদিনে ক্ষুধিত পাষাণ জেনে গেছেন। তাই জনগণের কাছে সৌমিত্রর পরিচিতি হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ক্ষুধিত পাষাণ এর সরকারি কর্মচারী দিয়েই। কারণ অপুর সংসার তখনও সকলের দেখা হয়ে ওঠেনি।

•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, " আমি মাণিকদার আবিষ্কার। আসলে সৌমিত্র যখন জানতে পারলেন যে সত্যজিৎ রায় 'অপরাজিত' করছেন, তখনই তার প্রথম সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছা জাগে এবং এক বন্ধুর বন্ধুকে ধরে সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি গিয়ে দেখাও করেন। কিন্তু সৌমিত্র তখন সেই অপুর থেকে একটু লম্বা হয়ে যাওয়াতে ও বয়স বেশি হওয়ায় সৌমিত্রকে সেটাও জানিয়ে দেন, সত্যজিৎ রায়। তাই সেই সময় তার চান্স হয়নি। কিন্তু অপুর সংসার করার আগেই সত্যজিৎ রায় ডেকে পাঠান সৌমিত্রকে। অপুর সংসারের সাফল্যের পর সৌমিত্র ভেবেই ছিলেন সিনেমাকেই পেশা করবেন, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তো ডাক আসেনি, তাছাড়া এতদিন তো নাটক ও শিশির ভাদুড়ীর কাছে যাতায়াত করেছেন সৌমিত্র এবং নানা জায়গায় নাটকের মঞ্চে চান্স কীভাবে পাওয়া যায় সেই দিকেই বেশি নজর দিয়েছেন। জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার সময় তার চলে যাচ্ছে, বিস্তর টানাপোড়েন তখন।

•চারুলতাকে নিয়ে সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুজনকেই সাংবাদিকরা বহুবার, বহু রকম প্রশ্ন করেছেন। সৌমিত্র বলেছেন চারুলতা বিশ্বের একটা শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, এমনকি মাণিকদার কাছেও চারুলতা, তাঁর প্রিয় ছবি। সৌমিত্রর দ্বিতীয় ছবি ক্ষুদিত পাষাণ তপন সিংহর সঙ্গে। সত্যজিৎ রায় তপন সিংহ দুজনকেই সৌমিত্র ভীষণ সম্মান করতেন সেটা সকলেই জানেন। ক্ষুধিত পাষাণ, যেহেতু চেনা ও বিখ্যাত গল্প, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই নেওয়া তাই সৌমিত্রর তো পড়াই ছিল। তপন সিংহ ডাকতেও সঙ্গে সঙ্গে তবুও কথা দেননি। যদিও সৌমিত্র জানতেন, তপন সিংহ বাংলা ছায়াছবির তখন একজন বড় বাণিজ্যিক সফল পরিচালক এবং হাবিজাবি ছবি করেন না, তাছাড়া বহু নবাগতকে সুযোগ দিয়েছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে সৌমিত্র তো সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করে বুঝে ফেলেছেন কি ধরনের কাজের সিস্টেম, অভিনয় শেখানো কোন স্তরের, মোদ্দা কথা সৌমিত্রও আশা করছেন যে চান্স পেলে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে আবার একবার যদি চান্স পাওয়া যায়, তবেই তার ফেম হবে। ঠিক এই সময়টাতেই সিনেমাকে পেশা হিসেবে গ্রহণের দিগদর্শনও খুলে যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। মনের মধ্যে আলোড়ন হতে থাকে, কি করবেন তিনি। মানিকদাকে কীভাবে জানাবেন। সত্যি কি ক্ষুধিত পাষাণে তিনি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন ? এই দুশ্চিন্তা নিয়ে তখন সত্যজিৎ রায়ের কাছ যান। সৌমিত্র জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তার পক্ষে ওই রোল করা উচিত হবে কিনা ? অর্থাৎ তিনি ক্ষুধিত পাষাণে সাচ্ছন্দ্য হতে পারবেন কিনা। তপন সিংহ ডাকার পর রীতিমতো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। জিজ্ঞেস করেছিলেন," মাণিকদা, আমার কি ছবিটা করা উচিত হবে? সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, " অবশ্যই উচিত হবে, একশো বার উচিত হবে। "

•সৌমিত্র বলেছেন, মাণিকদা বিচক্ষণ ব্যক্তিত্ব, অত্যন্ত বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির মূল্যায়ণ করেছিলেন। " সত্যজিৎ রায়ের উৎসাহেই সৌমিত্র তপন সিংহর কাছে কাজ করতে শাহস পেয়েছিলেন। যদিও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিয়ে গিয়ে, প্রথম প্রথম সৌমিত্রর, বাধো বাধো লাগতো সেটে। সৌমিত্র আবারও বলেছেন, তপন সিংহের সঙ্গে কাজ করে কিন্তু অনেক কিছু শিখেছি। পরে বুঝতে পারি মাণিকদা কেন জোর দিয়ে বলেছিলেন। পরে ঝিন্দের বন্দীতে, বিশেষ করে কীভাবে হাঁটাচলা করতে হবে তার বেশ কিছু ট্রেনিং নিতে হয়েছিল। ঘোড়ায় চড়া ও অসি শিক্ষাও নিতে হয়েছিল পরে। তপন সিংহ অভিনয় শিল্পটা ভালই জানতেন। নাট্যকার মন্মথ রায়ের নাটকটি হুবহু ফলো করেছিলেন তপন সিংহ। তপন দা সবসময় খুব সচেতন ভাবে সাধারণ দর্শকদের জন্য সিনেমা করতেন। কিন্তু ক্ষুধিত পাষাণ মুক্তির পর কাগজে বহুভাবে বিরূপ সমালোচনা, অনেক কটুবাক্য ও ব্যঙ্গোক্তি শোনা গেলেও সাধারণ পাবলিক ক্ষুধিত পাষাণ দেখতে ছাড়েননি। রবীন্দ্রনাথের কাহিনী নিয়ে ছবি বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়নি। কিন্তু ছবির সংগীত সৃষ্টিতে ছিলেন দিকপাল মানুষরা। উস্তাদ আলি আকবর খান। সহযোগিতায় ছিলেন, উস্তাদ আমির খান, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিখিল ব্যানার্জী, দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। তখনই 'যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে' রবীন্দ্র সঙ্গীত থেকে জনগণের গান হয়ে গেল। এই সময়ে রবীন্দ্র সংগীতের ফাংশনও বেড়ে যায়। নৈহাটির একটা জলসায় গিয়ে পৌঁছেছেন দেবব্রত বিশ্বাস ও দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়। সংগঠকদের জলসায় নিয়ম ছিল, যিনি আগে পৌঁছবেন তিনি আগে গাইবেন। দ্বিজেন দা আগে গেলেও, জর্জ দা বললেন, আগে আমি গামু, বলে জোর করে স্টেজে গিয়ে বসে পড়লেন। উনি সিনিয়র। দ্বিজেন দা খানিকটা থম মেরে গেছেন। দেবব্রত বিশ্বাস হারমোনিয়াম ধরে যা করেন না তাই করলেন সে-দিন। জনতাকে জিজ্ঞেস করলেন কোন গান তিনি গাইবেন? প্রায় একসঙ্গে সবাই চেঁচিয়ে, ' যে রাতে মোর। ' জর্জ দা তখন দুবার হারমোনিয়ামে যে রাতের সুর বাজিয়ে থামলেন। বললেন, " শুনেন, এইখানে উদ্যোক্তারা ঠিক করেছিল একডা জিনিস। যে আগে আইবেন, সে-ই আগে গাইবো। দ্বিজেনবাবু এইহ্যানে আগে আইছেন, ওঁরই আগে গাওনের কথা, কিন্তু আমি অঁরে এখানে বসতে দিই নাই। ক্যান দিই নাই হেইডা আপনাগো কই---আপনারা সক্কলে 'ক্ষুধিত পাষাণ' সিনেমাডা দ্যাখছেন, সেই সিনেমাডাটায় দ্বিজেনবাবু এত অসাধারণ গাইছেন যে সেই গান আমার আগে শোনালে আর আপনারা আমার গান শোনবেন না। " জর্জ দার অনুকরণীয় গলায় ওই কথার পর হাততালিতে ভরে গিয়েছিল জলসাস্থল। একই সঙ্গে জর্জ বিশ্বাসের মতো মানুষ, দ্বিজেনদাকে ও ছবিটাকে সম্মান জানিয়েছিলেন যা ভাবাই যায়না।

•তপন দার সঙ্গে ভূপাল ও রাজস্থানে আউটডোরে গিয়ে ইউনিটের সকলের মধ্যে যে বন্ধুত্ব হয়েছিল তা বহুকাল ভাঙেনি। এমনকি ক্যাম্পফায়ার পর্যন্ত হয়েছিল। ভূপালের যে বাড়িটা বাইরে থেকে সিনেমায় দেখান হয়েছিল তা আসলে একটা পুরনো বিখ্যাত মসজিদ। এই কারণে তখন ওখানকার ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তপন দা বহু আলোচনা করে সমস্যাটি মিটিয়ে ছিলেন। ভারতবর্ষের সম্প্রীতি এটাই বোধহয়। যারা গল্পটি পড়েছেন ও সিনেমাটি দেখেছেন তারা অন্তত বলবেন, সেই প্রাচীন স্থাপত্যের কতখানি প্রয়োজন ছিল ওই সিনেমায় ও রবীন্দ্রনাথের বর্ণনায়। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনের কয়েকদিন আগে ক্ষুধিত পাষাণের মুক্তি হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে মাণিকদার তিন কন্যাও, যেখানে রবীন্দ্রনাথের অপূর্ব, অমূল্য হয়েছিল। কেননা মাণিকদার ছিল নতুন ভাবে বিন্যাস করার প্রবণতা।কাদামাখামাখির দৃশ্যটা করতে গ্রামের লোকেরা জল ঢেলে ঢেলে "মালদা"তে কাদা করেছিল রাস্তা, টাকা খরচ করে জল ঢালাতে সমস্যা হয়েছিল কারণ বৃষ্টির অপেক্ষায় সময় চলে যাচ্ছিল। সিনেমার ভেতর কত যে গল্প থাকে যার শেষ নেই।

•১৯৬১-রবীন্দ্রনাথের শতবর্ষ। ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। সমাপ্তির মতো অত মিষ্টি প্রেমের সিনেমা বাংলাতে নেই বললেই চলে। তবে তিন কন্যার পোস্টমাস্টার ( ১৮৯১/১৯৬১) স্বর্ণখচিত একখন্ড হীরে। চারুলতা অর্থাৎ নষ্টনীড় তো কলেজে পড়া ছিল (১৯৬৪) কিন্তু মানিকদা কখনও হুবহু গল্প প্রোজেক্ট করে দেননি। পৃথিবীর বহু সিনেমা স্কুলে অবশ্যই পাঠ্য চারুলতা ও পথের পাঁচালী। যার কোনও কিছু বাদ দেওয়া যায় না। যদিও নষ্টনীড় রবীন্দ্রনাথের আত্মজীবনীমূলক লেখা। সিনেমার চারুলত হলো, আলোছায়ার মায়া।

( সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন সাক্ষাতকার ও লেখাকে সংগ্রহ করে এডিট করা। - অলোক কুন্ডু)
©® অলোক কুন্ডু। ২৭.১১.২০২০






বুধবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২০

অলোকের ঝর্নাধারায়

⛔ পুজোতে আমার কোনও জামাকাপড় খুব একটা হয়না। ছোটবেলায় যদি বা একটা প্যান্ট একটা জামা হতো তার যে কত দাম ছিল তা বুঝি এখন। বেশ মনে আছে এক এক বছর বাবা জামাকাপড় দিতে পারতেন না। অভাব ছিল আমাদের। তবে এখন বুঝতে পারি প্রতিদিন আমাদের সংসারে, এত জলখাবার, পরটা-আলুর দম, রবিবার রবিবার মাংস, প্রতিদিন চার পাঁচ রকম তরকারি দেওয়া ভাত এতসব খাওয়া দাওয়া করতে গিয়ে আমার বাবা-মা সংসার ঠিক প্ল্যান করে চালাতে পারতো না। কিন্তু মাসের মশলাপাতি আসতো পেল্লাই ঝাঁকামুটে করে, যেন বিয়ে বাড়ির ফর্দ। আমাদের মশলাপাতি কখনও মাসে দুবার আসতো না, ফুরিয়ে যেতনা। এখন ভাবি এত রকমের খাওয়া দাওয়া আজ পয়সা থেকেও আমাদের কিন্তু আর হয়না। কারণ এত রকম রান্না করতে যে কেউ আজ বিরক্তবোধ করবে। তখনকার দিনে উনুনে আর কেরোসিন স্টোভ মিলিয়ে মা একা কত রান্নায় সময় দিত। তারমধ্যে বাটনা বাটা কাপড় কাচা ঘর মোছা বিছানা ঝাড়া খেতে দেওয়া কত কি। সারাদিন উনুন জ্বলে দুপুর বাদ দিয়ে। তবে শনিবার শনিবার আমরা বাবা মা ভাই বোন সবাই মিলে হয় উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা নয় তো স্টারে, মিনার্ভায়, রঙমহলে, কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে নাটক দেখতে যেতাম। 
শীতে চিড়িয়াখানা, তারকেশ্বরের মন্দির, দক্ষিণশ্বর মন্দির দেখতে। শুধুমাত্র বাংলা সিনেমা নয়, হিন্দি সিনেমাও বিস্তর দেখতাম। শনিবার আমাদের লেখাপড়া একেবারে বন্ধ। আগেকার দিনে সিনেমার হলে গানের বই পাওয়া যেত সেগুলো আমার দিদির কাছে বহুকাল ছিল। কোথায় হারিয়ে ফেললো কে জানে ? এইসব করে পুজোতে আর আমাদের জামাকাপড় খুব একটা হতো না। 

•কিন্তু যেই কলেজে উঠে টিউশনি শুরু করলাম, জামাকাপড় পরা শুরু হলো আমার। ওই শখ একমাত্র করোনায় মাঠা মারা গেছে। তা না হলে জামাকাপড় রাখার আর আমার বাড়িতে জায়গা নেই। দক্ষিণ ভারত থেকে আনা দুটো পাঞ্জাবি এখন আলমারিতে পচছে। রায়নার গৌতম,সুশান্তরা দেখেছে আমি এক জামা প্যান্ট দ্বিতীয় দিন আর পরতাম না। গতবছর দুখানা প্যান্ট করালাম। যার অনেকগুলো করে পকেট। বিশেষ করে বাইরে গিয়ে ক্যামেরার অ্যাক্সেসারিজ ও মোবাইল,টাকাপয়সা,চাবি টিকিট, রুমাল,ওষুধ পত্র রাখার সুবিধার জন্য। এইসব ব্যাগে নিয়ে ঘোরাঘুরির বিপদ ও অসুবিধা দুই আছে। একবার সিমলা থেকে আসার সময় ব্যাগে টাকা, টিকিট ক্যামেরা রেস্টুরেন্টে ফেলে অনেক দূর ফেলে চলে এসেছিলাম, এখনও ভাবলে বুক উড়ে যায়। গত ১/১১/১৯ তারিখে করিয়েছিলাম। পরলাম ৬/১১/১৯ তারিখে। ওই প্যান্টটা ভাঙলাম যেদিন, বর্ধমানের গুইরে সন্দীপপ্রসন্ন চক্রবর্তী বাবুর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর নিমন্ত্রণ ছিল। ওইদিন রায়নার শ্যামসুন্দরেও গিয়েছিলাম একবার কারণ ওখানে আমার একটা ব্যাঙ্কের পুরনো অ্যাকাউন্ট ছিল।
প্যান্টটা ওইদিন পরার পর অপছন্দ হওয়ায় আবার খুলিয়ে সেলাই করালাম। দুবারে (৮০০+৫০০) ১৩০০/-টাকা মজুরি পড়ে গেল। বড়বাজারে যে দোকানে প্যান্টটা বানালাম এই মাসে গতবছর, তাদের ওস্তাগর মাস্টার খুব নামকরা। তাছাড়া বিদেশি মেশিনে সেলাই হয়। স্টিচ ও ফিনসিং দারুণ। প্যান্টের মজুরিও বেশ চড়া। অন্য যে কোনও জায়গার চেয়ে বেশি। আমাকে একটা অচেনা দোকানদার সন্ধান দিয়েছিল। সামনে দুটো ইনার পকেট সহ মোট পকেট সাতখানা হবে । তো আমার এই আব্দার নিয়ে গেলাম বড়বাজারে ২০৩/৪ ,মহাত্মা গান্ধী রোডস্থ দোকানে। একজন ননবেঙ্গলি ভদ্রলোককে পরতে দেখেছিলাম রাস্তায় ওইরকম প্যান্ট। বলেছিলেন দিল্লি থেকে তিনি কিনেছেন‌। অপরিচিত বেশি কথা রাস্তায় আর জিজ্ঞেস করা হ‌য়ে ওঠেনি । যাইহোক এ‌ঁকে ছক করে দেখিয়ে দিয়েছিলাম বড়বাজারে যে দোকানে করতে দিয়েছিলাম। ৮০০/-টাকা মজুরি কারণ সামনে দুটো এক্সট্রা ও দুটো ইনার পকেট। পরলে স্মার্ট লাগতেও পারে সেটা মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হলো
ট্রেনে-প্লেনে এইরকম পকেট রাখা যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত
ব্যাপার, সেফটি পারপাস । প্যান্টটা পরার আগে
এত‌টাই নিশ্চিত ছিলাম যে পরে আর দেখিনি এনে তুলেই রেখে দিয়েছিলাম । পরবার পর দেখলাম ঠিক মতো হয়নি । মনটা একটু খটমট করছিল । বর্ধমানে রায়নার শিক্ষক বাসুবাবুর বাড়িতে ( মিরছোবা) রাতে ছিলাম  গতবছর, সন্দীপপ্রসন্নবাবুর বাড়ি (গুইর) থেকে ফিরে এসে । বাসুবাবুর ২২/২৩ বছরের ছেলে রাজের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার প্যান্টটা নিয়ে। ও কিছু সংশোধন করলো। প্রথম পরেছিলাম সেইদিন আর দ্বিতীয়বার ১৭.৩.২০২০ সারান্ডায় ব্যস তারপর অভিশাপে পড়লাম। কোথাও আর যাওয়া হয়নি। প্যান্টের কাপড় একেবারে ১০০% কটন। একটা ১৬০ কাপড়ের (১৩০ লাগে ) দাম ১২০০/- মজুরি ৮০০/-নিয়ে প্রায়  ২০০০/- পড়লো,পরে আবার ৫০০/-। সঙ্গে ঊনিশ-বিশ রঙের আর একটা পিস‌ও কিনেছিলাম তখনই। বলেছিলাম একটা তৈরি করে যদি ভালো লাগে তো আর একটা তোমাকেই করতে দেব --হুবহু ডুপ্লিকেট আর একটাও হয়েছে। 

•বহুবছর আগে যখন কলেজে উঠে পুজোর সময় নিউ মার্কেটে সব বন্ধু মিলে প্যান্ট করাতে দিতে যেতাম এই নতুন প্যান্টটা করতে দিতে যাওয়ার সময় সেইসব পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে গেল। আর একটা ঘটনা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। আমাদের মধ্য হাওড়ার শ্রীরামকৃষ্ণ শিক্ষালয়ে বরাবরই একটা কড়াকড়ির মধ্যেই আমরা স্কুলে বড় হয়েছিল। আমি ওই স্কুলের ছাত্র। ক্লাস নাইনে প্রথম চুস প্যান্ট পরে স্কুলে গেছি। ওই প্যান্ট পরার জন্য মুকুলবাবু স্যার ( উনি দু বছর আগে হঠাৎ প্রয়াত হয়েছেন ) আমাকে বেঞ্চে উঠিয়ে মাপ
নিয়েছিলেন। আমার সেই প্যান্টের মুহুরির মাপ কত?
স্যারের নির্দেশে, তখন বোর্ডে আমার এক বন্ধু প্যান্ট এঁকে, লিখছে কোমর এত লম্বা এত মুহুরি এত। সারা ক্লাসের কাছে আমার তখন শ্রাদ্ধ হচ্ছে। এটাই শাসন পরে বুঝেছিলাম। সে লজ্জা অবশ্য এখন কবেই কেটে গেছে। তবে জামাকাপড়ে যে আমার একটু বেশি লোভ আর মায়া সে কথা স্বীকার না করে পারছি না। আমাদের পাড়ার ইস্ত্রি যে করে সে তো দেখা হলেই এখন বলে, "কি গো এইভাবে পেটে মারবে দাদা।" একবার রায়নার শ্যামসুন্দরে হাটতলায় ( ২০১২) একটা জামাকাপড়ের রেডিমেড দোকান হলো সবে। রায়না-১ এর শিক্ষাবন্ধু গৌতম সাহা বললো স্যার (দোকানের শো-কেসে সাজানো) জামাটা আপনাকে মানাবে। আমি বললাম গায়ে হলে কিনে নেব, তবে এখন পয়সা নেই, দিতে পারবো না । একটু পরেই দেখি কীরকম দেখার জন্য গৌতম হৈহৈ করতে করতে ওই জামাটা নিয়ে চলেই এসেছে। দোকানটা অফিসের জানলা থেকে দেখা যায়। গ্রামে দু-তিনটি ইন্সটলমেন্টে আকচার বিক্রি হয় জামাকাপড়। তাবলে আমিও ধারে কিনবো ?! কারণ রাস্তার দুধারে নমস্কার আর স্যার শুনতে শুনতে নিজেকে আরও সম্মান করতে শিখেছি বোধহয়। গৌতমের আনা জামাটা পরেই ফেললাম কারণ সেদিন শুক্রবার ছিল। মোটামুটি ওইদিন বাড়িতে যাই। সঙ্গে সঙ্গে পরেই ফেললাম দেখবার জন্য ফিট হলো কিনা এবং আমার মনে আছে জামাটা খুব ফিটিং হয়েছিল ( দোলের রঙ লেগে যাওয়ায় ওটা বাড়ির ঝাড়পোছে লেগে গেছে ) এবং সত্যি সত্যি তিনবারেই জামাটার দাম শোধ করেছিলাম। যদিও আমি রেডিমেডের একেবারেই খদ্দের ন‌ই । বেশ কয়েকবছর আমার পাড়ার টেলরের থেকেও বেশ কটি জামা প্যান্ট পাঞ্জাবি করিয়েছি। খুব খারাপ না করলেও আমার যেন খু‍ঁতখুঁত করতো। কোথায় টেলর পাই খুঁজতাম। কারণ আমি ফিটিং পছন্দ করি। তবে গতবারে চারটে পাঞ্জাবি ও দুটো প্যান্ট করতে দিয়ে দেখেছি কলকাতার টেলরের সত্যি কাজ ভালো। স্টিচ দেখলে হ্যাঁ মনে হবে প্রফেশনাল। ফিটিং দারুন। ছেলেদের টেলরদের প্রথম দোষ হচ্ছে, জামা বা পাঞ্জাবির হাতের ঝুল ৪/৫ ইঞ্চি বড় রাখবে। জামার কাটিং একটু ভি হ‌ওয়া দরকার অধিকাংশরা ড্রাম কাটিং করে অর্থাৎ জামার ঘের উপর নীচ সমান মাপ । ছাতি ও জামার নীচের ঘের সমান। অবশ্য অনেকে বলবেন ছেলেদের ভুঁড়ির জন্য ওটা করে। কিন্তু কলকাতায় জামা সেলাই করিয়ে এই প্রথম দেখলাম জামা একটু ভি কাটিং করেছে। তারপর অধিকাংশ টেলর জামার হাতের ঘেরের মাপ একটা অ্যাভারেজ মাপে করে ,অর্থাৎ লুজ 
করে । আমি জিজ্ঞেস করে দেখেছি, দরজিরা বলে থাকে, বাসে ছেলেদের রড ধরে দাঁড়াতে হয় তখন হাতে টান পড়ে । হয়তো বা পড়ে। তা বলে সব ছেলেরা হাত উপরে তুলে রাখবে বলে এত ঢিলা সহ‍্য করা যায়না। রেডিমেড কেনা জামা মাপে ছোটবড় হলেও বড় বড় কোম্পানি এইসব বডি ডেকোরাম মেনে ছেলেদের জামা তৈরি করে থাকে । সে কারণেই বড় দোকানের রেডিমেডের একটা প্রলোভন আছে পুরুষের কাছে। আমি আর কিছু করি না করি এবেলার জামা প্যান্ট ওবেলা কখনও পরিনা, করোনা এসে মনে হয় সকলকে এটা শিখিয়েছে। না সকলে এটা করোনা তেও করেনা। আবার কখনও শতচ্ছিন্ন জামাপ্যান্ট পরে মেট্রোগলিতে ক্যামেরার ব্যাটারি কিনতে চলেও গেছি । এইরকম বহুবার দূরে চলে গেছি বলে তো আমার ব‌উ --এই বকে তো সেই বকে। আমি এখন বলেই ফেলেছি এই তো পাড়ায় গিয়েছিলাম ( মেট্রোগলি)। একসময় তো আমাদের এক বন্ধু হাফপ্যান্ট পরে গ্লোবে অ্যাডাল্ট সিনেমা দেখতে গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। তখন প্রবল আপত্তি করেছিল সেকথা তো ভুলিনি। কিছুতেই ঢুকতে দেবেনা। তবে আজেবাজে জামাকাপড় পরে আর‌ও যে দু-চারবার মেট্রোগলিতে যাবো না এই গ্যারান্টি নেই, এসপ্ল্যানেডে ঘুরবো না এই দিব্যি কেউ দিলেও ধোপে টিঁকবে না। যা বলছিলাম। আমার ওই একটাই শখ জামাকাপড় দেখলে জিভ দিয়ে জল গড়ায় সব সময়। গত বছর বড়বাজারের মহাত্মা গান্ধী রোডের দোকানের মাস্টার (ওস্তাগর) আজকের দিনে আগের প্যান্ট ও নতুন আর একটা পিস সহ দুটোই ডেলিভারি দিয়েছিল । ৬/১১/১৯ -এর পরাটাও ঠিক করে দিয়েছিল। প্যান্ট দুটোর বিশেষত্ব হলো সামনে দুটো এক্সট্রা পেস্ট পকেট। ভেতরে সেম সাইজের সমান দুটি গুপ্ত পকেট ও একটা ব্যাক পকেট ও নরম্যাল দুটো সাইড পকেট । সেম কাপড়ের মজবুত মোট সাতটা পকেট। বেড়াতে গেলে এই দুটো প্যান্ট ট্রেনে-প্লেনে সঙ্গী করবো ভেবেছিলাম মনে হয় তা আর হবেনা। দুটো কাপড়ের রঙ সামান্য
হেরফের ।

মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর, ২০২০

হাওড়ায় সৌমিত্র ও অভিযান : অলোক কুন্ডু

⛔ হাওড়ায় সৌমিত্র ও অভিযান- এর যোগ : অলোক কুন্ডু

⛔ সৌমিত্র চ্যাটার্জী হাওড়াকে নিয়ে তিনটি ঘটনা বা বিষয়কে উল্লেখ করে গেছেন, তাঁর বিভিন্ন লেখায়। তাঁর কালীবাবুবাজারে বাজার করার কথা আগেই বলেছি। ক্ষণজন্মা অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে বিশেষভাবে একটি নিবন্ধ লিখেছেন কিছুটা জীবনীও। অভিযান করতে গিয়ে ড্রাইভারের অঙ্গভঙ্গি কিরকম হবে তা তার আগে থাকতেই কিছুটা রপ্ত হয়েছিল। কারণ এই অভিজ্ঞতা হয়েছিল হাওড়ায়। তা হলো হাওড়া জেলা স্কুলে যখন তিনি উচ্চ ক্লাসে পড়তেন। এখানে ধরে নিতে হবে স্কুল ফাইনাল দেওয়ার সময়ের কিছু আগের বা পরের ঘটনা। অথবা পরীক্ষার পরে যে অবসর পাওয়া যায় সেই সময়কার ঘটনা হলেও হতে পারে। একজন ড্রাইভারের সঙ্গে তাঁর ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল। সেই সময় জেলা স্কুলের দু একজন বন্ধু ও তার সঙ্গে হাওড়ার কোনও একটি রুটের বাস ড্রাইভারের সঙ্গে আলাপ হয়। আলাপ গভীর বন্ধুত্বে পৌঁছয়। 
বেশ কয়েকদিন তাঁরা, সেই ড্রাইভারের পাশে বসে  ইল্লিদিল্লি করতেন। তাঁরা বাসে করে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘুরেছেন কদিন এবং বাস কীভাবে চলে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা নিয়েছেন। তখন ড্রাইভারের কেবিন ছিল লরীর মতো। যাত্রীদের থেকে আলাদা। এখানে উল্লেখ্য তখনকার দিনে হাওড়ার রুটের বাস কিন্তু কলকাতায় যেত না। বাসের কাঠামোও এইরকম ছিল না। বনেট অনেকটা সামনের দিকে বের করা হতো। ইঞ্জিনের ঢাকনা বাঁয়ে ডানে দুদিকে খুলতো। বাসের টাইপও লম্বায় ছোট হোতো। 

•অভিযান করতে গিয়ে কিছু ডায়লগ সৌমিত্র চ্যাটার্জী, উচ্চারণ নিজের মতো করে তৈরি করে নিয়েছিলেন হিন্দি বাংলা মিশিয়ে। দুবরাজপুরে যখন স্যুটিং শুরু হলো, তখন সিনেমার ওই নতুন কেনা গাড়িটাও সৌমিত্রই চালাতেন সব সময়, সিনেমার বাইরেও চালাতে হতো তাঁকে। আলাদা কোনও ড্রাইভার না থাকায় স্যুটিংয়ের কাজে চালাতে হতো। তিনিই  লিখেছেন গাড়িটাকে নিয়ে যা ইচ্ছা করতাম যেমনভাবে চালাতে চাইতাম, সেই ভাবে গাড়িটা চলতো। সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করবেন না, করবেন না, করতে করতে শেষ পর্যন্ত পরিচালনা করেছিলেন, অভিযান। তাই সৌমিত্র আগে থাকতেই নিজের জীবনের হাওড়ার অভিজ্ঞতা থেকেই উচ্চারণ তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু যখন জানলেন সত্যজিৎ রায়ই পরিচালনা করবেন তখন তিনি বার বার তা মানিকদাকে জানালেন। তার উচ্চারণ তৈরি করে ফেলার কথা। কি সেই উচ্চারণ তা মানিকদা দু তিনবার শুনতেও চাইলেন। তিনবার করে রিয়ার্সাল হতো, তখন প্রতিবারই সৌমিত্র তাঁর মানিক দাকে জিজ্ঞেস করতেন, "ডায়লগ কি নিজের মতো বলবো? নাকি আপনার মতো করে বলবো।" সৌমিত্র বলেছেন মানিকদা ততবারই কোনও উচ্চবাচ্য করতেন না। কিন্তু যেদিন প্রথম স্যুটিং ফাইনাল টেক হলো মানিকদা আমাকে আমার মতো বলতে অনুমতি দিলেন। " 

• প্রসঙ্গক্রমে বলি, যারা হাওড়ায় থাকেন তাদের মনে হতে পারে হাওড়া জেলা স্কুলের সামনে বোধহয় তখন থেকেই বাস দাঁড়াতো এখনকার মতো। তখন বঙ্গবাসীর এই উড়ালপুল একেবারেই ছিলনা। বাসও হাওড়া ময়দানে কোথাও দাঁড়াতো না। জেলা স্কুলের গা দিয়ে ট্রাম লাইন ছিল, ট্রাম যেত। কিন্তু একটা পেট্রোল পাম্প ওখানে ছিল, সেখানেই হয়তো ড্রাইভারের সঙ্গে তাদের আলাপ হয়ে থাকতে পারে। 
©® অলোক কুন্ডু

তুলসী চক্রবর্তী প্রসঙ্গ-১: অলোক কুন্ডু

⛔ অলোকের ঝর্নাধারায় 

⛔ আমার মা দিদি ইতিমধ্যে মারা গেছেন, তাঁরা বেঁচে থাকলে আরও কিছু বলতে পারতেন। আমার বাবাকে তুলসী চক্রবর্তী নামেই চিনতেন, আসলে তুলসী চক্রবর্তী এই অঞ্চলের প্রতিটি মানুষকেই বোধহয় চিনতেন। পরে এখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যায়ণ যুক্ত করবো। তাহলেই মানুষটাকে বোঝা যাবে। আমার বাবা রামকৃষ্ণপুর অঞ্চলে, রবীন্দ্রলাল সিংহের অধীনে এ. আর. পি-র চিপ ভলান্টিয়ার ছিলেন। পরে রবীন্দ্রলাল সিংহ কংগ্রেসের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। তখনকার দিনে বেতন বাড়ানোর দাবিতে একবার, সারা রাজ্যের বামপন্থী শিক্ষকরা হাওড়ার সিদ্ধেশ্বরীতলা লেন দিয়ে এসে রাজবল্লভ সাহা লেন ও সন্ধ্যাবাজার দিয়ে ঢুকে রবীন্দ্রলাল সিংহের বাড়ি ঘেরাও করেছিলেন (এইসব পুরনো কথা আমার বাবা ও আমাদের বন্ধুবান্ধবদের অভিভাবকদের কাছ থেকে ছোটবেলায় শোনা। খানিকটা সাংবাদিক জয়ন্ত সিংহ বন্ধু অশোককৃষ্ণ দাস ঝালিয়ে দিয়েছেন)। 

•আমার বাবা, তুলসী দা তুলসী দা বলতে তো অজ্ঞান ছিলেন। বিশেষ করে বাবার কোলে আমার ছোটবোন, সঙ্গে আমার মা এবং দিদির হাত ধরে ছোটবেলায় আমি, আমার বাবার তুলসী-দার বই (সিনেমা) শনিবার নাইট শোতে দেখতে যেতাম, হাওড়ার পার্বতী, নবরূপম, শ্যামাশ্রীতে। তুলসী চক্রবর্তীর বাড়িটা এখনও আছে। তবে তা কার দখলে তা আর খেয়াল রাখিনা। হেঁটে বড় জোর তিন থেকে চার মিনিটের দূরত্ব। এমনকি তুলসী চক্রবর্তীর কাছে স্টারের পাশ এনেছেন আমার বাবা, থিয়েটার দেখার জন্য। সেইসব বিস্তৃত মনে করতে পারছি না আর। সম্প্রতি কয়েকবছর আগে আমাদের ষষ্ঠীতলার মাঠটি তুলসী চক্রবর্তীর নামে উৎসর্গ ও সাজানো হয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে। 

• কিন্তু আমি তখন খুব ছোট। হয়তো স্কুলে পড়িও না। অথবা দীর্ঘদিন একই দৃশ্য দেখতে দেখতে বড় হয়েছি বলে সময়টা ভাগ করে বলতে পারছি না। এখানে সেটা বিবেচ্য নয়। আমাদের বাড়ির লাগোয়া তখন আমাদের পাঁচিলঘেরা বিশাল পুকুরটা ছিল, খুরুট রোডের উপরে। যার অর্ধেকটা এখন পেট্রোল পাম্প হয়েছে। জ্ঞান হওয়া থেকে দেখছি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে ৫২ ও ৫৮ নম্বর বাস চলছে। আসলে এইসব গৌরচন্দ্রিকা উপলক্ষ মাত্র। আসল হচ্ছে তুলসী চক্রবর্তী। আমাদের বাড়ির সামনে নিধিরাম মাঝি লেন। তুলসী চক্রবর্তী যতদিন বেঁচে ছিলেন ঠিক বেলা দেড়টা নাগাদ ধুতি ফতুয়া একটা বড় ঘোরানো ডাঁটিওয়ালা ছাতা হাতে একটা থলি গোছের ব্যাগ নিয়ে ১০ থেকে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতেন বাসে উঠবেন বলে। আমাদের বাড়ির উল্টোদিক থেকে তিনি এসে প্রথমে উড়িয়া পানের দোকান থেকে পান নিতেন এবং ওইখানে দাঁড়াতেন আমাদের দিকে মুখ করে। আমার দিদি দুপুরের দিকে স্কুলে গেলে মা আর আমি ধাক্কাধাক্কি করে মুখ বাড়াতাম। আমাদের মস্তবড় গাড়ি বারান্দা ছিল আগেকার দিনের। কিন্তু শীতকাল ছাড়া রোদে দাঁড়ানো যেতনা। দিদি থাকলে ঠিক সময়টা ডেকে নিত। যেদিন উনি আসতেন না সেদিন আমরা হতাশ হতাম। আসলে আমার তখনও এত কৌতূহল হওয়ার কথা নয় কিন্তু যে লোকটাকে সিনেমায় দেখেছি বাড়িতে আকচার রাতদিন শুনছি তিনি তো তখন আমার কাছে এক আশ্চর্য মানুষ। তখন বাস হাওড়া পর্যন্ত যেত। ওখানে গিয়ে তুলসী চক্রবর্তী ছ-নম্বর দোতলা বাসে উঠে টালিগঞ্জ যেতেন এবং ওইভাবে ফিরে আসতেন। কখনও মাঝপথে পাল্টে ১৬ নম্বর বাসে করে এসে হাওড়ার মল্লিক ফটকে নামতেন। হেঁটে এবং পথে কথা বলতে বলতে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির ছুঁয়ে বাড়ি ফিরতেন। এই ছিল নিত্য রুটিন কিছু দেখা কিছুটা বাবার কাছে ও বন্ধুদের কাছে বয়ঃজেষ্ঠদের কাছে শোনা বহু আগে। ( তাই তুলসী চক্রবর্তী ট্রামে করে যাতায়াত করতেন ফেসবুকের উড়ো খবর মানতে পারবো না, কখনও নিশ্চিত এক আধদিন শিবপুর হাওড়ার দুমুখো ট্রামে উঠেছিলেন, এটা হতেও পারে।

• হাওড়ার নাট্যকার জগমোহন মজুমদাররা যখন হাওড়ায় কংগ্রেসি ক্লাব উদার সংঘে প্রথম নাটক মহলা দিচ্ছিলেন তখন রবীন মন্ডলের সঙ্গে তাদের নাটক দেখতে এসেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, এই বিষয়টা আমি আমার অন্য লেখায় উল্লেখ করেছি। 
তখন কংগ্রেসের জোড়াবলদ প্রতীক। অতুল্য ঘোষকে  কেউ কেউ রিপোর্ট করলেন সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় কোনও একটি জায়গায় বলদের বিষয়টা আছে। অতুল্যবাবু তখন কংগ্রেসের থিঙ্কারম্যান বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে (যিনি এক ঝটকায় হাওড়ার অজয় ঘোষের নাম ছাত্র পরিষদের সভাপতির প্যানেল থেকে কেটে দিয়ে রায়গঞ্জ থেকে কলকাতায়, বাংলায় এম.এ পড়তে আসা বেলঘড়িয়ায় সিঁড়ির তলায় বসবাস করা ময়লা অখ্যাত প্রিয়রঞ্জনকে বেছে নিয়েছিলেন।) বিষয়টা দেখতে বললেন। বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায় আবার দুজনকে ডাকলেন। তুলসী চক্রবর্তী ও জগমোহন মজুমদার, সেখানে বন্ধু জগমোহন ডেকে নিলেন শিল্পী রবীন মণ্ডলকে। তিনজনে নাইট শোতে সিনেমা দেখলেন পার্বতীতে। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেলনা। এখানে বলে রাখা ভালো রবীন মন্ডল কখনও কোনও রাজনীতি করেননি মতও দেননি। কিন্তু তার দুই বন্ধু পার্বতী দা ও জগমোহন দা কংগ্রেস করতেন। অবশ্য প্রথম জীবনে পার্বতী দা পি এস পির অর্ধেন্দুশেখর বোসের সমর্থক ছিলেন। ( ক্রমশঃ চলবে...) ©® অলোক কুন্ডু ( ১৭.১১.২০২০)

সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০

সৌমিত্র প্রসঙ্গ: হাওড়া ও অন্যান্য•• অলোক কুন্ডু


⛔ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গ: হাওড়া ও অন্যান্য • অলোক কুন্ডু

⛔ আমাদের হাওড়ায় স্কুল কলেজের কিছুটা সময় কেটেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। কৃষ্ণনগর থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পিতার চাকরিসূত্রে হাওড়ায় এসে পৌঁছন তিনি। উল্লেখ্য হাওড়ার ভূমিপুত্র পরবর্তীতে বিখ্যাত পেন্টার, রবীন মন্ডল ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বাল্যবন্ধু। বলা ভালো যে হাওড়া-ময়দানেই রবীন দার সঙ্গে একদিন আলাপ হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। রবীন দা, গতবছর প্রয়াত হন। রবীন দার মুখে শুনেছি দুটি পৃথক স্কুলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য কলেজ লাইফ থেকে সেই সখ্যতা আরও বেড়েছিল। প্রথমদিকে রবীন দা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকের মঞ্চ ভাবনা এঁকে দিয়েছিলেন। যাইহোক রবীন মন্ডল দা তখন ছবি আঁকা নিয়ে পড়ছেন আর্ট কলেজে। সৌমিত্র সিটি কলেজে। রবীন দা প্রচ্ছদ করে দেন বন্ধুদের আর্ট কলেজের নামী ছাত্র তখন তিনি, রবীন্দ্রনাথ মন্ডলকে তখন অনেকে চেনেন। সৌমিত্র কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। কিন্তু হাওড়ার সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রাক্তন অধ্যাপক চারুচন্দ্র কলেজ, ও নটরঙ্গ থিয়েটার গ্রুপের পরিচালক) এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে নাটকের জন্য আর একটু বেশি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। লালু ও পলুর বন্ধুত্ব আরও বেশি করে জমে উঠেছে কারণ দুজনেই কলকাতায় পড়াশোনা করেন এবং নাটক ভালোবাসেন। লালুদা কিছুটা সিনিয়র। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়দের 'যুবসভা ক্লাব'-এ তখন নাটকের রেওয়াজ হচ্ছে সেখানে আছেন স্বয়ং সৌমিত্র। সঙ্গে ভগবান গাঙ্গুলী লেনের অমিয়কান্তি ব্যানার্জী ও শঙ্কর ব্যানার্জী। বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউশনের ( শিক্ষক ) বিশ্বনাথ দত্ত। আড্ডাখানার স্থান সন্ধ্যাবাজারের চায়ের দোকানে। এরা সকলেই নাটকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পরবর্তীতে। 

•এখানে প্রসঙ্গত একটু অন্য আলোচনায় আসি। স্বাধীনতার আগে হাওড়ায় সুভাষচন্দ্র এসে, নীলমণি মল্লিক লেন ও এম সি ঘোষ লেনে ফরওয়ার্ড ব্লকের যে ভিত খুঁড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তা হাওড়ায় তখনও অক্ষুন্ন আছে। ফরওয়ার্ডব্লক আশ্রিত হাওড়া সঙ্ঘ ক্লাব তখন হাওড়ার সংস্কৃতির পিঠস্থান। তখন হাওড়ায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক বিশাল নেতা বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায় আছেন। এদতসত্ত্বেও কিছুমাত্র নড়ানো যায়নি হাওড়া সঙ্ঘের সদস্যদের। তাই পাশেই কংগ্রেস তৈরি করলো হাওড়া উদার সঙ্ঘ ক্লাব। নাট্যকার তখন যুবক জগমোহন মজুমদার সেখানে নাটক করা শুরু করলেন তিনি, কংগ্রেসের ব কলমে --" ঠাকুর দা। " নাটক মহলা চলছে তাঁদের। এদিকে হাওড়ায় তখন 'হাওড়া সঙ্ঘ' উঠতি যুবকদের কাছে সংস্কৃতির পুরোযায়ী হয়ে উঠেছে, প্রেরণাস্বরূপ। এর মাঝে রাজনৈতিক দলের ছত্রাছায়ায় না থেকে সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়রা পঞ্চাননতলায় নতুন নাটকের মহলা শুরু করলো রবীন মন্ডল পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ( রবীন মন্ডলের মঞ্চ ভাবনা), তাদের নাটকের নাম --"সধবার একাদশী। " সম্ভবত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখানেই প্রথম অভিনয় করেন। এই দলের পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুজনকেই দেখতে তখন উত্তমকুমার একেবারে। পার্বতী দাকে তো আরও সুন্দর দেখতে। বহু আগেই শুনেছি জগমোহন মজুমদারদের সেই নাটকের মহলাকক্ষে, হাওড়া উদার সঙ্ঘ ক্লাবে এলেন শুভেচ্ছা জানাতে রবীন মন্ডল, সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়রা। তখন থেকেই রবীন মন্ডলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুরু হলো জগমোহন মজুমদারের। পরে রবীন মন্ডল এঁকে দিলেন নটনাট্যমের লোগো এবং মঞ্চ ভাবনা। 

•প্রকৃতপক্ষে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতার ওকালতি ছেড়ে হাওড়ায় রেলের বড় চাকরি নেওয়ার কারণে ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই স্কুল জীবন শেষ করেন। বোর্ডের পরীক্ষার সিট পড়েছিল আজকের অক্ষয় শিক্ষায়তনে অর্থাৎ তখনকার হাওড়া রিপন স্কুলে। তিনি হাওড়া থেকেই সিটি কলেজে পড়তে শুরু করেন। হাওড়া জেলা স্কুলের ১৫০ বর্ষ উদযাপনের সময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০১১-তেও স্কুলে এসেছিলেন আবৃত্তি করে গেছেন প্রাক্তনীদের অনুষ্ঠানে জেলা স্কুলে। 
অনেকে বলেন সালকিয়ার,গোলাবাড়ির রেলের নূন গোলায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতা অফিসার হিসেবে চাকরি করতেন এবং নূন গোলায় সৌমিত্ররা
থাকতেন। তবে এই প্রতিবেদক শুনেছিলেন তিনি থাকতেন হাওড়ার ফাঁসিতলার কলভিন কোর্টে রেলের অফিসার্স কোয়ার্টারে। কারণ স্কুল বয়েসেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পিতার সঙ্গে কালীবাবু বাজার আসতেন। 
তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন তৎকালীন রিপন স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক ( বর্তমান অক্ষয় শিক্ষায়তনে 
পাশে উনি থাকতেন) মাধবকিশোর চক্রবর্তী। 

•আগেই বলেছি, হাওড়ার পঞ্চাননতলা রোডের নাট্যকার অধ্যাপক,সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ( নটরঙ্গের ফজল আলী আসছে-এর ডিরেক্টর) ছিলেন কাছের বন্ধু। রামকৃষ্ণপুরে পুরনো বাটার দোকানের কাছে একটি চায়ের দোকানে যুবসভার আড্ডা বসতো। দুজনে মিলে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখতে যেতেন। সুশান্ত দা সৌমিত্রর থেকে কিঞ্চিৎ বড় ছিলেন। এখান থেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় শিশির ভাদুড়ীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন এবং এম এ পঞ্চম বর্ষে পড়ার সময় তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। যাইহোক হাওড়ার এম. সি. ঘোষ লেনে পার্বতী মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতেও ছোটখাটো আড্ডা ছিল তাঁদের। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়ার অন্নপূর্ণা ব্যায়াম সমিতির কাছে রবীন-দার বাড়ি, পঞ্চাননতলা রোডে লালুদার বাড়ি, গোরাবাজারে পার্বতী দার বাড়িতে আকচার এসেছেন ও গেছেন। লক্ষ্মণ দাস লেনের মুখে পঞ্চাননতলা রোডে সামান্য কিছু দিন বসবাস করে গেছেন। এমনকি সালকিয়ায় শ্বশুর বাড়ি। অনেকে তাই বলেন সালকিয়ায় থাকার সময়ই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীর আলাপ হয়। 

•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সবে এম.এ পাশ করেছেন। ব্যাটমিন্টন খেলোয়াড় সালকিয়ার একটি মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম শুরু হয়েছে। তখন হাওড়ায় আর থাকেন না। শিশির ভাদুড়ীর কাছে যেতে শুরু করেছেন এম. এ-শেষ বছর থেকে। বাংলায় এম. এ করছে শুনে শিশির ভাদুড়ী বললেন ,"বা বেশ।" এতদিন বাংলায় এম.এ-কে সকলে যাচ্ছেতাই করতো, সৌমিত্র মনে মনে ভাবলেন এই মানুষটার বলাতে ভরসা পাওয়া গেল। এতদিনে একজন সঠিক মানুষের দেখা পেলেন। সেই সময় একটা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন সৌমিত্র। আকাশবাণীর একটি ঘোষকের পদে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখা হলো অখ্যাত এবং থিয়েটারের সাইডরোলের অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। হাজার জনের মধ্যে প্রথম হলেন অনিল চট্টোপাধ্যায় দ্বিতীয় হলেন সৌমিত্র। চাকরি হলো অনিলের। সেই যে ইডেন গার্ডেন্সের ফুটপাতে সিগারেট খেতে খেতে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ হলো সেই আলাপ চলেছিল অনিল চট্টোপাধ্যায়ের আমৃত্যু পর্যন্ত। পরে অনিল চট্টোপাধ্যায় টালিগঞ্জে যোগ দিয়েছিলেন সহকারী পরিচালক হিসেবে। পরে নায়ক ও অভিনেতা। অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই প্রতিবেদক একবার অনিল চট্টোপাধ্যায়ের একটি সেমিনারে উপস্থিত হয়েছিলেন তাতে অনিল চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন ও তপন সিংহকেই বাংলা সিনেমার আদর্শ পরিচালক বলেছিলেন। বলেছিলেন বাংলা সিনেমার উন্নতধারার এই দুই পরিচালক বাঙালি জীবনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। 

•পরবর্তীকালে শিবপুরে একটি ঘরোয়া আসরে রবীনদাকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হলো তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঘরোয়া আসরে দুজনের সখ্যতার গল্প ও ডালমিয়া পার্কে ঘাসের উপর শুয়ে হাওড়ায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কৈশোর ও কলেজর লাইফের কথা ও গল্প  বলেছিলেন। কেউ কেউ বলেন তিনি থাকতেন হাওড়ার ফাঁসিতলার কলভিন কোর্টের রেলের অফিসার্স কম্পাউন্ডে ( অনেকে বলেন তিনি গোলাবাড়ি থানার কাছে নূনগোলা কোয়ার্টারে থাকতেন, যেহেতু তাঁর পিতা রেলের নূন গোলার বড় অফিসার ছিলেন)। চার্চ রোড, পুরনো হাওড়া ময়দান, পঞ্চাননতলা রোড, রামকৃষ্ণপুরে হেঁটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের হাওড়ার ধুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছেন এটা ভাবলেই আশ্চর্য হতে হয়। টাউন হলেও উপস্থিত হয়েছেন তখনকার দিনের সখের নাটকে। কলকাতায় চলে যাওয়ার আগে অন্ততপক্ষে ৭ বছর তিনি হাওড়ায় থেকে গেছেন খানিকটা অলক্ষ্যে। অনেক পরেও মৃণাল সেনের বাড়ির ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা ক্যালকাটা পেন্টার্সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীনদার দেখা হতো। রবীন দার ছবি দেখতেও এসেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। রবীনদাও কয়লাঘাটে, রেলের অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে কলকাতা করপোরেশন থেকে পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা দেখতে। বহু আসরে দু-বন্ধু বোঝাপড়া করে উপস্থিত হয়েছেন কখনও। বিখ্যাত কলা সমালোচক ও কলকাতার প্রথম বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা অহিভূষণ মালিক রবীন দাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আনন্দবাজারে অহিভূষণ মালিকের টেবিলের চারপাশে বসে আড্ডা দিয়েছেন রবীন দা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পার্বতী মুখোপাধ্যায়। একদিন রবীন দা ছবি আঁকছেন আমি এই অধম, বসে তাই দেখতে দেখতে হাওড়ার পঞ্চাননতলার বাড়িতে সেইসব শুনছি। আমি পার্বতী মুখোপাধ্যায়ের স্নেহভাজন ছিলাম। উনি কংগ্রেস করতেন ওনার স্ত্রী ছিলেন ব্যাঁটরা বিবিপিসি স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। পার্বতী দা কলকাতা করপোরেশনের বড় অফিসার ছিলেন এবং ছবি আঁকার একজন বিদগ্ধ আলোচক ছিলেন। পরে গড়িয়াহাটে ফ্ল্যাট করে পার্বতী দা চলে যান এবং লেক মার্কেটের সামনে আর্ট গ্যালারি করেন। 

•হাওড়ার মেথর ইউনিয়নের লিডার অর্ধেন্দুশেখর বোসও ছিলেন কলকাতার পুরনো, বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। আবার হাওড়ার 'যুবসভা'রও তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পুরনো বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন বলতে গেলে একসময় ছিল সংস্কৃতির চাঁদের হাট আর এখানেই অহিভূষণ মালিকের হাতেই ছিল শিল্পীদের উঠে আসার সিঁড়ি। সহকারী,পার্বতী মুখোপাধ্যায় এখানেই থেকেই হয়েছিলেন কলা সমালোচক, রবীন দা পেয়েছিলেন শিল্পীর উত্তরণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকে হাতেখড়ি। হাওড়ার অর্ধেন্দু বোস ও আনন্দবাজারের অহিভূষণ মালিকের হাত ধরে একপ্রকার সংস্কৃতির উত্থান হয়েছিল বলা যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও ছিলেন তার আর এক সহযোগী। আজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে সেই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তবে শুধুমাত্র জগমোহন মজুমদার এখনও বেঁচে আছেন, তাঁর আরও থাকার দরকার। 

•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্য অনেকবার বলেছেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে যখন কবি তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা সত্যজিৎ রায়কে প্রথম নাগরিক সংবর্ধনা দিলেন, তখনও সত্যজিৎ রায়ের কাছে পর্যন্ত যেতে পারেননি। চেনার কথা তো দুর। এমনকি কফি হাউসে সুনীল শরৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের টেবিলে তার কোনও স্থান ছিলনা। কফি হাউসে যাওয়ার জন্য কোনোরকমে বন্ধু নির্মাল্য আচার্যর মাধ্যমে একটা কার্ড জোগাড় করতে পেরেছিলেন। তখনও তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত 
"এক্ষণ "-এর ভাবনা আসেনি। পরে যখন এক্ষণ প্রকাশিত হয় তার প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পর নির্মাল্য আচার্যর কাছে সত্যজিত রায়ের অনেক কিছু আসল আর্টওয়ার্ক ও পান্ডুলিপি থেকে যাওয়ায় পুলিশ যখন নির্মাল্য আচার্যর বাড়ি রেইড করে তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঝামেলায় থাকতে চাননি, কারণ নির্মাল্য আচার্য, সত্যজিৎ রায়ের কাছে পৌঁছনোর সেতু হলেও রায় পরিবারের জন্য আজ তিনি সৌমিত্র হতে পেরেছেন। এমনকি তিনি মাণিকদা বললেও নিজেকে পুত্রই মনে করতেন। তাই সত্যজিৎ রায়ের মরদেহ বাড়ি থেকে যখন বের করে নিয়ে আসা হয় নন্দনের পথে, তখন সিনে সেন্ট্রালের ছেলেদের সঙ্গে একই লরিতে একমাত্র ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই কাঁদো কাঁদো মুখের ছবি ইতিপূর্বে আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। 

• এবার একটা আমার ব্যক্তিগত একটা আনন্দের কথা। সেটা হলো আই. এ বি. এ পড়ার সময় তিনি যে হাওড়ার পঞ্চাননতলায় থাকতেন এবং রোজ যে কালীবাবু বাজারে বাজার করতে আসতেন সেকথা সৌমিত্র চ্যাটার্জী লিখে ছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের ৭ জন অভিনেতার মধ্যে তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কেও লিখে গেছেন। তখন আক্ষেপ করে বলেছিলেন কালীবাবুবাজারে বাজার করেছি অথচ অত কাছে থেকেও তখন এত বড় মাপের অভিনেতা যে থাকতেন তখন আলাপ করতে পারিনি। ( সূত্র সৌমিত্র চ্যাটার্জীর লেখালেখি) 

•সাংবাদিক #সুপ্রকাশকে ধন্যবাদ  হাওড়ার কিছু সময় #এইসময়ে (১৬.১১.২০) তুলে ধরার জন্য। আমি এখানে আরও একটু সংযোজন করবো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিরিক্ষা সম্পর্কে। হাওড়ার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে সব থেকে ভালো তথ্য দিতে পারতেন অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ও শিল্পী রবীন মন্ডল। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। উনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের থেকে কিঞ্চিৎ বড় ছিলেন এবং উনিই সৌমিত্রকে নিয়ে শিশির ভাদুড়ীর নাটক দেখতে যেতেন। সেই সময় সালকিয়ার ব্যাটমিন্টন খেলোয়াড় দীপা চ্যাটার্জীর সঙ্গে সৌমিত্রর প্রেম হয় নাটকের সুবাদে। অনেকে বলেন সালকিয়ার গোলাবাড়ির রেলের নূনগোলার অফিসার ছিলেন তাঁর পিতা, তাই হয়তো দুজনের দেখাসাক্ষাৎ হয়ে থাকতে পারে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়ায় মিশতেন অহিভূষণ মালিকের ভাবশিষ্য পার্বতী মুখোপাধ্যায়, ভারত বিখ্যাত পেন্টার রবীন মন্ডল ও কংগ্রেস নেতা বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ভাই বিমল চট্টোপাধ্যায়ের জামাই চারুচন্দ্র কলেজের অধ্যাপক সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ওঁনাদের আড্ডা ছিল রামকৃষ্ণপুর সন্ধ্যা বাজারে। এই থেকে বোঝা যায় তখন থেকেই তাঁর মেলামেশা পরবর্তীতে যারা বিখ্যাত হয়েছিলেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মেলামেশা ছিল সংস্কৃতির সঙ্গে। পরবর্তীতে একমাত্র শিল্পী রবীন মন্ডলের সঙ্গেই তাঁর যোগাযোগ ছিল। তিনি নিজে বলেছেন আমি স্কুলে পড়ার সময় থেকে কালীবাবুবাজারে যেতাম কিন্তু আলাপ হয়নি অত বড় অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর সঙ্গে। এই থেকে বোঝা যায় তিনি থাকতেন মধ্য হাওড়ায় ছোট থেকেই। সব মিলিয়ে ৭ বছর মতো ছিলেন। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় সৌমিত্রর প্রথম মেন্টর ছিলেন বলা যায় ( সৌমিত্র সেকথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু নামটা উল্লেখ করেননি), শিশির ভাদুড়ীর কথা সেই যে কানে ঢুকিয়ে ছিলেন তারপর থেকে শিশির ভাদুড়ীর সমস্ত শো-য়ে তিনি গেছেন। তাঁর শেষ মঞ্চ অভিনয়ের দিন আলাপ করেন প্রণামের মাধ্যমে এবং প্রায় বাড়ি যাতায়াত শুরু করে দেন এম. এ পড়ার শেষ বছর থেকে। তারপর সকলে জানেন শিশির ভাদুড়ী সম্পর্কে তাঁর বিস্তৃত লেখালেখি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মাত্র সাতজন সর্বভারতীয় অভিনেতাকে নিয়ে নানাভাবে লিখেছেন। বলরাজ সাহানী থেকে তুলসী চক্রবর্তী। 
কালীবাবুবাজারে তুলসী চক্রবর্তী একটা ময়লা সাধারণ গেঞ্জি বা কখনও ফতুয়া পরে ও ভাঁজকরা ধুতি পরে বাজার করতেন সেকথা তার অবজারভেশন থেকে পাওয়া যায়। আলু পটল দোকানি ও মুটে ওলাদের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তীর রঙ্গ-রসিকতাগুলো তিনি তুলে ধরেছেন বিভিন্ন ভাবে, পরে বিভিন্ন আলোচনায় তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কে তাঁর মূল্যায়ণ হাওড়ায় আজ পর্যন্ত কেউ করেছেন বলে আমি দেখিনি। ভানু-জহর বিশেষ করে অনিল চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে তিনি ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন। 

•পড়ার পাঠ চুকিয়ে যখন আকাশবাণীর একটি ঘোষক পদের এক হাজার জনের মধ্যে ইন্টারভিউ দিয়ে দ্বিতীয় হন তখন প্রথমজন অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ এবং সেই আলাপ চিরস্থায়ী ছিল দুজনের। যখন শতরূপা দি-র বাবা অধ্যাপক তরুণ সান্যাল সাধারণ খ্যাত সত্যজিৎ রায়ের সংবর্ধনার আয়োজনে ব্যস্ত এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কজনকে জড়ালেন এবং পরে আরও অনেকে যুক্ত হলেন তখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কফি হাউসে, নিতান্তই ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মতো বন্ধু নিয়ে আলাদা বসে থাকেন এবং শিশির ভাদুড়ীর ভাবশিষ্য হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। ©® অলোক কুন্ডু।
( সূত্র : প্রয়াত পার্বতী মুখোপাধ্যায়, প্রয়াত রবীন মন্ডল, নাট্যকার জগমোহন মজুমদার, বন্ধু অশোককৃষ্ণ দাস)

রবিবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২০

হাওড়ার সৌমিত্র ও তাঁর বন্ধুরা: অলোক কুন্ডু

⛔ আমাদের হাওড়ায় স্কুল জীবনটা কেটেছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। কৃষ্ণনগর থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পিতার চাকরিসূত্রে তিনি হাওড়ায় এসে পৌঁছন। উল্লেখ্য হাওড়ার ভূমিপুত্র পরবর্তীতে বিখ্যাত পেন্টার রবীন মন্ডল ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একজন বন্ধু। বলা ভালো যে হাওড়া ময়দানেই রবীন-দা'র সঙ্গে একদিন আলাপ হয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। রবীন দা, গতবছর প্রয়াত হয়েছেন। রবীন দার মুখে শুনেছি দুটি পৃথক স্কুলের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে একটা সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরে অবশ্য কলেজ লাইফ থেকে সেই সখ্যতা আরও প্রগাঢ়
হয়েছিল। প্রথমদিকে রবীন-দা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকের মঞ্চ ভাবনা এঁকে দিয়েছিলেন। যাইহোক রবীন মন্ডল-দা তখন ছবি আঁকা নিয়ে পড়ছেন আর্ট কলেজে তখন সৌমিত্র সিটি কলেজে যাচ্ছেন। রবীন দা প্রচ্ছদ করে দেন বন্ধুদের আর্ট কলেজের নামী ছাত্র তখন তিনি। সৌমিত্র কবিতা লিখতে শুরু করেছেন। হাওড়ার সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (প্রাক্তন অধ্যাপক চারুচন্দ্র কলেজ) আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে নাটকের জন্য আর একটু বেশি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তখন। লালু ও পলুর বন্ধুত্ব আরও বেশি করে জমে উঠেছে কারণ দুজনেই কলকাতায় পড়াশোনা করেন এবং নাটক ভালোবাসেন, বাসে একসঙ্গে যাতায়াত করেন। সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়দের 'যুবসভা' ক্লাবে তখন নাটকের রিয়ার্সাল হচ্ছে। সেখানে আছেন স্বয়ং সৌমিত্র।

•এখানে প্রসঙ্গত একটু অন্য আলোচনায় আসি। স্বাধীনতার আগে হাওড়ায় সুভাষচন্দ্র এসে, নীলমণি মল্লিক লেন ও এম সি ঘোষ লেনে ফরওয়ার্ড ব্লকের যে ভিত খুঁড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন তা হাওড়ায় তখনও সমান অক্ষুন্ন আছে। ফরওয়ার্ডব্লক আশ্রিত হাওড়া সঙ্ঘ ক্লাব তখন হাওড়ার সংস্কৃতির পিঠস্থান। তখন হাওড়ায় কংগ্রেসের প্রাদেশিক বিশাল নেতা বিজয়ানন্দ চট্টোপাধ্যায় আছেন। এদতসত্ত্বেও কিছুমাত্র নড়ানো যায়নি হাওড়া সঙ্ঘকে। তাই পাশেই কংগ্রেস তৈরি করলো হাওড়া উদার সঙ্ঘ ক্লাব। প্রখ্যাত নাট্যকার, তখন যুবক জগমোহন মজুমদার সেখানে নাটক করা শুরু করলেন কংগ্রেসের ব কলমে --" ঠাকুর দা। " নাটক মহলা চলছে তাঁদের। এদিকে হাওড়ায় তখন হাওড়া সঙ্ঘ উঠতি যুবকদের কাছে সংস্কৃতির পুরোযায়ী হয়ে উঠেছে, প্রেরণাস্বরূপ। এর মাঝে রাজনৈতিক দলের ছত্রাছায়ায় না থেকে সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়রা পঞ্চাননতলায় অর্ধেন্দু বোসের পৃষ্ঠপোষকতায় নাটকের মহড়া দেওয়া শুরু করলো, রবীন মন্ডল পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে ( রবীন মন্ডলের মঞ্চ ভাবনা), তাদের নাটকের নাম --"সধবার একাদশী। " সম্ভবত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এখানেই প্রথম অভিনয় করেন।
এই দলের পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় দুজনকেই দেখতে তখন উত্তমকুমার একেবারে। পার্বতী দাকে তো আরও সুন্দর দেখতে।

•প্রকৃতপক্ষে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পিতার ওকালতি ছেড়ে হাওড়ায় রেলের বড় চাকরি নেওয়ার কারণে কৃষ্ণনগর থেকে এসে ষষ্ঠ শ্রেণিতে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হাওড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং এখানেই স্কুল জীবন শেষ করেন। তাঁর বোর্ডের পরীক্ষার সিট পড়েছিল আজকের অক্ষয় শিক্ষায়তনে অর্থাৎ তখনকার হাওড়ার রিপন স্কুলে। তিনি হাওড়া থেকেই সিটি কলেজে পড়তে শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে যখন হাওড়া জেলা স্কুলের শতবার্ষিকী হয় তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে অনুষ্ঠানে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
আগেই বলেছি, হাওড়ার নাট্যকার অধ্যাপক,
সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ( নটরঙ্গের ফজল আলী আসছেনের ডিরেক্টর) ছিলেন কাছের বন্ধু। রামকৃষ্ণপুরে পুরনো বাটার দোকানের কাছে একটি চায়ের দোকানে যুবসভার আড্ডা বসতো। এম. সি. ঘোষ লেনে পার্বতী মুখোপাধ্যায়দের বাড়ির মস্তবড় উঠোনের একপাশে ছোটখাটো একটা আড্ডা ছিল তাঁদের। পরবর্তীকালে শিবপুরে একটি ঘরোয়া আসরে রবীনদাকে যখন সংবর্ধনা দেওয়া হলো তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঘরোয়া আসরে দুজনের সখ্যতার গল্প ও ডালমিয়া পার্কে ঘাসের উপর শুয়ে, হাওড়ায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কৈশোর ও কলেজর লাইফের কথা ও গল্প বলেছিলেন। তিনি থাকতেন হাওড়ার ফাঁসিতলার কলভিন কোর্টের রেলের অফিসার্স কম্পাউন্ডে। চার্চ রোড, পুরনো হাওড়া ময়দান, রামকৃষ্ণপুরে হেঁটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমাদের হাওড়ার ধুলোয় ঘুরে বেড়িয়েছেন। টাউন হলেও উপস্থিত হয়েছেন তখনকার দিনের সখের নাটকে। হাওড়ার রেলের মঞ্চে হল পেতে তখন তাঁর অসুবিধা হওয়ার কথা নয় ( এই হলেই হাওড়ায় উত্তমকুমারকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল)। কলকাতায় চলে যাওয়ার আগে অন্ততপক্ষে ৭/৮ বছর তিনি হাওড়ায় থেকে গেছেন খানিকটা অলক্ষ্যে। অনেক পরেও মৃণাল সেনের বাড়ির ঘরোয়া আড্ডায় কিংবা ক্যালকাটা পেন্টার্সে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীনদার দেখা হতো। রবীন দার ছবি দেখতেও এসেছেন বহুবার। রবীনদাও কয়লাঘাট রেলের অফিস থেকে সোজা বেরিয়ে কলকাতা করপোরেশন থেকে পার্বতী মুখোপাধ্যায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমা দেখতে। বহু আসরে দু-বন্ধু বোঝাপড়া করে উপস্থিত হয়েছেন কখনও। বিখ্যাত কলা-সমালোচক ও কলকাতার প্রথম বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা অহিভূষণ মালিক রবীন দাকে বিশেষ স্নেহ করতেন। আনন্দবাজারে অহিভূষণ মালিকের টেবিলের চারপাশে বসে আড্ডা দিয়েছেন রবীন দা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও পার্বতী মুখোপাধ্যায়। একদিন রবীন দা ছবি আঁকছেন আমি ( এই অধম) বসে তাই দেখতে দেখতে হাওড়ার পঞ্চাননতলার বাড়িতে সেইসব শুনছি। হাওড়ার মেথর ইউনিয়নের লিডার অর্ধেন্দু বোসও ছিলেন কলকাতার বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। আবার হাওড়ার যুবসভারও তিনি ছিলেন অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। পুরনো বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলন বলতে গেলে ছিল সংস্কৃতির চাঁদের হাট আর এখানেই অহিভূষণ মালিকের হাতেই ছিল শিল্পীদের উঠে আসার সিঁড়ি। পার্বতী মুখোপাধ্যায় এখান থেকেই হয়েছিলেন কলা সমালোচক, রবীন দা পেয়েছিলেন শিল্পীর উত্তরণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নাটকে হাতেখড়ি। হাওড়ার অর্ধেন্দু বোস ও আনন্দবাজারের অহিভূষণ মালিকের হাত ধরে একপ্রকার সংস্কৃতির উত্থান হয়েছিল বলা যায়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও
ছিলেন বঙ্গ সংস্কৃতির আর এক সহযোগী। আজ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে সেই যুগের সম্পূর্ণ সমাপ্তি ঘটলো।

•সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অবশ্য অনেকবার বলেছেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে যখন কবি অধ্যাপক তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা সত্যজিৎ রায়কে প্রথম নাগরিক সংবর্ধনা দিলেন, তখনও সত্যজিৎ রায়ের কাছে পর্যন্ত যেতে পারেননি তিনি। এমনকি কফি হাউসে সুনীল শরৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের টেবিলে তার কোনও স্থান ছিলনা। কফি হাউসে যাওয়ার জন্য কোনোরকমে বন্ধু নির্মাল্য আচার্যর মাধ্যমে একটা কার্ড জোগাড় করতে পেরেছিলেন। তখনও তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত " এক্ষণ "-এর ভাবনা আসেনি। পরে যখন এক্ষণ প্রকাশিত হয় তার প্রতিটি সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পর নির্মাল্য আচার্যর কাছে সত্যজিত রায়ের অনেক কিছু আসল আর্টওয়ার্ক ও পান্ডুলিপি থেকে যাওয়ায় পুলিশ যখন নির্মাল্য আচার্যর বাড়ি রেইড করে, তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেই ঝামেলায় থাকতে চাননি, কারণ নির্মাল্য আচার্য, সত্যজিৎ রায়ের কাছে পৌঁছনোর সেতু হলেও রায় পরিবারের জন্য আজ তিনি সৌমিত্র হতে পেরেছেন। এমনকি তিনি নিজেকে পুত্রও মনে করতেন। তাই সত্যজিৎ রায়ের মরদেহ বাড়ি থেকে যখন বের করে নিয়ে আসা হয় নন্দনের পথে, তখন সিনে সেন্ট্রালের ছেলেদের সঙ্গে একই লরিতে একমাত্র ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সেই কাঁদো কাঁদো মুখের ছবি ইতিপূর্বে আমি ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। ©® অলোক কুন্ডু।

শুক্রবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২০

রাজ্য রাজনীতি সরগরম : অলোক কুন্ডু

রাজ্য রাজনীতি সরগরম: অলোক কুন্ডু

⛔ আজ ( ১৩.১১.২০২০) শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক উপদেষ্টা পিকে-কে পৌঁছতে হলো শুভেন্দুদের বাড়ি। এইথেকে পরিষ্কার হলো যে শুভেন্দু যা বলেছেন তার ভিত্তি আছে। এই মূহুর্তে শুভেন্দুর যে একতরফা জয় ,ক্ষমতা ও ভোট বেড়ে গেল একথা অনস্বীকার্য। ইদানীং কিন্তু সেখানে বিজেপিও একটা মাটি খুঁজে নিচ্ছিল। বিশেষ করে অমুসলিম এলাকাগুলো এখন ভেতরে ভেতরে বিজেপিও দাপট দেখাতে আসরে নেমে পড়েছিল। সব থেকে বড় বিষয় হলো, এই কদিন নেট দুনিয়ার রাজনীতি চর্চায় একমাত্র শুভেন্দু অধিকারীর নাম উঠে আসছিল, সমস্ত চ্যানেলজুড়ে। এখন আবার নন্দীগ্রাম রাজ্যের রাজনৈতিক আসরে মূল ভরকেন্দ্র বা এপি-সেন্টার হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এবারে নির্বাচনে যদি শুভেন্দু নিজের এই ইমেজ ধরে রাখতে পারে তবে পূর্ব মেদিনীপুরে, বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস দুটো দলই এখন শুভেন্দুকে কাছে টানতে চাইবে। এতদিন পরে এই যে শুভেন্দুর প্রকাশ্য উত্থান, এই যে জাত চেনানো, এতে করে এই পর্বটি যদি তিনি ২০২১-এর নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারেন তবে শুভেন্দু অধিকারী আগামী নির্বাচনে তার মনোনীত ৪০-৫০ জন সমর্থককে টিকিট দিতে সমর্থ হবেন এবং জিতিয়ে আনবেন এবং তা তৃণমূলে থেকেই। আর যদি তিনি নিজেই একটি দল গড়ে ফেলেন তবে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি এই দুটি প্রধান দলকেও ভাবনায় ফেল দিতে পারবেন। যাই হোক না কেন, শুভেন্দু এখন চাইলেই তৃণমূলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হতে পারবেন অথবা নিজের দল গড়ে জোট রাজনীতিকে মদত দেবেন। এখনও শুভেন্দুকে কেউ সাম্প্রদায়িক বলতে পারেননি এখনও বরং তার সহযোগীদের মধ্যে মুসলিম সমাজের ভালো কিছু নেতারাও আছেন। সেইদিক থেকে শুভেন্দু রাজনৈতিক স্তরে এখন একটা ভালো জায়গায় আছেন। সঙ্গে শিশির অধিকারীর মতো দুঁদে রাজনৈতিক নেতা আছেন যাকে পূর্ব-মেদিনীপুরের মানুষ যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন।
•২০১১ নয়, বরং ১৯৯৬ ২০০১ ২০০৬ প্রতিটি নির্বাচনে শুভেন্দুদের সঙ্গে জনজোয়ার ছিল। প্রতিটি নির্বাচনেই মনে হয়েছে এই বুঝি পূর্ব মেদিনীপুর বামেদের হাতছাড়া হলো কিন্তু শেষ মূহুর্তে সব ফল গুলিয়ে গেছে তার কারণ রাজ্যবাসী জানেন। জনগণ সঙ্গে থেকেও শুভেন্দুরা রাজ্যের ক্ষমতা পাননি সেইসব এখন তথ্য ও ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের খবর সারা ভারতে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এতটাই ছিল তার ব্যাপ্তি যে তার কম্পনে রাজ্য নড়ে গিয়েছিল। নন্দীগ্রামের অনেক মানুষ এখনও নিখোঁজ। সেই সময় বাইরে থেকে ঢুকতে রীতিমতো ক্ষমতা লাগতো। শুধুমাত্র নকশাল, শুধুমাত্র কোনও একটি রাজনৈতিক দলের পৌঁছনোর শুধুমাত্র বুদ্ধিজীবীদের পৌঁছে যাওয়া স্বপ্ন ছিল যদি না পেছন থেকে শুভেন্দুরা মদত দিতো।
শুভেন্দুরও প্রচুর সহযোগিতা ছিল, আশ্রয় দেওয়া
অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসার সাপোর্ট দেওয়া। তাৎক্ষণিকভাবে অধিকারীদের সমর্থনে তাই বাম বুদ্ধিজীবীরাও ভেতরে গিয়ে আন্দোলনের একজন হতে পেরেছিলেন। তা না হলে যেভাবে লাশ গায়েব তখন পদ্ধতি হয়ে গিয়েছিল তাতে করে কলকাতা থেকে মদত দেওয়া কঠিন হোতো। এইসব তো পুরনো কথা শুভেন্দু যা বলতে চান। শুভেন্দু বক্তব্যের মধ্যে বলেননি তিনি বা তারা পাশে ছিলেন। বলেছেন নন্দীগ্রাম লড়েছে, স্থানীয় মানুষের আবেগকে রীতিমতো সম্মাননা দিয়েছেন। তাই এখন শুভেন্দু অধিকারীকে নিয়ে আসর সরগরম। হ্যাঁ রাজনৈতিক আসর সরগরম।
•অনেকে বলছেন শুভেন্দু অধিকারী বি. জে. পি-তে যাচ্ছেন। আমার মনে হয়, তা একদমই নয়। তবে বহুদিন থেকেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসন অনেক পুরনো তৃণমূল কংগ্রেস নেতা মেনে নিতে চাইছিলেন না। শুভেন্দু অধিকারীর এই নিভৃত উষ্মা তারই নামান্তর। তৃণমূলের একগুচ্ছ দলে ভেড়া নেতা তিনি মোটেই নন। আদতে তিনি ছিলেন যুব গোষ্ঠীর প্রধান নেতা।
পূর্ব-মেদিনীপুরের অধিকারী পরিবারকে বামেরাও জব্দ করে রাখতে পারেনি, যদিও সেখানে মমতা ব্যানার্জীর নেতৃত্ব শুভেন্দুকে সব সময় সাপোর্ট দিয়েছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মলগ্ন থেকে যদি ভালো করে এলাকাগুলো বেছে বেছে দেখেন তবে দেখবেন মেদিনীপুর ও পূর্ব-মেদিনীপুরে বামফ্রন্টের যতটা দুর্গ ছিল বলে মনে করা হয় তার থেকে বেশি দুর্গ ছিল লক্ষণ শেঠের ব্যক্তিগত দীপক সরকার শুকুর আলীদের ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য। বিশেষ করে পূর্ব মেদিনীপুর লক্ষণ শেঠের সাম্রাজ্য ছিল। কিন্তু লক্ষণ শেঠও অধিকারী পরিবারকে জব্দ করে রাখতে পারেনি। আবার তৃণমূলে, লক্ষণ শেঠের ঢোকার যাও একটা চান্স পরিবর্তী সময়ে হয়েছিল তাও শুভেন্দুদের জন্য হয় নি। অবশ্য নন্দীগ্রাম না হলে সেখানে কিন্তু তৎকালীন সময়ে বি.জে.পি ও কংগ্রেসের লড়াইটা ছিল বামেদের বিরুদ্ধে মাটি উদ্ধারের লড়াই। কিন্তু ১৯৯৬-এ কংগ্রেস থেকে মমতা ব্যানার্জীকে বহিষ্কার করার পর সেই লড়াইয়ের একমাত্র নেতা ও নেত্রী ছিলেন মমতা ব্যানার্জী ও তৃণমূল কংগ্রেস। কেশপুর থেকে বাঁকুড়ার চমকাইতলা কিংবা সুচপুর তখন পশ্চিমবঙ্গের ম্যাপে জ্বলছে। নন্দীগ্রাম নয়। নন্দীগ্রাম শেষ পেরেক হলেও পূর্ব মেদিনীপুর থেকে একমাত্র অধিকারী ভাইরা পশ্চিমের লড়াইয়ে শুকুর আলী দীপক সরকারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। মানস ভূঁইয়া কিন্তু কংগ্রেসে থেকে নিজের কেন্দ্রীটি শুধুমাত্র বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। পাশেই শুভেন্দুদের চৌকস লড়াই ছিল বলে তা সম্ভব হয়েছিল। তা নাহলে তার পক্ষেও বাম আমলে লক্ষণ শেঠের হাত থেকে জমি উদ্ধার করার সমস্যা ছিল। কিন্তু সি. পি. এমের এই জেলায় একটা দোটানার রাজনীতি ছিল। তা হলো তারা কিছুতেই মাইনাস লক্ষণ শেঠ ও পূর্ব মেদিনীপুরকে ভাবতে পারেননি। আর লক্ষণ শেঠও বাম-পার্টির তৃণমূলস্তরকে সেখানে বাড়তে দেননি। লক্ষণ শেঠের দায়িত্ব ছিল সি.পি.এম-এর কাঁড়ি খানেক সহযোগী সংগঠনের বড় বড় রাজ্য সম্মেলন সফল করানো সেখানে। কি হতো তখন। এক একটি ইউনিয়ন বা সংগঠন পূর্ব-মেদিনীপুরের এক একটি স্থানে তিনদিন ধরে গান্ডেপিন্ডে মাছ ভাত, মাংস ভাত বিরিয়ানি খেয়ে স্থানীয় ভাবে মিছিল মিটিং করে ফেরত চলে যেত। ব্যানারে, ফেস্টুনে লাল কাপড়ে এলাকা ছেয়ে যেত। খরচ সব লক্ষণ শেঠের। এমনকি হলদিয়া উৎসবে, এলিতেলি কবিরাও গিয়ে বামপন্থী কবিতা আউড়ে, তিনদিন গান্ডেপিন্ডে খেত এবং গাদা উপহার নিয়ে ঘরে ফিরতো। আখেরে বামেদের মাটি ধসতেই থাকতো। সাধারণভাবে বিপ্লবের মাটি মেদিনীপুর তা মেনে নেয়নি, এইসব বেনিয়মকে সহ্য করেনি। সেই মাটিকে শিশির অধিকারীর মতো মানুষরা ভোটের বাক্সে সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। শুভেন্দু তার অন্যতম কারিগর। কনটাই কো-অপারেটিভ তখনও তারা বে-হাত হতে দেননি। পারিবারিক ব্যবসা, জায়গাজমি, প্রতিপত্তি, নগদ টাকা সবকিছু তারা দিয়েছেন রাজনীতির স্বার্থে। বামেদের মধ্যে সোস্যালিস্ট পার্টি, ফরোয়ার্ড ব্লক, সিপিআই, আরএসপি থাকলেও সকলকে একঘরে করে রেখেছিলেন লক্ষণ শেঠ। যার ফলে অন্য বাম দলগুলোর সহানুভূতি ছিল শুভেন্দুর সঙ্গে। সকলেই চেয়েছিলেন লক্ষণ শেঠকে হঠাতে। শক্তিশালীতায়, অর্থে লোকবলে দ্বিতীয় দল ছিল প্রথমে কংগ্রেস তারপর ১৯৯৬থেকে তৃণমূল কংগ্রেস। যে কারণে ১৯৯৬-এ দ্বিতীয় বড় সভা হয়েছিল শিশির অধিকারীর আহ্বানে এবং রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়কে আনন্দবাজার পাঠিয়েছিল মমতা ব্যানার্জীর গাড়িতে সেই জনস্রোতকে কাগজের প্রথম পাতায় তুলে আনতে।
ইংরেজি সাহিত্যের রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তার আগে কখনও রাজনৈতিক আসরের বিবরণ লেখেননি। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের টানটান গদ্যে একদিনেই তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান হয়েছিল সারা বিশ্বজুড়ে।
পরেরদিন আনন্দবাজারের একটাও কপি আর পাওয়া যায়নি।
•পশ্চিম মেদিনীপুরের দীপক-তপন-শুকুর ও পূর্বে লক্ষণ ও তাদের অনুগামীরা দিন দিন বড়লোক, পয়সাওয়ালা হতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে তাদের এলাকায় তাদের একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়ায় সিপিএম-কে জেতানো। এর ফলে ভোট করতে না দেওয়াতে মানুষের বিরোধিতা বাড়তে থাকে। যত গ্রাম ঘিরে ফেলা হতে থাকলো, তত শুভেন্দুদের ঝুঁকি ও ঝাঁজও বাড়তে থাকে এবং এরা নিজেদের কেন্দ্রগুলিতে ভোটের মাটিতে বামেদের পরাস্ত করতে থাকে যার ফলে আরও রক্তারক্তি, খুনখারাপিতে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থকদের জমি জান প্রাণ যেতে থাকে ও শুভেন্দুদের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। যার ফলে স্বরূপ শুভেন্দু ২০০৬ থেকে নিজের ও পরিবারের আরও দুজনের ছবি বড় বড় ঢাউস মুখ দিয়ে দীঘা থেকে কাঁথি-নন্দকুমার পর্যন্ত মুড়ে দেয়। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস এসে গেলে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর তাই স্বাভাবিক ভাবে জোনাল নেতৃত্বের দ্বিতীয় সারির নেতা হিসেবে শুভেন্দু উঠে আসেন। কে হবেন যুব নেতা সেই আলোচনা শুভেন্দু ঘিরে চলতে চলতেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় উঠে আসেন সর্বোচ্চ আসনে। মনে হয় এখান থেকেই তৃণমূলের অন্দরে সামান্য সংঘাত শুরু হলেও তা কখনও প্রকাশ পায়নি। কারণ এই দলে মূল নেতা একজনই সমস্ত সিদ্ধান্ত তাঁকে বাদ দিয়ে নয় তিনি মুখ্যমন্ত্রী তিনি তৃণমূল গড়েছেন নিজের হাতে, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১-এর জেতার দিনে যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাড়ির ছাদে পায়চারি করতে ছাড়া আর কোথাও দেখা যায়নি, তার হাতে তৃণমূল কংগ্রেসের মূল চাবিকাঠি অর্থাৎ যুব সম্প্রদায় এখন। অথচ একসময় যা শুভেন্দুদের বেশ খানিকটা এক্তিয়ারভুক্ত ছিল। ওই একই কারণে দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি মুকুলের দল ছেড়ে যাওয়া। মন্ত্রী ও কয়েকটি জেলার দায়িত্ব ছাড়া এখন শুভেন্দু কিন্তু দ্বিতীয় সারির নেতাও নন।
•অথচ অধিকারীরা মনে করেন মূলত শিশির অধিকারীর নামে পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তির্ণ অঞ্চলে ২০১১ -এর আগে থেকেই তৃণমূল কংগ্রেসের সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে উঠেছিল। কিন্তু অধিকারী পরিবার যেভাবে পূর্ব মেদিনীপুর সংগঠন গড়ে দিয়েছিল এবং ধরে রেখেছিল তা এক কথায় উদাহরণ। এই কৃষিজীবী,মৎস্যজীবী ও শিল্পাঞ্চলে একসময় সিপিএম নয় সেখানকার সাম্রাজ্য লক্ষণ শেঠ চালালেও অধিকারীদের সাংগঠনিক ক্ষমতা দিন দিন বেড়েছে। পূর্ব মেদিনীপুরে দলনেত্রীর কাট আউট খুব সামান্য আগেও ছিল এখনও তাই। এই দেখাদেখি বছর তিনেক আগে সল্টলেকের পুর পিতা নিজের ছবি দিয়ে মুড়ে দিয়েছিলেন কিন্তু তিনদিনের মধ্যে বাইরে থেকে ছেলে গিয়ে সমস্ত কাটআউট খুলে দেয় এবং দল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে যান তিনি। এখানেই শুভেন্দুদের ক্যারিশমা। শুভেন্দুর জন ভিত্তি। প্রথম যে নির্বাচন তৃণমূল লড়েছিল তার দ্বিতীয় বৃহত্তম সভা হয়েছিল পূর্ব-মেদিনীপুরে। অতএব শুভেন্দু যদি কখনও চলে যান তবে দল গড়ে ফেলবেন। সেখানে মুকুল রায়ের সাপোর্ট পাবেন। এমন যদি হয় শুভেন্দু ও মুকুল একজোট হয়ে গেল। বিজেপি ও তৃণমূল দুটো দলকেই তখন তারা খেলাতে পারেন। তখন দিল্লিতে পর্যন্ত এদের জোট বাংলায় একটি পক্ষ হয়ে যেতে পারে এবং রাজ্য রাজনীতিতে মূল দল হিসেবে উঠে আসতে পারে। তবে আগামী নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠতে চলেছে সারাদেশের কাছে যুদ্ধের গর্ভগৃহ। যদি শুভেন্দু তৃণমূল কংগ্রেসে শেষ পর্যন্ত থেকে যান তবে তারা একটি দলের ভেতর দল করে নির্বাচনে নামতে পারেন।
•এদিকে আগামী নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা শুধুমাত্র কোনও দলে থাকবেন না একটি দলকে সাপোর্ট করবেন অথবা তাদের সমাজ থেকে উঠে আসা নতুন কোনও দলকে সাপোর্ট করবেন এইরকম নানা ইঙ্গিত বা রাজনৈতিক সমীকরণ উঠে আসতে চলেছে। ইতিমধ্যে বিজেপিও বিহার নির্বাচনে প্রতিকূলতার মধ্যে লড়ে যথেষ্ট ভালো ফল করায় তাদের জোর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় চলে এসেছে। হিন্দু মুসলমান ভোট সবক্ষেত্রে ভাগাভাগি না হলেও কে কীভাবে তা পাবেন তা এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। মুসলিম সমাজ থেকেও তারা এই প্রথম যে দলকে সাপোর্ট করবেন তাদের কাছে নির্দিষ্ট কথা চান।
•শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন যদি এইসময় রাজনৈতিক ইস্যুতে পিছিয়ে পড়ে তবে তা এই রাজ্যের পক্ষে হবে অত্যন্ত হতাশাজনক।
•তবে আরও একটা প্রশ্ন উঠে এসেছে তাহলো পুরোটাই এটা নাটক। কিন্তু মাঝখান থেকে লক্ষ্য করুন সেটা হলো এই রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে যা ভাবতেও পারছেন না তাহলো সি.পি.এম যদি কোনোরকমে টিকেট যায় তবু কংগ্রেসের এই ধাঁধার মধ্যে বেঁচে থাকা খুব মুস্কিল হতে পারে। 
©® অলোক কুন্ডু

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...