⛔ বাংলায় কার ভিড় কোন দিকে : অলোক কুন্ডু
•৩১জানুয়ারী, ২০২১
⛔ আমি যখন আড়াই মাস আগে ভাঙড়ের একটি ভিডিও ফেসবুকে দেখতে পাই, তখন থেকেই আব্বাস সিদ্দিকীকে ফলো করতে শুরু করলাম। ওর মনমোহনী কথার প্রক্ষেপণে মুগ্ধ হয়ে গেছি। অনেকেই আমাকে আমার পোস্টে বলেছিলেন লোকটা ফালতু, ধান্দাবাজ, অনেকের কাছে থেকে নলেজ সিটি করবো বলে টাকা নিয়ে-- নয় ছয় করেছেন। শিক্ষিত মুসলমানরা এই জোয়ান ছেলেটিকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না। ঠিকই কথা তারা বলেছিলেন। সত্যি মুসলিমদের বেশিরভাগ মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গেই আছেন। বরং পশ্চিমবঙ্গে আব্বাস সিদ্দিকীকে সকলে বিজেপির লোক বলে, বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু আমার ধারণা হচ্ছিল এই ছেলেটার বক্তব্য কিন্তু পরিষ্কার। আমি তিনমাস আগে থেকেই বলেছি এবারে পশ্চিমবঙ্গে যদি মুসলিম ভোট অনেকটা কেটে যায় তা যাবে সিপিএম ( বাম) + কংগ্রেসের ভোট থেকেই। তৃণমূলের মুসলিম ভোটও সামান্য কাটবে--আব্বাস সিদ্দিকীরা।
•আর হিন্দু ভোটের যা দশা দেখছি তাহলো, বুদ্ধিজীবী আর কলেজ- ইউনিভার্সিটির ছাত্ররা, আর সামান্য কিছু বামপন্থী মানুষজন ছাড়া প্রধান হিন্দু ভোটও তৃণমূল এবং বিজেপির দিকে। জনসভা দেখতে ও শুনতে আসা ভোটটুকু ছাড়া বাম+কংগ্রেসের ভোট তাদের নেই বললেই চলে। তার মধ্যে স্বাস্থ্যসাথী ও ট্যাবের জন্য বাম-কংগ্রেসের হিন্দু-মুসলিম ভোট যদি তৃণমূল কিছুটা অধিকার করে নেয় তবে বাম+কংগ্রেসের আরও দৈন্য দশা হবে। বারবার বলতে চাইছি বাম+কংগ্রেস যদি আব্বাস সিদ্দিকীকে দলে নেয় তবে এ যাত্রা তারা বেঁচে গেলেও যেতে পারে। বরং তারা গেন করবে, অনেক ভালো অবস্থায় উঠে আসবে। কোথাও কোথাও বাম-কংগ্রেস-তৃণমূল মিলে লোকাল লেভেলে একটা সমঝোতা হতে পারে। কারণ এটা না করতে পারলে বিজেপি দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতে পারে। বিজেপির এজেন্ট তুলে দিতে পারলে কিন্তু ভোট আর নিরপেক্ষ নাও হতে পারে। তখন কিন্তু বিজেপির সমস্ত আয়োজন মাঠে মারা যাবে। একটা কোথাও জিততে পারবে না তারা। ভেতর ভেতর এরকমটা যে হবে না বলা যায় না। বিশেষ করে বামেরা এটা করতেই পারে।
•আমি কদিন আগেই একটা কথা বলেছি সেটা কি ? তা হলো ২০২৬-এ আব্বাস সিদ্দিকী মুখ্যমন্ত্রীর দাবিদার। অনেকে হেসেছেন আমি জানি। কিন্তু আমি সত্যিই বেশ দূর পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করি, অবশ্যই ঠিকমত দেখতে পাই না। ২০২৬ না হোক অন্তত ২০৩১-এ এই আব্বাসকে কেউ আর রুখতে পারবে না। এই ধারণা আমিই শুধুমাত্র করতে পারি, আমার নিরেপেক্ষতা থাকার জন্য। আরও একটা কারণ হলো, এদের সঙ্গে একটি বড় আদিবাসী দলও যোগ দিয়েছে। এদের ভালো ভোট ব্যাঙ্ক আছে। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, হায়দ্রাবাদের মিম। ব্যারিস্টার ওয়েসি সাহেবের দল। ওঁরা হায়দ্রাবাদে বেশ জনপ্রিয়। তৃণমূল কংগ্রেস যাদের বিজেপির এজেন্ট বলতে কসুর করেনি। এরাও কলকাতা, হাওড়া এবং দুই ২৪ পরগণায় এবারে গোটা ২০ প্রার্থী দিতে পারে। আব্বাস সিদ্দিকীর ভাই যে দলের চেয়ারম্যান, (ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট) তারা আদিবাসীদের নিয়ে গোটা ৫০ প্রার্থী দিতে পারে। শুনেছি তাদের টার্গেট ৪৫ টা। মাত্র তিন মাসের দল যে এইভাবে ভোটে ভাগ বসাতে পারে তা আমি আড়াই মাস আগেই বলে দিয়েছিলাম। এখন যত দিন যাচ্ছে আমি জোর পাচ্ছি আমার বক্তব্যের ব্যাপারে। তারা কটাতে জিতবে ? দু-মাস আগে বলেছিলাম ২০ টা। শুধুমাত্র ৫/৬ টা জনসভার ভিডিও দেখে বলেছিলাম। আমি জানি আমার প্রচুর মুসলিম বন্ধু এই বলা পছন্দ করেননি, এমনকি ভালো চোখেও দেখেননি। আমি কিন্তু এই শ্রেণির ভোটের মধ্যে, উচ্চ-শিক্ষিত ও উদার মুসলিম জনগণকে একদম ধরিনি।
•সমস্ত ভোট ব্যাঙ্কে একটা ধর্মপ্রাণ ও সাদাসিধে ভোটার থাকেন। কি হিন্দু, কি মুসলিম পাড়ায় এরকম ভোটার ১০% আছেই। তবে কি ওই সামান্য ভোটার, কোনও দল বা কাউকে জেতাতে পারে ? সচরাচর পারেনা, কিন্তু যদি কোনও নতুন দল এসেই হুট করে ১০% ভোটার প্রাথমিক ভাবে সঙ্গে পেয়ে যান, আর যদি তাদের রক্ত টগবগ করতে থাকে, তাহলে বুঝতে হবে এই সংখ্যা ক্রমশই বাড়বে। তার ওপর এদের সঙ্গে আদিবাসী নেতা যিনি আছেন তার ময়দানি বক্তব্য বেশ পায়রা উড়িয়ে দিতে পারে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এরা কখনও কোনও রাজনৈতিক দলে আগে প্রত্যক্ষভাবে ছিলনা। এদের সঙ্গে গরিব শ্রেণি নিঃস্বার্থ ভাবে আছেন। শ্রমিক শ্রেণি আছেন। মজবুত শরীরের ছেলেপিলে আছেন। ওয়েসি-সাহেব যুক্ত হলে অবাঙালি মুসলমানরা অবধারিত চুপচাপভাবে যোগ দেবেন, এদের সঙ্গে। শোনা যাচ্ছে এদের সঙ্গে উকিল, ব্যারিস্টার, অফিসার, ব্যবসায়ী এবং বুদ্ধিজীবীও আছেন। যারাই থাকুন না কেন, তার চাইতে বেশি আছে সোস্যাল মিডিয়ার ফলোয়ার, যদিও এই ফলোয়ার সকলে তার ভোটার নন। একটি জবরদস্ত জনসংখ্যা যে এদের সঙ্গে চলে আসবেন না কিছু বলা যায় না, এই সম্ভাবনাকে কেউ আগাম না বলতে পারবেন না। নিরীহ আনপড় অনেক সংখ্যা দেশে থাকতে পারেন, এমনকি খুব গরিব মানুষ আছেন যারা, কিছুই এখনও পাননি। এই শ্রেণিকে যদি এরা এদের সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন তবে এদেরকে দোষ দিতে সহজে কেউ পারবেন না। কদিন আগে হায়দ্রাবাদের প্রাক্তন মেয়র এসে এদের জোর বাড়িয়ে দিয়ে গেছেন। জোরালো বক্তব্য রেখে গেছেন এখানে এসে। এরা যে কিছুতেই বিজেপির বি.টিম নন তা পরিষ্কারভাবে বলে দিয়ে গেছেন।
•আসলে কারা ধর্মনিরপেক্ষ এটাই এইবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট যদি সেই হাওয়া সম্পূর্ণ ইতিমধ্যে কেড়ে নিতে পারেন তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এই দলের লেজুড় হয়ে থাকতে হবে অন্যদের। আর এটাই এই দলের মুখ্য উদ্দেশ্য এখন। সরকার যারা গড়বে অন্ততঃ ৪০% মন্ত্রী যে সেক্যুলার ফ্রন্ট থেকে নিতে হবে, তা একরকম পরিষ্কার। তারা আজ বলেছেন, আমরা কোনও ভৃত্যকে দাঁড় করাবো না। বলছেন,দাঁড় করাবো এক-একজন বাঘকে।
•যদি তারা মন্ত্রীসভায় নাও আসতে পারেন, তাহলেও এদের এড়াতে গেলে যেকোনও সরকারকে সাতবার ভাবতে হবে তখন। ধরে নেওয়া গেল ২০ টার বেশি সিটে এই ফ্রন্ট জিততে পারলো না, তাহলেও এরাই এখন থেকে পশ্চিমবঙ্গের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে পারে। আজ পর্যন্ত ভারতের কোনও রাজ্যেই মন্ত্রীসভায় মুসলিম বা সংখ্যালঘু প্রাধান্য হয়নি, দেখা যায়নি। এই নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। জগজীবন রাম চেষ্টা করেও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। সেক্যুলার ফ্রন্ট প্রথম থেকেই তাই তাদের চাকরি, তাদের কর্মে নিযুক্তি, তাদের গরিবি, তাদের না পাওয়া ও অশিক্ষা নিয়ে বলতে শুরু করেছে। যদিও তাদের এই চাওয়ার পেছনেও অনেকেই নানা অভিসন্ধি দেখছেন, নানা স্বার্থ দেখছেন। তবু এদেরকে সঙ্গে চেয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসেও। চেয়েছে কংগ্রেস, চেয়েছে সিপিএম। খানিকটা পরিষ্কার করে দিয়েছে, মিম। যেকোনো অবস্থাতেই তারা কোনও সমঝোতা করবে না। অর্থাৎ মিমকে সঙ্গে নিয়েই আব্বাস সিদ্দিকী এই বাংলায় লড়বেন। তাতে যদি কংগ্রেসে ও বামেরা না আসে, আসুক।
•কিন্তু এদিকে ভেতরে ভেতরে বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে ওই ৪০-৬০ টা আসন ধরেই সমঝোতার কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। তবে বিজেপি এদের কখনও গালাগালি অথবা দুরছাই করেনি। বরং দিলীপ ঘোষ বলেছেন বিজেপি তাদের নিজের জোরেই লড়বেন। বিজেপি শুধুমাত্র হিন্দু ভোটকেই তাদের আদর্শ ভোটার হিসেবে মেনে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা মুসলিম সমাজের, ব্যক্তির সাহায্যও প্রার্থনা করছে। মুসলিমরাও কিছু সংখ্যক তাদের সঙ্গেও আছেন। গতবছর তারা কলকাতার এক বাঙালি প্রধান-শিক্ষককে জাতীয় শিক্ষকের মর্যাদাও দিয়েছেন।
•ইতিমধ্যে এখানে বিজেপির জনপ্রিয়তা বরং বেড়েছে আগের তুলনায়। এখন ভোট ভাগাভাগি নিয়ে কারা এগোবে কারা পিছোবে জনগণ বুঝেও নির্বিকারের ভান তবু করে আছে। কিন্তু যাই হোক না কেন, যেন ভোট শান্তিপূর্ণ হয়। ভোট যেন অশান্তির পরিবেশ না তৈরি করে। যদিও বিনা রক্তপাতে ভোট হওয়া জরুরি বলে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করেনা। এখন তো বুদ্ধিজীবীরাও নিরপেক্ষ নন। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদেরও দুর্দিন আসতে চলেছে, কারণ গরুর মাংস খাওয়ার ভয়ঙ্করতা সৃষ্টি করা আর কেন্দ্রের কৃষি বিল বাতিল করা ছাড়া তাদের ভোটে দাঁড়ানোর আর কোনও রাস্তা নেই, দ্বিতীয় চিন্তা নেই। এর মধ্যে বামেদের হাত থেকে রাজনৈতিক অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে কিন্তু আব্বাস সিদ্দিকীর দল। অভুক্ত ও গরিব শ্রেণিকে নিয়েই একটি নতুন রাজনৈতিক দল এবার লড়াইয়ের ময়দানে। তাদের কাছে বরং গরুর মাংস নয় ভালো ভাবে বেঁচে থাকার সমস্ত চাহিদা মেটানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তাদের কথাবার্তায়।
•কিন্তু সিপিএম বা বামেরা জেতার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে, সুশান্ত ঘোষ ও লক্ষ্মণ শেঠেদের দিকে। প্রায় সমস্ত হিন্দু ভোট কংগ্রেসের হাত ছাড়া হয়ে গেছে। এখনও আদিবাসী ও মুসলমানরা তবু তাদের ভোট ব্যাঙ্ক। কিন্তু তাদের এমন ভাগ্য যে বহু নেতা কংগ্রেস ছেড়ে দিয়েছেন। এখনও ছাড়বেন অনেকে। কংগ্রেসকে খানিকটা লড়তে হবে সিপিএমের সংগঠনের উপর। স্পষ্ট করে বললে বলা উচিত দক্ষিণ বঙ্গে তাদের ভোট খুব কম তারা ধরে রাখতে পেরেছেন। পুরো দল ও ভোটার এখন তৃণমূলে। কিন্তু গত তিনমাস ধরে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস থেকে বিজেপিতে যাওয়ার বরং ঢল নেমেছে। যাকে তৃণমূল কংগ্রেস বলছে বিশ্বাসঘাতকতা, মীরজাফর। এমনকি সিপিএমের লোকজন এখন বিজেপিতে পর্যন্ত যোগদান করছে। সর্বত্র মেগা যোগদান মেলা এখন বিজেপিই করতে পারছে। প্রচারের আলোর বেশিটাই তারা কেড়ে নিয়েছেন গত ডিসেম্বর ২০২০ থেকে শুভেন্দু অধিকারী তার মধ্যে অন্যতম। শুভেন্দু অধিকারী যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই ভিড় আর ভিড়। এমনকি তৃণমূলের কুনাল ঘোষ শুভেন্দুর অনবদ্য সৃষ্টি স্লোগান চুরি করে নিচ্ছেন। কদিন আগে আরামবাগে শুভেন্দুর মিছিলে জনস্রোতের বন্যা হয়ে গেছে একপ্রকার। তৃণমূলের ভিড় তো আগেই ছিল। কিন্তু তাতে সরকারের সাপোর্ট থাকে সবসময়। কিন্তু বিরোধী দলে সেরকম সুবিধা থাকেনা। চাকরি থাকেনা, পুলিশের নিরাপত্তা থাকেনা, ক্লাবের ঠেস থাকেনা, শিক্ষক সংগঠন থাকেনা, বাধ্যতামূলক কোনও কিছু থাকেনা, উপঢৌকন থাকেনা, চাকরি দেওয়া থাকেনা, নাটক-সিনেমার লোক থাকেনা পরন্তু ভয়ভীতি থাকে। তাতে যদি জনস্রোত বিজেপির দিকে চলে যায় তবে বুঝতে হবে সরকারের সাপোর্ট না থাকা সত্ত্বেও কিছু গোলমাল আছে মানুষের চিন্তার মধ্যে। গ্রামে গঞ্জে এইরকম ভিড় হতো সেই ২০১১-তে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে। ভিড়ের এই পরিবর্তন মারাত্মক হতে পারে ধরে নিয়ে যদি বুথে বিজেপির বিরুদ্ধে সকলে একত্রিত হয়, তবে কিছুতেই বিজেপি জিততে পারবে না।
•এই ভিড় আর আছে আব্বাস সিদ্দিকীর সভায়, তারও তো কিছুই নেই। ভিড় ক্রমশ সরে যাচ্ছে বিজেপি ও সেক্যুলার ফ্রন্টের দিকে। আগামী ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ তাকিয়ে থাকবে বাম-কংগ্রেস ব্রিগেডের দিকে। তবে পাড়ায় পাড়ায় ভিড় করাতে না পারলে সেই দলের ভাগ্যে দুর্গতি স্পষ্ট লেখা থাকবে। ©® অলোক কুন্ডু