রবিবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২০

বোলপুরে অমিত শাহের উপচে পড়া বারান্দার ভিড় না শুভেন্দুর নন্দীগ্রামের সংখ্যালঘু ভোটারের সহায়তা কোনটা বেশি জরুরি: অলোক কুন্ডু

শুভেন্দুর বিজেপিতে যাওয়ার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের রাগ, দুঃখ, ক্ষোভ, মান- অভিমান এবং অপমানিত হওয়া সমস্ত কিছু বোঝা যায়। পার্টি অফিস দখল, ফ্লেক্স জ্বালানো এইসবের কারণ বোঝা যায়। কিন্তু এইজন্য কদিন ধরে সব থেকে বেশি চটেছেন বামপন্থীরা বিশেষ করে সিপিএম দল। তারাই এইসবের আলোচনা নরক গুলজার করে রেখেছেন। এই মূহুর্তে পার্টি বাঁচাতে দু একটি কর্মসূচি ও কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়ে যাওয়া ছাড়া এমনকিছু নিজেদের প্রোগ্রাম নেই। নিজেদের প্রচার নেই বললেই চলে। তাদের ৩৪ বছরেই যে সরকারের বিস্তারিত সরকারি অর্ডার বেরিয়েছিল সেই খবর সংগ্রহ করে তা তারা জানাতে পারতো। তারা জানাতে পারতো পার্টির বাইরে কত পরিবারের তারা উন্নয়ন করেছিলেন। কিন্তু তাদের এখন বুঝি নেগেটিভ রাজনীতি করার সময় এসেছে। গণশক্তিতে কদিন ধরেই তারা শুভেন্দুর বিষয়ে লিখে চলেছেন। কিন্তু শুধুমাত্র শুভেন্দু তো দলবদল করেনি। লক্ষ্মণ শেঠ বাহাত্তরটা দলের কাছে গিয়েছিল। দল বদলুতে তারাই বা কম কিসের। বহু সিপিএম, সিপিআইও যোগ দিয়েছে বিজেপিতে এবং তৃণমূলে। কিন্তু বামপন্থীরা একটানা গালাগাল, ছবি-শেয়ার, লেখা লিখছে শুধুমাত্র শুভেন্দুকে নিয়ে। গণশক্তিতে প্রথম পৃষ্ঠার দুটো স্থানে লেখা হয়েছে গতকাল-- দলবল নিয়ে। অথচ তাদের এম.এল.এ, থেকে পঞ্চায়েত প্রধান ২০১২ থেকে ৯ বছর ধরে রোজ চলে যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেসে। দলবদল নিয়ে সিপিএম বিগ্রেড ডাকেনি, মাইলব্যাপী বড় বড় মিছিল করেনি বাংলা-বনধ্ করেনি। তাদের দলের লোকেরা মিছিল করে যখন চলে গেছেন তখন সেই খবর ছেপেছে খুব বেশি নয়। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত তারাই। তাদের হারিয়েই তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। তাদের ক্যাডার মার খেয়েছেন। মরে পর্যন্ত গেছেন। জেল খেটেছেন তারাই। দিন দিন তাদের অবস্থা খারাপের দিকে চলে যাচ্ছে। ইদানিং তাদের পার্টি অফিস যে অবাধে খুলতে দেওয়া হচ্ছে তার কারণ সাধারণ মানুষের অজানা নয়। আবার বেশি বাড়াবাড়ি করলেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সিপিএমের বক্তব্য, তাদের ব্যবহার, তাদের উঠাবসা সবটুকু আজ বিজেপি কেন্দ্রিক। এইজন্য তাদের হিন্দু ভোট দিন কে দিন কমে যাচ্ছে। এতে তাদের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। জ্যোতি বাবু পলিটব্যুরোর মিটিং থেকে বেরিয়ে বলেছিলেন ওদের বিরুদ্ধে মুখ খুললে ওরা শাস্তি দেবে, মেরে ফেলবে। ওরা কারা। ওরা সিপিএম দল। সকলেই জানেন প্রকাশ কারাত ও সীতারাম ইয়েচুরির জন্য জ্যোতি বাবু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। অমন ভাল রাজনৈতিক নেতাকে অবধি চোখের জলে নাকের জলে হতে হয়েছিল,স্পিকার পদ থেকে পদত্যাগের চাপ দিয়ে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। সিপিএম ভাল করে জানে তাদের ক্যাডাররাই বিজেপিতে গেছে। ক্ষমতায় যে থাকে সেখানে প্রচুর মধু থাকে। গরীব মানুষ কিছু পেতে ওই দলে যায়। ক্যাডার কারও তাই কেনা নয় গোলাম নয়। বামপন্থীদের সেইসব ভাল, সৎ চরিত্রবান সৃষ্টিশীল, নিষ্ঠাবান নেতারা আর নেই, সেই যুগও নেই তাদের। কম্যুনিজম দিয়ে এইদেশে আর কিছু হবেনা। লেনিন, স্টালিন মাও জেদং এর অমন রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো চীন এখন কর্পোরেট। এখানে সিপিএম কেন্দ্রীয় সরকার থেকে বেরিয়ে এসে যে ভুল করেছে সেই মাসুল তারা গুণে চলেছে। এখন কৃষক আন্দোলনে এগিয়ে থেকে সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে তারা। প্রকৃতপক্ষে ২০১১ সালে দিল্লির কংগ্রেস সরকার, যে সমস্ত অফিসারকে এখানে নির্বাচনে ডেপুটশনে পাঠিয়েছিল। তাদের পই পই করে বলে দিয়েছিল যেভাবেই হোক গ্রামেগঞ্জে সিপিএমের ভোট মেশিনকে বসিয়ে দিতে হবে। সেইসব ডেপুটেশনে আসা অফিসাররা, কোনও বুথে সিপিএমেকে নড়তে দেয়নি। ধারে কাছে এলে পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ছিল। ২০১১ এর ফল সিপিএম জানে। এমনকি নির্বাচনের আগের দিন সারারাত ওইসব অফিসার ঘুমোননি, সিপিএমকে রীতিমতো তাড়া করে রেখেছিল। এবারের নির্বাচনে ভোট জোগাড় করা তাদের পক্ষে আরও কঠিন। কিন্তু তাদের লড়াই কিরকম হবে, সেই অনিল বিশ্বাস এখন নেই। এখন ভাটবকে যে, নির্বাচনে ভোট উদ্ধার করা যাবেনা এই কথা বামপন্থী দল সিপিএমের না বোঝার কথা নয়। এমনিতে দুর্গা পুজোয় তারা বাংলার সস্কৃতি থেকে চিরকাল নিজেদের গুটিয়ে রাখতে রাখতে সমাজে হীনমন্য হয়ে গেছে। সপ্তাহে সপ্তাহে পার্টি ক্লাসের থেকে যে ক্লাব অনেক বড় কালচার সেই কথা তারাও বুঝেছেন তৃণমূলের আমলে। তারা ৩৪ বছরে বহু ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু তাদের সেইসব কাজ কেউ মনে রাখেনি তাদের ধর্মীয় রীতিনীতির জন্য। কারণ সমাজে তারা বন্ধু হয়ে ঢুকতে পারেনি। উটপাখির রাজনীতি তাদের ভুলিয়ে দিয়েছে। লক্ষ্মণ শেঠ, তপন, শুকুর এই তিনটি লোক তাদের গোটা পার্টির সর্বনাশ করে দিয়েছে। লক্ষ্মণ শেঠ ফিরে আসায় তাদের তাই ভালোর থেকে খারাপ হবে। নাক কেটে যাত্রা ভঙ্গর আয়োজনের এই রাজনীতি, তাদের আরও পিছিয়ে দেবে। কিন্তু বাম রাজনীতির পথ এরকম নয়। তাদের নিবিড়ভাবে কাজ করে যাওয়া থেকে তাদের ৩৪ বছর কাজের গুণগান প্রচার করতে কখনও তারা এগিয়ে আসেনি। বরং পিছনে গিয়ে বিজেপির বিরুদ্ধে কাটি করাই মুখ্য ভাবনাতে তারা এখন এসে দাঁড়িয়েছে। গত নির্বাচিনে ৭% ভোট ছিল। এই হিসাব বাড়ার থেকে এইবার তাদের ভোট আরও কমে যাওয়ার চান্স খুব বেশি। খুব জোর উত্তরবঙ্গ থেকে তারা একটি বা দুটি এম. এল.এ সিট বার করতে পারেন। তাও সন্দেহ আছে। পূর্ব মেদিনীপুরে যদিও বা কিছু ভোট ছিল তাও সেইসব এখন দ্বিধাবিভক্ত। তাদের হাতের অক্ষয় সংখ্যালঘু ও মুসলিম ভোট এবারে তাদের হাতে না থাকার চান্স সবচেয়ে বেশি। কংগ্রেসের অবস্থাও শোচনীয় হলেও অধীররঞ্জন চৌধুরী বুঝেছেন সবসময় হিন্দু ভোট হিন্দু ভোট করে বিজেপিকে ব্যঙ্গ করলে হিন্দু ভোটও কংগ্রেসের হাত ছাড়া হয়ে যাবে। মুর্শিদাবাদ বাদে কংগ্রেসের হালও খারাপ। তবে কংগ্রেসের সঙ্গে বামপন্থীদের জোট থাকলেও দুটো দলের শুভেন্দুকে নিয়ে মতামত দুরকম। পশ্চিমবঙ্গে ইতিপূর্বে কখনও হিন্দু-মুসলমান জাতের বিভাজনে ভোট হয়নি। আজ এই পরিস্থিতি হলো কেন। কে দায়ী তার জন্য দায়ী বরং বামপন্থীরা তা খুঁজে বার করলে তাদের উপকার হতো। কিন্তু খুব দুর্ভাগ্য এবারেই পশ্চিমবঙ্গে তা প্রথম হতে চলেছে। এইরকম সাম্প্রদায়িক ভোটের সুফল ও কুফল দুই আছে। এবারে সর্ব প্রথম এইরকম সম্ভাবনা হতে যাচ্ছে। যদি সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের জন্য এই ধরনের ভোট পরিকল্পনা এগোয় তাহলে তা সমর্থন যোগ্য তা নাহলে দুটি সম্প্রদায়ের পক্ষে সামাজিক বিভাজন বাড়তে পারে, যা শুভ নয়। মুখে মুসলিম ভোট না বলে সংখ্যালঘু ভোট বললেও কথার মানে সেই একই দাঁড়ায়। এমনকি অন্য দলের বড় বড় সংখ্যালঘু নেতাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, জল কোনদিকে গড়াচ্ছে। অধীর চৌধুরী ও আব্দুল মান্নান বুঝেছেন এই মূহুর্তে হিন্দুভোট কতটা জরুরি। কংগ্রেস সর্ব ভারতীয় দল হলেও মুসলিম বিশ্বাসী দল হলেও ফুরফুরা শরীফের আশীর্বাদ নিতে অধীররঞ্জন চৌধুরী তাই ভুল করেননি। এমনকি ঠিক একই কারণে তাই ভুলেও এখানে তারা হিন্দু ভোটের বিরুদ্ধে মুখ খেলেননি। অধীররঞ্জন চৌধুরী ও আব্দুল মান্নান বা মুর্শিদাবাদ-মালদার কোনও সিট জিততে হলে "ফুরফুরা সরীফের" আব্বাস সিদ্দিকীদের সমর্থন ছাড়া এবারে জেতা মুস্কিল হতে পারে। এই সময়টা একটা রাজনৈতিক ডামাডোলের সময়। ৪০ দিন আগেই বলে দিয়েছি এইবারে পশ্চিমবঙ্গে লিখিত অলিখিতভাবে যুক্তফ্রন্ট হতে পারে। তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেস সিপিএমের ফ্রন্ট হতে পারে। অলিখিত জোট হতে পারে। এইসব হোক বা না হোক আব্বাস সিদ্দিকীকে বাদ দিয়ে কিছু হবে না। আবার অনেকেই বেশ বুঝেছেন তা হলো, নন্দীগ্রামের বৃহত্তর মুসলিম জনগণের সঙ্গে বিনা আলোচনা না করে শুভেন্দু, তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়েননি। শুভেন্দুকে ছোট বড় চ্যানেল ও বামপন্থীরা, কদিন ধরেই সমানে এত কামান দেগে চলেছে যে তৃণমূলের সৌগত রায়, সুব্রত কল্যাণ পর্যন্ত পিছিয়ে পড়েছেন। কিন্তু শুভেন্দু ৩২ টা কমিটি ও তিনটি মন্ত্রীপদ ছেড়ে দিয়েছেন ও মাঝেমাঝেই চুপ করে বসে আছেন। সত্যি কথা কি, শুভেন্দু চুপ আছেন না জবাব তৈরি করছেন এটা জানতে সকলেই আগ্রহী। আগামী দিন বলবে কী হবে, বা কী হতে যাচ্ছে। যদি নন্দীগ্রামের ১০% সংখ্যালঘুদের তিনি বিশ্বাস অর্জন করতে পারেন তাহলে বামপন্থীরা কিন্তু আগামী দিনে আরও পিছিয়ে পড়বে। সেই সম্ভাবনা কিন্তু প্রবল। এখন দেখার নন্দীগ্রাম কি করে ? দ্বিতীয় সম্ভাবনা: বোলপুরে অমিত শাহের উপচে পড়া ভিড়। সঙ্গে বাড়ির ছাদ থেকে ব্যালকনিতে পর্যন্ত গিজগিজ করছে জনগণ।এই ভিড় কি তবে বিশেষ বার্তা দিয়ে গেল- ২০০ আসনে এগিয়ে থাকার। তবে খুনোখুনি না বন্ধ হলে এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আগামী দিনে বামপন্থীরা উঠতে চাইলে তাদের পজিটিভ রাজ ©® অলোক কুন্ডু

বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০

শুভেন্দু কি ঠিক পথে এগোচ্ছেন, একটি নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ: অলোক কুন্ডু


রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

⛔ শুভেন্দু অধিকারী প্রায় একমাস সময় নিলেন। ঠিক এই সময়ে ঝড় তুলে বক্তব্য রাখার মতো মাঠ জমানো ময়দান কাঁপানো নেতা কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আর নেই। শুভেন্দু অধিকারীর ছেলেমেয়ে বউ-বাচ্চাও নেই। কিন্তু সব থেকে বেশি ফেসবুকের গ্রুপ-ফলোয়ার শুভেন্দুর আছে। ৫০ টার ওপর গ্রুপ লাখ লাখ ফলোয়ার। আমি ২০০৮ এবং ২০১৬ তে দীঘা গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি দীর্ঘ রাস্তার অলিগলিতে বাজারে বড় রাস্তায় শুভেন্দুর ছবির ঢাউস ফ্লেক্সের ছড়াছড়ি ছিল। হ্যাঁ শুভেন্দুর ভাই সহ বাবা শিশির অধিকারীরও কিছু ছবি দেখেছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক নেতা যে তিনি তা প্রমাণ করে ছেড়েছিলেন অত ফ্লেক্সের মাধ্যমে। আর কারও ছবি লাগাতেই দেননি। দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করে আসছেন। তৃণমূলের উত্থান কিন্তু পূর্ব মেদিনীপুর থেকে, এই কথা ভুলে গেলে চলবেনা। দীর্ঘ রাজনৈতিক ধ্যানধারণার অধিকারী শুভেন্দু। সঙ্গে আছেন তার পোড়খাওয়া, দীর্ঘদিনের রাজনীতিবিদ শিশির অধিকারী, পিতা। তিনি এই লড়াইয়ের বিচক্ষণ নেতা ও লক্ষবস্তুতে আঘাত করার মূল কান্ডারি। কম কথা বলেন। রাজনৈতিক কলাকৌশল সাজাতে অখিল গিরিকে সাইড করে রাখতে তাঁর রাজনৈতিক মেধার জুড়ি মেলা ভার। তারা এখনও দল ছাড়েননি। এটাও একটা রাজনৈতিক অ্যান্টি গিমিক। সবকিছুকে অপ্রকাশিত করার কৌশল। সবচেয়ে বড় কথা সমবায় ব্যাংকে যখন চুরিচামারি পশ্চিমবঙ্গজজুড়ে লেগেই আছে, তখন অধিকারীবংশ কন্টাই সমবায় ব্যাংকের উন্নয়ন ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। বিশ্বাস অর্জন করেছে। ১৯৯৬-৯৭ থেকে তৃণমূলের ক্ষমতা ধরে রেখেছিলেন, জবরদস্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুভেন্দু এমন নেতা যে তৃণমূল পর্যন্ত তাকে ৩০/৩৫ টা পদের দায়িত্ব দিয়েছিল। মন্ত্রিত্ব ছাড়া এত বড় বড় ক্ষমতা শুভেন্দু পরিত্যাগ করলো তাতে ওর ত্যাগের মহিমা এখন প্রচার পাবে। এত বছর বাদে যতই চোর সুদীপ্ত সেন শুভেন্দুকে টাকা দিয়েছে প্রচার করুক না কেন তা ধোপে টিঁকবে না। শুভেন্দু নিজেকে পান্তাভাত খাওয়া গ্রামের ছেলে বলে প্রচারের আলোয় বার বার আনছেন। এই যে এইভাবে নিজেকে ভাবলেন এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তার সুরেলা মজার বক্তব্য বহুমুখী প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি নিজেকে নিয়ে এইভাবে যে এলেন তাও একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। খানিকটা হেঁয়ালি। যদিও তার একটি প্রক্রিয়াপর্ব ভেতরে ভেতরে বহুকাল ধরে চলে থাকতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। একমাত্র আব্বাস সিদ্দিকী ছাড়া আর কোনও বক্তা তার ধারে কাছে নেই

⛔ শুভেন্দুকে ৪২ টা সিট দিলে শুভেন্দু মর্যাদা নিয়ে পুরাতন দলে থেকে যেতেন হয়তো। কিন্তু তা হয়নি। শুভেন্দু অধিকারী ভবিষ্যতে কি করবে বিজেপির অতশত দেখার ও জানার দরকার নেই। তাদের টার্গেট
অস্থায়ী নয়। ২০১৫ এর আগে থেকেই বিজেপি অত্যন্ত খারাপ দল বলে, বামপন্থী ও কংগ্রেসের প্রচার চলে এলেও এখনও বিজেপিকে শেষ করে দেওয়া যায়নি। সাম্প্রদায়িক দল বলে মিডিয়া পর্যন্ত বিজেপির ব্যান্ড বাজালেও এই বাংলায় বিজেপির যথেষ্ট উত্থান হয়েছে। 
তবু বিজেপির দল এখানে সুঠাম নয়। তাদের নিজস্ব নেতা একমাত্র দিলীপ ঘোষ। মেঠো রাজনীতিই যার একমাত্র সম্বল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি যে এখন সভ্যতার ধরাবাঁধা গন্ডিতে আটকানো নেই সে কথা সকলেই জানেন। তাই দিলীপ ঘোষ ছাড়া কি এখানে মানাতো ? 

⛔ শুভেন্দু বিজেপিতে যাচ্ছে মানে মুখ্যমন্ত্রী অথবা উপ-মুখ্যমন্ত্রীত্ব পাবেন। তবে প্রকাশ্যে এই নিয়ে দর কষাকষি একেবারেই নেই। ৪২ টা সিট না পেলেও ৩০ টা সিট পাবেনই তার পছন্দ মতো। শুভেন্দুর সঙ্গে অনেক সংখ্যালঘু মানুষ আছেন। তাঁরা অধিকারী পরিবার ও শুভেন্দুকে বিশ্বাস করেন। এদের পরামর্শ ছাড়া শুভেন্দু বিজেপিতে যাচ্ছেন না। ধরে নিতে হবে সংখ্যালঘু ভোট শুভেন্দু ভাগ করতে দেবেন না, অন্ততঃ তার নিজের পূর্ব মেদিনীপুরে। কিন্তু তবুও যদি কিছু না পান তাতে তার দুঃখ নেই। ইতিমধ্যেই বিজেপির ভোটব্যাঙ্ক একটা ভালো জায়গায় যে পৌঁচেছে এটা শুভেন্দু জেনেই তো দল বদল করছেন। যিনি তৃণমূলের ৩২ টা পদ একা সামলেছেন তিনি কিছুই বোঝেননি এটা ভাবা আমাদের বোকামি হবে। একমাত্র আমি ছাড়া সকলেই জানতেন যে, শুভেন্দু দল বদল করে বিজেপিতে যাবেন। যাইহোক না কেন একমাসের মধ্যে শুভেন্দু একই সঙ্গে তার মূল শত্রুকে চিহ্নিত করে দিয়েছেন এবং নিজেকে প্রচারের আলোয় এক নম্বরে তুলে এনেছেন। মিডিয়া খুললেই শুভেন্দুময়। 

⛔ শুভেন্দু দল ছেড়ে দেওয়ার ফলে তার বাড়তি একটা সুবিধা যেটা হলো তা হচ্ছে পুরনো দিনের তৃণমূল কংগ্রেসের আদি দলটাকে তিনি কাছে পাবেন, কারণ বর্তমানে তৃণমূলের অধিকাংশই দলের সঙ্গে ছিলনা। প্রত্যেকটি মানুষ রয়েছেন তার নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। কখনো তাদের দেখাও যায়নি ১৯৯৬ থেকে ২০১০ পর্যন্ত। এই যে বসে যাওয়া শ্রেণি এটা নেহাত কম নয়। এরা অন্ততঃ নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে, এরাই তৃণমূলকে আনার জন্য ছিলেন। 

⛔ শুভেন্দু অধিকারীকে দল ছাড়ার ব্যাপারে পেছন থেকে সমানে বুদ্ধি দিয়েছেন বিজেপির বর্তমান চাণক্য মুকুল রায়। এই নির্বাচন সব থেকে বেশি চ্যালেঞ্জ মুকুল রায়ের কাছে। তৃণমূল দলের সংগঠন গড়ার পেছনেও প্রধান কান্ডারি ছিলেন মুকুল রায়। বাজি ধরার ক্ষেত্রে ক্ষুরধার বুদ্ধি ধরেন। ২০১০-২০১১ এই প্রতিবেদক দীর্ঘ দিন তৃণমূল ভবনে যেত। তখন আমি দেখেছি তৃণমূল বলতে মুকুল রায় ছিলেন সর্বেসর্বা। তিনি সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হলেও বিজেপি কাউকে প্রজেক্ট করবে না। 

⛔ শুভেন্দু বাইরে থাকলে যদি বিজেপির ৫০% লাভ হতো এখন তা ১০০% লাভে চলে গেল। যদি ভালোভাবে দেখি তো দিলীপ ঘোষ কিন্তু মাঠ ময়দান চাঙ্গা করার জন্য বিজেপির জবরদস্ত এক নেতা। দিলীপ ঘোষ একাই দলটাকে টেনে তুলে এনেছেন। যতই তাকে নিয়ে ব্যঙ্গ বা কার্টুন হোক না কেন লোকটার যত গাড়ির কাঁচ ভেঙেছে তত লোকটার নাম হয়েছে। বিজেপির ডাকাবুকো নেতা। সেই দিক দিয়ে দেখলে সাহসিকতার পরিচয়ে উঠে আসা নেতা আর কোনও দলে তেমন নেই। যদিও বেফাঁস মন্তব্য করা তার একটি স্বাভাবিক অভ্যাস। তাতে বিস্তর সমালোচনা হলেও যে মাঠ ময়দানের ভিড় কোথাও কমেনি বিজেপির নেতৃত্ব সেটা বিলক্ষণ জানেন। ভদ্রলোকের মধ্যে নানারকম প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা থাকে, বিজেপির নেতৃত্বের তাও জানা আছে নিশ্চিত। তাদের চাই মেঠো জনতা। মেঠো জনতা পিছিয়ে পড়া মানুষ তাদের এখন একান্ত আপন। তাই মঞ্চের ছবিতেও দিলীপ ঘোষের বড় মুখ। কিন্তু উনি মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে গালাগালি দিচ্ছেন এটা কিন্তু অনেকেই বরদাস্ত করবেন না। এক একজন এরকম থাকেন মুখটা খুব পাতলা হয় কিন্তু কুচক্রী হন না। 

⛔ এখন শুভেন্দু এলে বিজেপির মাঠ ময়দানের জোর অনেকটাই বেড়ে যাবে। রাজনীতিতে কেউ যে ভালো কথা বলবে না, তা মানুষের জানা হয়ে গেছে। তাহলে হলোটা কি ? যারা ফেসবুক করে তাদের বড় অংশ বামপন্থী। এখন ফেসবুক দেখে কিন্তু শুভেন্দুর যাওয়া আসা থাকা বোঝা যাবে না। বিজেপির মূল উদ্দেশ্য এতদিনে কাজ করতে শুরু করেছে। প্রকৃতপক্ষে রাহুল সিনহা ছিলেন একজন শুধুমাত্র বক্তা। তার পক্ষে সংগঠন করা হয়নি। বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব চাইছেন ক্ষমতা পেতে। সেই লক্ষ্যে তাদের অগ্রসর নেহাত ভ্রান্তি দিয়ে ভরা নয়। তুল্যমূল্য লড়াইয়ে শুভেন্দুর আগমনে তাদের প্রথম রাউন্ডে জয় হয়ে গেছে। শত্রুকে দুর্বল করা রণনীতির একটা বড় কৌশল। এই কৌশলের মূল কান্ডারি সম্ভবত মুকুল রায়। এখনও পর্যন্ত বিজেপিকে যত গালাগালিই দিই না কেন বিজেপি করতে গিয়ে অনেক তাজা প্রাণ চলে যাচ্ছে। এই খুনোখুনির রাজনীতি বিজেপিকেই টানতে হচ্ছে। 
তাই তারা এখন বলতে পারবে বাংলায় বামপন্থীদের মতো রাজনীতি করতে এসে তারাও ক্ষতি স্বীকার করেছে অনেক। রাজনীতিতে খুন-জখমের বিষয়টা জনসাধারণ ঠিক বুঝতে পারে। খুনি দল সব সময় দূরে সরে গেছে। এটা জনগণের একটা ভালো চিন্তা। 

⛔ ১৯৭২-৭৭ কংগ্রেসকে যতই বাজে বলে প্রচার হোক না কেন অথবা এখন নিঃস্ব বলা হোক না কেন কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গে একটা সময় রীতিমতো লড়াই করেছে। আসলে রাজনৈতিক লড়াই সব সময় করে থাকেন ক্যাডাররা। নেতারা এদল-ওদল করে যায়, নেতাদের দায়বদ্ধতা থাকার প্রয়োজন হয়না। বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসি ক্যাডাররা লড়াই করে  উঠতে পারেনি, হয় মরেছে, তা না হলে অত্যাচারিত হয়ে বসে গেছে। সুযোগ পেলে তৃণমূলে গেছে। অনেকে সরে গেছে। এইরকম যারা আছে তারা সিপিএমের সঙ্গে ফ্রন্ট করা কখনও মেনে নেবে না। আমতায় যাদের হাতকাটা গিয়েছিল তারা এই ফ্রন্ট জীবনে মেনে নিতে পারবেনা। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মিথ্যে প্রচার ও ইন্দিরার ইমারজেন্সির কারণে কংগ্রেসের বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা হয়নি। কিন্তু কংগ্রেসের নেতাদের তাতে দুঃখ নেই তারা তৃণমূল কংগ্রেসে গিয়ে পুরস্কার জিতেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের মূল অংশ কখনও তৃণমূলে যায়নি। ২% হলেও তারা আর কখনও তৃণমূলের সঙ্গে যাবেনা। 

⛔ বামপন্থীদের মধ্যে কিছু দল প্রায় উঠে গেছে আর তাদের দেখা যাবেনা। তবে বামপন্থা উঠে যেতে পারেনা। 
বড় বড় দল একেবারে উঠে যাবে এ কল্পনাও করা ছেলেমানুষি। তবে আমি ক্যাডারদের কথা বলছি। 
যারা এখনও আছেন তারা যে তৃণমূল কংগ্রেসকে হঠিয়ে ফিরে আসতে পারবেন এ নিশ্চয়তা আগামী ১০ বছরে আর নেই এখানে। বামপন্থীদের সেইসব ক্যাডাররা অনেকে এখন শুভেন্দুর সঙ্গে যেতে পারেন শুভেন্দুর বিপ্লবী চরিত্রের কারণে। সেটাও শুভেন্দুর বড় অস্ত্র। তাদেরও তিনি কাছে পাবেন। আসলে একদল লোক যারা সবসময় বিরোধী আসনে থেকে যায়। 

⛔ সবথেকে বিশ্বাসযোগ্যতা শুভেন্দু অর্জন করেছে একগাদা ক্ষমতাকে পরিত্যাগ করে দিয়েছে। বামপন্থী নেচারের এই মেজাজ বহু নিরপেক্ষ মানুষ পছন্দ করেন। ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতা ছাড়তে কেউই চাননা। এই দিক দিয়ে বিজেপি দলটাই তৈরি হলো তৃণমূলের ক্ষমতা থেকে সরে এসে, একদম ক্ষমতায় না থাকা নেতাদের নিয়ে গড়া একটা দল। শুভেন্দু যদি নির্বাচিনের পরে আসতেন এই সম্মান তার থাকতো না। এই বাজারে এত আত্মত্যাগ করার ক্ষমতা কিন্তু সকলের থাকেনা। বিজেপি তার এই যাওয়া তাই সসম্মানের। 

⛔ শুভেন্দু কিন্তু খুব কৌশলী। তার লাভালাভ ছাড়া এত আত্মত্যাগ তিনি করবেন না। দেখতে গেলে এক্ষেত্রে শুভেন্দু ও বিজেপির যৌথ লাভ হলো। দুপক্ষের শক্তিই বেড়ে গেল। তাদের উদ্দেশ্য লক্ষ্য এক বিন্দুতে এসে মিশেছে। 

(সমস্ত রাজনৈতিক দলের কাছে আবেদন খুনোখুনি বাদ দিয়ে রাজনীতি করুন দয়া করে। এই প্রতিবেদক আবেদন করছে নিবেদন করছে। বিজেপির কেউ মারা 
যাচ্ছে না। মারা যাচ্ছে তরতাজা যুবক। যারা নীচুতলায় পার্টি করেন তারা কখনও টাকা পয়সার জন্য কিছু করেন না। তাদের এইভাবে মেরে ফেলা উচিত নয়। এই খুনোখুনি আর কবে শেষ হবে?)

বুধবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০

নিরপেক্ষ মতামতে শুভেন্দু ও রাজনীতি বিচার : অলোক কুন্ডু


⛔ শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়ে যাওয়ায় কারও আনন্দ, কারও ভয়, কারও হিংসা, কারও মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। এটা হবে জানাই ছিল। অধীর চৌধুরী ও আব্দুল মান্নানের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় কিন্তু শুভেন্দুকে সমর্থন ও তৃণমূল কংগ্রেসের স্পষ্ট বিরোধীতা প্রচারিত হয়েছে। এখন এই সুযোগে কংগ্রেস সিপিএমের সিদ্ধান্ত দূরকম হয়েছে। বামপন্থীরা এই প্রসঙ্গে প্রচারের আলোয় পিছিয়ে পড়েছেন। কারণ তাদের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় বিজেপিকেই মূল দোষী ভাবা হয়েছে। কংগ্রেস কিন্তু দোষী হিসেবে তৃণমূল দলকে টার্গেট করেছে। এখানে এই দুটি দল আগামী দিনে ফ্রন্ট করে লড়তে মনস্থির করলেও তাদের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ কিন্তু শুভেন্দুকে নিয়ে দুরকম। সত্যিকথা বলতে কি বামপন্থীরা এখানে রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়েছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা থেকে এখানে তাদের শুরু করাটা তাই কৃষক আন্দোলনের ওপর অপেক্ষা করতে হবে। এমনও হতে পারে দশটা দলে জায়গা না পেয়ে লক্ষ্মণ শেঠ যেমন আবার দলে ফেরত এসেছে যদি সেইভাবে তারা আরও কিছু ফিরে পায়। তবে দলবদলের বিশ্বাসযোগ্যতা এখন অনেকটা তলানিতে এসে ঠেকেছে। এখানে একমাত্র শুভেন্দু অধিকারীর দল বদল ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছে। দল-বদল হলেও শুভেন্দুর স্টাইল অভিনব তাই তার দলবদল তার পক্ষে প্রচার পেয়েছে সঙ্গে সরকার বিরোধীতা মূল লক্ষ্য হয়েে উঠে এসেছে। 

⛔ আসলে কেন্দ্রীয়ভাবে দিল্লিতে কংগ্রেসের মূল শত্রু বিজেপি হলেও পশ্চিমবঙ্গে, কংগ্রেসের মূল শত্রু কিন্তু এখন তৃণমূল কংগ্রেস। কারণ ২০১১ থেকে যে ঝড়ঝাপটা যে ঘর ভাঙানি কংগ্রেসকে সামলাতে হয়েছে যে অশান্তি তাদের সহ্য করতে এখানে হয়েছে তা সিপিএম বিজেপি কাউকেই করতে হয়নি। আসলে কিন্তু দল বদলের কারণে কংগ্রেসের নেতানেত্রীদের মানুষ অবিশ্বাস করতে শিখেছে এই দোষ কিন্তু কংগ্রেসের ঘাড়ে এসে পড়ে গেছে। কংগ্রেসের ভোটে জিতে দল ছেড়ে চলে যাওয়া মোটেই সাধারণ মানুষ বরদাস্ত করতে কখনও পারেনি। তাই পরবর্তীতে কংগ্রেসের ভোট কমে গেছে অথবা তারা ভোট করতেই পারেনি। বাম আমলে কংগ্রেসিরা ভোট দিতে পারতো না বর্তমানেও কংগ্রেসের একই দশা। ১৯৭৭ সাল থেকে কংগ্রেসের ক্যাডাররা মার খেতে খেতে ২০০৬-এ তার অবশিষ্ট অংশ প্রকাশ্যে ও ভোট বাক্সে বিজেপির দিকে চলে গেছে। প্রকৃতপক্ষে কিছু মুসলিম ভোট কংগ্রেসের পক্ষে না থাকলে তাদের আরও দুর্দশা হতো। সেইদিক থেকে এই মূহুর্তটি কংগ্রেস যদি সঠিক অনুধাবন করতে পারে তবে তাদের কিছু লাভ হলেও হতে পারে। তাই বুদ্ধি করেই আব্দুল মান্নান ও অধীর চৌধুরী প্রকাশ্যে তৃণমূলের যত বিরোধীতা করেছে তত বিরোধীতা বিজেপির করেনি এবং শুভেন্দুকে বরং উৎসাহিত করেছে। এই সময় কংগ্রেসের চাল সঠিক না হলে তাদের সমূহ বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হতে পারে। কারণ একদিকে সমস্ত প্রচার শুভেন্দু অধিকারী কেড়ে নিয়েছেন অন্যদিকে এবারে মুসলিম ভোটের ভালো অংশ সংগঠিতভাবে স্থায়ী দলকে বিপর্যস্ত করে দিয়ে নিজেরাই আলাদা আলাদা ভাবে উঠে আসতে পারে ( যদিও এর ভালো খারাপ এখনই কিছু বলা যাবেনা )। তাই সিপিএমে ও কংগ্রেসের একটা ভোট ব্যাঙ্কের ভালো ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এখন হাতছাড়া হিন্দু ভোট পুনুরুদ্ধার করা এই দুটি দলের মহাকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

⛔ একটা সময় কংগ্রেসের ক্যাডাররা জানতো দুটো দল ( কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেস) বোধহয় এক। ২০১১ তে খানিকটা না না করেও প্রণব মুখার্জীর দূরদর্শিতায় কংগ্রেস নিজের সবকিছু ক্ষতি করে জোট করেছিল। সেদিন কংগ্রেস শুভেন্দু অধিকারীর মতো ধুরন্ধরতা দেখাতে পারেনি। সরল সহজ রাজনৈতিক ম্যাপ মেনে নিয়েছিল ও নিজেদের একপ্রকার পথে বসিয়ে দিয়েছিল। অথচ ২০১১ সালে তাদের হাতে কেন্দ্রীয় সরকার ছিল। কংগ্রেসও যে প্রকৃতপক্ষে ১৯৭৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত মার খেয়েছিল এ কথার তুল্যমূল্য বিচারে কংগ্রেস একপ্রকার আত্মহত্যার রাজনীতি করেছিল সেই সময়। তারপর মানস ভূঁইয়া ও অন্যান্যরা দলে দলে কংগ্রেস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার ফিরে এলেও আর তেমন সুবিধা করতে পারেননি। 

⛔ বাম আমলে বিরোধীদের যত উত্থান হয়েছে তার অনেকটা হয়েছিল চিটফান্ড কান্ডের জন্য। বলতে গেলে মিডিয়া ও খবর কাগজের জন্য। মূল ধারার খবর কাগজ-- আনন্দবাজার, বর্তমান, সংবাদ প্রতিদিন, দৈনিক স্টেটসম্যান, একদিন ছাড়াও তখন চিটফান্ড-এর  অনেকগুলো কাগজ প্রতিদিন সরকারের বিরোধীতা করে খবর ছাপতো। যেমন- আবার যুগান্তর, এখন খবর, ভোরের বার্তা, নিউজ বাংলা, স্ব-ভূমি, সকালবেলা, সান সময়। এছাড়াও আরও দুটি কাগজ বের হতো। উত্তরবঙ্গ সংবাদ ও বর্ধমানের সংবাদ। এছাড়াও মিডিয়া তো ছিলই। একযোগে প্রায় ১৪ টি সংবাদ পত্র ৩ টি সংবাদ চ্যানেল বামেদের বিরোধীতা করেছিল। শুধুমাত্র কোনও দলের ক্রেডিট নয়। সঙ্গে সংবাদপত্র থাকাটা কত জরুরি এই আন্দাজ করা যেতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের খবর তারাই পরিবেশন করেছিল। সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সরবরাহ করেছিল। কিন্তু এই সমগ্র সুবিধা পেয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বের জন্য। পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবীরা মধুভান্ড ভক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। 

⛔ আরও একটি বৃহত্তর সুবিধা বিরোধীরা সেই সময় রেল থেকে পেয়েছিল। মমতা ব্যানার্জীর রেল দপ্তর দিয়েছিল--বিজেপি ও কংগ্রেস এই দুটি সরকারের কাছ থেকে। ওই দুটি আমলের সবকটি কাগজের বিজ্ঞাপনে বাংলার রেলওয়ের উন্নয়ন ছিল একমাত্র হাতিয়ার। প্রতিদিন কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ হয়ে যেত। ফুলপেজ বিজ্ঞাপন। কয়েক বছর ধরে এই প্রচার রেল থেকে কাগজে দেওয়ার ফলে এবং সেই কারণে কাগজগুলিতে উন্নয়নের জোয়ারের প্রতিষ্ঠিত হয় বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে রেখেছিল, এটা ছিল পরোক্ষভাবে তৃণমূল দলের প্রচার। এই সমগ্র সুবিধার বৃহত্তম অংশ ছিল বিরোধীদের দিকে। যার ফলে বাম আমলে আর্থিক নয় ছয় যত কম হোকনা কেন, যতই বেশি ছেলেমেয়ে চাকরি পাকনা কেন যত উন্নয়ন করুক না কেন বামফ্রন্ট একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়েছিল। তাদের খুনোখুনি এত বেশি হয়ে গিয়েছিল যা তাদের ভূমিসংস্কারকেও পর্যদুস্ত করে দিয়েছিল। শিক্ষা ও শিক্ষাজীবনের উন্নয়ন বামেরা যা করেছিল শুধুমাত্র প্রাথমিকে ইংরেজি ও পাশফেল এই দুটি কারণে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। অথচ ইংরেজি ও পাশফেল প্রথা এসেও লেখাপড়ার উন্নয়ন যে কত হয়েছে তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের লক্ষ্মণ শেঠ ও তপন-শুকুর মিলে বামফ্রন্টের দফারফা করে দিয়েছিল। তারমধ্যে বীরভূমে গণহত্যা অন্ওযতম। সিঙ্গুরের টাটাকে বিদায় জানাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রচারে বাঙালি মেতে উঠেছিল। যা এখন হাত কামড়ালে কারও 
কিছু করার নেই। 

⛔ সূচপুর, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, কেশপুর,ও আরও অন্যান্য ঘটনায় এগিয়ে আসা বুদ্ধিজীবীরা এম.পি, মন্ত্রী, উচ্চপদ, পেনশন, স্যালারি, গাড়ি, টাকা পয়সায় ফুলেফেঁপে উঠেছেন। গরীব মানুষ, খেটেখাওয়া মানুষ সহ্য করতে পারেনি তারা ক্রমশ সরকার বিরোধীতায় চলে গেছে। অথচ ইংরেজি আনয়ন, পাশফেল প্রথা রাখা, ইলেকট্রিসিটি বিল এইসবের বিরোধীতা ও আনয়নে একমাত্র দল এস ইউ আই সি ও স্টেটসম্যান-এর সদর্থক ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এই দল অবশ্য বর্তমান সরকারের কাছ থেকে সরে গেছে। বাম আন্দোলনে এদের চিরস্থায়ী একটা বিশাল ভূমিকা থাকলেও এই দল তেমন করে ক্ষমতা দখলে এগিয়ে যায়নি। আন্দোলনমূখীতায় তাই এই দল সব সময় সকলের থেকে পৃথক ভূমিকায় নিজেদের একটা গন্ডির মধ্যে রাখতে পেরেছেন। তবে এই আমলে ছোট বামপন্থী দলগুলো একেবারে উঠে গেছে। 

⛔ এখন এইসব নিয়ে জোর বাজার গরম হয়ে উঠেছে। হয়তো তৃণমূলের বিদ্রোহ অংশ এখনও তৃণমূলে থেকেই বিরোধীতা করে যাবে এত তাড়াতাড়ি তারা অনেকেই বিজেপির দিকে যাবে না। গেলেও জোটবদ্ধ হয়ে থাকবে। 


⛔ ©® অলোক কুন্ডু 

রবিবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০

আমাদের জাতীয় সংগীত 🌏 অলোক কুন্ডু


⛔ শান্তিদেব ঘোষ তাঁর বিস্তৃত লেখালিখিতে বলে গেছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অনেকগুলি। 

⛔অলোক কুন্ডু

• • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • • •
• সম্প্রতি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে কোনও বক্তার মন্তব্যের পর আনপড় লোকেদের চর্চায় গেল গেল রব উঠেছে। সেই প্রসঙ্গে শান্তিদেব ঘোষ সকলের পড়ে নেওয়া উচিত।
(এই লেখা শেয়ার করুন ক্ষতি নাই কিন্তু আমি লেখার আগে এ প্রসঙ্গে আর কেউ লেখেননি। তাই টোকাটুকি করবেন না) আমাদের মনে রাখতে হবে স্বাধীনতা ও স্বদেশী আন্দোলনে দেশ মাতানো জাতীয় সঙ্গীতগুলি কিন্তু জাতীয় সঙ্গীতের স্বীকৃতি পায়নি। 

• শান্তিদেব ঘোষ তাঁর বিস্তৃত লেখালিখিতে বলে গেছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীত অনেকগুলি। 
মূলত ঠাকুর বাড়ির উদ্যোগে হিন্দুমেলার চল হয়েছিল। 

• ১৮৭৬ সালে, হিন্দুমেলার উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সমগ্র গান প্রকাশিত হয়েছিল, " জাতীয় সঙ্গীত " বইটি। 

•সেই পুস্তিকের জাতীয় সঙ্গীতগুলি লিখেছিলেন, দ্বিজেন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ, গোবিন্দচন্দ্র রায় প্রভৃতি। ভারতমাতা সুরেন্দ্রবিনোদিনী, সরোজিনি-নাটক, নীলদর্পণ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত হয় মোট ২৯ টি জাতীয় সঙ্গীত।

•শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, এইসব গানে অন্য দেশের সঙ্গে স্বদেশের তুলনা ও নিজের দেশের প্রাচীন হিন্দু গৌরবের কাহিনী বর্ণনা ক'রে ক্রমাগত দেশবাসীকে উদ্বোধিত করার চেষ্টা হয়েছিল। হেমচন্দ্র চন্দ্রের, "বাজ্ রে শিঙা এই রবে।" গোবিন্দচন্দ্রের, " কতকাল পরে ভারত রে। " সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, " মিলে সবে ভারতসন্তান। " এই গানটি সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশস্তি ছিল। বঙ্গদর্শনে তিনি বলেছিলেন, " গানটি ভারতের সব জায়গায় ধ্বনিত হোক--"বিংশতি কোটি ভারতবাসী", ভারতবাসীর হৃদয়-যন্ত্র ইহার সঙ্গে বাজিতে থাকুক। শান্তিদেব ঘোষ আরও বলেছেন, সঞ্জীবনী সভা উপলক্ষে গুরুদেব যে গানটি রচনা করেছিলেন সেই, " একসূত্রে বাঁধা আছি। " গানটি স্বদেশী চিত্তের উন্মাদনা, সঙ্ঘবদ্ধতার শক্তি ও জীবন-পণের দৃঢ়তা সেই গানে সুন্দর প্রকাশভিবে পেয়েছে। স্বদেশ পর্যায়ের গানের মধ্যে, " একসূত্রে বাঁধা আছি। " গানটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা। তবে গুরুদেব তাঁর রচনার অনেক গুলো গান বাদ দিয়েছিলেন। বাংলা ১২৯১ সনের মাঘোৎসব উপলক্ষে গাওয়া গান, " শোন শোন আমাদের ব্যথা। " পরে জাতীয় সঙ্গীত বইতে স্থান পেয়েছে। 

•১২৯৩ (বাংলা) কংগ্রেস অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত, " আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে।" রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্-কে সুপ্রচলিত করেন। রবীন্দ্রনাথ, 

•১২৯২ (বাংলা)-এ। বঙ্কিমচন্দ্রের উপস্থিতিথে রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম সুর রচনা করে শুনিয়েছিলেন এবং পরে বাংলা ১৩০৩-এ রবীন্দ্রনাথ, কংগ্রেসের সভায় নিজে গান। এর পর থেকে বন্দেমাতরম্-এর ব্যাপক প্রচার হয়। 
আশ্চর্যজনক বিষয় বঙ্কিমচন্দ্রের সুরারোপিত বন্দেমাতরম এখন আর কোথাও শোনা যায় না। আবার বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের দেওয়া সুরের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। ১৩১০-এ রবীন্দ্রনাথের জাতীয় সঙ্গীত পর্যায়ের গান ( স্বদেশ)  অয়ি ভূবন-মনমোহিনী, কে এসে যায় ফিরে ফিরে, আজি এ ভারত লজ্জিত হে, জননীর দ্বারে আজি ঐ, নব বৎসরে করিলাম পণ, হে ভারত আজি নবীন বর্ষে। শান্তিদেব ঘোষ বলেছেন, এই কটি গুরুদেবের জাতীয় সঙ্গীত। ১৩১২ তে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে, " এবার তোর মরা গাঙে বাণ এসেছে। " গানটি সম্পর্কে রামেন্দ্রসুন্দর বলেছিলেন, এ গান শুনে গঙ্গা বক্ষে ঝাঁপাইয়া পড়িবার উন্মাদনা সৃষ্টি হইয়াছিল। 

•১৩১৮ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য কাব্যে ভগবানের কাছে নৈবেদ্য উত্থিত করে এই গানের রচনা। পরবর্তীতে সেই গান, " জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে... " আমাদের দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। 

⛔ ©® অলোক কুন্ডু। 

শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০

শ্রী ল প্রভুপাদ ও ইসকন : অলোক কুন্ডু


🌏 গান্ধীবাদী স্বদেশী থেকে সন্ন্যাসী গৌরাঙ্গে 
সমর্পিত প্রাণ কর্পোরেট জীবন থেকে এক 
আশ্চর্য ভিক্ষুক শ্রীল প্রভুপাদ - অলোক কুন্ডু ©

⛔ আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি ও কেউ কেউ পড়েছি মিশেল ফুকোর আত্মার যত্ন। যদিও এই ফরাসি দার্শনিক যৌনতার ইতিহাসও লিখেছেন সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। দক্ষিণী ও আদিগুরু যমুনাচার্য যিনি ছিলেন রামানুজমের (আয়েঙ্গার গোষ্ঠীর) গুরুদেব। তিনি ছিলেন বৈষ্ণব বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানী অদ্বৈতবাদী দশনামী সম্প্রদায়। স্বামীজির -- নিরাকার অদ্বৈতবাদ। তোতাপুরী, বড়পলঙ্গ, তেঙ্গলঈ-ধারা, সীতরাম দাস ওঙ্কারনাথ থেকে শঙ্করের মায়াবাদ প্রায় সব মিলিয়ে ৯০০ বছরের একটি ফল্গুধারার মতো হিন্দুদের ধর্মের নানাবিধ চর্চা ও আত্ম উপলব্ধির বিষয় কিন্তু এইসব এত জটিল যে সাধারণ মানুষের দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয়নি, সে তাই সব সময় একজন গুরু খুঁজেছেন। কখনো হিন্দুরা তাদের ধর্মের তুল্যমূল্য বিচারে যায়নি। বরং স্বাধীনভাবে যে যার মতো মূর্তি পুজোয় বিশ্বাসী থেকেছে। একে অপরের দেখে দেখে নিজেরাই ধর্মের আচরণে হয়ে উঠেছেন নিজেরাই পুরোহিত। একদল অর্ধ শিক্ষিত পুরোহিতের
শেখানো বুলিও কেউ কেউ শিখে ফেলেছেন। অশিক্ষিতের হাতে পড়ে পুরোহিতরাই এখন জানে না যা করতে বলছে তা তারা জানেনা এবং জানতেও চায়না। ইতিহাস ও সাহিত্যের হাত ধরে ধর্মীয় মতবাদ যেমন এগিয়ে এসেছে, হিন্দুদের কাছে আজ সেটাই ধর্ম। 

⛔ধর্মীয় আচরণ তাই হিন্দুদের কাছে খানিকটা দুর্গা পুজোর হৈ-হল্লার মতো। যার ফলে গুরু গজাতে ভারতের নানা প্রান্তে কোনো অসুবিধা হয়নি। প্রকাশ্যে স্বামীজিই প্রথম, ধর্মীয় যুক্তির কথা বললেন। তারও আগে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সারা ভারতে হিন্দুদের ধর্মের এই শাখা যা দক্ষিণে চালু ছিল তাতেই চৈতন্য এনেদিলেন। বিপুল জন সমর্থনে (রথ ও যাত্রাপালায় বাংলাদেশ এক নতুন সংস্কৃতি আবিষ্কার করলো উড়িষ্যা থেকে এল রথ) দেশকে ভক্তিরসে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। মানুষের দুঃখ কষ্টে শ্রীকৃষ্ণ হলেন আশ্রয়। শুধু কৃষ্ণ নাম নিয়েই বহু মানুষ তখন থেকেই বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নামে, হিন্দুদের মধ্যেই একটি নতুন সম্প্রদায়ের শ্রীবৃদ্ধি ঘটালো এবং এই সুযোগে সারা বাংলাদেশের মধ্যে কিছু ধান্দাবাজ গুরুর গুরত্বও বেড়ে গেল। একদিকে সমস্ত ধর্মমত থেকে এই মানবধর্মের যত প্রসার হতে লাগলো তত হিন্দু ব্রাহ্মণরাও নিজেরা জটাজুট হয়ে গুরু বনতে লাগলো। 

⛔ একদিকে স্বাধীনতার মতো উত্তাল আন্দোলনে মানুষের দিশেহারা অবস্থা। বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রামমোহন দ্বারকানাথ ঠাকুর ধর্মের বিচার বিবেচনার সাথে মানুষের অধিকার সুরক্ষার কথা ভাবছেন। বিদ্যাসাগরের কাছে পন্ডিতের ধর্মীয় ভাবাবেগের থেকে বাস্তব আচরণ বড় হয়ে দাঁড়ালো। রামমোহন আবার ধর্মকে প্রার্থনা সভায় নিয়ে গেলেন। দেবদেবীর মাহাত্ম্য মধ্যযুগে বাড়বাড়ন্ত হলেও বিদ্যাসাগর ও রামমোহনের হাতে পড়ে তার নবজন্ম হলেও সেই ধারা ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে পড়লো পরিচর্যার অভাবে। মানুষের কী করা উচিত তা তার বোধগম্য হচ্ছে না এরকমই পরিবেষ্টিত দেশে এলেন এক তিনি স্বামীজি। স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মের চর্চা করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন কমপ্রোমাইজের কথা। আসলে আমার মনে হয় জীবনের সমস্তস্তরে সহাবস্থানের কথাই স্বামীজি বলতে চেয়েছিলেন।  কারণ তাঁর নিজের ধর্ম ছিল অদ্বৈতবাদ আর তাঁর গুরু শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন মূর্তির পূজারী। 

⛔ শ্রীরামকৃষ্ণ ধর্মের এই বুনোনকে দুহাতে তলতলে মাটির মতো নিয়ে যেকোনো মূর্তির মাঝে ভগবানের লীলা দেখাত পারতেন। যত মত তত পথের সন্ধান আসলে উদারতার জন্ম হলো শ্রীরামকৃষ্ণের জন্য এইদেশে।সহজ ও সরল কথায় অন্যদের টেনে নিয়ে আসতে পারতেন নিজের কাছে। শুধুমাত্র শুনে শুনে তিনি পুরাণ মহাভারতের ব্যাখ্যা প্রাঞ্জলভাবে করতে পারতেন তাই সে যুগে ইংরেজি জানা রীতিমতো মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে যাওয়ার পথে এগিয়ে থাকা স্বামীজিকেও শ্রীরামকৃষ্ণ চুম্বকের মতো টেনে রেখেছিলেন। এ বড় আশ্চর্য ব্যাপার। পৃথিবীর বিরলতম ঘটনা। তাই এক সামান্য পূজারীর বাক্য ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেননি স্বামীজি। যদিও স্বামীজির ধর্মবোধ শ্রীরামকৃষ্ণের থেকে আকাশ পাতাল তফাৎ ছিল। শ্রীরামকৃষ্ণের কালীভক্তির কারণে যুক্তিবাদী বিদ্যাসাগর আর কখনো দ্বিতীয়বার শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা করেননি । কিন্তু স্বামীজিও ছিলেন যুক্তিবাদী এবং পুতুল পূজার বিরোধী। তিনি কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছিলেন । অদ্বৈতবাদী স্বামীজি যখন হিন্দুদের দেবী দুর্গার পুজো করার মনস্থ করেন (Compromise) তখন কোনো শিষ্যই তার কাজে বাধা দেননি পরন্তু যে রাজা ও ব্যবসায়ীদের সাহায্যে স্বামীজি আমেরিকায় যেতে পেরেছিলেন সেইসমস্ত শিষ্যরা, রাজারা আনন্দিত হয়েছিলেন, এই ভেবে যে, যত মত তত পথকে স্বামীজি বাস্তবে করে দেখাতে পেরেছিলেন। শুধুমাত্র শ্রীশ্রী মায়ের কথামতো পাঁঠাবলি না করার বিষয়টি তিনি মেনে নিয়েছিলেন। 

⛔ স্বামীজি নিজেই ধর্মের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়ে গিয়েছিলেন যার তাৎপর্য বোঝা আজ অত্যন্ত কঠিন। নিজে সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছেন দান চাইতে। পরিব্রাজক স্বামীজি যেখানে যেমন পেরেছেন মানিয়ে নিয়েছেন। পুরাণে সন্ন্যাসীকে ঘুরে ঘুরে গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে দেখতে বলেছে, যাতে একজন সন্ন্যাসী দেশের মানুষের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও খিদের কথা জানতে ও তাদের পরামর্শ দিতে পারেন এবং সকলের সাথে মানিয়ে নিতে পারেন স্বামীজি যতটা সম্ভব তাই করেছেন। তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে ১৯৩৮ সালে বেলুড় মঠ স্থাপিত হয়েছে। তার এত পয়সার অভাব ছিল যে শ্রীমাকে ঘুষুড়িতে টাকা পাঠাতে পারেননি সব সময়। তখন সারা ভারত ঘুরে মঠের জন্যে তাঁকে একটা একটা করে টাকা ভিক্ষা করতে হয়েছে। স্বামীজি জরুথ্রুস্টের ভক্ত ছিলেন। অনেক বক্তৃতায় তাকে বিদেশীরা অনেক সময় জরথ্রুস্টবাদী মনে করে ভুল করেছেন। নারীর অধিকার জরথ্রুস্টের মতের প্রথম অঙ্গীকারকে স্বামীজি মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন। শ্রীচৈতন্যের গণধর্মমতও তাঁকে বিস্মিত করেছিল তিনি জেনেছিলেন শ্রীমদ্ভাগবতের নানা বিশ্লেষণ এবং তাঁর মস্তিষ্কের মধ্যে বারবার ধর্মের নানা পন্থার দীর্ঘ কাটাছেঁড়া চলেছে। তাই বিশ্ব ধর্মসভা যেখানে বসেছিল আজও সেই রাস্তার নাম স্বামী বিবেকানন্দের নামে হয়ে আছে। স্বামীজি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁর অদ্বৈতবাদের রাস্তা অন্য এক মহত্বে বাঁক নিত যা আজ কারো পক্ষেই জানা আর সম্ভব নয়। নানা মতের সমন্বয় সাধন করতে তাঁকে যত্নবান হতে হয়েছিল। মূর্তির পূজারী হলেও শ্রীরামকৃষ্ণ নিজে ছিলেন সর্বজনগ্রাহ্য একজন মানবরূপী মহামানব। তাই বেলুড় মঠের নকশায় হিন্দু খ্রিস্টান মুসলিম পারসিক ধর্মের সমস্ত মোটিফকে একত্রীকরণ করা হয়েছে। পরে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন শিক্ষা -স্বাস্থ্য-রোজগার-মানব উত্থানকে মাথায় রেখে বিশ্ব মানব ধর্মের এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। 

⛔ এই দেশে নতুন করে হিন্দু ধর্মের আর কোনো এমন বলিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির দ্বারা পথের সন্ধান কারও চোখে আসেনি বা নতুন দিশা নিয়ে সমস্ত জগতের কল্যাণের পথ তেমন প্রশস্ত করার কথা কোথাও শোনা যায়নি। আদপে বেলুড় মঠের সন্ন্যাসীরা মানুষ শ্রীরামকৃষ্ণকে দেবতার আসনে প্রতিষ্ঠিত করে বিন্দু ধর্মের পূজা ব্যবস্থা প্রবেশ করিয়ে দিলেও তা কোনও অবাস্তব কিছু হয়নি। আমাদের অজানার নীচের অংশ আমরা যেন দেখতেই পাইনি। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের পর খুব কম সময়ের মধ্যে একক প্রচেষ্টায় এক বৃহদাকার কর্মযজ্ঞের সূচনা করে গেছেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী , সন্ন্যাসী শ্রী ল প্রভুপাদ মহারাজ । 

⛔ তিনি যা করলেন তা আরও বিস্ময়কর। স্বামীজি ছিলেন অদ্বৈতবাদী যে কারণে আমেরিকা ঘুরে আসার পর ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেশা নিয়ে স্বামীজিকে দক্ষিণেশ্বরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীকে জগন্নাথদেব দর্শন করা তো দূরে থাক মন্দিরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। মুজতবা আলী শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের মতো উদার মহামানবের সংস্পর্শে এসে পুরীর মন্দিরে প্রবেশের এক মহা রসিকতা শুনিয়ে গেছেন আমাদের। আজও অনেক আজব ধর্মীয় আচরণে বন্দী আমরা, এই দেশে। আর এই দেশেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে পান্ডারা নুলিয়াদের দিয়ে হত্যা করিয়েছিল, পা টেনে ধরে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিল। অন্যমতে গর্ভগৃহে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। কারণ সেই সময় সমস্ত ধর্মের মানুষ শ্রীচৈতন্যের সাম্যবাদী ধর্মের কাছে এসে ফল্গুধারার মতো মিশে যাচ্ছিল। যেখানে কাউকেই অচ্যুত ভাবা হয়না। ৫০০ বছর আগে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভূত হওয়ার সময়ে যা নির্দিষ্ট হয়েছিল মায়াপুরের কাছে। তাঁর জন্মস্থানের পাশেই। দলে দলে এক নতুন ধর্মীয় ভাবনায় এসে মিশ্রিত হচ্ছিলেন এই সৃষ্টিতে শ্রীকৃষ্ণকে করেছিলেন তিনি জনগণের দেবতা ---" মায়ামুগ্ধ জীবের নাহি স্বঃত কৃষ্ণ জ্ঞান "(চৈতন্য চরিতামৃত)। 

⛔ স্কটিসচার্চে সুভাষচন্দ্রের এক ক্লাস নীচুতে পড়া ও সুভাষ অনুগামী অভয়চরণ দে স্বদেশী আন্দোলনে নেমে পড়লেন এবং ইংরেজদের দেওয়া কলেজের শংসাপত্র প্রত্যাখ্যান করে তা নিলেন না। পরে বসু গবেষণাগারের প্রধান হয়েছিলেন। ৫৪  বছর বয়সে সন্ন্যাসী হন এবং ৭০ বছর বয়স যখন তখন মাত্র ১৫ ডলার হাতে নিয়ে অনির্দিষ্ট যাত্রায় আমেরিকা পৌঁছন সঙ্গে সঙ্গী - "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।" 
এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা। তিনি তখন শ্রীল প্রভুপাদ। তাঁর কাছে আছেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীচৈতন্য। তিনি বললেন শ্রীকৃষ্ণ হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান কোনো কিছুই নয় তিনি শুধুমাত্র ভগবানকে জানেন। কে এই ভগবান ? শ্রীচৈতন্য ৫০০ বছর আগে যে সাম্যবাদী ধর্মীয় আচরণ ও সংকির্তন গণভোট গণজমায়েত "হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে।" এই মন্ত্র আর ১০৮ টি গুটিকা যুক্ত যপমালা। এই ভাবাবেগের পৃথিবীব্যাপী একটি প্রধান কার্যালয় মায়াপুরের ইসকন মন্দির। 
⛔©® অলোক কুন্ডু

ভারতীয় শাড়ির ইতিহাস : অলোক কুন্ডু


🇮🇳 শাড়ি নারীর এক অনন্য আভরণ

🌏 অলোক কুন্ডু ⛔

⛔ গ্রিস মেসোপটেমিয়া রোম সুমেরু মিশরীয় সভ্যতা ছাড়াও দেখা যায়, আসিরিয়া সভ্যতায় কাপড়ের প্রচলন ছিল। তখন অবশ্য স্ত্রী বা পুরুষের আলাদা কোনো কাপড়ের ভাগ ছিলনা । আর্যরা ভারতে
আসার সময় সঙ্গে করে " ভাসত্রা " শব্দ নিয়ে আসে। সংস্কৃত মতে যা কাপড় তখন অবশ্য চামড়ার কাপড় পরার রেওয়াজ ছিল। ঋকবেদ থেকেও আমরা শাড়ির কথা জানতে পারি। সিন্ধু নদীর তীরে আর্য সমাজে বয়ন শিল্পের পেশায় যুক্ত মানুষকে তন্তুবায় শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্রে পাণিণির রচনাতেও শাড়ির উল্লেখ রয়েছে। " মহাদেব জাতক" নামক গ্রন্থে আছে -- " পীলেত্বা আপনেতাব্বা কারপাত্তা অহেংসু " অর্থাত শাড়ি ভিজিয়া অপনয়ন করিবার যোগ্য হইল " । মধ্য ভারতে সাটক বা সাটিকা শব্দের ব্যবহার অতি প্রাচীনকাল থেকেই কানে শুনে আসতে থাকে মানুষ। মানুষের সভ্যতার উৎপত্তি ও উত্থান থেকেই শাড়ি সভ্যতার বিকাশ। খুকি থেকে বুড়ি শাড়ি যুগে যুগে অনেক লুন্ঠন ভাঙচুর ও ফ্যাশনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে প্রাচীনতম পোশাক হিসেবে। জমকালো আবেদন ও সামাজিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে শাড়ি। সাধু দায়ানেশ্বরের লেখা পুথি থেকে ( ১২৭৫-১২৯৬) কান্দানাকি চোলি শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়।

⛔ আর্যদের আসার সময় থেকেই নিভিয়ে বা কোমর এবং কাঁচুকি শব্দের প্রচলন পাওয়া যায়। চীন থেকে হাজার বছর ধরে সিল্করুট ধরে সিল্ক ও সুক্ষ্ম রেশমি আসতো। এখন আসছে ভারতীয় ও বাংলাদেশের শাড়ির জন্য মুগা, সিল্কের খুব কম দামের সুতোও । উপনিবেশিক আমলে মাদাম বেলানোসের চিত্রে এদেশের শাড়ি পরা মহিলার পেইন্টিং দেখতে পাওয়া গেছে এ। ১৮৫১ তে ফ্যানি পার্কসের বিবরণ থেকে জানা যায় বাঙালি ধনী পরিবারের মধ্যে শাড়ি পড়ার ভালই প্রচল ছিল । ১৮৮৫ তে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বিলেত থেকে ফিরে লিখেছিলেন বাঙালির পোশাক অতি আদিম এবং আদমিক " । মুকুন্দরামের কাব্যে ধুতি ও শাড়ির শব্দটি সমার্থক শব্দটি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে । তার লেখায় --সুরঙ্গ পাটের শাড়ি, তসরের শাড়ি , মেঘডম্বুর শাড়ি , ক্ষীরোদ শাড়ি ও খুঞ্চার ধুতির কথা থেকে আরও জানা যায় " তন্তুবায় ভুনি ধুতি খাদি বুনে গড়া " । মনে করা হয় ১৫/১৬ শতকে নারীরা কেবলমাত্র একখন্ড আধখানা শাড়ি পরতেন তেমনভাবে উদ্ধার্ঙ্গের জন্যে কোনো ব্যবস্থা ছিলনা । তারও আগে কটিবন্ধকে বলা হতো --"নিভি " । সিন্ধু সভ্যতায় একটি কাপড়ের টুকরো কে বলা হতো - কাঁচুকি । তখন কটিবন্ধ আর কাঁচুকি মিলে শাড়ির একটা ধারণা ধীরে ধীরে তৈরি হতে লাগলো। আবার অনেক পরে হলেও রাজা রবিবর্মার পেন্টিং-এ ১১ জন রমণী ১১ রকমের শাড়ি পরিহিত হয়ে বসে আছেন। বৃটিশ মিউজিয়ামের পেন্টিংয়ে দেখতে পাওয়া যায় বাঁ দিকে আঁচল ও দু পায়ে ভাগ করা সামনে কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরিহিতা ভারতীয় রমণীকে ব্রিটিশ গুয়াস পেন্টিং-এ। চন্ডীদাসের কাব্যে আছে-
" নীল শাড়ি মোহনকারী / উছলিতে দেখি পাশ।" সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬৪ তে বলেছেন --" আমাদের স্ত্রীলোকেরা যেরূপ কাপড় পরেন তাহা না পরিলেও হয়।" ১৮৬৩-৬৫ আবার রাজকুমার চন্দ্র লিখেছেন--
"দশ হাত কাপড়ে স্ত্রীলোক লেংটা (আক্কেল
গুড়ুম)"। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে রাজনারায়ণ বসু তার সেকাল আর একাল গ্রন্থে পোশাক নিয়ে মন্তব্য করেন যে --আমাদিগের বাঙালি জাতির একটি নির্দিষ্ট কোনো পরিচ্ছদ নাই "। যোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি শাড়ির জন্যে গুজরাট থেকে তুলো আসতে থাকে আর তার বদলে তৎকালীন বাংলা থেকে যেতে থাকে রেশম। ইতিহাসে রাফেল ফিচার (১৫৮০--৯৯)-এর বিবরণের পর ভারতীয় শাড়ির একটা পাকাপাকি রেকর্ড নথিবদ্ধ হয় । মহাভারতে শাড়ি নিয়েই মহাকাব্য বাঁক নিয়েছে। দ্রৌপদীর শাড়ি কাহিনি কে না জানেন,
চান্দেরি ? সাহিত্য, বাণিজ্য ও ইতিহাস ঘাঁটলে মেয়েদের শাড়ি তৈরি ও পরার এক বিস্তৃত ইতিহাস পাওয়া যায়। সংস্কৃত " শাটী " শব্দ বা " সত্তিকা " থেকে শাড়ি শব্দের উৎপত্তি হয়েছে। সিন্ধু এবং মেহেড়গড়ের অনার্য সভ্যতার ধ্বংসাবশাস থেকেও শাড়ি পরিহিত রমণীর খোঁজ মেলে। কলকাতায় রবীন্দ্রনাথের ভাই সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞাননন্দিনী
প্রথম বঙ্গদেশে পার্শি স্টাইলে শাড়ি পরে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। পাল আমলের (৭৫০ থেকে
১১৬২ ) পাহাড়পুরের ময়নামতি ভাস্কর্য ও পোড়ামাটির মন্দির ও দেওয়াল চিত্রে শাড়ি পরা নারীকে ইতিহাসবিদগণ বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসের মাধ্যমে অনেক আগেই তা জানিয়ে দিয়েছেন। অষ্টম শতাব্দী থেকে শাড়ির প্রচলন নানা মূর্তিতে অনেক পরিমাণে পাওয়া যেতে থাকে। ড. নীহাররঞ্জন রায় আধখানা শাড়ির উল্লেখ করেছেন। বিনা সেলাই করা কাপড় হিসেবেই শাড়ি নারীর আবরণ ও আড়াল হিসেবে উঠে এসেছে। কখনো তা ধীরে ধীরে দুপাট হয়েছে । এখনও অসমে বা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এই দুপাটি শাড়ির প্রচলন রয়ে গিয়েছে । প্রথম দিকে শাড়ি কেবল নারীর নিম্নদেশে ঢাকার জন্যে প্রচলিত ছিল। দক্ষিণ ভারতে হিন্দু রাজাদের আমলে মেয়েদের  " স্তনকর " নামে একটি কর চালু ছিল এ থেকে মনে করা হয় ভারতীয় নারীর মধ্যে একপাটের বা অর্ধেক শাড়ি পড়া প্রচলিত ছিল। চোলির কথাও প্রসঙ্গে উঠে আসে বিশেষভাবে-- সিনেমার গানে অন্যভাবে তা ব্যবহৃত হলেও তা প্রাচীন যুগে শাড়ির অংশবিশেষ বলেই মনে করা হয়। কোনো কোনো স্থানে হয়তো উর্দ্ধাঙ্গে কাঁচুলি বা অন্য কোনো ভাবে আড়ালের ব্যবস্থা ছিল। ব্রিটিশ আমলে মেয়েদের অন্তর্বাস ও ফুলহাতা ব্লাউজ পরার স্টাইল ও কৌশল ছড়িয়ে
পড়ে। কলকাতায় ঠাকুর বাড়িতে অন্তর্বাস প্রচলিত হলেও রবীন্দ্রনাথ পরিবেষ্টিত ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা দু-ভাঁজের শাড়ি পরিহিত হয়ে বসে আছেন এরকম অনেক আলোকচিত্রতে তা দেখতে পাওয়া যায় (সেখানে কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরিহিত কেউ নেই)। গুপ্ত
যুগে ( ৩০০--৫০০) অজন্তা-ইলোরার ভাস্কর্যে ও দেওয়াল চিত্রে শাড়ির প্রমাণ পাওয়া গেছে। কালীদাসের শকুন্তলা ও কুমারসম্ভব কাব্যগ্রন্থে শাড়ির উল্লিখিত আছে। ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে বিদ্যার শাড়ি পরার উল্লেখ দেখতে পাই । আবার ভারতের হিন্দু মতবাদে যেকোনো পুজোয় তসরের শাড়ি পরার প্রচলন ধর্মের সঙ্গে মিথ আকারে চলে আসছে। যেহেতু তসরে প্রাণি হত্যা হয়না তাই পুজোতো তসর বা পাট থেকে তন্তু সংগ্রহ করে তসরের সঙ্গে মিলিয়ে ঠাকুর ঘরে সনাতন হিন্দুদের একটা রীতি চলে আসছে কারণ এই শাড়িকে পুরোহিত এবং মেয়েরা দুপক্ষই ব্যবহার করে থাকে। সাধারণভাবে এদেশে মুগল সম্রাটদের সময়ে যখন জমিদারি প্রথা চালু হয় তখন জমিনদারদের বাড়িতে ইংরেজ মেমেদের যাতায়াত তৈরি হয় এবং মনে করা হয় এই সময় থেকে ভারতে ও বঙ্গদেশে ধনী বাড়ির মেয়েদের মধ্যে শাড়ি পরার প্যাঁচ-কুঁচি পদ্ধতি-আঁচলের আবষ্কার হয়। অন্যভাবে শাড়ি বিত্তবানেদের ঘরে প্রবেশও করে।
শাড়ি পরার ধরণ, রীতি, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য ও তার বিন্যস্ত রূপ, কুঁচি ,একভাঁজ ,দুভাঁজ, একপেঁচে, দুপেঁচে, টানটান আঁচল রীতি, পরম্পরা ও পরিপাটি হয়ে  আধুনিকতায়-র পথ ধরে এই স্টাইলে আসার মধ্যে শাড়ির একটা ইতিহাস মোটামুটি ৫৫০০ বছরের পুরাতন বলেই ইতিহাসবিদরা মনে করেন। মুগল ও মগ রমণীদের হাত ধরে খানিকটা আকবরের সৌজন্যে শাড়ি শিল্প একটা স্থান করে নেয়। মনে করা হয় হুমায়ুনের আমলে কাশিতে প্রথম শাড়ির কারখানা তৈরি হয়। অনেকে বলেন তারও আগে মহাভারতে চেদিরাজ শিশুপালের সময় থেকেই শাড়ির ব্যবহার শুরু হয় এবং মধ্যপ্রদেশের চান্দেরি নামকরণ আসলে চেদি থেকেই এসেছে এবং দ্রৌপদীর অঙ্গে যে শাড়ি ছিল তার নাম আসলে চান্দেরি (পরে যখন চান্দেরি শাড়ির কথা আসবে তখন সেই আলোচনা করবো ) । আবার ইংরেজ আমলে এই শাড়ি পরার রীতি নিয়ে ব্রাহ্মসমাজের মেয়েদেরকে অসম্মানজনক কথাবার্তা শুনতেও হয়। তবে বহু উত্থান পতনে শাড়ির ইতিহাস দীর্ঘতর যে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ভারতীয় সমাজে অবাঙালিরা শাড়িকে শোভিত করেছেন ও নানা স্টাইলে তা পরারও কায়দা এনেছেন । সিনেমায় রাজকাপুর তার নায়িকা পদ্মিনীকে একটু আঁটোসাটো শাড়িতে পছন্দ করতেন। শাড়ি পরিহিতা নার্গিসকে তিনি বৃষ্টির সঙ্গে গানজুড়ে পৃথিবী বিখ্যাত করে
দিয়ে গেছেন। নায়িকা মুমতাজ টাইট শাড়িতে ও ছোটহাতা ব্লাউজে এক অভিনবত্য এনেছিলেন। বাংলায় শাড়িতে সুচিত্রা সেন একটি যুগ তৈরি করে গেছেন। মুগল আমলে একটি ছোট বাঁশের কৌটতে একটি মসলিন শাড়ি সম্রাট আকবরকে উপহার দেওয়া হয়েছিল যা পরীক্ষার জন্যে সম্রাট আকবরের সামনে সেটাই একটা গোটা হাতীকে মুড়ে দেওয়া হয়েছিল।  রবীন্দ্রনাথের গল্পে পাওয়া যায়- উমার চরিত্র নির্মাণে শাড়ির কথা। একসময় বাংলায় ফুটি তুলো চাষ হতো। অনেকেই মনে করেন ওই তুলো থেকে মসলিনের কাপড় তৈরি সহজ হতো। ইংরেজরা বঙ্গদেশে ওই তুলোর চাষ বন্ধ করে দেন। বিদেশী বণিক ও ঐতিহাসিক ফ্রাঁসোয়া তেভারনিয়েরের বিবরণ থেকে ভারতীয় মেয়েদের শাড়ি পড়ার একটা ইতিহাস জানা যায়। অনেক ইতিহাসবিদ দেখিয়েছেন ১৭ শতকে ভারতে শাড়িবোনা ব্যাপকভাবে শুরু হলেও ১৯ শতকে এর কদর বেড়ে যায়। ডাচেরা বাংলার রেশম ও গুজরাটের পাটোলা কাপড়ের কিনে নিয়ে গিয়ে এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যে শাড়ি ও তা থেকে পোশাক তৈরি করে এশিয়া ইউরোপে ব্যবসা শুরু করতে শুরু করে এবং তার ফলে নতুন করে ভারতীয় কাপড় বা শাড়ির সৌন্দর্যের বিকাশ ঘটে। " আগে ওকে বারবার দেখেছি/ লালরঙের শাড়িতে/ দালিম ফুলের মতো রাঙা/আজ পড়েছে কালো রেশমের কাপড়/ আঁচল তুলেছে মাথায়।" অথবা -" বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে ললনারা হেঁটে যায়।" ১৯১০ সালে ঠাকুর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আছেন প্রতিমা, বেলা
মীরা ও রথীন্দ্রনাথ। সেই ছবিতে ঠাকুর বাড়ির
তিন মেয়েদের দু ভা‌‌‌‌‌‌‌‌জের শাড়ি পরিহিত হয়ে বসে থাকার ছবি সঙ্গে ব্লাউজ পরিহিতা দেখতে পাওয়া
যায় কিন্তু ওই ছবিতে কেউই কুঁচি দেওয়া শাড়ি পরে
নেই। এতো গেল রবীন্দ্রনাথের কথা। ১৯২৮ সালে
একটি প্রামাণ্য জলরঙের ছবির পাওয়া যায় যেখানে
চারজন ভারতীয় রমণীদের ছবিতে তাদের ব্লাউজ পরিহিত অবস্থায় দেখা যায় ( শিল্পী এম ভিধুরন্ধর)। হান্টার ও উডের ডেসপ্যাচে ভারতীয় সুতি ও রেশমি শাড়ির ও বয়ন শিল্পের কথা জানা যায় । পাহাড়পুরের অষ্টম শতাব্দীর যে নারী মূর্তি উদ্ধার হয় তাই থেকে মনে করা হয় সেই সময় আধখানা শাড়ি পরার প্রচলন ছিল। সেই সময় শাড়িকে জুড়ে জুড়ে পরাটা প্রায় শাস্ত্রের বিরোধী ছিল। মধ্যযুগে ঢিলা করে কোমরে জড়ানো আর পেছন দিকে যেমন করে হোক আঁচল ফেলে দেওয়াই ছিল শাড়ি পরা। একটা সময় ছিল যখন লম্বা কাপড় জড়িয়ে পরাটাই ছিল রেওয়াজ পেটিকোট ও ব্লাউজের ভাবনা তখন আবিষ্কার‌ই
হয়নি। আসলে আদিম যুগ থেকেই আজ পর্যন্ত নারীর
অঙ্গে চাপানোর আগে পর্যন্ত শাড়ি পুরুষের হাতেই
তার কলা-কৌশল , টানা-ভরনা , টানা-পোড়েন,
মাকুর (এক ,দুই,তিন) ব্যবহার , বুনন রীতি,
সৌন্দর্যবোধ, মোটিফের জাদু , জমকালো করা,
আবেদনমোহিত করা, অমেয়, নান্দনিক, পরিশ্রম
থেকে ঘাম ঝরানো ও তাকে শিল্প-সুষমায় ভরিয়ে
দেওয়ার পেছনে পুরুষের একাগ্রতা ঐকান্তিক নিষ্ঠা প্রেম ও বাহুবলের এক অনন্য পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও ইদানিং মেয়েরাও সুতো তোলা রঙ করার কাজে সাহায্য করছে তবুও যে অধ্যবসায় দিয়ে শাড়ি বুনতে একজন পুরুষের জীবনের আনন্দের সময়টা অন্ধকারে কেটে যায় যা কেউ ভেবেই দেখেনা। সুতো তৈরি থেকে রঙ করা শেষে মাড় দিয়ে পালিশ করে দোকানে গেলেও শাড়ি পুরুষের হাতের নাগালের বাইরে যায়না। বিশেষ করে এদেশে ভিক্টোরিয়ান যুগ থেকেই শাড়ি ও তার অ্যাক্সেসরিজের প্রকাশ ঘটে।
তারপর হিন্দি সিনেমার সৌজন্যে শাড়ি আরও কৌলিন্য পায়। এখন নানা ডিজাইনার শাড়ি ব্র্যান্ড হিসেবে উঠে এসেছে। অভিনেত্রী রেখার এক রঙ্গা শাড়ি পড়ার সঙ্গে লম্বা হাতের ব্লাউজ ও তার ওষ্ঠরঞ্জনী সব নিয়ে রেখার শাড়ি পরার কায়দা এখন খ্যাতির তালিকায়। সত্যম শিবম সুন্দরমের মিনি শাড়ি রাজকাপূরকে ভারতীয় সিনেমার শাড়ির ডিজাইনার বলা যেতেই পারে। হর দিল যো প্যার করেনা ও গানা
গায়েগা "সঙ্গম"এর গানের সিকোয়েন্স -এ
বৈজয়ন্তীমালাকে দেখতে পাই টানটান ডিজাইনার
শাড়িতে। ইতিহাসে পাই মধ্যপ্রদেশের মহেশ্বরের উপাসিকা রানী অহল্যাবাঈকে। রানীকে ও মন্দির ঘিরে গড়ে উঠেছে চান্দেরি শাড়ির কাছাকাছি মহেশ্বরী শাড়ি। গুজরাটের পাটনের সোলাঙ্কি রাজাদের আমলে ৮০০ বছরের বেশি ধরে চলে আসছে পৃথিবীর বিখ্যাত শাড়ি পাটোলা যার দাম ৫/৭ লাখ। চান্দেরি ও
কাঞ্জিভরম‌ও দামে কম যায়না এদের দাম‌ও ৩/৪
লাখ পার করে পাওয়া যায় । শোনা কথা আনুষ্কা
ওর রিসেপশনে ৫ লাখের বেনারসি পরেছিলেন তবে এই সব শাড়ি একটাই বোনা হয় । পুরাণে পাওয়া
যায় মার্কন্ড ঋষির বংশোদ্ভূত শিল্পীরাই কাঞ্চিপূরমে
" কাঞ্জিভরম " শাড়ি তৈরি করতেন । পুরাণে আছে ভগবান বিষ্ণুর পছন্দ রেশমি ও রঙিন আর শিবের সাদা। এই কারণে কোনো কোনো শাড়ির রঙ তৈরি হয়েছে। কাঞ্জিভরমে ভারতীয় সমস্ত মোটিফ নিয়ে
দেবতার জন্য তৈরি হয়েছে শাড়ি। মোটিফ গড়ে উঠেছে সেই সময়ের সম্রাট, রাজা ও দেবতাকে
ঘিরে। মনে করা হয় দাক্ষিণাত্যের চোল রাজাদের আমলে থেকে চোলি বা আঁচলের পরম্পরা চালু হয়েছে। পল্লবরাজ থেকেই যে আসলে পল্লু কথাটা
এসেছে এতেও একটা প্রমাণ মেলে পল্লু অর্থাৎ
আঁচল। তখন থেকেই মেয়েদের উর্ধাঙ্গের কাপড়ের প্রচলন বলে মনে করা হয় । ইন্দোনেশিয়ায় বাঁশ
দিয়ে রঙ করার পদ্ধতিতে উড়িষ্যা আর পচমপল্লীর ইক্কত শাড়িও দামে ও ঐতিহ্যের এক ভারতীয় হয়ে উঠেছে। বেনারসি নিয়ে তো আলাদা করে লিখতে হবে। এই শাড়ি বেনারসি ও বাংলাদেশের একমাত্র বিয়ের শাড়ি হয়ে উঠেছে। মনে পড়ে যায় উত্তমকুমারের মুখে -" যদি ওই চোরকাঁটা হ‌ই শাড়ির ভাঁজে " শাড়িকে ভাঁজে ভাঁজে বিন্যস্ত করতে বেশ কয়েক বছর আগে শাড়ি পরানো শেখাতে নিউ
দিল্লির জ‌ঙপুরাতে রিতা কাপূর স্কুল খোলেন। ১০৮ ধরনের শাড়ি সেখানে পরা শেখানো হয়। শাড়ি স্মার্ট হয়ে ওঠে বিমানবালাদের হাত ধরে। এদেশে পুলিশ ও মিলিটারি অফিসারদের শাড়ি পরার রেওয়াজ আছে তবে সেখানে বেল্টের একটা সংযোজন আছে। একটা সময় ছিল যখন পাঁচতারা হোটেলে শাড়ি পরাবার জন্য পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। বিদেশে শাড়িকে ছড়িয়ে দিয়েছে ইসকন সম্প্রদায়। পাকিস্তানের করাচিতে মোহাজি শাড়ি আর ধনীদের মধ্যে পাটোলা কোনোরকমে টিঁকে আছে সেখানে। বাংলাদেশ এখনও শাড়িকে টিকিয়ে রেখেছে। এখন শাড়ির মাপ ১২ হাত ১৮ ফুট ৪ থেকে ৯ মিটার। তবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আবার তার চন্দ্রনাথে বার্মিজ রমণীদের রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার স্মার্টনেস দেখে বাঙালি ললনাদের শাড়ি পড়া রমণীদের জড়সড় ভাবে দেখে দুঃখিত হয়েছেন। যদিও সেই যুগ আজ আমূল বদলে গেছে। আজ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রেগনের পার্টিতে সোনিয়া গান্ধির পরা পাটোলার তখন দাম ছিল তখন পাঁচ লাখের মতন। (কপিরাইট- Alok
Kumar Kundu / আলোক কুন্ডু
( আলোক কুন্ডু রং লেখালিখি ও কবিতা , ফেসবুক পেজ । alokkundu.blogspot.in)

© অলোক কুন্ডু

শাড়ি : অলোক কুন্ডু-র কবিতা


🌎⛔🌐⛔🌏⛔🌎⛔🌐⛔🌏⛔

বড় শাড়ির শখ ছিল / অলোক কুন্ডু

রাজশাহী-রেশমি ঢাকাই-জামদানি 
ব্রোকেট-জর্জেট-মাইসোর সিল্কে 
তার মা কে দারুন মানাতো। 
ক্লাস ইলেভেন যখন 
মা বলতেন--এখন থেকেই শাড়ি পরবি রে ?
কলেজে উঠলে সব নিয়ে নিস 
মায়ের মুখ থেকে হরেক শাড়ির নাম শুনতে শুনতে
মুখস্থ করতো মেয়েটা 
মা বলতেন আহা মেয়ের শখ দেখ ।

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার 
সেই থেকে শাড়ি দেখলেই 
মেয়েটা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেত
এঘর থেকে ওঘরে।

ইউনিভার্সিটির প্রথম দিনই পরে গিয়েছিল 
মায়ের মুগা-মেখলাখানা
আর সেদিনই আলাপ হলো অমিতেশের সঙ্গে
আলাপ যত বাড়তে লাগলো
তত একটার পর একটা শাড়ি ভাঙে
কখনো আদিবাসী-উমারিয়া তো বিষ্ণুপুরী
আরানি-রেশম তো কখনো কাঞ্চিপূরম 
পাইথানি-সিল্ক থেকে মসলিন 
কোনোদিন ভাসতারা-কটন।

অমিতেশ শাড়ির খুঁট ধরে একটান দিয়ে বলতো 
খুব যে সাজা দেখছি আজ 
কারণ টা কি শুনি ? 
কখনো ভাগলপুরী-কটনে কফি হাউসের হৈচৈয়ে
দুজনে চলে যেত নির্জনে
অমিতেশ ধরে রাখতো ইক্কতের খুঁট
অবাক তাকিয়ে বলতো 
এত সেজে বুঝি কেউ পড়তে যায় 
মেয়েটা বলতো, জানো সাহেব--
কাঁধের ওপর থেকে পিছনে 
এই যে মস্ত ঝোলা দেখছো 
ওই ঝোলায় তোমাকে বেঁধে রাখবো কিন্তু
অমিতেশ বলতো- বেঁধে রেখে দেবে তো এই আচ্ছা তথাস্তু। 

দুবছরের সিনিয়ার অমিতেশ 
আমেদাবাদ থেকে পিএইচিডি করে ফিরে
সটান এসেছিল দুপুরে তাদের বাড়িতে 
সদর থেকে চিলেকোঠায় গিয়ে থেমেছিল
অমিতেশ বলেছিল চোখ বন্ধ কর উঁহু দেখবেনা
চুপিদেওয়া চোখে দেখেছিল সে --
লালপেড়ে গঙ্গাজল রঙের পাটোলা
সে কি দৌড়োদৌড়ি ছাদের ওপর 
শাড়িটা পরিয়ে ছাড়লো শেষে
নীচে নেমে দরজা বন্ধ করে একছুটে আয়নায় গিয়ে দাঁড়ালো
পেছন পেছন এসে ঘোমটা তুলে অমিতেশ বললো
বা এত সুন্দর তো কখনও দেখিনি
ঘন্ট শুক্তো মাটনের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে চলে গেল অমিতেশ। 

বাবা বলেছিলেন শাড়িটার নাম যেন কী 
মা যুগিয়ে দিয়েছিলেন - পাটোলা 
বাবার মুখ থেকেই প্রথম শোনা
গুজরাটের পাটনে এই পৃথিবী বিখ্যাত শাড়ি তৈরি হয়
বাবা জিজ্ঞেস করেননি দাম 
বিশ হাজার টাকা দামের স্টিকারটা
সে আগেই তুলে ফেলছিল 
শাড়ি পাগল মেয়েটা শাড়িটার যত্ন করতো বটে
মা বলতেন ওটা আর কবে পরবি বলতো ?
বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার।

প্রতি বছর পুজোতে মা বলতেন 
আমার কেনা শাড়ি তো তোর পছন্দ হবেনা
মেয়ের আমার বড় নাক উঁচু।

কত বছর যে চলে গেল 
তারপর কে জানে
অমিতেশের চিঠিগুলো জুড়ে জুড়ে 
মস্ত একটা আঠারো ফুট সম্বলপুরী 
বা পচমপল্লীর পৈঠানী 
কিংবা বারো হাত বোমকাই হয়ে যেতে পারতো। 

শেষে একদিন টরেন্টোর অলিভ অ্যাভিন্যু থেকে
চিঠি আসা একবারে বন্ধ হয়ে গেল 
পাটোলাটা জীবনে দ্বিতীয়বার কখনও ছোঁয়া হলোনা আর।

অমিতেশের ঘামলাগা শাড়িগুলো 
আর কোথাও পরে যেতনা ইদানিং
আলমারির থাকে থাকে
বেঙ্কটগিরি লুগালে গাদোয়াল ক্লাসিকেট
চান্দেরি কটাদরিয়া ঢাকাই-জামদানি
বলরামপূরম মঙ্গলগিরি শান্তিপুরি বাঁধনি
বেগমপরি কাঞ্জিভরম কটকিগুলো
আর ভাদ্রমাসের রোদ দেখতে পেত না।

মা বললেন, বর আর পছন্দ হয়না 
শেষে বাবাও বলতে শুরু করলেন --
মেয়ের আমার ভীষণ নাকউঁচু 
প্রথম প্রথম লুকিয়ে চোখ মুছতো
এইভাবেই দুটো বছর 
তবু আশা ছাড়েনি মেয়েটা
গোঙানির কোনো শব্দ কেউ টের পাইনি তার। 

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার
বড় বরেরও শখ ছিল মেয়েটার।

দ্বিতীয় পক্ষের বলে বাবা মা রাজি হননি কিছুতেই 
শেষে জোর করে রাজি হয়ে গেল নিজেই
বললো আমার তো অপছন্দ হইনি 
তোমাদের এত আপত্তির কি আছে বলোতো। 

একটা লাল রঙের কাতান বেনারসীতে 
ভারি মানিয়েছিল মণিকুন্তলাকে
হুল্লোড় করতে বন্ধুরাও এসেছিল দল বেঁধে 
ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল। 

ফুলশয্যার রাত কাটলে 
বাড়ির সকলের সঙ্গে মিশে গেল সে 
সেদিনই সুশোভন খুলে দেখালো একটা আলমারি 
আলমারিটায় শুধু সার সার শাড়ি আর শাড়ি
তাকে তাকে পারফিউমের সুগন্ধি লেগে আছে 
যতক্ষণ শাড়ি গুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল
ততক্ষণ এক হাতে সুশোভনের পাঞ্জাবিটা
চেপে ধরে রেখেছিল। 

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার 
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে 
শাড়ির সব নাম মুখস্থ করেছিল। 

আলমারিভর্তি কলমকারী ধনিয়াখালি কলাক্ষেত্র শোলাপুরি ভেঙ্কটগিরি তাঞ্চোই বালুচরি 
কড়িয়াল-বেনারসি কিমেরা-সুনোঢ়ি ওভেন পাট্টু
নৌভরী নারায়ণপেট কোসা সিল্কের মতো 
শাড়ি গুলোর নাম বলতে লাগলো একটা একটা করে
শাড়ির পাহাড়ের মধ্যে হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো 
একটা গঙ্গাজল রঙের লালপেড়ে। 

মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে 
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা। 

যে গোঙানিগুলো এতদিন শব্দ করেনি 
যে কান্নাগুলো লুকিয়ে যেত চটপট
যে কষ্টটা গলার কাছে আটকে থাকতো
আজ তা আর সামলানো গেলনা কিছুতেই 
কোনোরকমে আলমারিটা বন্ধ করে 
পিঠ দিয়ে দরজা বন্ধ করলো
এই প্রথম হ্যাঁ এই প্রথম ভেঙে গেল বাঁধ
সুশোভনের মুখের দিকে তাকালো একবার 
সুশোভন কিছু জানতে চাইলো না 
দু হাতে গাল ধরতেই 
মেয়েটা বুকের পাঞ্জাবি আঙড়ে ধরলো দুহাতে
গোঙানিগুলো ততক্ষণে কাঁন্নার শব্দে বাঁক নিয়েছে 
সুশোভন অস্ফুটে কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে গেল
সুশোভন টের পাচ্ছে পাঞ্জাবিটা ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে  
মণিকুন্তলা ফুঁপিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে
সুশোভন নীচু স্বরে বললো কুন্তলা কি হয়েছে
মেয়েটা মাথা নাড়তে শুধু। 

বড় শাড়ির শখ ছিল মেয়েটার 
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে 
শাড়ির নাম মুখস্থ করতো মেয়েটা। 

©® অলোক কুন্ডু ⛔

প্রয়াত তরুণ মজুমদার--অলোক কুন্ডু

#তরুণ_মজুমদার_চলেগেলেন অধিকার এই শিরোনামে--কয়লাখনির শ্রমিকদের জন্য ডকুমেন্টারি বানিয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত পরিচালক তরুণ মজুমদার। ছিলেন আজীবন বাম...