রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

আমাদের জাতীয় সংগীত 🌏 অলোক কুন্ডু


⛔ শান্তিদেব ঘোষ তাঁর বিস্তৃত লেখালিখিতে বলে গেছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অনেকগুলি। 

⛔অলোক কুন্ডু

• • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • •
• সম্প্রতি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে কোনও বক্তার মন্তব্যের পর আনপড় লোকেদের চর্চায় গেল গেল রব উঠেছে। সেই প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ সকলের পড়ে নেওয়া উচিত।
(এই লেখা শেয়ার করুন ক্ষতি নাই কিন্তু আমি লেখার আগে এ প্রসঙ্গে আর কেউ লেখেননি। তাই টোকাটুকি করবেন না) আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা ও স্বদেশী আন্দোলনে দেশ মাতানো জাতীয় সঙ্গীতগুলি কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি পায়নি। 

• শান্তিদেব ঘোষ তাঁর বিস্তৃত লেখালিখিতে বলে গেছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অনেকগুলি। 
মূলত ঠাকুর বাড়ির উদ্যোগে হিন্দুমেলার চল হয়েছিল। 

• ১৮৭৬ সালে, হিন্দুমেলার উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সমগ্র গান প্রকাশিত হয়েছিল, " জাতীয় সঙ্গীত " বইটি। 

•সেই পুস্তিকের জাতীয় সঙ্গীতগুলি লিখেছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, গোবিন্দচন্দ্র রায় প্রভৃতি। ভারতমাতা সুরেন্দ্রবিনোদিনী, সরোজিনি-নাটক, নীলদর্পণ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয় মোট ২৯ টি জাতীয় সঙ্গীত।

•শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, এইসব গানে অন্য দেশের সঙ্গে স্বদেশের তুলনা ও নিজের দেশের প্রাচীন হিন্দু গৌরবের কাহিনী বর্ণনা ক'রে ক্রমাগত দেশবাসীকে উদ্বোধিত করার চেষ্টা হয়েছিল। হেমচন্দ্র চন্দ্রের, "বাজ্ রে শিঙা এই রবে।" গোবিন্দচন্দ্রের, " কতকাল পরে ভারত রে। " সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, " মিলে সবে ভারতসন্তান। " এই গানটি সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশস্তি ছিল। বঙ্গদর্শনে তিনি বলেছিলেন, " গানটি ভারতের সব জায়গায় ধ্বনিত হোক--"বিংশতি কোটি ভারতবাসী", ভারতবাসীর হৃদয়-যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক। শান্তিদেব ঘোষ আরও বলেছেন, সঞ্জীবনী সভা উপলক্ষে গুরুদেব যে গানটি রচনা করেছিলেন সেই, " একসূত্রে বাঁধা আছি। " গানটি স্বদেশী চিত্তের উন্মাদনা, সঙ্ঘবদ্ধতার শক্তি ও জীবন-পণের দৃঢ়তা সেই গানে সুন্দর প্রকাশভিবে পেয়েছে। স্বদেশ পর্যায়ের গানের মধ্যে, " একসূত্রে বাঁধা আছি। " গানটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা। তবে গুরুদেব তাঁর রচনার অনেক গুলো গান বাদ দিয়েছিলেন। বাংলা ১২৯১ সনের মাঘোৎসব উপলক্ষে গাওয়া গান, " শোন শোন আমাদের ব্যথা। " পরে জাতীয় সঙ্গীত বইতে স্থান পেয়েছে। 

•১২৯৩ (বাংলা) কংগ্রেস অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত, " আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।" রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্-কে সুপ্রচলিত করেন। রবীন্দ্রনাথ, 

•১২৯২ (বাংলা)-এ। বঙ্কিমচন্দ্রের উপস্থিতিথে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম সুর রচনা করে শুনিয়েছিলেন এবং পরে বাংলা ১৩০৩-এ রবীন্দ্রনাথ, কংগ্রেসের সভায় নিজে গান। এর পর থেকে বন্দেমাতরম্-এর ব্যাপক প্রচার হয়। 
আশ্চর্যজনক বিষয় বঙ্কিমচন্দ্রের সুরারোপিত বন্দেমাতরম এখন আর কোথাও শোনা যায় না। আবার বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। ১৩১০-এ রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত পর্যায়ের গান ( স্বদেশ)  অয়ি ভূবন-মনমোহিনী, কে এসে যায় ফিরে ফিরে, আজি এ ভারত লজ্জিত হে, জননীর দ্বারে আজি ঐ, নব বৎসরে করিলাম পণ, হে ভারত আজি নবীন বর্ষে। শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, এই কটি গুরুদেবের জাতীয় সঙ্গীত। ১৩১২ তে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে, " এবার তোর মরা গাঙে বাণ এসেছে। " গানটি সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছিলেন, এ গান শুনে গঙ্গা বক্ষে ঝাঁপাইয়া পড়িবার উন্মাদনা সৃষ্টি হইয়াছিল। 

•১৩১৮ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য কাব্যে ভগবানের কাছে নৈবেদ্য উত্থিত করে এই গানের রচনা। পরবর্তীতে সেই গান, " জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে... " আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। 

⛔ ©® অলোক কুন্ডু। 

শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০

শ্রী ল প্রভুপাদ ও ইসকন : অলোক কুন্ডু


🌏 গান্ধীবাদী স্বদেশী থেকে সন্ন্যাসী গৌরাঙ্গে 
সমর্পিত প্রাণ কর্পোরেট জীবন থেকে এক 
আশ্চর্য ভিক্ষুক শ্রীল প্রভুপাদ - অলোক কুন্ডু ©

⛔ আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি ও কেউ কেউ পড়েছি মিশেল ফুকোর আত্মার যত্ন। যদিও এই ফরাসি দার্শনিক যৌনতার ইতিহাসও লিখেছেন সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। দক্ষিণী ও আদিগুরু যমুনাচার্য যিনি ছিলেন রামানুজমের (আয়েঙ্গার গোষ্ঠীর) গুরুদেব। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী অদ্বৈতবাদী দশনামী সম্প্রদায়। স্বামীজির -- নিরাকার অদ্বৈতবাদ। তোতাপুরী, বড়পলঙ্গ, তেঙ্গলঈ-ধারা, সীতরাম দাস ওঙ্কারনাথ থেকে শঙ্করের মায়াবাদ প্রায় সব মিলিয়ে ৯০০ বছরের একটি ফল্গুধারার মতো হিন্দুদের ধর্মের নানাবিধ চর্চা ও আত্ম উপলব্ধির বিষয় কিন্তু এইসব এত জটিল যে সাধারণ মানুষের দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয়নি, সে তাই সব সময় একজন গুরু খুঁজেছেন। কখনো হিন্দুরা তাদের ধর্মের তুল্যমূল্য বিচারে যায়নি। বরং স্বাধীনভাবে যে যার মতো মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী থেকেছে। একে অপরের দেখে দেখে নিজেরাই ধর্মের আচরণে হয়ে উঠেছেন নিজেরাই পুরোহিত। একদল অর্ধ শিক্ষিত পুরোহিতের
শেখানো বুলিও কেউ কেউ শিখে ফেলেছেন। অশিক্ষিতের হাতে পড়ে পুরোহিতরাই এখন জানে না যা করতে বলছে তা তারা জানেনা এবং জানতেও চায়না। ইতিহাস ও সাহিত্যের হাত ধরে ধর্মীয় মতবাদ যেমন এগিয়ে এসেছে, হিন্দুদের কাছে আজ সেটাই ধর্ম। 

⛔ধর্মীয় আচরণ তাই হিন্দুদের কাছে খানিকটা দুর্গা পুজোর হৈ-হল্লার মতো। যার ফলে গুরু গজাতে ভারতের নানা প্রান্তে কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রকাশ্যে স্বামীজিই প্রথম, ধর্মীয় যুক্তির কথা বললেন। তারও আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সারা ভারতে হিন্দুদের ধর্মের এই শাখা যা দক্ষিণে চালু ছিল তাতেই চৈতন্য এনেদিলেন। বিপুল জন সমর্থনে (রথ ও যাত্রাপালায় বাংলাদেশ এক নতুন সংস্কৃতি আবিষ্কার করলো উড়িষ্যা থেকে এল রথ) দেশকে ভক্তিরসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। মানুষের দুঃখ কষ্টে শ্রীকৃষ্ণ হলেন আশ্রয়। শুধু কৃষ্ণ নাম নিয়েই বহু মানুষ তখন থেকেই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নামে, হিন্দুদের মধ্যেই একটি নতুন সম্প্রদায়ের শ্রীবৃদ্ধি ঘটালো এবং এই সুযোগে সারা বাংলাদেশের মধ্যে কিছু ধান্দাবাজ গুরুর গুরত্বও বেড়ে গেল। একদিকে সমস্ত ধর্মমত থেকে এই মানবধর্মের যত প্রসার হতে লাগলো তত হিন্দু ব্রাহ্মণরাও নিজেরা জটাজুট হয়ে গুরু বনতে লাগলো। 

⛔ একদিকে স্বাধীনতার মতো উত্তাল আন্দোলনে মানুষের দিশেহারা অবস্থা। বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রামমোহন দ্বারকানাথ ঠাকুর ধর্মের বিচার বিবেচনার সাথে মানুষের অধিকার সুরক্ষার কথা ভাবছেন। বিদ্যাসাগরের কাছে পন্ডিতের ধর্মীয় ভাবাবেগের থেকে বাস্তব আচরণ বড় হয়ে দাঁড়ালো। রামমোহন আবার ধর্মকে প্রার্থনা সভায় নিয়ে গেলেন। দেবদেবীর মাহাত্ম্য মধ্যযুগে বাড়বাড়ন্ত হলেও বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের হাতে পড়ে তার নবজন্ম হলেও সেই ধারা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে পড়লো পরিচর্যার অভাবে। মানুষের কী করা উচিত তা তার বোধগম্য হচ্ছে না এরকমই পরিবেষ্টিত দেশে এলেন এক তিনি স্বামীজি। স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের চর্চা করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন কমপ্রোমাইজের কথা। আসলে আমার মনে হয় জীবনের সমস্তস্তরে সহাবস্থানের কথাই স্বামীজি বলতে চেয়েছিলেন।  কারণ তাঁর নিজের ধর্ম ছিল অদ্বৈতবাদ আর তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন মূর্তির পূজারী। 

⛔ শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের এই বুনোনকে দুহাতে তলতলে মাটির মতো নিয়ে যেকোনো মূর্তির মাঝে ভগবানের লীলা দেখাত পারতেন। যত মত তত পথের সন্ধান আসলে উদারতার জন্ম হলো শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য এইদেশে।সহজ ও সরল কথায় অন্যদের টেনে নিয়ে আসতে পারতেন নিজের কাছে। শুধুমাত্র শুনে শুনে তিনি পুরাণ মহাভারতের ব্যাখ্যা প্রাঞ্জলভাবে করতে পারতেন তাই সে যুগে ইংরেজি জানা রীতিমতো মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে যাওয়ার পথে এগিয়ে থাকা স্বামীজিকেও শ্রীরামকৃষ্ণ চুম্বকের মতো টেনে রেখেছিলেন। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার। পৃথিবীর বিরলতম ঘটনা। তাই এক সামান্য পূজারীর বাক্য ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেননি স্বামীজি। যদিও স্বামীজির ধর্মবোধ শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের কালীভক্তির কারণে যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর আর কখনো দ্বিতীয়বার শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেননি । কিন্তু স্বামীজিও ছিলেন যুক্তিবাদী এবং পুতুল পূজার বিরোধী। তিনি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছিলেন । অদ্বৈতবাদী স্বামীজি যখন হিন্দুদের দেবী দুর্গার পুজো করার মনস্থ করেন (Compromise) তখন কোনো শিষ্যই তার কাজে বাধা দেননি পরন্তু যে রাজা ও ব্যবসায়ীদের সাহায্যে স্বামীজি আমেরিকায় যেতে পেরেছিলেন সেইসমস্ত শিষ্যরা, রাজারা আনন্দিত হয়েছিলেন, এই ভেবে যে, যত মত তত পথকে স্বামীজি বাস্তবে করে দেখাতে পেরেছিলেন। শুধুমাত্র শ্রীশ্রী মায়ের কথামতো পাঁঠাবলি না করার বিষয়টি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। 

⛔ স্বামীজি নিজেই ধর্মের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন যার তাৎপর্য বোঝা আজ অত্যন্ত কঠিন। নিজে সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন দান চাইতে। পরিব্রাজক স্বামীজি যেখানে যেমন পেরেছেন মানিয়ে নিয়েছেন। পুরাণে সন্ন্যাসীকে ঘুরে ঘুরে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখতে বলেছে, যাতে একজন সন্ন্যাসী দেশের মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খিদের কথা জানতে ও তাদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং সকলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন স্বামীজি যতটা সম্ভব তাই করেছেন। তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে ১৯৩৮ সালে বেলুড় মঠ স্থাপিত হয়েছে। তার এত পয়সার অভাব ছিল যে শ্রীমাকে ঘুষুড়িতে টাকা পাঠাতে পারেননি সব সময়। তখন সারা ভারত ঘুরে মঠের জন্যে তাঁকে একটা একটা করে টাকা ভিক্ষা করতে হয়েছে। স্বামীজি জরুথ্রুস্টের ভক্ত ছিলেন। অনেক বক্তৃতায় তাকে বিদেশীরা অনেক সময় জরথ্রুস্টবাদী মনে করে ভুল করেছেন। নারীর অধিকার জরথ্রুস্টের মতের প্রথম অঙ্গীকারকে স্বামীজি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের গণধর্মমতও তাঁকে বিস্মিত করেছিল তিনি জেনেছিলেন শ্রীমদ্ভাগবতের নানা বিশ্লেষণ এবং তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে বারবার ধর্মের নানা পন্থার দীর্ঘ কাটাছেঁড়া চলেছে। তাই বিশ্ব ধর্মসভা যেখানে বসেছিল আজও সেই রাস্তার নাম স্বামী বিবেকানন্দের নামে হয়ে আছে। স্বামীজি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর অদ্বৈতবাদের রাস্তা অন্য এক মহত্বে বাঁক নিত যা আজ কারো পক্ষেই জানা আর সম্ভব নয়। নানা মতের সমন্বয় সাধন করতে তাঁকে যত্নবান হতে হয়েছিল। মূর্তির পূজারী হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে ছিলেন সর্বজনগ্রাহ্য একজন মানবরূপী মহামানব। তাই বেলুড় মঠের নকশায় হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম পারসিক ধর্মের সমস্ত মোটিফকে একত্রীকরণ করা হয়েছে। পরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন শিক্ষা -স্বাস্থ্য-রোজগার-মানব উত্থানকে মাথায় রেখে বিশ্ব মানব ধর্মের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। 

⛔ এই দেশে নতুন করে হিন্দু ধর্মের আর কোনো এমন বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দ্বারা পথের সন্ধান কারও চোখে আসেনি বা নতুন দিশা নিয়ে সমস্ত জগতের কল্যাণের পথ তেমন প্রশস্ত করার কথা কোথাও শোনা যায়নি। আদপে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে বিন্দু ধর্মের পূজা ব্যবস্থা প্রবেশ করিয়ে দিলেও তা কোনও অবাস্তব কিছু হয়নি। আমাদের অজানার নীচের অংশ আমরা যেন দেখতেই পাইনি। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের পর খুব কম সময়ের মধ্যে একক প্রচেষ্টায় এক বৃহদাকার কর্মযজ্ঞের সূচনা করে গেছেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী , সন্ন্যাসী শ্রী ল প্রভুপাদ মহারাজ । 

⛔ তিনি যা করলেন তা আরও বিস্ময়কর। স্বামীজি ছিলেন অদ্বৈতবাদী যে কারণে আমেরিকা ঘুরে আসার পর ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেশা নিয়ে স্বামীজিকে দক্ষিণেশ্বরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীকে জগন্নাথদেব দর্শন করা তো দূরে থাক মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের মতো উদার মহামানবের সংস্পর্শে এসে পুরীর মন্দিরে প্রবেশের এক মহা রসিকতা শুনিয়ে গেছেন আমাদের। আজও অনেক আজব ধর্মীয় আচরণে বন্দী আমরা, এই দেশে। আর এই দেশেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পান্ডারা নুলিয়াদের দিয়ে হত্যা করিয়েছিল, পা টেনে ধরে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিল। অন্যমতে গর্ভগৃহে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ সেই সময় সমস্ত ধর্মের মানুষ শ্রীচৈতন্যের সাম্যবাদী ধর্মের কাছে এসে ফল্গুধারার মতো মিশে যাচ্ছিল। যেখানে কাউকেই অচ্যুত ভাবা হয়না। ৫০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভূত হওয়ার সময়ে যা নির্দিষ্ট হয়েছিল মায়াপুরের কাছে। তাঁর জন্মস্থানের পাশেই। দলে দলে এক নতুন ধর্মীয় ভাবনায় এসে মিশ্রিত হচ্ছিলেন এই সৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণকে করেছিলেন তিনি জনগণের দেবতা ---" মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বঃত কৃষ্ণ জ্ঞান "(চৈতন্য চরিতামৃত)। 

⛔ স্কটিসচার্চে সুভাষচন্দ্রের এক ক্লাস নীচুতে পড়া ও সুভাষ অনুগামী অভয়চরণ দে স্বদেশী আন্দোলনে নেমে পড়লেন এবং ইংরেজদের দেওয়া কলেজের শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান করে তা নিলেন না। পরে বসু গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন। ৫৪  বছর বয়সে সন্ন্যাসী হন এবং ৭০ বছর বয়স যখন তখন মাত্র ১৫ ডলার হাতে নিয়ে অনির্দিষ্ট যাত্রায় আমেরিকা পৌঁছন সঙ্গে সঙ্গী - "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।" 
এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা। তিনি তখন শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁর কাছে আছেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য। তিনি বললেন শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান কোনো কিছুই নয় তিনি শুধুমাত্র ভগবানকে জানেন। কে এই ভগবান ? শ্রীচৈতন্য ৫০০ বছর আগে যে সাম্যবাদী ধর্মীয় আচরণ ও সংকির্তন গণভোট গণজমায়েত "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।" এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা। এই ভাবাবেগের পৃথিবীব্যাপী একটি প্রধান কার্যালয় মায়াপুরের ইসকন মন্দির। 
⛔©® অলোক কুন্ডু

ভারতীয় শাড়ির ইতিহাস : অলোক কুন্ডু


🇮🇳 শাড়ি নারীর এক অনন্য আভরণ

🌏 অলোক কুন্ডু ⛔

⛔ গ্রিস মেসোপটেমিয়া রোম সুমেরু মিশরীয় সভ্যতা ছাড়াও দেখা যায়, আসিরিয়া সভ্যতায় কাপড়ের প্রচলন ছিল। তখন অবশ্য স্ত্রী বা পুরুষের আলাদা কোনো কাপড়ের ভাগ ছিলনা । আর্যরা ভারতে
আসার সময় সঙ্গে করে " ভাসত্রা " শব্দ নিয়ে আসে। সংস্কৃত মতে যা কাপড় তখন অবশ্য চামড়ার কাপড় পরার রেওয়াজ ছিল। ঋকবেদ থেকেও আমরা শাড়ির কথা জানতে পারি। সিন্ধু নদীর তীরে আর্য সমাজে বয়ন শিল্পের পেশায় যুক্ত মানুষকে তন্তুবায় শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে পাণিণির রচনাতেও শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। " মহাদেব জাতক" নামক গ্রন্থে আছে -- " পীলেত্বা আপনেতাব্বা কারপাত্তা অহেংসু " অর্থাত শাড়ি ভিজিয়া অপনয়ন করিবার যোগ্য হইল " । মধ্য ভারতে সাটক বা সাটিকা শব্দের ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকেই কানে শুনে আসতে থাকে মানুষ। মানুষের সভ্যতার উৎপত্তি ও উত্থান থেকেই শাড়ি সভ্যতার বিকাশ। খুকি থেকে বুড়ি শাড়ি যুগে যুগে অনেক লুন্ঠন ভাঙচুর ও ফ্যাশনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে প্রাচীনতম পোশাক হিসেবে। জমকালো আবেদন ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে শাড়ি। সাধু দায়ানেশ্বরের লেখা পুথি থেকে ( ১২৭৫-১২৯৬) কান্দানাকি চোলি শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

⛔ আর্যদের আসার সময় থেকেই নিভিয়ে বা কোমর এবং কাঁচুকি শব্দের প্রচলন পাওয়া যায়। চীন থেকে হাজার বছর ধরে সিল্করুট ধরে সিল্ক ও সুক্ষ্ম রেশমি আসতো। এখন আসছে ভারতীয় ও বাংলাদেশের শাড়ির জন্য মুগা, সিল্কের খুব কম দামের সুতোও । উপনিবেশিক আমলে মাদাম বেলানোসের চিত্রে এদেশের শাড়ি পরা মহিলার পেইন্টিং দেখতে পাওয়া গেছে এ। ১৮৫১ তে ফ্যানি পার্কসের বিবরণ থেকে জানা যায় বাঙালি ধনী পরিবারের মধ্যে শাড়ি পড়ার ভালই প্রচল ছিল । ১৮৮৫ তে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিলেত থেকে ফিরে লিখেছিলেন বাঙালির পোশাক অতি আদিম এবং আদমিক " । মুকুন্দরামের কাব্যে ধুতি ও শাড়ির শব্দটি সমার্থক শব্দটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । তার লেখায় --সুরঙ্গ পাটের শাড়ি, তসরের শাড়ি , মেঘডম্বুর শাড়ি , ক্ষীরোদ শাড়ি ও খুঞ্চার ধুতির কথা থেকে আরও জানা যায় " তন্তুবায় ভুনি ধুতি খাদি বুনে গড়া " । মনে করা হয় ১৫/১৬ শতকে নারীরা কেবলমাত্র একখন্ড আধখানা শাড়ি পরতেন তেমনভাবে উদ্ধার্ঙ্গের জন্যে কোনো ব্যবস্থা ছিলনা । তারও আগে কটিবন্ধকে বলা হতো --"নিভি " । সিন্ধু সভ্যতায় একটি কাপড়ের টুকরো কে বলা হতো - কাঁচুকি । তখন কটিবন্ধ আর কাঁচুকি মিলে শাড়ির একটা ধারণা ধীরে ধীরে তৈরি হতে লাগলো। আবার অনেক পরে হলেও রাজা রবিবর্মার পেন্টিং-এ ১১ জন রমণী ১১ রকমের শাড়ি পরিহিত হয়ে বসে আছেন। বৃটিশ মিউজিয়ামের পেন্টিংয়ে দেখতে পাওয়া যায় বাঁ দিকে আঁচল ও দু পায়ে ভাগ করা সামনে কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরিহিতা ভারতীয় রমণীকে ব্রিটিশ গুয়াস পেন্টিং-এ। চন্ডীদাসের কাব্যে আছে-
" নীল শাড়ি মোহনকারী / উছলিতে দেখি পাশ।" সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ তে বলেছেন --" আমাদের স্ত্রীলোকেরা যেরূপ কাপড় পরেন তাহা না পরিলেও হয়।" ১৮৬৩-৬৫ আবার রাজকুমার চন্দ্র লিখেছেন--
"দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেংটা (আক্কেল
গুড়ুম)"। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু তার সেকাল আর একাল গ্রন্থে পোশাক নিয়ে মন্তব্য করেন যে --আমাদিগের বাঙালি জাতির একটি নির্দিষ্ট কোনো পরিচ্ছদ নাই "। যোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি শাড়ির জন্যে গুজরাট থেকে তুলো আসতে থাকে আর তার বদলে তৎকালীন বাংলা থেকে যেতে থাকে রেশম। ইতিহাসে রাফেল ফিচার (১৫৮০--৯৯)-এর বিবরণের পর ভারতীয় শাড়ির একটা পাকাপাকি রেকর্ড নথিবদ্ধ হয় । মহাভারতে শাড়ি নিয়েই মহাকাব্য বাঁক নিয়েছে। দ্রৌপদীর শাড়ি কাহিনি কে না জানেন,
চান্দেরি ? সাহিত্য, বাণিজ্য ও ইতিহাস ঘাঁটলে মেয়েদের শাড়ি তৈরি ও পরার এক বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায়। সংস্কৃত " শাটী " শব্দ বা " সত্তিকা " থেকে শাড়ি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সিন্ধু এবং মেহেড়গড়ের অনার্য সভ্যতার ধ্বংসাবশাস থেকেও শাড়ি পরিহিত রমণীর খোঁজ মেলে। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞাননন্দিনী
প্রথম বঙ্গদেশে পার্শি স্টাইলে শাড়ি পরে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। পাল আমলের (৭৫০ থেকে
১১৬২ ) পাহাড়পুরের ময়নামতি ভাস্কর্য ও পোড়ামাটির মন্দির ও দেওয়াল চিত্রে শাড়ি পরা নারীকে ইতিহাসবিদগণ বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের মাধ্যমে অনেক আগেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। অষ্টম শতাব্দী থেকে শাড়ির প্রচলন নানা মূর্তিতে অনেক পরিমাণে পাওয়া যেতে থাকে। ড. নীহাররঞ্জন রায় আধখানা শাড়ির উল্লেখ করেছেন। বিনা সেলাই করা কাপড় হিসেবেই শাড়ি নারীর আবরণ ও আড়াল হিসেবে উঠে এসেছে। কখনো তা ধীরে ধীরে দুপাট হয়েছে । এখনও অসমে বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই দুপাটি শাড়ির প্রচলন রয়ে গিয়েছে । প্রথম দিকে শাড়ি কেবল নারীর নিম্নদেশে ঢাকার জন্যে প্রচলিত ছিল। দক্ষিণ ভারতে হিন্দু রাজাদের আমলে মেয়েদের  " স্তনকর " নামে একটি কর চালু ছিল এ থেকে মনে করা হয় ভারতীয় নারীর মধ্যে একপাটের বা অর্ধেক শাড়ি পড়া প্রচলিত ছিল। চোলির কথাও প্রসঙ্গে উঠে আসে বিশেষভাবে-- সিনেমার গানে অন্যভাবে তা ব্যবহৃত হলেও তা প্রাচীন যুগে শাড়ির অংশবিশেষ বলেই মনে করা হয়। কোনো কোনো স্থানে হয়তো উর্দ্ধাঙ্গে কাঁচুলি বা অন্য কোনো ভাবে আড়ালের ব্যবস্থা ছিল। ব্রিটিশ আমলে মেয়েদের অন্তর্বাস ও ফুলহাতা ব্লাউজ পরার স্টাইল ও কৌশল ছড়িয়ে
পড়ে। কলকাতায় ঠাকুর বাড়িতে অন্তর্বাস প্রচলিত হলেও রবীন্দ্রনাথ পরিবেষ্টিত ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা দু-ভাঁজের শাড়ি পরিহিত হয়ে বসে আছেন এরকম অনেক আলোকচিত্রতে তা দেখতে পাওয়া যায় (সেখানে কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরিহিত কেউ নেই)। গুপ্ত
যুগে ( ৩০০--৫০০) অজন্তা-ইলোরার ভাস্কর্যে ও দেওয়াল চিত্রে শাড়ির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কালীদাসের শকুন্তলা ও কুমারসম্ভব কাব্যগ্রন্থে শাড়ির উল্লিখিত আছে। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে বিদ্যার শাড়ি পরার উল্লেখ দেখতে পাই । আবার ভারতের হিন্দু মতবাদে যেকোনো পুজোয় তসরের শাড়ি পরার প্রচলন ধর্মের সঙ্গে মিথ আকারে চলে আসছে। যেহেতু তসরে প্রাণি হত্যা হয়না তাই পুজোতো তসর বা পাট থেকে তন্তু সংগ্রহ করে তসরের সঙ্গে মিলিয়ে ঠাকুর ঘরে সনাতন হিন্দুদের একটা রীতি চলে আসছে কারণ এই শাড়িকে পুরোহিত এবং মেয়েরা দুপক্ষই ব্যবহার করে থাকে। সাধারণভাবে এদেশে মুগল সম্রাটদের সময়ে যখন জমিদারি প্রথা চালু হয় তখন জমিনদারদের বাড়িতে ইংরেজ মেমেদের যাতায়াত তৈরি হয় এবং মনে করা হয় এই সময় থেকে ভারতে ও বঙ্গদেশে ধনী বাড়ির মেয়েদের মধ্যে শাড়ি পরার প্যাঁচ-কুঁচি পদ্ধতি-আঁচলের আবষ্কার হয়। অন্যভাবে শাড়ি বিত্তবানেদের ঘরে প্রবেশও করে।
শাড়ি পরার ধরণ, রীতি, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও তার বিন্যস্ত রূপ, কুঁচি ,একভাঁজ ,দুভাঁজ, একপেঁচে, দুপেঁচে, টানটান আঁচল রীতি, পরম্পরা ও পরিপাটি হয়ে  আধুনিকতায়-র পথ ধরে এই স্টাইলে আসার মধ্যে শাড়ির একটা ইতিহাস মোটামুটি ৫৫০০ বছরের পুরাতন বলেই ইতিহাসবিদরা মনে করেন। মুগল ও মগ রমণীদের হাত ধরে খানিকটা আকবরের সৌজন্যে শাড়ি শিল্প একটা স্থান করে নেয়। মনে করা হয় হুমায়ুনের আমলে কাশিতে প্রথম শাড়ির কারখানা তৈরি হয়। অনেকে বলেন তারও আগে মহাভারতে চেদিরাজ শিশুপালের সময় থেকেই শাড়ির ব্যবহার শুরু হয় এবং মধ্যপ্রদেশের চান্দেরি নামকরণ আসলে চেদি থেকেই এসেছে এবং দ্রৌপদীর অঙ্গে যে শাড়ি ছিল তার নাম আসলে চান্দেরি (পরে যখন চান্দেরি শাড়ির কথা আসবে তখন সেই আলোচনা করবো ) । আবার ইংরেজ আমলে এই শাড়ি পরার রীতি নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের মেয়েদেরকে অসম্মানজনক কথাবার্তা শুনতেও হয়। তবে বহু উত্থান পতনে শাড়ির ইতিহাস দীর্ঘতর যে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ভারতীয় সমাজে অবাঙালিরা শাড়িকে শোভিত করেছেন ও নানা স্টাইলে তা পরারও কায়দা এনেছেন । সিনেমায় রাজকাপুর তার নায়িকা পদ্মিনীকে একটু আঁটোসাটো শাড়িতে পছন্দ করতেন। শাড়ি পরিহিতা নার্গিসকে তিনি বৃষ্টির সঙ্গে গানজুড়ে পৃথিবী বিখ্যাত করে
দিয়ে গেছেন। নায়িকা মুমতাজ টাইট শাড়িতে ও ছোটহাতা ব্লাউজে এক অভিনবত্য এনেছিলেন। বাংলায় শাড়িতে সুচিত্রা সেন একটি যুগ তৈরি করে গেছেন। মুগল আমলে একটি ছোট বাঁশের কৌটতে একটি মসলিন শাড়ি সম্রাট আকবরকে উপহার দেওয়া হয়েছিল যা পরীক্ষার জন্যে সম্রাট আকবরের সামনে সেটাই একটা গোটা হাতীকে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল।  রবীন্দ্রনাথের গল্পে পাওয়া যায়- উমার চরিত্র নির্মাণে শাড়ির কথা। একসময় বাংলায় ফুটি তুলো চাষ হতো। অনেকেই মনে করেন ওই তুলো থেকে মসলিনের কাপড় তৈরি সহজ হতো। ইংরেজরা বঙ্গদেশে ওই তুলোর চাষ বন্ধ করে দেন। বিদেশী বণিক ও ঐতিহাসিক ফ্রাঁসোয়া তেভারনিয়েরের বিবরণ থেকে ভারতীয় মেয়েদের শাড়ি পড়ার একটা ইতিহাস জানা যায়। অনেক ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন ১৭ শতকে ভারতে শাড়িবোনা ব্যাপকভাবে শুরু হলেও ১৯ শতকে এর কদর বেড়ে যায়। ডাচেরা বাংলার রেশম ও গুজরাটের পাটোলা কাপড়ের কিনে নিয়ে গিয়ে এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যে শাড়ি ও তা থেকে পোশাক তৈরি করে এশিয়া ইউরোপে ব্যবসা শুরু করতে শুরু করে এবং তার ফলে নতুন করে ভারতীয় কাপড় বা শাড়ির সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে। " আগে ওকে বারবার দেখেছি/ লালরঙের শাড়িতে/ দালিম ফুলের মতো রাঙা/আজ পড়েছে কালো রেশমের কাপড়/ আঁচল তুলেছে মাথায়।" অথবা -" বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়।" ১৯১০ সালে ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আছেন প্রতিমা, বেলা
মীরা ও রথীন্দ্রনাথ। সেই ছবিতে ঠাকুর বাড়ির
তিন মেয়েদের দু ভা‌‌‌‌‌‌‌‌জের শাড়ি পরিহিত হয়ে বসে থাকার ছবি সঙ্গে ব্লাউজ পরিহিতা দেখতে পাওয়া
যায় কিন্তু ওই ছবিতে কেউই কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরে
নেই। এতো গেল রবীন্দ্রনাথের কথা। ১৯২৮ সালে
একটি প্রামাণ্য জলরঙের ছবির পাওয়া যায় যেখানে
চারজন ভারতীয় রমণীদের ছবিতে তাদের ব্লাউজ পরিহিত অবস্থায় দেখা যায় ( শিল্পী এম ভিধুরন্ধর)। হান্টার ও উডের ডেসপ্যাচে ভারতীয় সুতি ও রেশমি শাড়ির ও বয়ন শিল্পের কথা জানা যায় । পাহাড়পুরের অষ্টম শতাব্দীর যে নারী মূর্তি উদ্ধার হয় তাই থেকে মনে করা হয় সেই সময় আধখানা শাড়ি পরার প্রচলন ছিল। সেই সময় শাড়িকে জুড়ে জুড়ে পরাটা প্রায় শাস্ত্রের বিরোধী ছিল। মধ্যযুগে ঢিলা করে কোমরে জড়ানো আর পেছন দিকে যেমন করে হোক আঁচল ফেলে দেওয়াই ছিল শাড়ি পরা। একটা সময় ছিল যখন লম্বা কাপড় জড়িয়ে পরাটাই ছিল রেওয়াজ পেটিকোট ও ব্লাউজের ভাবনা তখন আবিষ্কার‌ই
হয়নি। আসলে আদিম যুগ থেকেই আজ পর্যন্ত নারীর
অঙ্গে চাপানোর আগে পর্যন্ত শাড়ি পুরুষের হাতেই
তার কলা-কৌশল , টানা-ভরনা , টানা-পোড়েন,
মাকুর (এক ,দুই,তিন) ব্যবহার , বুনন রীতি,
সৌন্দর্যবোধ, মোটিফের জাদু , জমকালো করা,
আবেদনমোহিত করা, অমেয়, নান্দনিক, পরিশ্রম
থেকে ঘাম ঝরানো ও তাকে শিল্প-সুষমায় ভরিয়ে
দেওয়ার পেছনে পুরুষের একাগ্রতা ঐকান্তিক নিষ্ঠা প্রেম ও বাহুবলের এক অনন্য পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও ইদানিং মেয়েরাও সুতো তোলা রঙ করার কাজে সাহায্য করছে তবুও যে অধ্যবসায় দিয়ে শাড়ি বুনতে একজন পুরুষের জীবনের আনন্দের সময়টা অন্ধকারে কেটে যায় যা কেউ ভেবেই দেখেনা। সুতো তৈরি থেকে রঙ করা শেষে মাড় দিয়ে পালিশ করে দোকানে গেলেও শাড়ি পুরুষের হাতের নাগালের বাইরে যায়না। বিশেষ করে এদেশে ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকেই শাড়ি ও তার অ্যাক্সেসরিজের প্রকাশ ঘটে।
তারপর হিন্দি সিনেমার সৌজন্যে শাড়ি আরও কৌলিন্য পায়। এখন নানা ডিজাইনার শাড়ি ব্র্যান্ড হিসেবে উঠে এসেছে। অভিনেত্রী রেখার এক রঙ্গা শাড়ি পড়ার সঙ্গে লম্বা হাতের ব্লাউজ ও তার ওষ্ঠরঞ্জনী সব নিয়ে রেখার শাড়ি পরার কায়দা এখন খ্যাতির তালিকায়। সত্যম শিবম সুন্দরমের মিনি শাড়ি রাজকাপূরকে ভারতীয় সিনেমার শাড়ির ডিজাইনার বলা যেতেই পারে। হর দিল যো প্যার করেনা ও গানা
গায়েগা "সঙ্গম"এর গানের সিকোয়েন্স -এ
বৈজয়ন্তীমালাকে দেখতে পাই টানটান ডিজাইনার
শাড়িতে। ইতিহাসে পাই মধ্যপ্রদেশের মহেশ্বরের উপাসিকা রানী অহল্যাবাঈকে। রানীকে ও মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছে চান্দেরি শাড়ির কাছাকাছি মহেশ্বরী শাড়ি। গুজরাটের পাটনের সোলাঙ্কি রাজাদের আমলে ৮০০ বছরের বেশি ধরে চলে আসছে পৃথিবীর বিখ্যাত শাড়ি পাটোলা যার দাম ৫/৭ লাখ। চান্দেরি ও
কাঞ্জিভরম‌ও দামে কম যায়না এদের দাম‌ও ৩/৪
লাখ পার করে পাওয়া যায় । শোনা কথা আনুষ্কা
ওর রিসেপশনে ৫ লাখের বেনারসি পরেছিলেন তবে এই সব শাড়ি একটাই বোনা হয় । পুরাণে পাওয়া
যায় মার্কন্ড ঋষির বংশোদ্ভূত শিল্পীরাই কাঞ্চিপূরমে
" কাঞ্জিভরম " শাড়ি তৈরি করতেন । পুরাণে আছে ভগবান বিষ্ণুর পছন্দ রেশমি ও রঙিন আর শিবের সাদা। এই কারণে কোনো কোনো শাড়ির রঙ তৈরি হয়েছে। কাঞ্জিভরমে ভারতীয় সমস্ত মোটিফ নিয়ে
দেবতার জন্য তৈরি হয়েছে শাড়ি। মোটিফ গড়ে উঠেছে সেই সময়ের সম্রাট, রাজা ও দেবতাকে
ঘিরে। মনে করা হয় দাক্ষিণাত্যের চোল রাজাদের আমলে থেকে চোলি বা আঁচলের পরম্পরা চালু হয়েছে। পল্লবরাজ থেকেই যে আসলে পল্লু কথাটা
এসেছে এতেও একটা প্রমাণ মেলে পল্লু অর্থাৎ
আঁচল। তখন থেকেই মেয়েদের উর্ধাঙ্গের কাপড়ের প্রচলন বলে মনে করা হয় । ইন্দোনেশিয়ায় বাঁশ
দিয়ে রঙ করার পদ্ধতিতে উড়িষ্যা আর পচমপল্লীর ইক্কত শাড়িও দামে ও ঐতিহ্যের এক ভারতীয় হয়ে উঠেছে। বেনারসি নিয়ে তো আলাদা করে লিখতে হবে। এই শাড়ি বেনারসি ও বাংলাদেশের একমাত্র বিয়ের শাড়ি হয়ে উঠেছে। মনে পড়ে যায় উত্তমকুমারের মুখে -" যদি ওই চোরকাঁটা হ‌ই শাড়ির ভাঁজে " শাড়িকে ভাঁজে ভাঁজে বিন্যস্ত করতে বেশ কয়েক বছর আগে শাড়ি পরানো শেখাতে নিউ
দিল্লির জ‌ঙপুরাতে রিতা কাপূর স্কুল খোলেন। ১০৮ ধরনের শাড়ি সেখানে পরা শেখানো হয়। শাড়ি স্মার্ট হয়ে ওঠে বিমানবালাদের হাত ধরে। এদেশে পুলিশ ও মিলিটারি অফিসারদের শাড়ি পরার রেওয়াজ আছে তবে সেখানে বেল্টের একটা সংযোজন আছে। একটা সময় ছিল যখন পাঁচতারা হোটেলে শাড়ি পরাবার জন্য পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। বিদেশে শাড়িকে ছড়িয়ে দিয়েছে ইসকন সম্প্রদায়। পাকিস্তানের করাচিতে মোহাজি শাড়ি আর ধনীদের মধ্যে পাটোলা কোনোরকমে টিঁকে আছে সেখানে। বাংলাদেশ এখনও শাড়িকে টিকিয়ে রেখেছে। এখন শাড়ির মাপ ১২ হাত ১৮ ফুট ৪ থেকে ৯ মিটার। তবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আবার তার চন্দ্রনাথে বার্মিজ রমণীদের রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার স্মার্টনেস দেখে বাঙালি ললনাদের শাড়ি পড়া রমণীদের জড়সড় ভাবে দেখে দুঃখিত হয়েছেন। যদিও সেই যুগ আজ আমূল বদলে গেছে। আজ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেগনের পার্টিতে সোনিয়া গান্ধির পরা পাটোলার তখন দাম ছিল তখন পাঁচ লাখের মতন। (কপিরাইট- Alok
Kumar Kundu / আলোক কুন্ডু
( আলোক কুন্ডু রং লেখালিখি ও কবিতা , ফেসবুক পেজ । alokkundu.blogspot.in)

© অলোক কুন্ডু

শাড়ি : অলোক কুন্ডু-র কবিতা


🌎⛔🌐⛔🌏⛔🌎⛔🌐⛔🌏⛔

বড় শাড়ির শখ ছিল / অলোক কুন্ডু

রাজশাহী-রেশমি ঢাকাই-জামদানি 
ব্রোকেট-জর্জেট-মাইসোর সিল্কে 
তার মা কে দারুন মানাতো। 
ক্লাস ইলেভেন যখন 
মা বলতেন--এখন থেকেই শাড়ি পরবি রে ?
কলেজে উঠলে সব নিয়ে নিস 
মায়ের মুখ থেকে হরেক শাড়ির নাম শুনতে শুনতে
মুখস্থ করতো মেয়েটা 
মা বলতেন আহা মেয়ের শখ দেখ ।

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার 
সেই থেকে শাড়ি দেখলেই 
মেয়েটা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেত
এঘর থেকে ওঘরে।

ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনই পরে গিয়েছিল 
মায়ের মুগা-মেখলাখানা
আর সেদিনই আলাপ হলো অমিতেশের সঙ্গে
আলাপ যত বাড়তে লাগলো
তত একটার পর একটা শাড়ি ভাঙে
কখনো আদিবাসী-উমারিয়া তো বিষ্ণুপুরী
আরানি-রেশম তো কখনো কাঞ্চিপূরম 
পাইথানি-সিল্ক থেকে মসলিন 
কোনোদিন ভাসতারা-কটন।

অমিতেশ শাড়ির খুঁট ধরে একটান দিয়ে বলতো 
খুব যে সাজা দেখছি আজ 
কারণ টা কি শুনি ? 
কখনো ভাগলপুরী-কটনে কফি হাউসের হৈচৈয়ে
দুজনে চলে যেত নির্জনে
অমিতেশ ধরে রাখতো ইক্কতের খুঁট
অবাক তাকিয়ে বলতো 
এত সেজে বুঝি কেউ পড়তে যায় 
মেয়েটা বলতো, জানো সাহেব--
কাঁধের ওপর থেকে পিছনে 
এই যে মস্ত ঝোলা দেখছো 
ওই ঝোলায় তোমাকে বেঁধে রাখবো কিন্তু
অমিতেশ বলতো- বেঁধে রেখে দেবে তো এই আচ্ছা তথাস্তু। 

দুবছরের সিনিয়ার অমিতেশ 
আমেদাবাদ থেকে পিএইচিডি করে ফিরে
সটান এসেছিল দুপুরে তাদের বাড়িতে 
সদর থেকে চিলেকোঠায় গিয়ে থেমেছিল
অমিতেশ বলেছিল চোখ বন্ধ কর উঁহু দেখবেনা
চুপিদেওয়া চোখে দেখেছিল সে --
লালপেড়ে গঙ্গাজল রঙের পাটোলা
সে কি দৌড়োদৌড়ি ছাদের ওপর 
শাড়িটা পরিয়ে ছাড়লো শেষে
নীচে নেমে দরজা বন্ধ করে একছুটে আয়নায় গিয়ে দাঁড়ালো
পেছন পেছন এসে ঘোমটা তুলে অমিতেশ বললো
বা এত সুন্দর তো কখনও দেখিনি
ঘন্ট শুক্তো মাটনের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে চলে গেল অমিতেশ। 

বাবা বলেছিলেন শাড়িটার নাম যেন কী 
মা যুগিয়ে দিয়েছিলেন - পাটোলা 
বাবার মুখ থেকেই প্রথম শোনা
গুজরাটের পাটনে এই পৃথিবী বিখ্যাত শাড়ি তৈরি হয়
বাবা জিজ্ঞেস করেননি দাম 
বিশ হাজার টাকা দামের স্টিকারটা
সে আগেই তুলে ফেলছিল 
শাড়ি পাগল মেয়েটা শাড়িটার যত্ন করতো বটে
মা বলতেন ওটা আর কবে পরবি বলতো ?
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার।

প্রতি বছর পুজোতে মা বলতেন 
আমার কেনা শাড়ি তো তোর পছন্দ হবেনা
মেয়ের আমার বড় নাক উঁচু।

কত বছর যে চলে গেল 
তারপর কে জানে
অমিতেশের চিঠিগুলো জুড়ে জুড়ে 
মস্ত একটা আঠারো ফুট সম্বলপুরী 
বা পচমপল্লীর পৈঠানী 
কিংবা বারো হাত বোমকাই হয়ে যেতে পারতো। 

শেষে একদিন টরেন্টোর অলিভ অ্যাভিন্যু থেকে
চিঠি আসা একবারে বন্ধ হয়ে গেল 
পাটোলাটা জীবনে দ্বিতীয়বার কখনও ছোঁয়া হলোনা আর।

অমিতেশের ঘামলাগা শাড়িগুলো 
আর কোথাও পরে যেতনা ইদানিং
আলমারির থাকে থাকে
বেঙ্কটগিরি লুগালে গাদোয়াল ক্লাসিকেট
চান্দেরি কটাদরিয়া ঢাকাই-জামদানি
বলরামপূরম মঙ্গলগিরি শান্তিপুরি বাঁধনি
বেগমপরি কাঞ্জিভরম কটকিগুলো
আর ভাদ্রমাসের রোদ দেখতে পেত না।

মা বললেন, বর আর পছন্দ হয়না 
শেষে বাবাও বলতে শুরু করলেন --
মেয়ের আমার ভীষণ নাকউঁচু 
প্রথম প্রথম লুকিয়ে চোখ মুছতো
এইভাবেই দুটো বছর 
তবু আশা ছাড়েনি মেয়েটা
গোঙানির কোনো শব্দ কেউ টের পাইনি তার। 

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
বড় বরেরও শখ ছিল মেয়েটার।

দ্বিতীয় পক্ষের বলে বাবা মা রাজি হননি কিছুতেই 
শেষে জোর করে রাজি হয়ে গেল নিজেই
বললো আমার তো অপছন্দ হইনি 
তোমাদের এত আপত্তির কি আছে বলোতো। 

একটা লাল রঙের কাতান বেনারসীতে 
ভারি মানিয়েছিল মণিকুন্তলাকে
হুল্লোড় করতে বন্ধুরাও এসেছিল দল বেঁধে 
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। 

ফুলশয্যার রাত কাটলে 
বাড়ির সকলের সঙ্গে মিশে গেল সে 
সেদিনই সুশোভন খুলে দেখালো একটা আলমারি 
আলমারিটায় শুধু সার সার শাড়ি আর শাড়ি
তাকে তাকে পারফিউমের সুগন্ধি লেগে আছে 
যতক্ষণ শাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল
ততক্ষণ এক হাতে সুশোভনের পাঞ্জাবিটা
চেপে ধরে রেখেছিল। 

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার 
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে 
শাড়ির সব নাম মুখস্থ করেছিল। 

আলমারিভর্তি কলমকারী ধনিয়াখালি কলাক্ষেত্র শোলাপুরি ভেঙ্কটগিরি তাঞ্চোই বালুচরি 
কড়িয়াল-বেনারসি কিমেরা-সুনোঢ়ি ওভেন পাট্টু
নৌভরী নারায়ণপেট কোসা সিল্কের মতো 
শাড়ি গুলোর নাম বলতে লাগলো একটা একটা করে
শাড়ির পাহাড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো 
একটা গঙ্গাজল রঙের লালপেড়ে। 

মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে 
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা। 

যে গোঙানিগুলো এতদিন শব্দ করেনি 
যে কান্নাগুলো লুকিয়ে যেত চটপট
যে কষ্টটা গলার কাছে আটকে থাকতো
আজ তা আর সামলানো গেলনা কিছুতেই 
কোনোরকমে আলমারিটা বন্ধ করে 
পিঠ দিয়ে দরজা বন্ধ করলো
এই প্রথম হ্যাঁ এই প্রথম ভেঙে গেল বাঁধ
সুশোভনের মুখের দিকে তাকালো একবার 
সুশোভন কিছু জানতে চাইলো না 
দু হাতে গাল ধরতেই 
মেয়েটা বুকের পাঞ্জাবি আঙড়ে ধরলো দুহাতে
গোঙানিগুলো ততক্ষণে কাঁন্নার শব্দে বাঁক নিয়েছে 
সুশোভন অস্ফুটে কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল
সুশোভন টের পাচ্ছে পাঞ্জাবিটা ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে  
মণিকুন্তলা ফুঁপিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে
সুশোভন নীচু স্বরে বললো কুন্তলা কি হয়েছে
মেয়েটা মাথা নাড়তে শুধু। 

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার 
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে 
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা। 

©® অলোক কুন্ডু ⛔

বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০২০

শতবর্ষে ছাপচিত্রি শিল্পী হরেন দাস : অলোক কুন্ডু






⛔ শিল্পী হরেন দাস : অলোক কুন্ডু

(১) 🎨 • ইউরোপ ও পৃথিবীতে অষ্টাদশ শতককে দিগদর্শনের দশক বলা যেতে পারে। যেখানে মুদ্রণ শিল্প ও ছোটগল্প থেকে কল্পনা নির্ভর অবাস্তব রোমান্টিক কাহিনীর উদ্ভাবনার কাল বা আঁতুড়ঘরের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ইউরোপীয় শিল্পকলার বিস্তার ও উদ্ভাবন তারও আগে। শিল্পকলার মন্ময়তার কথা বলতে গেলে পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলতে গেলে সাহিত্য সংস্কৃতির প্রভাব আলোচনা করতে গেলে ইউরোপের প্রভাব ফেলে দেওয়া যায়না। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা সর্বোপরি পেন্টিং সম্পর্কে বলতে গেলে ইউরোপীয় অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু ছাপচিত্র আবিষ্কার হয় অষ্টম শতাব্দীতে, চীনে। ভগবান বুদ্ধের বাণী ও ছবি আজ্ঞা ও উপদেশ গ্রথিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। ছাপচিত্র আধুনিক হয়ে মাথা তোলে, টেকনোলজির সাহায্য নেয় জাপান, স্পেন জার্মানিতে। আমাদের দেশে ১৫৭৯-এ কেরালার খ্রীস্টানদের কাছ থেকে যীশুর ছবি ও বাণী ভারতে ছাপচিত্রের প্রচার পায়। ১৮১৬ সালে সমগ্র বাংলাদেশে অন্নদামঙ্গল কাব্যে ছাপচিত্রের গরিমা মানুষ বুঝতে পারে এখানে। ১৮৫৩ সালে কলকাতার বউবাজারে বটতলার বইয়ে ছাপচিত্রের আকাশে নক্ষত্র সমাবেশের আয়োজন দেখা যায়। উত্তর ও মধ্য কলকাতা জুড়ে শিল্পী ও কর্মকার ছুতোর সম্প্রদায়ের জোটবদ্ধতা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে শিল্পীরা নিজেরাই লোক শিল্পীদের মতো করে নিজেদের শিল্প গড়ে নেয়। রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে জোড়াসাঁকোর বিচিত্রা স্টুডিওতে (১৯১৬) মুকুল দে ছাপচিত্রের চর্চা শুরু করেন ( উল্লেখ্য মুকুল দে আইনস্টাইনের দু ঘন্টা ধরে পোট্রেট করেছিলেন।)

(২) 🎨• অবনীন্দ্রনাথের নতুন চিত্রধারণার বিরুদ্ধে ধিক্কার বিস্তৃত হচ্ছে এখানে। অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথের নামকরণের দ্বারাই প্রবাসীর উন্মোচন হচ্ছে। মর্ডান রিভিউতে " সীতা " ছেপে বের হচ্ছে সঙ্গে ভারতীয় শিল্প সুষমার একনিষ্ঠ প্রচারক এক আইরিশ যুবতীর ( নিবেদতা ) প্রশংসিত বিবরণ থাকছে সঙ্গে। বিংশশতাব্দীর প্রারম্ভে ১৯০১-এ জাপানি চিত্রকর ওকাকুরা কাকুজো এলেন জাপানি ওয়াস পদ্ধতি নিয়ে। শিল্পের সংস্কারবাদী চিন্তাধারার প্রয়োগ এবং ঔপনিবেশিক বিস্তারবাদের নকল ও অনুকৃতি ধারাকে রুখে দিয়ে ভারতীয় ধারার সংস্কার সাধন করে ভারতীয় বোধের পুনুরুত্থানে এগিয়ে এলেন আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ,ই.বি. হ্যাভেল। তিনি অবনীন্দ্রনাথকেই ভারতীয়ত্ব ধারার পথপ্রদর্শক রূপে চিহ্নিত করলেন। হ্যাভেল চলে যেতে আর্ট স্কুল থেকে বিদগ্ধ ছাত্র নন্দলাল, অসিতকুমার হালদারদের নিয়ে (১৯১৫) বেরিয়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথ। খুললেন ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি। দক্ষিণে রবি বর্মার ইউরোপীয় ঘরানার ভারতীয় মিথ ও পুরাণের পুনর্জন্ম শুরু ঘটে গেছে। অবনীন্দ্রনাথের হাত ধরে রাধাকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ওমর খৈয়াম উঠে এলো। ঈশ্বরী প্রসাদের মতো মাটি থেকে উঠে আসা পাটনা ঘরণার শিল্পী ও শান্তিনিকেতনের রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো ছাপচিত্রি আর্ট স্কুলের নতুন দলকে আবিষ্কার করলেন। এই
সবকিছু হরেন দাসকে উদগ্রীব ও উৎসাহী করে তুললো। ১৮৩৯ সালে ইংল্যান্ডে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ড্রইংয়ের উপর জোর দেওয়া হলো, তারপরও তার প্রভাব পড়লো। ভারতে তখন শ্বেতাঙ্গদের বর্ণবাদী শ্রেষ্ঠত্বের প্রভাব। কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হ্যাভেলের উদ্যোগপর্বে সেই অন্ধকার অনেকটা কেটে যায়।

(৩) 🎨• ১৯০১ সরকারি আর্ট স্কুল। ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ শাসনে, উৎপাদন নির্ভর সৃষ্টি করার উপর জোর। প্রভূত্ববাদ ঘিরে ফেলেছে চতুর্দিক। ভারতের বাইরে, গৃহযুদ্ধের পরিবেশ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। এখানে আমাদের উপনিবেশ ও ইংরেজ শাসনে দেশীয় জনজীবন প্রাণান্তকর, যন্ত্রণাকাতর। মুৎসুদ্দি, ফড়ে, বনিয়া সামন্ততান্ত্রিক স্থানীয় জমিদার রাজাদের অস্থিরতাময় অভিভাবকত্ব ও স্বজন-পোষণ ঘিরে ফেলেছে নাগরিকদের মনোজগত। শাসনের অমার্জিত জাঁতাকলে পড়ে এদেশের সামাজিক অবস্থান দিশেহারা। বিশ্বযুদ্ধের তটস্থতা, ভয়াল মন্দতা একদিকে। অন্যদিকে একের পর এক নিরাশাবাদীতা নিয়ে বাঙালি জীবনযুদ্ধ জারি রেখে ক্ষীণভাবে অগ্রসর হচ্ছে। বঙ্গভঙ্গ, স্বাধীনতা আন্দোলন, চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দা। এইসব মিলেমিশে বাংলাদেশের নাগরিক জীবনের এক প্রাণান্তকর অবস্থা। পারিপার্শ্বিক সমাজ চেতনায় নানা জটিলতা বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে মহা-মন্বন্তর ও দুর্ভিক্ষদশা এবং গণমৃত্যুর বিভীষিকায় নাগরিক দুর্দশা মানুষের চিন্তা চেতনায় বিকাশের বদলে ঘাটতি শুরু হয়েছে। ঔপনিবেশিক ও ব্রিটিশ যুগের শিল্প রীতির পরিচর্যায় (১৭৫৭-১৯৪৭) বৈদেশিক শাসক শ্রেণির রুচি প্রভাব পড়তে শুরু করলো ভারতের ঐতিহ্যবাহী নান্দনিক চিন্তা ভাবনায়। ভারতে পাশ্চাত্য ধারার ছবি আঁকিয়েদের আগমনে পুরোদস্তুর সংঘাতময় শিল্পের এক ঘরানা এদেশে সৃষ্টি হলো। ইউরোপীয় শিল্পচিন্তার বদলে যা অনেকটা ইংল্যান্ডীয় অনুকরণ। ঠিক সেইসময় শিল্প ও শিল্পতত্বের সন্ধানে তখন কলকাতার নামডাক শুরু হলো। ইংরেজরা তাদের প্রয়োজনেই ভারতের চারটি স্থানে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল আর্ট স্কুল খুলে দিলেন। শৌখিন কারুশিল্পের মর্যাদা ও সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় শিল্পকলাকে অস্বীকারের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। ভাবা শুরু হলো ঘর সাজানোর পদ্ধতি। জ্ঞান ও রুচিবোধ কিছুটা বাড়লো জমিদার বাড়িতেও। আলোছায়ার সংঘাতময় বিন্যাস বিস্তৃত হলো। জাপানি ওয়াসপদ্ধতিও এলো কলাভবন হয়ে। অজন্তা, কাপড়, রাজপুত ও মুগল যুগের শিল্পের সঙ্গে বিলিতি আধিপত্যর সামঞ্জস্যপূর্ণ সহাবস্থান ক্রমশ বাড়তে থাকলো। আর্ট কলেজের শিক্ষায় হান্টার সংযুক্ত করলেন প্রকৃতিবাদী শিক্ষা। সনাতন শিল্পশৈলীর প্রভাবকে হান্টার সুযোগ করেদিলেন। ভারতীয় শিল্পের পুনর্জীবন ঘটলো।

(৪) 🎨• অবশ্য এই সময় ভারতের ঊনিশ শতককে ধরে রাখার ক্ষেত্রে সাহেবদের অবদান অনস্বীকার্য। কলাভবন ও বেঙ্গল স্কুলের জনপ্রিয়তায় পূর্ববঙ্গ থেকে আগত ছাত্রদের মধ্যে কলকাতা ও শান্তিনিকেতনে ছবি আঁকায় ছাত্রদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। ইউরোপীয় নানা ঘরাণার সঙ্গে জাপানি ওয়াস পদ্ধতি জেনে নিতে চাইছে নবীন ছাত্রদল। অবনীন্দ্রনাথের ভারতীয় নস্টালজিক স্টাইলাইজেশনে সৃষ্টির নব উন্মোচন হলো। অনুপম সৌন্দর্যবোধে আকৃষ্ট হলেন ছাত্ররা। উন্মোচন হয়েছে অবনীন্দ্রনাথের নতুন শিল্পরীতির । জাতীয়তাবাদী ভূমিকা ছবি আঁকায় ছায়া ফেললো। রাজপুত, মুগল আমলের রীতিনীতি, কাঁঙড়া শিল্প রীতির কারুকাজ, পারসিক, জাপানি, তিব্বতী জাপানি ছাপাই ও ওয়াসপদ্ধতি মিলেমিশে ভারতের প্রাচীন শিল্প ভেঙে
তৈরি হলো শিল্পের সমাবেশ।

(৫) 🎨 •আমরা যারা ছবি আঁকার সঙ্গে পরিচিত তারা সকলেই জানি শিল্পী হরেন দাস তাঁর শিল্পকৃতি নিয়ে অমর হয়ে আছেন। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস শিল্পী হরেন দাসের নাম ৯০ ভাগ ভারতবাসী শোনেন নি। যদিও একসময়ে কলকাতার জি.সি.লাহা-য় পাওয়া যেত হরেন দাসের ছাপচিত্রের বই। যদিও আর্ট কলেজের ছাত্রদের কাজের সুবিধার জন্য হরেন দাস সামান্য দামে ওই বই প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু তবুও শিল্পীকে বহু মানুষ এখনও চেনেন না। এই না জানাটা আমাদের কাছে খুবই লজ্জার এবং দোষের। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবে এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছে যে একজন সামান্য রাজনৈতিক নেতা এখানে যত খ্যাতি পেয়েছেন শিল্প-সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বদের তত সম্মান জোটেনি। হরেন দাসকে জানতে চাইলে আপনারা এখন আমাজন থেকে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ছাপচিত্রের সম্ভারগুলির বই (১৯৪৫-১৯৯০) সংগ্রহে রাখতে পারি। প্রিন্ট মেকিং শিক্ষণীয় বিষয়ের ছাত্রদের অবশ্যই তা সংগ্রহ করার মতো।

(৬) 🎨• এমনিতেই ১৯২১ আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক সময়। যদিও ১৯১৯ থেকে শান্তিনিকেতনে
রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে অসিতকুমার হালদারকে প্রধান করে আঁকাআঁকির পর্ব চালু হয়েছিল তবু ১৯২০-তে নন্দলাল বসুর সেখানে যোগদান ও ১৯২১ থেকে কলাভবনের কাজ আরম্ভ হয়ে যায়। সত্যজিৎ রায় ১৯২১ এ জন্মগ্রহণ করে ১৯৯৩-এ প্রয়াত হন। হরেন দাসও (১৯২১-১৯৯৩) তাই। কিন্তু কেউ বড় একটা হরেন দাসকে আজও চেনেন না। অবশ্যই দুজনের এখানে তুলনা টানবার জন্য এই লেখার অবতারণা নয়।

(৭) 🎨• হরেন দাস একজন স্বনামধন্য ভারতীয় চিত্রকর। প্রধানত ছাপচিত্রির পরিচিতি নিয়ে তাঁর সৃষ্টির ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি বন্দিত হয়েছে। কাঠ খোদাই, লিনোকাট, এইচিং। ছাপচিত্রের সমূহ প্রক্রিয়ায় তিনি একজন লিথোগ্রাফের মাষ্টার পেন্টার হিসেবে ভারত ছাড়াও জাপান, জার্মানি, চিলি, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড ও আর্জেন্টিনাতেও আলোচিত হয়েছেন। যদিও বাটালি, নরুন, হাতুড়ি নিয়ে উডকাট বা কাঠখোদাই করে তার শিল্পরূপগুলি প্রকাশিত করেছেন এবং তাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বিদ্যাসমূহের প্রকাশভঙ্গি থেকে তিনি সচেতন ভাবে কাঠখোদাইয়ে বেশি সময় অতিবাহিত করেছিলেন। ছাপচিত্রের ক্রিয়াকৌশলে ঋদ্ধ এবং কাঠখোদাইয়ের একজন দক্ষতম কারিগর-শিল্পী তিনি। এক অনুপঙ্খ নিরীক্ষার মাধ্যমে তা অর্জন করেছিলেন। ছাপচিত্রের একজন মেধাবী চিত্রি হিসেবে, শিল্পী হরেন দাস সেই অনুপঙ্খ দক্ষতা অর্জন করেছিলেন যা একরকম বিরল। তিনি নিজের জাত চিনিয়ে গেছেন তাঁর মৌলিক সৃষ্টির মায়ামুগ্ধতার দুয়ার খুলে দিয়ে।

(৮) 🎨• বিষয় নির্বাচন, ড্রইং, ট্রেসিং, খোদাই, প্রিন্টিং
ও স্টাইল এই ৬ টি বিষয়ে সমান দক্ষতা ছাড়া একজন বিরল ছাপচিত্রি হওয়া যায় না। হরেন দাস ছিলেন সেই উচ্চাঙ্গের শিল্পী। ছবি তৈরির আর্থিক ভার কমের কারণে একসময় লোকশিল্পের সঙ্গে খোদাই শিল্পী ও শিল্পের পরিচিতি গড়ে ওঠে। নকশা অলঙ্করণ, অলঙ্কার, গৃহসজ্জায় এই শিল্পীদের কদর বেড়ে যায়। ইউরোপে এই শিল্পের পরীক্ষা নিরীক্ষার স্তরে ছাপাই ছবির দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়। বইয়ের ছবি ও ফটোগ্রাফ প্রিন্ট থেকে একটি চিত্রের একাধিক সংস্করণের কারণে মধ্যযুগে ছাপচিত্রের বিস্তার ও পরীক্ষা নিরীক্ষা বেড়ে যায়, আসে ইনটাগলিও পদ্ধতি। কখনও জলরঙের ওয়াস দিয়ে চতুর্থস্তর হয়ে ওঠে আরও মোহময়। ছাপচিত্রকে বলা, 'শূন্যতার জয়।' ইংরেজিতে বলা হয় "ডেলিকেট ট্রানপারান্সি।"
আদিম যুগ থেকে ছাপচিত্র মানুষের সঙ্গী হয়ে থাকার জন্য আজও এই শিল্প ব্যতিক্রমী হলেও তা উঠে যায়নি। হরেন দাস মাল্টিকালার ইম্প্রেশনে আপন দক্ষতার শীর্ষদেশ অতিক্রম করেছিলেন। প্রত্যেকটি রঙের জন্য মূল অঙ্কনকে সতন্ত্রভাবে বিচ্ছিন্ন করে পুণরায় একসূত্রে গ্রথিত করার মধ্য দিয়ে যে মধুর ব্যঞ্জনা, যে সঞ্চার, যে ধ্বনির সৃষ্টি করেছিলেন, সতন্ত্রভাবে ব্লকের ব্যবহার করেছিলেন তা আমাদের অবাক করে বইকি।

(৯) 🎨•হরেন দাস যখন শিল্পকলা চর্চায় ছাত্র হয়ে দিনাজপুর থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে এলেন তখন এবং তার বহু আগে থেকেই দীর্ঘকাল ধরে ইউরোপ ও ভারতবর্ষ জুড়ে নানাবিধ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষন্নতা দেখা দিয়েছে। এখানকার ভঙ্গুর স্বাস্থ্য পরিষেবা থেকে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও প্লেগ-ম্যালেরিয়া মহামারীতে জনজীবন প্রায়ান্ধকারে নিমজ্জিত। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ পর্যন্ত সেই দুঃখের সঙ্গী। আরও বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে জনজীবনে হতাশা নেমে এসেছে তখন।

(১০) 🎨• হরেন দাসের শিক্ষা এখান থেকেই পরিপূর্ণতা পেল। তার ছাপচিত্র ইউরোপীয় ও জাপানি ধারায় আত্মীকরণ করলো। পরম মোহনীয়তাকে তিনি করলেন বিষয়বস্তুর মূল উদ্ভাবনী শক্তি। উৎকৃষ্ট উৎকীর্ণ পদ্ধতিতে তাঁর শিক্ষা এতটাই নিবিষ্ট হলো যে তাকে উৎকর্ষতার বিচারে সৌন্দর্য নির্মাণের দিগদর্শন বলা হলো। ওয়াটার,অয়েল,গুয়াস,ওয়াস পেন্টিং, কালীঘাট চিত্রকলা, পুনর্জাগরণবাদী অগ্রগতি,
পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকে অনুপ্রাণনা। সংস্কারবাদী মনোনয়ন। এই সমস্ত মিলে শিল্পীর যুবা মনে বাছাই পর্বের অবতারণা শুরু। বিভিন্ন ভাবের সঞ্চারে তাঁর মনে বিচিত্র চিত্র ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু
এতকিছুর মধ্যে তিনি তার শিক্ষাগুরু কলাভবনের
রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকেই আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাঁর কাছেই শেখা শুধুমাত্র সাদাকালো নয় ছবির শূন্যতার বিভাজনে ছবিতে ঢালতে হবে আরও
রঙ, জীবনের রঙও। অবশ্য হরেন দাসের পূর্বসূরীদের সময় থেকেই শিল্পীরা নতুন ভাবে সাহস উদ্ধার করতে পেরেছিলেন এখানে। কারণ ইতিমধ্যেই জাপানে, জার্মানি ও ইংল্যান্ডে ভারতীয় চিন্তাধারার চিত্রকলা ধিকৃত হয়েছে। সমালোচিত হয়েছে। বিষয়ের অস্পষ্টতা, শিল্পের মায়া ধরতে অক্ষম, ধর্মীয় চিন্তায় মগ্ন, কারুকার্য প্রিয়তা ও অপূর্ণতা এইসব সমালোচনায় ইংল্যান্ড, জাপান ও জার্মানিতে ধিক্কার পড়ে গেছে। সেই সমস্ত ঘেন্না ইতিমধ্যে মিটিয়ে দিয়েছেন অসিত হালদার, নন্দলাল বসু ও হরেন দাসের গুরু রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীরা।

(১১) 🎨• আমাদের পক্ষে তাঁর গুণাগুণ বিচারে তাই কখনও স্পর্ধা দেখাতে পারি না। ছাপচিত্রের যে ৪/৬ প্রস্ত সমৃদ্ধ ব্যাকরণ থাকে বিখ্যাত চিত্রকর হরেন দাস তার প্রতিটি স্তরকে সন্নিবেশিত করেছেন তাঁর আপন ভালবাসা দিয়ে। নারী থেকে গ্রামগঞ্জের সরলতা, গল্পগাথা, যাত্রাপালার আলো আঁধার, প্রামাণ্য বাস্তব গ্রামীণ জীবন ও জীবিকা তুলে এনেছেন। নিজের দেখা গ্রামীণ ঘটনা প্রবাহকে মনোমুগ্ধকর ভাবে চিত্রিত করেছেন। গ্রামীণ শ্রমের মর্যাদাকে যে দক্ষতা দিয়ে, ললিতকলার সমধিক ভাব বিন্যাস সৃষ্টি করে তাকে ড্রইংয়ের পটুত্বের মহিমায় রঞ্জিত করেছেন শুধু তাই নয়, রঙ-রূপের ব্যঞ্জনার বৈভবে, বর্ণ বিভাজনের মুন্সিয়ানায়, বর্ণময়তার শুদ্ধতায়, শিল্পকলার সমূহ সম্ভার ঢেলে দিয়েছেন। ঐতিহ্যমন্ডিত শিল্পরীতির প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর প্রতিটি সতন্ত্র সজ্জায়। ট্র্যাডিশনাল প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার না করার সিদ্ধান্ত তাঁকে সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। অনাবিল সৌন্দর্য রীতিগুলি দাঁড় করানোর নান্দনিক চিন্তায় তিনি যে জাপান ও ইউরোপীয় আধারে আবদ্ধ থাকেননি, তা তাঁর পূর্বাপর সমস্ত প্রতিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আকারপ্রকার চয়নে তার মনোজগতের নান্দনিক রস ফুটে উঠেছে। কখনও দুরন্ত সাহসী অভিযান নেই তাঁর মধ্যে। অভিযোগের বার্তাবহন নেই, বিতর্ক নেই,
নগ্নিকার আবির্ভাব নেই। ছায়া প্রচ্ছায়ার সৃষ্টিতে কল্পনাশক্তির অনবদ্যতা লক্ষ্য করার মতো । লৌকিক ভারতীয়তাকে সঙ্গী করেছেন জীবনের বাস্তববোধ থেকে। পাশ্চাত্যর আধুনিক রীতির সমন্বয় রক্ষা করেছেন, মিশিয়ে দিয়েছেন ইউরোপ জাপান ও কলাভবনে তাঁর গুরুর শিক্ষাকে। মগ্নচেতনার মুগ্ধতাগুলি দিয়ে মণিমুক্তোর মতো তৈরি করেছেন তাঁর ছবির পটগুলিকে যা সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় এবং রচনার মৌলিকত্বে অহংকারি। সৌন্দর্য চেতনা শিল্পের মস্ত গুণ। শঙ্কা ও সংকটের গতিপ্রবাহ বুঝতে পারা শিল্পীর আরও বড় চেতনা। শিল্পের অক্ষয় উৎস্যকে উদযাপন করার মধ্য দিয়ে তিনি কোনও দুঃখবোধকে জাগ্রত করে প্রেক্ষাপট সাজাননি । শিরোনামে অভিহিত করার খুব প্রয়োজন থাকেনা তাঁর ছবিগুলিকে তবুও নাম তাঁর বুঝি এক ভূষণরূপে প্রকাশিত হয়েছে। এমনকি বর্ণের সংঘাত সৃষ্টি নেই তাঁর ছবিতে। জীবিকা যে জীবনের মহানবস্তু, প্রান্তিক জীবন চর্চার অঙ্গ, এইসবকিছুকে তার স্বভাবসিদ্ধ আবেগে প্রাণঢালা অভিব্যক্তিতে হরেন দাস এক স্বপ্নের মতো আলোর আভার মধ্যে সমস্ত সারল্যে তা উপস্থাপিত করে গেছেন। সাধারণ মানুষের গণসংস্কৃতির ধারা আমাদের ভারতীয় ধারণায় হরেন দাস বিধিবদ্ধ করে গেলেন। দেবতারা ক্যালেন্ডার ও কাঁচবাধানো থেকে নেমে এসে কোথাও গণকৃষ্টির হাত ধরে হরেন দাসের যাত্রাপালায় হ্যাজাকের পূর্বাপর রঙিন আলো জ্বেলে দিলেন। ( ছাপচিত্রি সুশান্ত চক্রবর্তী হরেন দাসের অনলাইন প্রদর্শনী সার্থক হোক এই কামনা করি) ©® অলোক কুন্ডু।












সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০

কলা আলোচক: পার্বতী মুখোপাধ্যায় [] অলোক কুন্ডু

⛔ তখনও হাওড়ার রবীন মন্ডল পুরোপুরি শিল্পী হয়ে যাননি।পার্বতী মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একই পাড়ার কাছাকাছি থাকতেন। সবাই মিলে গান্ধীজির বক্তৃতা শুনতে গিয়ে রবীন মন্ডল দা দাঁড়িয়ে গান্ধীজির ছবি এঁকে ফেললেন। সুদর্শন ধুতি পাঞ্জাবি পরা পার্বতী মুখোপাধ্যায়য়ের দাদা প্রভাত মুখোপাধ্যায় ছিলেন হাওড়ার ১২ জুলাই কমিটির প্রধান। করতেন সিপিএম পার্টি। পার্বতী দা হাওড়ায় করতেন কংগ্রেস। পার্বতী দা-র স্ত্রী ছিলেন হাওড়ার ব্যাঁটরা বিবিপিসি-র প্রধান শিক্ষিকা, সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। পার্বতী মুখোপাধ্যায় দীর্ঘদিন কলকাতা করপোরেশনের মিউটেশন অফিসার ছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার কলা সমালোচক, শিল্পী অহিভূষণ মালিকের স্নেহধন্য। কলকাতার পুরনো দিনের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মলনের একজন সদস্য। অহিভূষণ মালিকের ইচ্ছাতেই পার্বতীদা নানা সময়ে শিল্পের ক্রমবিবর্তনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখে গেছেন। আসলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেই বেশি ভালোবাসতেন। শেষে আর কংগ্রেসের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছিল না। রবীনদা যখন কয়লাঘাটের রেলের অফিসে চাকরি করতেন, তখন ওখানে একটা জায়গায় রবীন-দারা আড্ডা দিতেন। ওখানে আসতেন প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরী, যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন, পার্বতী মুখোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় হয় আরও বহু মানুষ। ওখানেই তৈরি হয় ক্যালকাটা পেন্টার্স, রবীন মন্ডলের উদ্যোগে। পার্বতী দার অফিসে বসেও ওঁদের চায়ের আসর বসতো মাঝেমধ্যে। ক্রমশ হাওড়ার পার্বতী মুখোপাধ্যায় হয়ে উঠলেন বিখ্যাত কলা-আলোচক। দেশ ও বিভিন্ন পত্রিকায় শিল্পকলা নিয়ে গুরুগম্ভীর লেখার প্রয়োজন হলে পার্বতীদার ডাক পড়তো। রাজনীতির সঙ্গে সামান্য পরিচিতি থাকলেও তিনি কখনও মাঠে নেমে রাজনীতি করেননি। যদিও ওঁর সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় প্রজা সোস্যালিস্ট পার্টির একটা ক্ষীণ যোগ ছিল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন কাছের বন্ধু। ১৯৯০ সাল নাগাদ কলকাতার গড়িয়াহাটে ফ্ল্যাট করে হাওড়ার বসবাস উঠিয়ে দেন। হাওড়ায় পড়ে থাকে গোরা বাজারে মস্ত জমিদার বাড়ি। অবসর নিয়ে লেক মার্কেটের সামনে তৈরি করলেন সাধের আর্ট গ্যালারি, দ্য লিটল গ্যালারি। ২০.৩ ১৯৯২-এ পার্বতী দার গ্যালারির উদ্বোধন হলে এই প্রতিবেদককে খবর পাঠালেন। গেলাম গড়িয়া হাটের ফ্ল্যাটে। বৌদি আমাকে বরাবর তুই বলেই সম্বোধন করেছেন। পার্বতী দার সঙ্গে আনন্দবাজারেও গেছি। 
বড় বড় বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে উঠাবসা পার্বতী দা বেশ কিছু বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন। ওই আর্ট গ্যালারিও উঠে গেছে কবেই। ©® অলোক কুন্ডু

গিলছি কিন্তু খাচ্ছি না: অলোক কুন্ডু

⛔ বলি, আমার কাছে কি চাও গো ? কেন এলে গো কিছু ধারটার চেয়োনা, আবার যেন। অনেক তো করেছো গো। মনে নেই না ? হবেই তো মনে থাকার কথা ছিলনা, ঠিক ঠিক বলেছো। জীবনটাকে বর্ষার পরের শুখনো এবড়োখেবড়ো মাঠ করে দিলে, এখন কীভাবে মনে থাকবে বলো ? ও কি বলছো গিলছো কিন্তু খাচ্ছে না। হ্যাঁ তাতো হবেই বাছা। এখন চোখেও কম দেখি, কানেও তো কম শুনি। তাই কী বললুম আর কী শুনলে এই দুয়ের মধ্যে একটু বিবেচনা কোরো বাবারা। গুণ থাকলে নিজগুণে ক্ষমা কোরো আর কি। জানোই তো এখন প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সমাজ, পলিটিক্যাল হোমওয়ার্ক, ব্রেনওয়াশ যার যেমন হয় গো। সে যদি কিছু বলতেই হয় টিভির লোক ডাকো, মিডিয়া ডাকো, সাংবাদিকদের যত ইচ্ছে খাবলাও। খিস্তি-খেউড়ের এমন জমকালো ময়দান আর কোথাও পাবেনা ইহজীবনে। যত পারো ভাববাচ্যে গাল দাও। বক্তিমে ঝাড়ো। পরে ক্ষমা চেয়ে বরং এক বাক্স করে বিরিয়ানি দিও। সাত খুন মাফ। তাই বলে যেন আবার আমার ফ্ল্যাটে এসোনা। এলে এই ভাঙা তক্তাতেই এসো। দিনকাল আর ভালো নেই বলবো না, বলবো ঠিক নেই। কে যে ঠিক করবে, সেই আশা এখন তলিয়ে ভেলি গুড়ের মতো শক্ত। ভেবো না, নকশাল মাওবাদী পুঁজিবাদি মূর্দাবাদী সুবিধাবাদী সব ঠিক ছিল। নিরাশাবাদী খুঁজতে বেরিয়েছো যদি তবে আমার নাম তুলে রাখো। বলবে যে নকশালরা ভালো ছিল, মুর্দাবাদী ভালো ছিল। কিন্তু আবার এখন এইসবের মধ্যে রামবাদী এনে ফেলেছো, রাম যে কি দোষ করলো কে জানে গো। কথায় কথায় রামের শ্রাদ্ধ লেগে আছে। বামপন্থীরা নিজেদের বলে বেড়ায় তারাই সবথেকে ভালো। উফ এইসব বললেই ৩৪ বছরের রামায়ণ আসবে, না ওসব থাক। সব ভাইয়া আলাদা কিছু নেই। সব শিয়ালের এক রা বলছি না ভালো খারাপ বুঝতে পারলে বোঝো। সবাই চায় তার তার রাজনীতি শিক্ষে করুক সবাই, ঝান্ডা ধরুক। ঝান্ডা না ধরলে মহা বিপদ। ডান্ডার বাড়ি এমন দেবে যে কোনও " পোতিবাদ" করা ভুলে যাবে। পরকে ভয় দেখাও, তটস্থ করে রাখো, এ এক চরম মহাবিদ্যা। কে কীভাবে শিখলো তা নিয়ে কেউ জানতে যখন চাইছে না তখন বরং তরজাটুকু থামালে রাতে সবাই একটুকু ঘুমোতে পারে। তরজা থামাও আর অতিষ্ঠ কোরোনা গো। অমন সাধের বোকাবাক্স খুলে কি একঘন্টায় চুল করতে দেবে। মারদাঙ্গা হৈচৈ দুরন্ত যে দুটো ভাল কিছু শুনবো তার কোনও উপায় নেই। স্বামীজি বেঁচে থাকলেও আচরণ শেখাতে কিছুতেই পারতেন না। কিন্তু দেখ গিয়ে সকলের আচরণের কত ভেদাভেদ, প্রভেদ, বিভেদ। সমাজ খাও দেশ খাও পয়সা খাও। যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে। কারও জল কামান আছে তো কেউ ইটবৃষ্টিতে দেবে একদম ঠেসে। এইসব ভবিতব্য মনে কর। সৃষ্টি-প্রলয় যেমনটা। এক মায়ের পেটে দুই ছেলে দিওয়ার দেখেছিলে ? কী সিটি পড়লো বলো তো! থামতে আর চায়না। মেরা পাশ মা হ্যায়। হাততালি পয়সার ঝনঝনানি। তা বলে কেউ কুড়োতে যেত না। আর এখন খুচরো দিলেই রায়ট লেগে যায় যায়। অমন উচ্চতার অমিতাভও যায় যায় আর কি খুচরো মাপতে। এমন ডায়লগ দিয়েছিল যে হাইট একবারে সমান। এখন কে যে অমিতাভ আর কে যে শশীকাপূর বোঝা দুষ্কর। কিন্তু তখন থেকে ফ্ল্যাট ,সাধারণ বাড়ি, রেলের গাড়ি বারান্দা দেখতে দেখতে বড় হওয়া। কোথায় বাবার আমলের পিয়াসা আমাদের মুকদ্দর কী সিকন্দর। মুগলে আজম না আনারকলি, উত্তম-সৌমিত্র নিয়ে বেমক্কা ঝগড়া কিছুটা থেমেছে এখন। কী সাংঘাতিক হিন্দু - মুসলমান ভাগের দ্বন্ধ অবধি দুদ্দাড়িয়ে ঘরে ঢুকে পড়েছে। সামাল দিতে চতুর্দিক কাঁপছে, গ্রামের পর গ্রাম। এইবার গ্রামে একসঙ্গে এতদিনকার বাস উঠলো বলে। তুমি কি জানো এই সাধারণ আয় আর ঘুষের আয়ের কতটা তফাত হয়। টেন্ডার থেকে আয়, আর মজুরি সমান হয় কখনো ? মাষ্টারের টিউশনি আর বেকারের ছেলেপড়ানো। বলবে হায় বাবা! হ্যায় রাম!  দেখলে রামের নাম মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল। মুন্নি বদনাম হুই। গন্ধি বাত গন্ধি বাত। কী পারতেন কেশব নাগ ? এইসব সমস্যা মেলাতে। আরে স্বাস্থ্য-সাথীর টাকা পাবো বলে অসুখ করাতে ছুটবো নাকি? ১০ কোটির বাইরে থেকে যদি সুস্থ থাকতে পারি তার দাম স্টার ইন্সুরেন্স পর্যন্ত কভারেজ দিতে পারবে না। আসলে কভারেজ কত টাকার না জেনে লাইন দিতে পারিনি গো। ছাড়ো ওই সব। আমার গাড়ি বাড়ি বাংলো হ্যায়। মেরা পাশ মা হ্যায়, বৃদ্ধাশ্রমের মা, তাড়িয়ে দেওয়া মা, ভাগের মা, তোলাবাজ দাদা, তোলাপৌঁছনোর ভাই, তোলাদাতাকে কমানো যাচ্ছেনা, বাড়বে বলেই ধারণা। কারণ আজকে এই আম্ফান তো কালকে ওই ঝড়। চতুর, ভালো, নরম, গরম চলছে ---এরা সব লোক গো। নিরপেক্ষ মানুষ ,দলীয় মানুষ , মধ্যবর্তী মানুষ। এদিক দেখ মানুষ মানুষ। ওদিক দেখ মানুষ মানুষ। উত্তরে দেখ। দক্ষিণে দেখ মানুষ মানুষ। হেই সামালো মানুষ মানুষ। গাল পেতে দে মানুষ মানুষ। কাস্তে তে দে সান মানুষ মানুষ। গান্ধীবাদ মাইনাস মানুষ মানুষ। মার্কসবাদী মানুষ মানুষ। হাইপার মানুষ। কংগ্রেস ফিনিশ অথবা ফিনিক্স। হাইপ তোলা মানুষ চতুর্দিকে। কেউ বলেনা আমি মায়ের ছেলে। সব মানুষের মধ্যে দুটো দল থাকবেই। এক ঝাড়িকল দলের, অন্যদল বঞ্চিতদের। যাচ্ছে কারা মানুষ মানুষ। বাঁচতে কারা মানুষ মানুষ। 
নাচছে কারা মানুষ মানুষ। খাচ্ছে কারা মানুষ মানুষ। ফন্দি ফিকির মানুষ মানুষ। বুঝতে পারা পাবলিক, ঘোট পাকানো পাবলিক। শিক্ষিত হয়ে বেকার থেকে যাও চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বেকার অশিক্ষিতের সাত লাখের চাকরি। আন্দোলনকারীরা চাকরির আশা গুণছে। আদালত আছে বিচারের কিন্তু তোমার তারিখ পেছোবার কোথাও কিছু করার নেই। ধার্মিক, তার সঙ্গে বক ধার্মিক, সাজুগুজু ধার্মিক। গড়বড়ে লোক। চটপটে লোক। ধামাধরা লোক। পোঁ-ধরা লোক। কেউ তাস খেলে। সাপ খেলা চলছে চলবে। কেউ কবিতায় আছে বরাবর, কেউ পার্টি ধরে কবি হয়েছে। কেউ বলে ইডি। কেউ বলে সিবিআই। কারও চায়ের ঠেক আছে তো কেউ নিরুপায় ভবঘুরে। কারো ধার চাই। ভাঙা ঘর, দিন আনে দিন খায় কেউ। কেউ ফ্ল্যাটে বসে দাবায় খুশি, ওপাশে বউটা সিরিয়ালে বেশি মেলামেশা। তা হোক কারও পেছনে তো লাগেনা। পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যালয় পরিদর্শক সমিতি বলে একটা বামপন্থী সংগঠনের নাম শুনেছেন কখনও, এদের জন্ম, খাওয়াদাওয়া, ওঠাপড়া সূর্য উদয়-অস্ত সব কিছু ছিল লোকের পেছনে লাগো, বাড়ি থেকে হিংসে নিয়েই এরা বের হতো, এখন মাজা ভেঙে পড়ে আছে। পেছনে লাগো আর পেছনে লাগো, তবে পেছনে লাগার দল একদিন শেষ হবেই। আজ মঞ্চ আছে কাল ঘেরাও করে কাটাবে। আবার তৈরি হবে নতুন পেছনে লাগার নতুন দল। আসলে কেউ বেশ্যায় যায় বুক ফুলিয়ে। গাড়ি চেপে হোটেলের ঘর নেয়। দেখবে এদের সবার কিন্তু ভীষণ মিল গো। কিন্তু সেলফি করলে দেখবে সব উল্টো। কিছুতেই কেউ আর হাত মেলাতে পারেনা। কয়েকজন যারা সাতেপাঁচে থাকেনা তারা পার্কে আড্ডা দেয়। সময় কাটায় আর মুন্নি বদনাম হুইর গল্প জোড়ে তাছাড়া করার কিছু নেই। তুমি ধারটার চেও না বুঝলে। সাবধানে যেও রাত হয়েছে। সত্যি বলছি মানুষের মন আর সুরভিত অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম বোরোলীনের মতো নয় গো। হিংসে নিয়ে জন্মায় হিংসে নিয়েই মরে যায়। উৎপল দত্তর কল্লোল বন্ধ করে দিয়ে কি লাভ হয়েছিল সেদিন? কেউ পরে অনুশোচনাও করলো না। পরে কি হলো ? উত্তমকুমার রবীন্দ্রসদনে ঠাঁই পেলনা গো। রাজনীতির গুষ্টির পিন্ডি। এখন জনগণের যত্ন কে করবে। আর কেউ নেই গো তোমার যত্ন করার। এখন যত্ন আমার নিজের নিজের! আমার বলতে, আমার কোলে ঝোল ঝাল অম্বল টেনে টেনে চেটে চেটে তোমাকে ঘুগনী চাটা শালপাতাটা এগিয়ে দেবে। আর যদি রাজনৈতিক দলে ভিড়ে একবার যেতে পারো তবে তো আর কথাই নেই...

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...